You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.01 | মুক্তিযুদ্ধকালে তাজউদ্দীন যুক্তরাষ্ট্র সফর বা সিআই'এর সাথে সাক্ষাৎ কোনােটাতেই রাজি হননি - সংগ্রামের নোটবুক
সৈয়দ আলী আহসান-এর লিখিত বিবৃতিতে বিতর্কিত তথ্য
মুজিব আমলে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, জিয়ার সামরিক শাসনামলে কিছুদিনের জন্য সরকারের উপদেষ্টা (শিক্ষামন্ত্রী), অধুনালুপ্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ ইতিহাস প্রকল্পের (২য় পর্যায়) প্রামাণ্যকরণ কমিটির চেয়ারম্যান, বর্তমান। রাষ্ট্রপতি এরশাদের অন্যতম শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব এবং সাম্প্রতিক ইতিহাসে মহল বিশেষের দৃষ্টিতে বিতর্কিত বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আলী আহসান একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে ১৯৮৪ সালের ১৯শে এপ্রিল যে লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন, পাঠকের সমীপে তারই গুরুত্বপূর্ণ অংশ বিশেষের উদ্ধৃতি :প্যারিসে আমার কিছু পরিচয়ের সূত্র ছিল। আকাডেমি ফ্রান্স-এর সদস্য এবং বিখ্যাত ফরাসি বুদ্ধিজীবী এবং কবি পিয়ের ইমানুয়েলকে আমি চিনতাম। তার কাছে আমি একটি দীর্ঘ পত্র লিখি। আমার চিঠি পিয়ের ইমানুয়েল পান ১৭ মে, তারিখে।
১৯ মে তারিখে ইমানুয়েলের পক্ষ থেকে একখানা ট্ৰেলিগ্রাম পাই। পিয়ের ইমানুয়েল বিভিন্ন সাহায্যকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের জন্য আবেদন জানান। অবশেষে International Association For Cultural Freedom-এর সভাপতি মি, শেফার্ড স্টোন আমাকে জানান যে, ফোর্ড ফাউন্ডেশন আমাদের সাহায্যের জন্য পঁচিশ হাজার ডলার অনুমােদন করেছে। এ টাকা “The writers, scholars and intellectuals who have been forced out of their land into India” তাদের জন্য ব্যয় করতে হবে। মে মাসের শেষে আমি কোলকাতায় যাই এবং পাম এভিনিউতে ব্যারিস্টার এ সালামের বাড়িতে অবস্থান করতে থাকি। সালাম সাহেবের ওখানে বাংলাদেশের তিনজন ছিলাম। আমি, মওদুদ আহমদ (বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী) এবং সাদেক খান। কলকাতায় আমার সঙ্গে যােগাযােগ করেন আমার পুরনাে বন্ধু বােম্বের এ বি শাহ। এ বি শাহ Secularist পত্রিকার সম্পাদক এবং Quest পত্রিকার প্রকাশক ছিলেন। এ বি শাহ্ কোলকাতায় আসেন ৮ই জুন। সে তারিখে রাত্রে গ্র্যান্ড হােটেলে তার সঙ্গে আমার যােগাযােগ হয়। ফোর্ড ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত টাকা যথাযথভাবে বন্টনের ব্যবস্থা করার জন্য। আমরা একটি কমিটি গঠন করি। কমিটির সভাপতি হন জাস্টিস এস এম মাসুদ এবং সদস্য থাকেন :

ক) অন্নদা শঙ্কর রায়।

খ) আমি (সৈয়দ আলী আহসান)

গ) ড. এ আর মল্লিক

ঘ) সুশীল ভদ্র এবং
ঙ) সুশীল মুখার্জী।
জাস্টিস মাসুদ কর্তৃক অনুমােদিত ২১শে জুন ১৯৭১ তারিখের বুদ্ধিজীবীদের যে তালিকা আমার কাছে আছে, তার মধ্যে জুন মাস থেকে দেশ স্বাধীন হবার সময় পর্যন্ত প্রতিমাসে নিয়মিতভাবে যারা সাহায্য পেয়েছেন তাদের নাম আছে। এ নামগুলাে হচ্ছে :
১. ড. এ আর মল্লিক
২. অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান
৩, ড, সারওয়ার মুর্শেদ
৪. ড. মাে. শামসুল হক
৫. ড. আনিসুজ্জামান।
৬, ড. মাহমুদ শাহ করায়শী
৭, ড. মােশাররফ হােসেন।
৮. ড. কাজী আবদুল মান্নান
৯. জনাব ওসমান জামাল
১০. জনাব আলী আশরাফ
১১. জনাব শওকত ওসমান
১২. জনাব বুলবুল ওসমান।
১৩. জনাব গােলাম মাের্শেদ
১৪. জনাব আব্দুল হাফিজ।
১৫. ড, ফারুক আজিজ খান
১৬. ড. জিয়াউদ্দিন আহমেদ
১৭. জনাব কামরুল হাসান
১৮, জনাব বদরুল হাসান
১৯, শ্রী দেবদাস চক্রবর্তী
২০. জনাব মাহবুব তালুকদার
২১, জনাব সাদেক খান।
২২. ড. স্বদেশ বােস।
২৩. ড. মাযহারুল ইসলাম।
২৪. জনাব মােস্তফা মনােয়ার
এই তালিকায় পরে আরাে অনেক নাম যুক্ত হয়েছিল যারা জুন মাসের পর কোলকাতায় এসেছিলেন। সে নামগুলাে আমার কাছে নেই। এদের মধ্যে ড. মুসলিম হুদার নাম মনে পড়ছে। আরাে দুজনের নাম মনে পড়ছে আকন্দ ও ডা সালেহ আহম্মদ। এ সময় মিসেস লি থ (Lee Thaw) নামক এক ভদ্রমহিলা কোলকাতায় আসেন এবং ওবেরয় গ্রান্ড হােটেলে অবস্থান করেন। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক উদ্বাস্তু সমিতির (International Refugee Organisation) প্রতিনিধি। তিনি লােকদের জন্য কিছু সাহায্য এনেছিলেন। তাঁর অর্থ দানের পাত্র ছিল সৃষ্টিধর্মী লেখক, শিল্পী ও সাংবাদিক। ৫-৭-৭১ তারিখে আমি মিসেস থ কর্তৃক অনুরুদ্ধ হয়ে লেখক ও সাংবাদিকদের একটি তালিকা তাকে প্রদান করি। সে তালিকা অনুসারে যারা পূর্বের সাহায্য সংস্থা থেকে কিছু পাননি এবং যারা সৃষ্টিধর্মী লেখক, শিল্পী এবং সাংবাদিক তাঁদের মধ্যে এ অর্থ বিতরণ করা হয়েছিল। তবে একটি কথা এখানে না বললে অন্যায় হবে তা হচ্ছে, লেখক ও সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ প্রথমে সাহায্য নিয়েছিলেন; কিন্তু পরে তার চেয়েও দুঃস্থ কোনাে লেখক বা সাংবাদিকের আনুকূল্যে অর্থ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এ সময় হার্ভার্ড গ্রুপ-এর পক্ষ থেকে অর্থনীতিবিদ গুস্তাফ পাপানেক (বােস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক) কোলকাতায় আমার সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং কয়েক দিন বিস্তারিত আলােচনার পর একটি প্রস্তাব ফোর্ড ফাউন্ডেশন-এর কাছে পেশ করেন।

প্রস্তাবটি একটি মেমােরেন্ডাম আকারে ছিল এবং নাম ছিল The Longer Term Problem of Bengali Refugee Intellectuals. মেমােরেন্ডামে পাপানেকের স্বাক্ষরের তারিখ হচ্ছে ১লা জুলাই ১৯৭১। পাপানেকের এই প্রস্তাব শেষ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি। শুধু উচ্চতর গবেষণার জন্য বাংলাদেশের দুজন শিক্ষককে তিনি আমেরিকায় অধ্যয়নের বৃত্তি দিতে সক্ষম হন। পাপানেক তার মেমােরেন্ডাম ফোর্ড ফাউন্ডেশনের জর্জ জাইগেনস্টাইন-এর কাছে পাঠিয়েছিলেন। (সৈয়দ আলী আহসান-এর পূর্ণ বিবৃতির জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : পঞ্চদশ খণ্ড-এর পৃষ্ঠা নং ৪৪০-৪৫১ দেখুন) (বিঃ দ্রঃ গবেষণা অন্তে দেখা যায় যে, সৈয়দ আলী আহসান বর্ণিত মার্কিনী অধ্যাপক গুস্তাফ পাপানেক এবং বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম-এর বিবৃতিতে উল্লেখিত অধ্যাপক গুস্তাফ পাপানেক একই ব্যক্তিত্ব। এ ধরনের এক প্রেক্ষিতে এতগুলাে বছর পরে সে আমলে (১৯৭১ সালে) কোলকাতায় বিরাজমান পরিস্থিতি অনুধাবনের লক্ষ্যে পুনরাবৃত্তি হওয়া সত্ত্বেও ব্যারিস্টার ইসলাম-এর বিবৃতির এতদসম্পর্কিত অংশ বিশেষ এখানে উল্লেখ অপরিহার্য মনে হয়।

ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম লিখেছেন, “…পররাষ্ট্র মন্ত্রী মােশতাক প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্যদের অগােচরে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে একটি রাজনৈতিক সমঝােতায় আসার চেষ্টা করেন। একই সাথে তিনি দলীয় নেতা, কর্মী ও সংসদ সদস্যদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি করেন। “বিভিন্ন সময় বিদেশ থেকে নানা ধরনের লােক প্রধানমন্ত্রীর (তাজউদ্দিন আহমদ) সাথে দেখা করতে আসতেন। অনেকের সাথেই তিনি দেখা করতেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজে সাক্ষাতের পূর্বে তিনি আমাকে পাঠাতেন। এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের বােস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক গুস্তাফ পাপানেক কোলকাতায় এসে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তার সাথে প্রাথমিক আলােচনার জন্য তাজউদ্দিন ভাই আমাকে প্রেরণ করেন। একটি হােটেলে তার সাথে আমি দেখা করতে যাই। তার সাথে আমার কোনাে পূর্ব পরিচয় নেই।  “পাপানেক বলেন, সিআইএ বাংলাদেশ আন্দোলনের পক্ষে নয়। হােয়াইট হাউসের মত পাল্টাতে হলে আগে সিআইএর মত পাল্টাতে হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফর করা প্রয়ােজন। মার্কিন প্রশাসন, বিশেষ করে সিআইএর মত পরিবর্তনের প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে। উত্তরে আমি জানাই, একজন রাজনৈতিক নেতার পক্ষে গােয়েন্দা সংস্থার সাথে কোনাে আলােচনা হতে পারে , তেমনি এর প্রয়ােজনীয়তাও আমি বুঝতে পারি না।  বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন হচ্ছে খােলামেলা ব্যাপার, এর মধ্যে কোনাে আঁতাত বা ষড়যন্ত্রের চিহ্ন নেই। তাছাড়া সিআই’এর মতাে শক্তিশালী গােয়েন্দা সংস্থা এই আন্দোলনের সকল বিষয় সম্পর্কে অবহিত। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের বন্ধুরা আমাদের পক্ষে কাজ করছেন। তাই মার্কিনীদের কোনাে বক্তব্য থাকলে আমাদের মিশনের মাধ্যমে খােলাখুলি উত্তর পেতে পারেন। পাপানেকের প্রস্তাব নিতান্তই অপ্রয়ােজনীয়। তবু প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলােচনা করে তাকে চূড়ান্ত কথা জানাবার প্রতিশ্রুতি দেই। তার প্রস্তাব শুনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সফর বা সিআই’এর সাথে সাক্ষাৎ কোনােটাতেই তিনি রাজি নন। আমি প্রধানমন্ত্রীর জবাব পাপানেককে জানাই। আমার জানা মতে বিদেশী ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র পাপানেকের সাথেই প্রধানমন্ত্রী সাক্ষাৎ করেননি। – লেখক

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল