You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
৩০শে আগস্ট, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ১৩ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

নতুন যাত্রা পথের শুরু

উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যকে সামনে রেখে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে প্রতিনিধি পর্যায়ে যে আলোচনা শুরু হয়েছিলো, দিল্লী বৈঠকের একাদশ দিনে তা এক চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয়। আলোচনা বৈঠকের ভিত্তি ছিলো বাংলাদেশ-ভারত যৌথ ঘোষণা। চুক্তির বিষয়াদি যতদূর জানা গেছে, তা থেকে মনে করা চলে উভয় দেশের প্রতিনিধি কার্যত সেই যৌথ ঘোষণাকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে বসবাসকারী পাকিস্তানী নাগরিক এবং পাকিস্তানে আটক বাংলাদেশের নাগরিক উভয়ে নিজ নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারবেন। যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তাও সেই যুক্ত ঘোষণারই অনুরূপ। যুদ্ধাপরাধে যে ১৯৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে তারা ছাড়া বাকী সকল যুদ্ধবন্দীই মুক্তি পাবে।
এই চুক্তি যদি সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়িত হয় তবে তা উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে বলে আমরা মনে করি। ইতিমধ্যেই আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অনুরূপ একটা আশাবাদ প্রকাশ করেছেন। বৈঠকে যোগদানকারী উভয় দেশের প্রতিনিধিবৃন্দই চুক্তি সম্পাদনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাস্তব সমর্থন ও সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করেন। তারা বলেন, বাংলাদেশের বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গঠনমূলক ও আন্তরিক সহযোগিতা ব্যতিরেকে এমন একটা চুক্তি সম্পাদন কোন প্রকারেই সম্ভব হতো না।
শুধু উপমহাদেশে কেন গোটা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়নি। বঙ্গবন্ধু শান্তিপ্রতিষ্ঠায় কার্যকরী সহযোগিতা দানের জন্যে বিশ্বের সকল মানুষের কাছে বার বার আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাত্তোরকালে উপমহাদেশে উদ্ভূত নানা মানবিক সমস্যার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর এবং ভারত সরকারের আন্তরিক ‍উদ্যোগে বিগত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশ-ভারত যে যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয়, সারাবিশ্বের শান্তিকামী মানুষ উপমহাদেশের মানবিক সমস্যা সমাধানে সে শান্তি প্রস্তাবকে এক বাক্যে অভিনন্দন জানায়। কিন্তু অনুকূল সাড়া মেলেনি শুধু পাকিস্তানের তরফ থেকে। তাদের একগুঁয়েমি এতদাঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার বাস্তব উদ্যোগ গ্রহণকে বিলম্বিত করেছে, দুর্ভোগ বাড়িয়েছে সমস্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত লক্ষ লক্ষ পরিবারের।
চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে, অতীতের সকল অন্ধত্বকে দূরে সরিয়ে পাকিস্তান এখন বাস্তবতা উপলব্ধির সঠিক প্রমাণ রাখবে এটাই আমরা আশা করবো। আমাদের মতো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে অব্যাহত বৈরিতা অক্ষুন্ন রাখা প্রগতি এবং সমৃদ্ধি অর্জনের পথেই বাঁধা স্বরূপ। সে বাঁধা অপসারণ করে এই চুক্তি উপমহাদেশের পারস্পরিক সহযোগিতা, শান্তি এবং জনগণের কল্যাণ সাধনে নয়াদিগন্তের উন্মোচন করবে—শান্তিকামী মানুষ মাত্রই এটা কামনা করে।

ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা

বাঙালী জাতি ও জাতীয়তাবাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আইয়ুব আমলে প্রণীত ও জারীকৃত সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার কন্ঠরোধকারী কুখ্যাত প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিল করে দিয়েছেন। গত মঙ্গলবার এ প্রসঙ্গে এক সরকারী ঘোষণায় বলা হয়েছে যে, গতকাল বুধবার থেকে এই ঘোষণা কার্যকরী করা হচ্ছে এবং এর সাথে সাথে ছাপাখানা ও সংবাদপত্র প্রকাশের ডিক্লারেশন গ্রহণ এবং বই পুস্তক রেজিস্ট্রেশন ইত্যাদির জন্যে রাষ্ট্রপতি একটি অর্ডিন্যান্স জারী করেছেন। এই নতুন অর্ডিন্যান্সে বলা হয়েছে যে, পূর্ববর্তী কালাকানুন অর্থাৎ প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী যে সব বিধি-ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিলো সেগুলো যদি এই নয়া অর্ডিন্যান্সে পরিপন্থী না হয় তবে সেগুলো বলবৎ থাকবে। পরিপন্থী হলে অবশ্য বাতিল হতে বাধ্য। তাছাড়া ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ দালাল আইন বলে যদি কোন ছাপাখানার মালিক বা প্রকাশককে এর আগে শাস্তি দেয়া হয়ে থাকে তবে সেটাও বর্তমান অর্ডিন্যান্স বলে বাতিল হবে না।
প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিল ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৬৬ সাল থেকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ এবং এই দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেই ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান সেনানী বঙ্গবন্ধু অতীতে বার বার বলেছিলেন : উপনিবেশবাদী ও শোষণবাদী পাকিস্তানী আমলের কোন কালাকানুনই এদেশে আর বলবৎ থাকবেনা।
বস্তুতঃ প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিল ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সরকার বিগত দশ বছর ধরে জাতির বুকে চেপে থাকা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার কন্ঠরোধকারী একটি কুখ্যাত আইনের অবসান ঘটালেন—জাতির প্রতি প্রদত্ত বক্তব্যের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করলেন—নিজেরাও জাতির কাছে সম্মানিত হলেন। বাক-স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং ব্যক্তি স্বাধীনতা রক্ষার মূর্ত-প্রতীক বঙ্গবন্ধু। তারই প্রমাণ এই কালা-কানুনের বাতিল ঘোষণা।
আমরা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ সরকারকে তাঁদের এই ঐতিহাসিক প্রতিশ্রুতি রক্ষার জন্যে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। এর সাথে সাথে নতুন জারীকৃত অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে এদেশের মানুষের মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে যে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিধি-ব্যবস্থা গৃহীহ হলো আমরা তার যথাযথ কার্যকারিতা কামনা করি।
অপরদিকে, বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার দপ্তরের মন্ত্রী শেখ আবদুল আজিজ ঐ একইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের এক অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে ঘোষণা করেছেন যে, প্রেস কাউন্সিল এবং সাংবাদিকদের বেতন বোর্ড গঠনের বিষয়টি চূড়ান্ত প্রায়। প্রেস কাউন্সিল গঠনের দাবী সাংবাদিক সমাজের একটি মৌলিক ও পেশাগত দাবী। কেননা এ কাউন্সিলের মাধ্যমেই সংবাদপত্র, সাংবাদিক সমাজ ও সরকারের মধ্যে বিভিন্ন জাতীয় জরুরী ব্যাপারে একটি সমঝোতাপূর্ণ যোগসূত্র স্থাপিত হতে পারে। আর সেই যোগসূত্র দেশের সাধারণ মানুষ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। কাজেই এই অপরিহার্য বিষয়টির প্রতি যথাযথ গুরুত্ব আরোপ করে সরকার দেশবাসীরই আস্থাভাজন হয়েছেন।
সাংবাদিক বেতন বোর্ডের প্রশ্নেও বঙ্গবন্ধুর সরকার অতীতের আরেকটি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করলেন। কেননা ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের ইয়াহিয়ার আমলে সারাদেশজুড়ে সাংবাদিকরা যখন বেতন বোর্ডের দাবীতে ধর্মঘট করছিলেন তখন একমাত্র নেতা বঙ্গবন্ধু এবং একমাত্র রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে সার্বিক সমর্থন জানিয়েছিলেন। আজ সেই সমর্থনদানকেই প্রতিশ্রুতি হিসেবে ধরে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার তা রক্ষা করার জন্যে এগিয়ে এসেছেন—আমাদের কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করেছেন।

জ্বালানী তেলের সংকট প্রসঙ্গে

সংবাদে প্রকাশ, দেশে জ্বালান তেলের মওজুত নিঃশেষ হয়ে এসেছে। ফলে যানবাহন ও শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহারোপযোগী পেট্রোলিয়ামজাত জ্বালানী তেলের অভাবে এক নিদারুণ সংকটের সৃষ্টি প্রায় নিশ্চিত হয়ে পড়েছে। খবরটি দিয়েছে একটি সংবাদ সংস্থা। সংবাদে বলা হয়েছে, আগামী কিছুদিনের মধ্যে জ্বালানী তেলের মওজুত এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছুবে যার দরুণ মিল-কারখানা ও পরিবহন ব্যবস্থা সচল রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ওয়াকিবহাল সূত্রের বরাত দিয়ে সংবাদ সংস্থাটি জানাচ্ছে যে, দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধিকে বানচাল করার জন্যে কোন বিশেষ মহল সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। তারা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেবার জন্যে একটি বিশেষ অসাধু উদ্দেশ্য নিয়ে এই তৎপরতা চালাচ্ছে। আর তাদের কর্মতৎপরতার ফলশ্রুতিতেই জ্বালানী তেলের উল্লেখিত সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
সংবাদে আরো বলা হয়েছে, পাকিস্তান আমলে এক ধরনের অপরিশোধিত তেল পরিশোধনের জন্যে চট্টগ্রামে একটি মাত্র পরিশোধন কারখানা স্থাপন করা হয়েছিলো। স্বাধীনতাত্তোরকালে এ ব্যাপারটি নিশ্চিত ও স্থির হয় যে ইষ্টার্ণ রিফাইনারীকে আধুনিকীকরণ করা হবে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত অপরিশোধিত তেল শোধনের যোগ্য করে তোলা হবে। অথবা বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে দেশের প্রয়োজন মেটানোর জন্যে অন্য একটি শোধনাগার স্থাপন করা হবে। দেশের জ্বালানী তেলের সংকট মোকাবেলার জন্যো সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ইরাক সহ কয়েকটি বন্ধুরাষ্ট্র সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেছে বলেও আমরা জানি। তবু ইষ্টার্ণ রিফাইনারীকে যথাযোগ্য উৎপাদনক্ষম করে তোলা হয়নি। এবং পূর্বাহ্নেই একটি কার্যকরী ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। জ্বালানী তেলের সংকট যখন নিশ্চিত হয়ে উঠেছে ঠিক তখনই তার বাস্তবতা আমরা উপলব্ধি করছি। অথচ জ্বালানী তেলের অভাব হবার পূর্বাহ্নেই কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতো। কর্তৃপক্ষের খামখেয়ালীর দরুণ গোটা জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেনা। অবিলম্বে এ ব্যাপারে একটি বাস্তব পদক্ষেপ গৃহীত হবে বলে আমাদের দাবী।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!