You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.17 | একাত্তরে দখলদার সরকারের সমর্থনে ঢাকায় ৫৫ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি - সংগ্রামের নোটবুক
একাত্তরে দখলদার সরকারের সমর্থনে ঢাকায় ৫৫ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতি

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ দিবাগত রাত থেকে তৎকালীন পাকিস্তান সৈন্য বাহিনী পূর্ব বাংলায় গণহত্যায় লিপ্ত হয়ে বিশেষ করে ঢাকায় বেশ কিছু সংখ্যক শিক্ষকবুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। হানাদার সরকারের আরােপিত সেন্সরের বেড়াজাল ভেদ করে বুদ্ধিজীবী হত্যার খবরাখবর বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এবং বেতার টিভিতে প্রচারিত হলে পাশ্চাত্য দেশগুলােতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। এ ধরনের এক পরিস্থিতিতে ফৌজি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সরকার আলােচ্য হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরই জের হিসাবে একাত্তরের মে মাস নাগাদ ৫৫ জন বাঙালি বুদ্ধিজীবীর স্বাক্ষরিত একটি প্রতিবাদ লিপি বিদেশের সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন আকারে এবং দেশীয় সংবাদপত্রে বিবৃতি হিসাবে প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রে প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনের শিরােনাম ছিল “A Statement By East Pakistan Scholars and Artistis.” উপরন্তু করাচীর সাইফি প্রিন্টার্স-এ ইংরেজি ভাষায় মুদ্রিত ৯ পৃষ্ঠার এই প্রতিবেদন পুস্তকাকারে প্রকাশ করে বিভিন্ন দূতাবাস ছাড়াও দেশ-বিদেশে বিতরণ করা হয়। এরই পাশাপাশি আলােচ্য বিবৃতিটি স্থানীয় পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের নির্দেশ দেয়া হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ই মে তারিখে সংবাদপত্রে ৫৫ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতির অংশ বিশেষ নিম্নরূপ : “নিউইয়র্কের ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব ইউনিভার্সিটি এমারজেন্সি” বলে পরিচিত একটি সংস্থা তাদের ভাষায় “ঢাকায় বিদ্বজ্জনের ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে” উদ্বেগ প্রকাশ করে যে বিবৃতি দিয়েছেন, আমরা তা পাঠ করে হতবাক হয়ে গিয়েছি।

“আমাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ ও নিহতের তালিকায় তাদের নাম দেখতে পেয়ে হতবাক হয়েছেন। নেহাত নাচার হয়েই আমাদের জানাতে হচ্ছে আমরা মৃত নই। আমাদের পেশাদার কাজের স্বাভাবিক রীতি অনুসারেই আমরা ঢাকা টেলিভিশনের পর্দায় আবির্ভূত হওয়ার সুযােগ নিয়েছি “ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে গােলযােগ চলাকালে আমাদের অধিকাংশই মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে নিজ নিজ গ্রামে চলে গিয়েছিল। এ কারণেই হয়তাে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হয়ে থাকবে। সময় নির্দিষ্ট করে বলার কারণ আছে। কেননা, এই সময়টাতেই দেশের প্রতিষ্ঠিত বৈধ সরকারকে অমান্য করার কাজ পুরােদমে চলছিল। নির্বাচনে জনগণের কাছ থেকে প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্ব শাসনের দাবিকে একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণার দাবিতে সম্প্রসারিত ও রূপায়িত করার জন্য উঠে পড়ে লেগে গিয়েছিল।  “পাকিস্তানি শাসন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আমাদের নিজস্ব অভাব অভিযােগ  রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমাদের যেটা প্রাপ্য সেটা না পেয়ে আমরা অসুখী। আমাদের এই অসন্তোষ আমরা প্রকাশ করেছি একই রাষ্ট্র কাঠামাের আওতায় পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপক স্বায়ত্ব শাসনের পক্ষে ভােট দিয়ে। “কিন্তু আওয়ামী লীগ চরমপন্থীরা এই সরল-সহজ আইনসঙ্গত দাবিকে  একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণার দাবিতে রূপান্তরিত করায় আমরা মর্মাহত হয়েছি। আমরা কখনাে এটা চাইনি, ফলে যা ঘটেছে তাতে আমরা হতাশ ও দুঃখিত হয়েছি।  “পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু প্রদেশ হিসাবে সারা পাকিস্তানকে শাসন করার অধিকার আমাদের আছে। আর সেটা আমাদের আয়ত্বের মধ্যেই এসে গিয়েছিল।
ঠিক তখনই চরমপন্থীদের দূরাশায় পেয়ে বসলাে এবং তারা জাতীয় অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তুলল। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন দিলেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়া আলােচনাকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে সংখ্যাগুরু দল হিসাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কিন্তু উল্টাটি ঘটে গেল এবং নেমে এল জাতীয় দুর্যোগ।  কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদী হওয়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে। আমরা পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়ােজিত এবং বর্তমান সরকার অবস্থা অনুকূল হওয়ার সাথে সাথে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু করার ইচ্ছা আবার ঘােষণা করেছেন। এমতাবস্থায় বিশ্বের অন্যান্য স্থানে অবস্থানরত আমাদের একাডেমিসিয়ানরা আমাদের কল্যাণের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করায় আমরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমরা আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কোনােরকম হস্তক্ষেপের বিরােধিতা ও নিন্দা করছি।” [দৈনিক পাকিস্তান ১৭/৫/৭১] এই বিবৃতিতে যারা স্বাক্ষর করেন তাঁরা হলেন : ১. ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন : উপাচার্য, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় । ২. প্রিন্সিপ্যাল ইব্রাহিম খাঁ : সাবেক কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রী/লেখক ও
নাট্যকার। ৩. এম কবীর*
ইতিহাস বিভাগের প্রধান, ঢা. বি. ৪. ড. মীর ফখরুজ্জামান : মনস্তত্ত্ব বিভাগের প্রধান, ঢা. বি.  ৫. ড. কাজী দীন মােহাম্মদ
বাংলা বিভাগের রিডার, ঢা. বি. ৬. নুরুল মােমেন
নাট্যকার, লেকচারার, আইন বিভাগ,
ঢা. বি.  ৭. জুলফিকার আলী
: ওএসডি, বাংলা একাডেমি ৮. আহসান হাবীব
: কবি
| ৯. খান আতাউর রহমান
চিত্র পরিচালক, অভিনেতা ও সঙ্গীত
পরিচালক ১০. শাহনাজ বেগম
| গায়িকা ১১. আশকার ইবনে শাইখ : নাট্যকার, সিনিয়র লেকচারার, ঢা. বি, ১২. ফরিদা ইয়াসমিন
