You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.12.11 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ আবশ্যক | মানবাধিকার দিবস | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১১ই ডিসেম্বর, বুধবার, ২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮১

মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ আবশ্যক

শুধু আমাদের জাতীয় জীবনে নয় গোটা মানবজাতি আজ এক সংকটের সম্মুখীন। মানবিক মূল্যবোধ অবলুপ্তির পথে। অনাহার, বুভুক্ষা, মৃত্যু বিশ্বের এক বিরাট জনগোষ্ঠীকে গ্রাস করতে চলেছে। একের পর এক মানুষ হারাতে বসেছে সুখ অনুভূতিগুলি। প্রকটতর অর্থনৈতিক বৈষম্য, শোষণ এবং রাজনৈতিক শঠতা ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী বিশেষের খেয়ালখুশিতে একদিকে যেমন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষেকে সভ্যতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত করে চলেছে তেমনি একটি ক্ষুদ্র অংশ সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের ঔরসে জন্ম দিয়েছে বিকৃত মানসিকতা। এ থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন জ্ঞান আহরণ, জ্ঞানের নবতর ব্যবহার এবং কল্যাণমুখী মূল্যবোধের জাগরণ। বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে ভাষণ দিতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ সেই মূল্যবোধ জনগণের আহ্বান জানিয়েছেন। জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা অন্তর থেকে অন্যের অন্তরে শিখা প্রজ্বলিত করার সুমহান দায়িত্ব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের। সুদূর অতীত থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সে দায়িত্ব পালনে অত্যন্ত নিষ্ঠার প্রদর্শন করে এসেছেন। শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা এবং তার বিকাশই নয় বরং জাতীয় চেতনার প্রতিচ্ছবি সর্বদাই প্রতিফলিত হয়েছে পবিত্র এই শিক্ষাঙ্গনে। শিক্ষা-সাংস্কৃতিক আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বায়ত্বশাসন এবং পরবর্তীকালে সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের সূচনা ঘটে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই। রাষ্ট্রপতি নিজেও তার ভাষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল আন্দোলনের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে বলেন, ইতিহাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা চিরদিন অম্লান থাকবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুমহান ঐতিহ্যকে আমরাও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু লজ্জাস্কর হলেও সত্যি যে, স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিশ্ববিদ্যালয় তার অতীত গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা অক্ষুন্ন রাখতে পারেনি। সংকীর্ণ ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক স্বার্থ, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং কলঙ্কজনক কিছু ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তিকে অনেকাংশে বিনষ্ট করেছে। স্বাধীনতা-পূর্ব কালে যা সম্ভব হয়নি একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠী স্বাধীনতা-উত্তরকালে শক্তি এবং ক্ষমতার মদমত্ততায় তাই করার অপচেষ্টা চালিয়ে আসছে। শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা ক্ষুন্ন করা হয়েছে বারবার।
আজ তাই মানবিক মূল্যবোধের পুনর্জাগরণ কামনা করে কল্যাণমুখী চিন্তা-চেতনার বিকাশের স্বার্থে বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহকে নানা রকম অনাচার এবং অপবিত্রতা থেকে রক্ষা করতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে অগ্রসর হতে হবে। অতীতে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে আমরা আশা করি ভবিষ্যতেও সেই শুভ চেতনার প্রতিচ্ছবি সেখানে ঘটবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবার নন্দিত হবে জাতীয় চেতনার আয়না হিসেবে।

মানবাধিকার দিবস

গতকাল জাতিসংঘ মানবাধিকার দিবস পালিত হয়েছে। বাংলাদেশে জাতিসংঘের সমিতি কর্তৃক আয়োজিত মানবাধিকার দিবস পালনের জন্য একটি কর্মসূচিও নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতির সভাপতি ডঃ কামাল হোসেন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার দিবস পালিত হচ্ছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অব্যবহিত পরে জাতিসংঘের মানবাধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার হয়। জার্মান যুদ্ধবাজরা মনুষ্যত্বের বিরুদ্ধে যেভাবে অবমাননাকর তৎপরতা চালায় তার প্রতিবাদে জাতিসংঘ মানবাধিকার সংরক্ষণের জোর আহ্বান জানায়। এবং যুদ্ধোত্তর দেশগুলো সেই আহবানে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসে। সকল দেশেই পালিত হয় মানবাধিকার দিবস। বিশ্বব্যাপী ১০ই ডিসেম্বর তাই মানবাধিকার দিবস হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
মানুষের মৌলিক অধিকার আদায়ের সহজাত দাবি বহু পুরনো। এটা মূলতঃ মানুষের মজ্জাগত একটা দাবি। প্রতিটি মানুষের বাঁচবার অধিকার আছে, রাষ্ট্র থেকে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে, খাবার, পরবার এবং বেঁচে থাকার অধিকার তার মৌলিক। এ অধিকার হরণের প্রচেষ্টা ও বহু পুরনো কাল থেকেই চলে আসছে। আর সে কারণেই মানুষের সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরোধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে দেখা দিয়েছে। যুগে যুগে মানুষের চাহিদা বেড়েছে এবং নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটেছে। ফলে মানুষের দাবী বা অধিকারের ক্ষেত্রেও সম্প্রসারিত হয়েছে। মানুষ হিসেবে এবং তার মনুষ্যত্ব সুকোমল বৃদ্ধির বিকাশের জন্য যে সকল দাবী ও অধিকার একান্তই মৌলিক তার নিশ্চয়তা বিধান করা একটা রাষ্ট্রের অবশ্যই কর্তব্য। কিন্তু দেখা গেছে কালে কালে ঐ মৌলিক অধিকারের বিরুদ্ধেই রাষ্ট্রীয় যন্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। মানুষের মনুষ্যত্বের অবমাননা করা হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটির অবদমিত মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটানোর জন্য যে আহ্বান প্রতিটি জাতির সামনে উপস্থাপন করেছে তা নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য।
মানুষের মৌলিক অধিকারকে কোনদিন কোন শক্তি উপেক্ষা করতে বা নস্যাৎ করে দিতে পারে না। যারা সে প্রচেষ্টা নিয়েছে তাদেরই পতন ঘটেছে মানুষের রোষানলের কাছে। আজও মানবতারবিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে ভিয়েতনাম, চিলি এবং ইসরাইল দ্বারা আরবীয়দের মানবাধিকার আজ বিভিন্নভাবে অত্যাচারিত হচ্ছে। মানুষের স্বাভাবিক এবং নাগরিক অধিকারের বিরুদ্ধে ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্র পরিচালিত হচ্ছে। এর পরিসমাপ্তি হওয়া দরকার। জাতিসংঘ বিশ্বব্যাপী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা আজ অনেকাংশে ব্যাহত। মানুষের স্বাধীন এবং সহজাত মনোভঙ্গির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ভাবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি, উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ এবং সামন্ত প্রভুরা কাজ করে চলেছে। মানুষের মৌলিক চিন্তা- চেতনা এবং অধিকার তাদের ষড়যন্ত্রের দ্বারা হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে। মানবাধিকার দিবস পালনের মহান সদিচ্ছার সঙ্গে আমরাও অভিন্নমত পোষণ করি। তবে আমরা জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আরও সঠিক এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে যথার্থ মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানাব।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন