You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
১৪ই আগস্ট, মঙ্গলবার, ১৯৭৩, ২৯শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

আটক বাঙালীদের ফিরিয়ে দিতে হবেই

অটোয়ায় প্রধানমন্ত্রী সম্মেলন শেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেনেভায় গিয়ে দুইদিনব্যাপী এক রাষ্ট্রদূত সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের যে সকর রাষ্ট্রদূত রয়েছেন তারা জেনেভার এ সম্মেলনে যোগদান করেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোচনা হয়েছে। বিশ্বের সকল দেশের মানুষের কাছে পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নটি তুলে ধরার জন্যে বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রদূতদের প্রতি আহ্বান জানান। অটোয়ায় অনুষ্ঠিত প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনেও বঙ্গবন্ধু আটক বাঙালীদের ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নটি অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরেছেন। বিশ্বের দুয়ারে বর্তমানে যতগুলো মানবিক সমস্যা অমীমাংসিত রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম পাকিস্তানে আটক বাঙালীদের সমস্যা। বহুদিন ধরে এই সমস্যাটি অমীমাংসিত রয়েছে। বিশ্বের বিবেকবান মানুষ বাঙালীদের ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। কিন্তু পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী বরাবর এই প্রশ্নটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। আটক বাঙালীদের উপর নির্যাতন করা হচ্ছে এবং তাদের চাকরী জীবন ও অন্যান্য বৈষয়িক জীবন দুর্বিষহ করে তোলা হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর পাকিস্তানে যে সকল বাঙালী আটকে পড়েছে তাদের ফিরিয়ে দেওয়া পাকিস্তানদের নৈতিক দায়িত্ব। বাংলাদেশে যে সকল পাকিস্তানী আটকে রয়েছে তাদেরকেও ছেড়ে দেওয়া বাংলাদেশের দায়িত্ব। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট অভিমত বহু পূর্বেই প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে যারা আটক পাকিস্তানী রয়েছে তাদেরকে ফেরত দেওয়া হবে। এমনকি যুদ্ধাপরাধী ছাড়া যুদ্ধবন্দীদেরকেও ফেরত দেওয়া হবে। কিন্তু পাকিস্তান এ ব্যাপারে তাদের নৈতিক দায়িত্বটুকুও পালন করেনি। তারা যুদ্ধাপরাধীদেরকে বিনা বিচারে ফিরিয়ে নেবার জন্যে বাঙালীদেরকে আটকিয়ে রেখে দরকষাকষি করছে। বাংলাদেশের বাস্তবতা না মেনে নিয়ে তারা উপমহাদেশে উত্তেজনার সৃষ্টি করছে। ইতিপূর্বে ভারত-বাংলাদেশ যে যুক্ত ইশতেহার ঘোষণা করেছে তার প্রতিও পাক সরকার চরম উন্নাসিকতা প্রদর্শন করেছে। বস্তুতঃপক্ষে উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত করাই তাদের লক্ষ্য। কোন প্রকার আপোষ মীমাংসার প্রতি তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। বিশ্বের মানবতাবাদী সম্প্রদায় পাকিস্তানের এহেন কার্যকলাপের বিরুদ্ধে মতামত প্রকাশ করেছে। তারা মহাদেশের এ অংশে স্থায়ী শান্তিতে বিশ্বাসী। ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মধ্যকার সকল সমস্যার সমাধান বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ আশা করে। পাকিস্তান তার মিত্র কয়েকটি দেশের অশুভ তৎপরতার সহায়ক হিসেবে কাজ করে চলেছে। চীন তার পরম বন্ধু, আমেরিকা তার সহচর। এরা উভয়ই মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানকে মদদ দিয়েছে, সমস্ত প্রকার সাহায্যও সহযোগিতা করেছে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ও উপমহাদেশের শান্তির বিরুদ্ধে যে সকল তৎপরতা পাকিস্তান চালাচ্ছে তার প্রধান সহায়ক শক্তি আমেরিকা, চীন। আর এদের সমর্থনেই পাকিস্তান আজ নিরপরাধ বাঙালীদেরকে আটকিয়ে রেখে দরকষাকষি করছে। পাকিস্তানের এই অশুভ তৎপরতার জবাবে বিদেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদেরকে অবশ্যই দক্ষ প্রচারকার্য চালাতে হবে। আটক বাঙালীদের ফিরিয়ে দেবার প্রশ্নটি বিশ্বের সকল দেশের মানুষের কাছে তুলে ধরতে হবে। পাকিস্তানের অশুভ তৎপরতার বিরুদ্ধে জনমত গঠন করতে হবে।

