বাঙলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের পথ
আবুল হাসনাত
বাঙলাদেশ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থায় প্রবেশ করেছে। গত ৬-৭ মাসের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে যে স্বাধীনতা ব্যতীত বাঙালি জনগণ আর কিছুই চায় না। ব্যাপক নরহত্যা, নারী নিগ্রহ সম্পত্তিলুণ্ঠন এবং গ্রামদাহ একদিনের জন্যও থামেনি। তথা কথিত পুতুল সরকার সৈন্যবাহিনীর সেবাদাসীতে পরিনত হয়েছে। নির্বাচনের নামে আর একটি প্রহসনের পালা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিনা। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রায় সবাই নির্বাচিত হয়েছে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের প্রধান দুশমন জামাতে ইসলামীর ক্ষমতা ও দাপট ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ পর্যন্ত এ দলের বারােজন নির্বাচিত হয়েছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ঠিক এই যখন অবস্থা তখন মুক্তিযুদ্ধকে সঠিক পথে পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশ মুক্তি যুদ্ধের দুই ফ্রণ্ট: রাজনৈতিক ফ্রন্ট ও প্রকৃত যুদ্ধের ফ্রন্ট। প্রকৃত যুদ্ধের ফ্রন্টে লড়ছে বাঙালির বীর সন্তানেরা। অন্যদিকে রাজনৈতিক ফ্রন্টের লড়াইয়ে কী ঘটছে তলিয়ে দেখার সময় উপস্থিত হয়েছে।
আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক। বাঙলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গত নির্বাচনে এই দলটি সর্বাধিক ভােট লাভ করে বাঙালি জাতির আস্থাভাজন হয়েছে। কাজেই এ দলের ভূমিকা ও কর্মসূচি বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে সংগ্রামরত জনগণকে প্রভাবিত করবে সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকের পর গত ২৯ অক্টোবর দলের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক ওবায়দুর রহমান সাংবাদিকদের কাছে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তাতে একটি তাৎপর্যময় বক্তব্য ছিল। স্বাধীনতার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ কোনও আপস রফা করবে না অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ চলছে, চলবে। আওয়ামী লীগের এই সিদ্ধান্ত যেমন অভিনন্দন যােগ্য, তেমনি লক্ষ্য করতে হবে যে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি সুস্পষ্টভাবে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী কোনও প্রােগ্রাম করেননি। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় সাম্রাজ্যবাদ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ন্যাক্কারজনক ভূমিককর প্রশ্ন অবশ্যই উঠেছিল, কিন্তু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদকে ধিক্কার জানিয়ে লিখিতভাবে কোনও প্রস্তাব ওয়াকিং কমিটি গ্রহণ করেননি দ্বিতীয়ত, ভারত সােভিয়েত মুক্ত বিবৃতিকে স্বাগত জানালেও, ওয়াকিং কমিটি সােভিয়েত বন্ধুত্বকে খােলাখুলি সমর্থন দেননি।
তৃতীয়ত, ওয়াকিং কমিটির সভায় আওয়ামী লীগের সংগঠনকে ‘বিপ্লবী সংগঠনে রূপান্তরিত করবার প্রস্তাব গৃহীত হলাে বটে, কিন্তু অন্যান্য দলের সঙ্গে সহযােগিতার প্রশ্নটি কোনাে গুরুত্ব পেল না। এমনকি সর্বস্তরে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হবে কিনা, তাও অস্পষ্ট থেকে গেল।
শত্রু যখন জোট বাঁধছে, তখন…