: গায়িকা। ১৩. আব্দুল আলীম
: পল্লী গায়ক ১৪. আব্দুল্লাহ্ ইউসুফ ইমাম : চিত্র পরিচালক, প্রযােজক এবং লেখক ১৫. এ এইচ চৌধুরী
: পরিচালক, প্রযােজক, লেখক, টিভি ১৬. ড. মােহর আলী
: ইতিহাস বিভাগের রিডার, ঢা. বি. ১৭. মুনীর চৌধুরী
: বাংলা বিভাগের প্রধান, ঢা. বি. ১৮. ড. আশরাফ সিদ্দিকী : বেঙ্গলি ডেভলপমেন্ট বাের্ড, ঢাকা ১৯. খােন্দকার ফারুক আহমেদ : গায়ক ২০. এস এ হাদী
: গায়ক ২১. নীনা হামিদ
গায়িকা ২২. এম এ হামিদ
গায়ক। ২৩. লায়লা আর্জুমান্দ বানু
গায়িকা ২৪. শামসুল হুদা চৌধুরী*
চিফ ইনফরমেশন অফিসার,
ইপিআইডিসি ২৫. বেদারউদ্দিন আহমেদ
শিল্পী ২৬. সাবিনা ইয়াসমীন
: গায়িকা ২৭. ফেরদৌসী রহমান
: গায়িকা ২৮, মােস্তফা জামান আব্বাসী : গায়ক ২৯, সরদার জয়েনউদ্দিন
| ছােট গল্পকার ৩০. সৈয়দ মূর্তজা আলী। : লেখক, সমালােচক ৩১. কবি তালিম হােসেন। : নজরুল একাডেমি, ঢাকা ৩২. শাহেদ আলী
: ছােট গল্পকার, ইসলামী একাডেমি ৩৩. কবি আবদুস সাত্তার : সম্পাদক, মাহে নও, ঢাকা ৩৪. ফররুখ শীয়র
: নাট্যকার, রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা ৩৫. কবি ফররুখ আহমেদ : প্রাইড অব পারফরমেনস ৩৬. সম্পাদক আব্দুস সালাম : পাকিস্তান অবজারভার, ঢাকা। ৩৭. সম্পাদক এস, জি, এম বদরুদ্দীন : মর্নিং নিউজ, ঢাকা ৩৮, আবুল কালাম শামসুদ্দীন : সম্পাদক, দৈনিক পাকিস্তান, ঢাকা ৩৯, ফতেহ লােহানী
: চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা ৪০. হেমায়েত হােসেন
: প্রাক্তন সম্পাদক, এলান, ঢাকা ৪১. বি এম রহমান।
: লেখক, ঢাকা। ৪২. মফজুলুল হােসেন। : নাট্যকার, রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা ২১৮ মুজিবের রক্ত লাল
৪৩. আকবরউদ্দিন।
: লেখক, গ্রন্থকার, ঢাকা। ৪৪. আকবর হােসেন
: লেখক, ঢাকা। ৪৫. এ এফ এম আব্দুল হক। : লেখক/সদস্য পাবলিক সার্ভিস কমিশন ৪৬, অধ্যক্ষ এ কিউ এম আদমউদ্দিন : শিক্ষাবিদ ৪৭. আলী মনসুর
| নাট্যশিল্পী ৪৮. কাজী আফসারউদ্দিন আহমেদ : লেখক ৪৯. সানাউল্লাহ নূরী
লেখক। ৫০. শামসুল হক।
কবি ও লেখক ৫১. সরদার ফজলুল করিম
লেখক ৫২. বদিউজ্জামান
: লেখক ৫৩. শফিক (শফিকুল) কবীর : লেখক ৫৪. ফওজিয়া খান
: গায়িকা ৫৫. লতিফা চৌধুরী
: গায়িকা
| জনাব এম কবীর (ডক্টর মফিজুল্লাহ কবীর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাে-ভাইস চ্যান্সেলর-১৯৭৮) প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসন আমলে স্বাধীনতাযুদ্ধ ইতিহাস প্রকল্পের (১ম পর্যায়) ৯-সদস্য বিশিষ্ট প্রামাণ্যকরণ কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন। জনাব শামসুল হুদা চৌধুরী প্রেসিডেন্ট জিয়ার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন। জনাব চৌধুরী জাতীয় পরিষদের মাননীয় স্পিকার পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। সম্প্রতি ইন্তেকাল করেছেন।
