You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৫ই সেপ্টেম্বর, রোববার, ৩০শে ভাদ্র, ১৩৮০

লাওস শান্তি চুক্তি

গত জানুয়ারি মাসে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে একটা সমঝোতার উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। সেই সমঝোতার ফলশ্রুতি হিসেবে গত পরশু প্রধানমন্ত্রী সুভানা ফুনা এবং প্যাথেটলাও বাহিনীর মধ্যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। ভিয়েনতিয়েনে স্বাক্ষরিত এ শান্তি চুক্তির ফলে সুদীর্ঘ দশ বছর ব্যাপী গৃহযুদ্ধের অবসান হলো। লাওস শান্তি চুক্তির খসড়াটি গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রণীত হয়েছিল। গত পরশু প্রধানমন্ত্রী সুভানা ফুমার কার্যালয়ে মিনিট পাঁচেকের এক সংক্ষিপ্ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রিন্স সুভানা ফুমা এই শান্তি চুক্তিতে স্বাক্ষর দানকালে আশা প্রকাশ করেছেন যে, যুদ্ধের অবসান হাওয়াতে সমস্ত বন্ধুরাষ্ট্র এখন লাওসকে সাহায্য দিতে এগিয়ে আসবে। এ শান্তি চুক্তির শর্ত অনুযায়ী সরকারি সূত্র থেকে প্রকাশ করা হয়েছে যে, বারো সদস্যবিশিষ্ট একটি নতুন কোয়ালিশন মন্ত্রিসভাও গঠন করা হবে। নতুন মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থনীতি ও পরিকল্পনা এবং তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের ভার থাকবে প্যাথেটলাও প্রতিনিধিদের উপর। নতুন মন্ত্রিসভায় প্রিন্স সুভানা ফুমা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হবেন এবং প্যাথেটলাও বাহিনীর প্রধান সুফানো ভং হবেন তার সহকারী। জানা গেছে আগামী দশই অক্টোবরের মধ্যে শান্তি চুক্তির শর্তাবলী কার্যকরী করা হবে। সরকার এবং প্যাথেটলাও বাহিনীর মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর এর ফলে ব্রিটেন এবং ভারত অভিনন্দন জ্ঞাপন করেছে। লাওস শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও এই চুক্তিকে অভিনন্দন জানিয়ে লাওসের প্রধানমন্ত্রীর কাছে তার একটি বার্তা প্রেরণ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তারবার্তায় আশা প্রকাশ করেছেন যে, এই শান্তি চুক্তির ফলে ইন্দোচীন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তির পথ আরো দৃঢ়তর হবে। তিনি বাংলাদেশের জনগণ এবং সরকারের পক্ষ থেকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন যে, লাওস শান্তিচুক্তি শান্তির শক্তিগুলোকেই শক্তিশালী করবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন বলেছেন যে, লাওসের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শান্তি ও স্থিতিশীলতার যেকোনো পদক্ষেপকেই স্বাভাবিক নিয়মে স্বাগতম জানাবে। সুদীর্ঘ দশ দশটি বছর ধরে লাওসে যে রক্তকে গৃহযুদ্ধ অব্যাহত ছিল, সেই সংঘর্ষের অবসানের জন্য নানা সময় নানা প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। কিন্তু বৃহৎ শক্তির কারসাজির ফলে লাওসের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়নি, বরং সংঘর্ষে লাওসের শান্তি বিঘ্নিত হয়েছে। ফুমা ও লাও বাহিনীর মধ্যে যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে তাতে লাওসের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। লাওসের শান্তি চিরস্থায়ী হোক। ইন্দোচীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়ও শান্তির পথ আরও মজবুত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