পাকিস্তান প্রথমাবধি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আশীর্বাদপুষ্ট, একথা সকলেরই জানা। ২৫ মার্চের আগে ও পরে অনেকে আশা করেছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাঙলাদেশের ন্যয্য গণতান্ত্রিক সংগ্রামকে সমর্থন দেবে কিন্তু বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাঙলাদেশে গণহত্যার জন্য নরঘাতক ইয়াহিয়া চক্রকে অস্ত্র ও আর্থিক সাহায্য দান অব্যাহত রেখেছে। এবং এই কারণেই বাঙলাদেশের জনগণের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদবিরােধীতা ক্রমাগত শক্তিশালী হচ্ছে। জাতীয় স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও স্থায়ী শান্তির প্রশ্নটিকে সামনে রেখে সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধীতার ভিত্তিতে এবং সােভিয়েতের বন্ধুত্বপূর্ণ মনােভাবের সঠিক মূল্যায়ন করেই কেবল বাঙলাদেশ মুক্তিসংগ্রামকে আজ নিশ্চিত জয়ের মুখে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। লক্ষ্য করা দরকার যে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামকে বানচাল করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যেমন পাকিস্তানকে প্রত্যক্ষও পরােক্ষ সাহায্য দিয়ে চলেছে, তেমনি অন্যদিক আজ যখন মুক্তিসংগ্রাম ক্রমাগত দুর্বার হয়ে উঠেছে, তখন সি আই এ ও অন্যান্য মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সংগঠনগুলাে মুক্তিসংগ্রামকে বানচাল করবার জন্য বাঙলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের সঙ্গে নতুন মাের্চায় আবদ্ধ হচ্ছে।
বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের এক নম্বর শত্রু জামাতে ইসলামী, পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি নেজামে ইসলাম, মুসলিম লীগ (এর তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপ সহ) এবং সর্বোপরি ভুট্টোর পিপলস পার্টি সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে নরহত্যার কাজে সাহায্য করে চলেছে।
একথা সত্য বটে যে আওয়ামী লীগ পূর্বাপেক্ষা অধিক সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ভূমিকা গ্রহণে প্রস্তুত কিন্তু তা স্পষ্ট নয়। মার্কিন অস্ত্র সাহায্যের কথা সমগ্র বিশ্বই জানে। অথচ আওয়ামী লীগ সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী তার প্রশ্নে একমত হয়েও বাঙলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী চরিত্র দান করার ব্যাপারে দোমনা হয়ে পড়েছেন। কে বন্ধু এবং কে শত্রু তা স্পষ্ট করে নির্দেশ না করায় নতুন সংকটের মুখােমুখি হবে মুক্তিযুদ্ধ।
বাঙলাদেশ ন্যাশন্যাল আওয়ামী পার্টির মুজাফফরপন্থী ও ভাসানীপন্থী গ্রুপ, জাতীয় কংগ্রেস এবং বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি আওয়ামী লীগের সঙ্গে সর্বস্তরে সহযােগিতা করতে প্রস্তুত। কিছুদিন পূর্বে আওয়ামী লীগের সদিচ্ছার দরুন এই পাঁচটি দল একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে। কিন্তু কোনও কাগুজে সিদ্ধান্ত দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে জোরদার করা সম্ভব নয়। আওয়ামী লীগ নির্বাচন-যুদ্ধে জয়লাভ করেছেন বলে ‘জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের বিরােধীবলে জানা গেছে। কিন্তু নির্বাচন-যুদ্ধ’ এবং জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ এক কথা নয়। সম্ভবত একথা উপলব্ধি করেই ওয়াকিং কমিটি আওয়ামী লীগের ‘পার্লামেন্টারি’ চরিত্রের অবসানঘটিয়ে তাকে ‘বৈপ্লবিক রূপ দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দলকে সুসংগঠিত এবং বিপ্লবী করার সিদ্ধান্তকেও অভিনন্দন জানাতে হবে। কিন্তু শুধুমাত্র এ কারণেই এবং দলীয় রণকৌশলের নয়া নীতি হিসেবে যদি অন্যান্য দলের সহযােগিতার প্রশ্নটিকে এড়িয়ে যাওয়া হয়, তবে তা মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক হতে পারে না।
অন্যান্য রাজনৈতিক দল যেমন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মুজাফফরপন্থী গ্রুপ, মাওলানা ভাসানী, জাতীয় কংগ্রেস ও বাঙলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি বাঙলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারকে শুধু সমর্থন দান করেননি, সহযােগিতার জন্যও তারা কাজ করছেন। শুধু নির্বাচনে জয়লাভ করেছেন বলে আওয়ামী লীগ এম এন এ এম পি এ এরা যদি অন্যান্য দলের সহযােগিতার প্রশ্নটিকে বিবেচনা না করেন, তবে তা একান্তই দুর্ভাগ্যজনক হবে। সংসদীয় রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের সমস্যা এক ও অভিন্ন হতে পারে না।
অন্যান্য দলগুলাের উচিত হবে আওয়ামী লীগের মধ্যে নেতা ও কর্মী পর্যায়ে সহযােগিতার প্রশ্নটি নিয়ে আলােচনা চালিয়ে যাওয়া। এ মুহূর্তে সবগুলাে দলের ‘অন্তর পরিবর্তন হওয়া দরকার। শত্রুকে ছােট করে দেখা কোনােক্রমে উচিত হবে না।
ট্রটস্কিপন্থী সুবিধাবাদী কার্যক্রম পরিত্যাগ করুন। বাঙলাদেশ মুক্তিসংগ্রামকে বানচাল করার জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তার পদলেহী ইয়াহিয়া সরকারকে দিনরাত সমানে মদত জুগিয়ে যাচ্ছে। এই মদত দেওয়ার পেছনে যেসব কারণ বিদ্যমান, তা সকলেরই জানা। কিন্তু কী কারণে চীন সরকার পাকিস্তানের নরঘাতী সরকারকে মদত দিয়ে যাচ্ছে তা বুঝতে হবে। বিস্ময়ের বিষয়, একশ্রেণীর উগ্র কমিউনিস্ট নামধারী ব্যক্তি আজ “ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে লাল চীনের মুক্তিফৌজ” বলে প্রচার করছে। পূর্বপাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বাঙলাদেশের গণহত্যাকে শুধু সমর্থন করেনি, উপরন্ত বাঙলাদেশে ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনী নাকি “সাম্রাজ্যবাদবিরােধী সংগ্রামে ভীষণভাবে লিপ্ত” বলে প্রচার করছে। অন্যদিকে নয় পার্টি জোটের ক্ষুদ্র অংশীদাররা বাঙলাদেশ মুক্তিসংগ্রামকে মৌখিক সমর্থন জানালেও রুশ-বিরােধী প্রচার চালিয়ে বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের শ্রেষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত বন্ধু রাশিয়াকেই আঘাত হানবার জন্য চক্রান্ত করে চলেছে। অথচ এই দলগুলাের সবারই জানা উচিত যে বাঙলাদেশ মুক্তিসংগ্রাম পাকিস্তানি শাসকবর্গের প্রত্যক্ষ জতিগত নিপীড়নের ফল। কিভাবে সাম্রাজ্যবাদীরা এই জাতিগত নিপীড়ন চালাবার জন্য পাকিস্তানের সামরিক সরকারগুলােকে সাহায্য দান করে, তাও এ দলগুলাের অজানা নয়। তবু যখন দেখা যায়, এ দলগুলাে সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধীতার ভিত্তিতে নয়, রুশ বিরােধীতার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়, তখন পরিচ্ছন্নভাবে বােঝা যায় এ দলগুলাে ট্রটাস্কি-পন্থী সুবিধাবাদের চোরাবালিতে পা দিয়েছে। সময় এসেছে, যখন এ দলগুলােকে নিজেদের রাজনৈতিক মতাদর্শ বাঙলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের আলােকে বিচার করে দেখতে হবে। বাঙলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রমাণ করে দিয়েছে চীন মূলত জাতীয় স্বার্থে ভারত বিরােধী কার্যক্রমকে বাস্তবায়িত করবার জন্য পাকিস্তানকে সবরকম মদত যুগিয়ে যাচ্ছে। আশা করা যায়, এ দলগুলাে নিজেদের ভুল বুঝতে পারবেন এবং বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামে যথার্থ ভূমিকা গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সহ অন্যান্য দলগুলাের সঙ্গে সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দেবেন।
স্বাধীনতার সড়ক: মুক্তির সড়ক
বাঙলাদেমের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে প্রকৃত অর্থে জয়ী করতে সংগ্রামকে প্রকৃত অর্থে জয়ী করতে হলে প্রতিটি রাজনৈতিক দলকে তিনটি শর্তে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে: (১) বাঙলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য, (২) সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধীতা এবং (৩) ইয়াহিয়ার খুনী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে অংশগ্রহণ।
বাঙলাদেশ জাতীয় মুক্তিসংগ্রামকে চোখের মণির মতাে অতি-বামপন্থী ও অতি-দক্ষিণপন্থী সুবিধাবাদের হাত থেকে রক্ষার জন্য সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ভূমিকা গ্রহণই হচ্ছে একমাত্র পথ।
সূত্র: সপ্তাহ, ৫ নভেম্বর, ১৯৭১