বিবৃতি সম্পর্কিত কিছু প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা ঢাকার সাপ্তাহিক বিচিন্তা পত্রিকায় ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসের ৩টি সংখ্যায় আলােচ্য বিবৃতিতে দস্তখতকারী কয়েকজন বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। এক্ষণে উল্লেখিত কয়েকটি সাক্ষাৎকারের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত হলাে : | … আমি ওদের বললাম, সবার স্বাক্ষর নিয়ে আসুন তারপর স্বাক্ষর দেব। তারা বলেছিল অন্য কপি নিয়ে বিভিন্ন জন স্বাক্ষর সংগ্রহ করছে। অবশ্য পরদিন তারা আবার এল, সবার স্বাক্ষর দেখে (দু’একজন বাদ ছিল, স্বাক্ষর দিই।… তখন অবস্থা এমন ছিল যে স্বাক্ষর না-দেওয়া আর মৃত্যুর পরােয়ানায় স্বাক্ষর দেওয়া সমান কথা।[কবি তালিম হােসেন, বিচিন্তা, ১লা জুলাই, ১৯৮৭।]
… কিন্তু কী বিবৃতি প্রকাশ হবে তা আমাকে দেখানাে হয় নাই। পরে যখন সেটা ছাপানাে হলাে তখন আমি ভয়ানক আপত্তি জানাই। এ রকম পলিটিক্যাল
বিবৃতি ছাপা হওয়ার জন্য আমি খুব বিরক্ত হই এবং রেডিওতে হেমায়েত হােসেনকে প্রতিবাদ জানাই। পরে তারা বলল, “আপনাদের জান বাঁচানাের জন্য এ কাজ আমরা করেছি। আমাকে ভুল বুঝিয়ে প্রতারণা করা হয়েছে। আমি ছাপানাে বক্তব্যটিকে গর্হিত মনে করি।” [লেখক শাহেদ আলী, বিচিন্তা, ১২ জুলাই ১৯৮৭।] “আপনাদের তালিকার পূর্বে বলা হয়েছে রাজাকার তালিকার সম্পূরক হিসাবে আপনারা পঞ্চান্নজন বুদ্ধিজীবী শিল্পীর নাম প্রকাশ করেছেন। এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হলাে ইব্রাহিম খাঁ, মুনীর চৌধুরী, আশরাফ সিদ্দিকী, সরদার জয়েনউদ্দিন ও সরদার ফজলুল করিম—এদের সঙ্গে আমি খান আতা যেকোনাে গােত্রভুক্ত হতে রাজি আছি। তবে বিবৃতির পটভূমি যতদূর মনে পড়ে, টেলিভিশন কেন্দ্র তখন ডিআইটিতে। একদিন সাদেক সাহেব একটি বিবৃতি নিয়ে এসে বললেন সই দিতে। অবস্থা এমন ছিল যে, সই না দিয়ে কোনাে উপায় ছিল না। কেননা, সই না দিলে আমার অবস্থা আলতাফ মাহমুদের মতােই হতাে। এ তাে বেঁচে থাকার জন্য। আর ‘মরিতে চাহিনা আমি সুন্দর ভুবনে’ ।… আমরা সই করেছি…।” [চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব খান আতাউর রহমান, বিচিন্তা, ১২ জুলাই ১৯৮৭।] “বিবৃতিতে স্বাক্ষর নিতে রেডিওর মাে. জাকারিয়া এবং কবি হেমায়েত হােসাইন আমার বাসায় আসেন। এরা দুজন প্রথম দিন আমাকে না পেয়ে দ্বিতীয় দিন এলে তাদেরকে আমার উপরস্থ কর্মকর্তার অনুমতির কথা বলে পরে আসতে বলি। এ ফাকে আমি আমার বন্ধু মুনির চৌধুরী, সৈয়দ মুর্তজা আলী, সরদার ফজলুল করিম, এদের সঙ্গে আলাপ করি। এরা বলে “এ রকম একটি বিবৃতি আমাদের কাছেও এসেছে, আমরা স্বাক্ষর দিয়েছি, তুমিও দিও।…” [ড. আশরাফ সিদ্দিকী, বিচিন্তা, ১৯ জুলাই, ১৯৮৭] বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯৭১ সালের ১৭ই মে তারিখে বুদ্ধিজীবীদের স্বাক্ষরিত আলােচ্য বিবৃতি সম্পর্কে একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ পুস্তকের মন্তব্য বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। | “… এ বিষয়ে প্রায় একই ধরনের বক্তব্য প্রদান করেন সানাউল্লাহ নূরী, আশকার ইবনে শাইখ প্রমুখ। শামসুল হুদা চৌধুরী বলেন, উক্ত বিবৃতিতে তিনি স্বাক্ষর করেননি। সরদার ফজলুল করিম এ বিষয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। বিচিন্তার সঙ্গে কথা বলতে অস্বীকার করেন ফওজিয়া খান, ড. কাজী দীন মােহম্মদ, ফেরদৌসী রহমান প্রমুখ । ড. আশরাফ সিদ্দিকী বিচিন্তার সাক্ষাৎকারের এক জায়গায় বলেছেন, “এদের মধ্যে অনেকে পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন, যেমনসানাউল্লাহ নূরী, আশকার ইবনে শাইখ, শাহেদ আলী, আরও অনেকে।’. “ঢাকা ও চট্টগ্রামের বুদ্ধিজীবীদের বিবৃতির মূল বক্তব্য একই এবং অনুমান করতে অসুবিধা হয় না একই জায়গা থেকে এই বিবৃতিগুলাে এসেছে। স্বাক্ষরদাতাদের তালিকায় এমন কয়েকজনের নাম রয়েছে যারা প্রগতিশীল চিন্তার অধিকারী এবং যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিকশিত করার ক্ষেত্রে