বেলুচিস্তানে ইরানি সৈন্য

খবরে প্রকাশ, বেলুচিস্তানের বিক্ষোভ দমনে পাকবাহিনীর সাহায্যার্থে গতমাসে সেখানে বহুসংখ্যক ইরানি সৈন্য নিয়োগ করা হয়েছে। এছাড়া পাকিস্তানের অন্ততঃ তিনটি বন্দরের ইরানের রণতরী উপস্থিত হয়েছে।
পেশোয়ারের উর্দু দৈনিক শাহবাজ জানিয়েছে যে, ইরানি সেনাদেরকে জাহিদান থেকে একটি বিশেষ সামরিক ট্রেনে করে মান্তুং এবং সেখান থেকে ট্রাকযোগে ঝালওয়ান পাঠানো হয়।
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মুখপাত্র আরো জানিয়েছে যে, ইরানি সেনারা স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হচ্ছে। গত ৩০শে আগস্টের মধ্যে প্রায় একশ’ ইরানি ও পাকিস্তানি সেনাদের বালুচদের হাতে নিহত হয়েছে।
পত্রিকাটিতে আরও বলা হয়েছে যে, বাদশাহজাদী আশরাফ পাহলভী সম্প্রতি নয়াদিল্লি যাবার পথে যাত্রা বিরতি ঘটিয়ে ইরানি সেনাদেরকে সাক্ষাৎ দান করেন। বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের সাধারণ মানুষের ন্যায় সঙ্গত দাবীকে ধামাচাপা দেবার জন্য ভুট্টো সরকার ইতিপূর্বে সন্ত্রাসের স্টিমরোলার চালিয়েছিলেন এবং এখনও চালাচ্ছেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে লন্ডনের গার্ডিয়ানের সংবাদদাতা ওয়াল্টার সোয়ার্জ গত দশ সেপ্টেম্বর তারিখে বলেছেন, সম্প্রতি প্রলয়ংকারী বন্যা কিংবা নতুন সংবিধান কোনটাই পাকিস্তানের জনজীবনে বড় রকমের ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয় নি। এর বদলে ভুট্টো সরকার এবং তার প্রতিপক্ষের ভেতরকার পাকিস্তানের জনজীবনে মারাত্মক ছায়া ফেলেছে। ওয়াল্টার সোয়ার্জ লিখেছেন, ক্ষমতাসীন দল বিরোধী গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টের নেতা ও কর্মীদের উপর চরম নির্যাতন চালাচ্ছে।
নতুন সংবিধান ও জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ থেকে আরম্ভ করে অন্যান্য কার্যাবলীর মাধ্যমে ভুট্টো সরকার একথাই বিশ্ববাসীকে জানাতে চেয়েছেন যে, পাকিস্তান স্বৈরতন্ত্রের পথ পরিত্যাগ করে গণতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তাছাড়া জনাব ভুট্টোর ভাষায় ‘ইসলামী সমাজতন্ত্র’ দেশের সাধারণ মানুষের জীবনের সার্বিক মঙ্গল ডেকে আনবে। কিন্তু না। ভুটান সরকার মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষতঃ বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ তো গণতন্ত্রের চিহ্নমাত্র নেই। সেখানকার গণ আন্দোলনকে দমন করার জন্য ভুট্টো সরকার সৈন্য বাহিনী নিয়োগ করেছেন। শুধু তাই নয় শেষ পর্যন্ত বেলুচিস্তানে এসে উপস্থিত হয়েছে ইরানি সৈন্যবাহিনী। ভুট্টো সরকার অবশ্য ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে নারাজ। ইতিহাস কিন্তু একথা বলেনা। গণতন্ত্রকে গলাটিপে হত্যা করে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে আর যাইই হোক ন্যায় সঙ্গত দাবি-দাওয়া কে দাবিয়ে রাখা যায়না। তাতে ফল উল্টো হয়।
কিন্তু ভুট্টো সরকার সোজা পথে না গিয়ে যেভাবে বাঁকা পথে যাচ্ছেন তাতে পাকিস্তানের কতটুকু মঙ্গল হবে সেটাই বিবেচ্য। তাছাড়া ভুট্টা সরকার বেলুচিস্তানের ন্যায়সঙ্গত দাবি দাবা কে দমন করার জন্য ইরানি সৈন্যবাহিনীকে ডেকে এনেছেন তা খাল কেটে কুমির আনারই সামিল।

বাসস্থান সংকটঃ বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম

ঢাকাতে যে ক’টি বড় সমস্যা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তার মধ্যে আবাসিক সমস্যা অন্যতম। দেশ স্বাধীন হবার পর থেকে যে হারে ঢাকা শহরে জনবসতি বৃদ্ধি পেয়েছে সে হারে নতুন বাসস্থান তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সম্ভাব্য হয়নি বাসগৃহ নির্মাণের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাব এবং দূর্মূল্যের জন্য। ফলে এ বাসস্থান সংকট চরমে পৌঁছেছে। বাসস্থানের সংকটের সুযোগে পূর্বতন বাড়িওয়ালারা দ্বিগুণ,তিনগুণ, চারগুণ করে ভাড়া হাঁকছেন। ফলে ব্যবসায়ী, উচ্চ বেতনের কর্মচারীদের পক্ষে তেমন অসুবিধা না হলে ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নির্ধারিত কর্মচারীদেরকে বাসস্থানের অভাবে যে কি সাংঘাতিক দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে সে কথা বলাই বাহুল্য। ইতিপূর্বে ঘোষণা করা হয়েছিল আবাসন সঙ্কট নিরসনকল্পে আজিমপুর, মতিঝিল এবং আগারগাঁওস্থ সরকারি কলোনি গুলোকে চারতলায় সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হচ্ছে। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আর কোনো হদিস মিলছে না। ফলে আবাসিক সমস্যা সমস্যাই হয়ে রয়েছে।
বাসস্থান সংকটের সুযোগে বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম যেভাবে দিন দিন বেড়ে চলেছে, সে বিষয়ে সরকারকে অতিশীঘ্রই সুনজর দিতে হবে। এ ব্যাপারে ভাড়াটিয়াদের স্বপক্ষে আইনের আশ্রয়ের যে সুযোগ প্রচলিত রয়েছে, মূলতঃ সে আইনও তেমন সুফলদায়ক নয়। ফলে বাসস্থানের সংকট এবং বাড়িওয়ালাদের দৌরাত্ম্যের দরুণ ভাড়াটিয়াদের নাভিশ্বাস উঠেছে। বিশেষ করে অবিবাহিত কর্মচারীদের দুর্ভোগের অন্ত নেই। অধিক ভাড়ায় যাওবা মাঝেমধ্যে দু’একটি বাসা ভাড়া পাওয়া যায় তথাপি সে বাসা অবিবাহিতদের কাছে ভাড়া দেওয়া হয় না। ফলে অবিবাহিত কর্মচারীদের কোনো কূল-কিনারা মিলছে না।
বাসস্থান সংকটের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির ফলে শুধু চাকরিজীবীদের দুর্ভোগই পোয়াতে হচ্ছে না উপরন্তু এই দুর্ভোগের জন্য সকল ক্ষেত্রের কর্মচারীদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় শ্রম পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না, সম্ভবও নয়। সেজন্য বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের কাজও বিঘ্নিত ও বিলম্বিত হচ্ছে।
কাজে আমরা মনে করি, বাসস্থান সমস্যাকে অগ্রাধিকার দেয়া দরকার এবং এই সংকট নিরসনের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। এ জন্য জরুরিভিত্তিতে গৃহ নির্মাণ সামগ্রী আমদানি করে পূর্বোক্ত গুলোর উপরে সম্প্রসারণ, সমবায় পদ্ধতিতে ঋণ প্রদানের মাধ্যমে নতুন ফ্ল্যাট নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদি উপায়ে আবাসিক সংকট দূরীকরণে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে বলে আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!