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন

অর্থনৈতিক বুনিয়াদ সুদৃঢ় না হলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের আশা দুরাশা মাত্র। অথচ আমরা দেশের সার্বিক উন্নয়ন কামনা করি প্রতিটি কর্মে। রাতারাতি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উন্নতি সাধন করা যায় না। অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নটি অন্যান্য অনেক ব্যাপারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রথমতঃ অতিরিক্ত জনসংখ্যা যে কোন দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নে অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ায়। এই প্রতিবন্ধকতা দূরীভূত করার মানসেই দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা রোধ করা দরকার। গত পরশু অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেছেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রিত না হলে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব হবে না। মন্ত্রী মহোদয় সমন্বিত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম কোর্সের সমাপ্তি অধিবেশনে প্রশিক্ষকদের উদ্দেশে প্রধান অতিথির ভাষণ দিচ্ছিলেন। তিনি সুস্পষ্টভাবে মন্তব্য করেছেন যে, পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বাস্তবায়িত করতে না পারলে আকাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হবেনা। তিনি আরো বলেছেন, পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম সফল হলে সামগ্রিক অর্থনৈতিক বুনিয়াদ জোরদার হবে। দেশের আর্থিক বুনিয়াদ দৃঢ়তর করার কথা যারাই সামান্য চিন্তা-ভাবনা করেন, তারাই এ মন্তব্যের সত্যাসত্য মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে সক্ষম হবেন। বর্তমানে দেশে যে হারে জনসংখ্যা বেড়ে চলেছে তাতে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বাস্তবায়িত হওয়া একান্ত প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে। অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘জন্ম নিয়ন্ত্রণের পথে বাঁধা রয়েছে যথেষ্ট। এই প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই আমাদের কাজ করতে হবে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ যেমন অত্যাবশ্যক, ঠিক তেমনি যে শিশু জন্ম নিলো তাকে সবল স্বাস্থ্য ও শিক্ষার মাধ্যমে দেশের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’ জন্মনিয়ন্ত্রণ রোধ করার ব্যাপারে অবশ্য কুসংস্কারও একটি প্রধান অন্তরায়। দেশের অধিকাংশ মানুষই অশিক্ষার অন্ধকারে নিমজ্জিত, ফলে পরিবার পরিকল্পনার নির্গলিতার্থ তাদের বোধের সীমায় ঢেউ তুলতে পারেনি। অনেকেই কুসংস্কারাচ্ছন্নতার জন্যে পরিবার পরিকল্পনার চৌকাঠও মাড়াতে রাজী নয়। অর্থাৎ পরিবার পরিকল্পনার সুফল সম্পর্কে এখনো গ্রাম বাংলার অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞ রয়েছে। এইসব কারণে সরকার যতই পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বিস্তৃত করুন না কেন, জন্ম নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারটা একটি বিরাট প্রতিবন্ধকতার পাহাড় খাড়া করে রাখবেই। সমন্বিত পল্লী স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা প্রকল্প যদি ব্যর্থ হয়, তবে তার ফলশ্রুতি হিসেবে জাতি গভীর অন্ধকারে ডুবে যাবে বলে অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন। এ মন্তব্যের যথার্থতা সম্পর্কে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। আমরা জানি, সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি রোধের সব রকম সম্ভাব্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু কিছুতেই ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ক প্রশিক্ষকদের আন্তরিকতা ও সার্বিক প্রচেষ্টায় যদি এ কর্মসূচী সাফল্য লাভ করে, তাহলে দেশের একটি মহা সমস্যার অবসান হবে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে না। জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমাদের অর্থনৈতিক সংকটের কারণ হিসেবে যেন দীর্ঘদিন বিরাজিত না থাকে, সেজন্যে আমাদের কাজ করে যেতে হবে। সকলকেই পরিবার পরিকল্পনার মাহাত্ম্য অনুভব করতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!