অবদান রেখেছেন। ৫৫ জন বুদ্ধিজীবীর ভেতর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাট্যকার মুনীর চৌধুরীর নাম রয়েছে যিনি ডিসেম্বরে আল বদরের ঘাতকদের হাতে নিহত হন। | “৫৫ জন বুদ্ধিজীবীর বিবৃতির মূল ভাষ্য ইংরেজিতে ছাপানাে (করাচীর সইফি প্রিন্টার্স কর্তৃক মুদ্রিত)। নয় পৃষ্ঠার এই বিবৃতির নামপত্রে বড় হরফে লেখা “A. | Statement by East Pakistan Scholars and Artists”। বিবৃতির মূল ভাষ্যের পর নামের তালিকা স্বাক্ষরকারীদের পরিচিতিসহ ছাপা হয়েছে। এই তালিকায় মােট ৫৭টি নাম রয়েছে, এর ভেতর গায়ক আব্দুল আলিমের নাম দুবার ছাপানাে রয়েছে। ছাপানাে নামের পাশে তিনি দুবার সই করেছেন, প্রথমবার ‘আব্দুল আলিম এবং শেষের বার শুধু ‘এ আলিম। ড. কাজী দীন মােহাম্মদ এবং নুরুল মােমেনের নামের মাঝখানে কবীর চৌধুরী, পরিচালক বাংলা একাডেমি, ঢাকা’ ছাপা রয়েছে। কিন্তু পাশের কলামে কবীর চৌধুরীর সই নেই। সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন, মুনীর চৌধুরী, কাজী দীন মােহাম্মদ, মীর ফকরুজ্জামান চৌধুরী, ইব্রাহীম খান প্রমুখ নামের পাশে সই করা ছাড়াও নামপত্রের উপর সই করেছেন। মােস্তফা জামান আব্বাসী, সানাউল্লাহ নূরী ও শামসুল হক বাংলায় সই করেছেন, অন্য সবাই করেছেন ইংরেজিতে। | “পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে বিবৃতিতে স্বাক্ষরদাতাদের অনেকে পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে কাজ করেছেন। ফলে অনুমান করে নেয়া যেতে পারে যে, কেউ কেউ বাধ্য হয়ে এই বিবৃতিতে সই করেছেন। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে কে। বা কারা তাদের বাধ্য করেছিল এ কথা তখন তারা বলেননি। স্বাধীনতার পর এসব নাম প্রকাশ করা অবশ্যই তাদের উচিত ছিল।…”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৩ জন দক্ষিণপন্থী অধ্যাপকের বিবৃতি
‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের ভারতীয় প্রচার নির্জলা মিথ্যা’ শিরােনামে দৈনিক পাকিস্তানে ২৭-৬-৭১ তারিখে এপিপি পরিবেশিত যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় নিম্নে তার অংশ বিশেষ : “আমরা নিম্ন স্বাক্ষরকারী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনায় গভীর বেদনা বােধ করছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস যে ভারতীয় যুদ্ধবাজ যারা মুসলমানদের স্বতন্ত্র আবাসভূমি হিসাবে পাকিস্তান সৃষ্টিকে কখনাে গ্রহণ করেনি প্রধানত তাদের চক্রান্তের ফলেই এটা হয়েছে। “আমরা আমাদের প্রিয় স্বদেশভূমির সংহতি ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য আমাদের সেনাবাহিনীর সময়ােচিত ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশংসা করছি।
“আমরা দেশের সংহতি ও অখণ্ডতা বিপন্ন করার জন্য চরম পন্থীদের অপপ্রয়াসের তীব্র নিন্দা করছি। বহির্বিশ্বের চোখে পাকিস্তানের মর্যাদা হ্রাস ও পাকিস্তানকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করার অপচেষ্টা এবং সীমান্তে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে আমাদের ঘরােয়া ব্যাপারে ভারতীয় হস্তক্ষেপের আমরা নিন্দা করছি। আমরা ভারতের ভিত্তিহীন ও দুরভিসন্ধিমূলক প্রচারণার নিন্দা করছি।… “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনের সকল ভবন অক্ষত রয়েছে এবং কোনাে ভবনের কোনােরূপ ক্ষতি সাধন করা হয়নি। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বর্তমান মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রয়ােজন আমাদের সকলের মধ্যে ঐক্য ও শৃঙ্খলা। আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রেখে আমরা বর্তমান সংকট হতে মুক্ত হতে পারব।”
বিবৃতিতে স্বাক্ষরদানকারী শিক্ষকরা হলেন :
১. জনাব ইউ এন সিদ্দিকী : ভারপ্রাপ্ত ভাইস চ্যান্সেলর
২. অধ্যাপক ড. আব্দুল করিম : অধ্যক্ষ, ইতিহাস বিভাগ
৩. ড. এম বদরুদ্দোজা : অধ্যক্ষ, সমাজ বিজ্ঞান
৪. জনাব মাে. ইনামুল হক : ইসলামের ইতিহাস বিভাগ
৫. ড. রফিকুল ইসলাম চৌধুরী : অধ্যক্ষ, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
৬. জনাব মাে: আনিসুজ্জামান : রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
৭. খােন্দকার রেজাউর রহমান : ইংরেজি বিভাগ
৮. সৈয়দ কামাল মােস্তফা। |: রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
৯. জনাব এম এ জিন্নাহ। : রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ
১০. জনাব রফিউদ্দিন
ইতিহাস বিভাগ
১১. জনাব এ কে এস আহমদ : অধ্যক্ষ, রসায়ন বিভাগ
১২. জনাব রুহুল আমিন : সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ
১৩, মাে: আলী ইমদাদুল খান : অধ্যক্ষ, বাণিজ্য বিভাগ
১৪. হােসেন মাে: ফজলে দাইয়ান : ইতিহাস বিভাগ
১৫. মাে: দিলওয়ান হােসেন : বাংলা বিভাগ
১৬. জনাব আব্দুর রশিদ
সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগ
১৭. জনাব মুকাদ্দাসুর রহমান : ইতিহাস বিভাগ
১৮. জনাব আহসানুল কবীর। : ইতিহাস বিভাগ
১৯, শাহ মাে: হুজ্জাতুল ইসলাম। : অর্থনীতি বিভাগ
২০. মােহাম্মদ আলী
অধ্যক্ষ, ইংরেজি বিভাগ
২১. জনাব এজাজ আহমদ : পদার্থবিদ্যা বিভাগ
২২. জনাব এস এম হােসেন : গণিত বিভাগ
২৩. জনাব জেড এইচ চৌধুরী : গণিত বিভাগ
২৪. জনাব হাতিম আলী হাওলাদার : সংখ্যাতত্ত্ব বিভাগ
২৫. ড. মাে: আব্দুল আওয়াল : বাংলা বিভাগ
২৬. মাে. মনিরুজ্জামান: বাংলা বিভাগ
২৭. মাে: মনিরুজ্জামান হায়াৎ* বাংলা বিভাগ
২৮. জনাব আব্দুল সায়ীদ : ইতিহাস বিভাগ
২৯, মাে: মুস্তফা
: অর্থনীতি বিভাগ
৩০. মিসেস সুলতানা নিজাম : ইতিহাস বিভাগ ৩১. ড. জাকিউদ্দিন আহমদ : ইতিহাস বিভাগ ৩২. আব্দুর রশিদ হায়দার। : ফাইন আর্টস বিভাগ
৩৩. নাম ছাপা হয়নি | [* ইনি হায়াৎ মাহমুদ নামে সমধিক পরিচিত। একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে
কোথায় পুস্তকের তথ্যের ভিত্তিতে অত্র প্রতিবেদন প্রণীত হয়েছে। এতদূসম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণের জন্য আলােচ্য পুস্তকের পৃষ্ঠা ১৫৮-১৮২ দেখুন।’-লেখক

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল