You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.03.01 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সময় শেষ অথচ— | দুর্নীতি আর ভুয়ার হাত থেকে মুক্তি চাই | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১লা মার্চ, শুক্রবার, ১৯৭৪, ১৭ই ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

সময় শেষ অথচ—

যেমন আশঙ্কা করা গিয়েছিল তেমনি ঘটেছে। সময় শেষ অথচ কাজ শুরু করবার ফুরসৎই পাননি আদমশুমারীর কর্মকর্তারা। এটা ঢাকার ক’টি এলাকার খবর। এমন খবর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আরো আসবে না এটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। লোক গণনা শুরু হবার আগে কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেখানে কথায়-বক্তৃতায় তাদের কি কি বলা হয়েছিল আমাদের জানা নেই, কিন্তু লোক গণনার গুরুত্ব এবং তাৎপর্য যে কর্তা ব্যক্তিরা সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন এমনটি মনে হয় না। উপলব্ধি করলে লোক গণনার শেষদিনে লোক গণনা শুরু হয়নি এমন একটা খবর অন্ততঃ আমাদের শুনতে হতো না।
স্বাধীনতার কিছু পরে যখন দেশের অর্থনীতিকে একটা পরিকল্পিত খাতে এগিয়ে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্যে দেশের পরিকল্পনা কমিশন গঠন করা হয় তখন থেকেই আমরা জনসম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক তথ্য অনুসন্ধানের উপর জোর দিয়ে আসছিলাম। দেশের জনসম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের একটা সঠিক হিসেব না থাকলে পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশ আদৌ সম্ভব নয়। সেই জনসম্পদ ও প্রাকৃতি সম্পদের তথ্য-হিসেব সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই গত ১০ই ফেব্রুয়ারী থেকে লোক গণনা শুরু হয়।
কিন্তু শুরু থেকেই এ কাজ যে ঢিলে তালে অগ্রসর হতে থাকে তাতে আমরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলাম। ক’দিন আগেও এ ব্যাপারে আমরা লোক গণনার দায়িত্বে নিযুক্ত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম তাদের কাজের অগ্রগতি ত্বরান্বিত করতে। গত পরশু আদমশুমারী কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন ঢাকার অনেক এলাকায় যে লোক গণনা শুরু হয়নি সে সম্পর্কিত অভিযোগ তারা পূর্বেই স্থানীয় জনসাধারণের নিকট থেকে পেয়েছেন। কিন্তু সে ব্যাপারে তারা কি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন তা জানা যায় নি।
লোক গণনায় শেষ দিনে ঢাকার যেসকল এলাকায় লোক গণনা আদৌ শুরু হয়নি সে সকল এলাকায় ‘টাস্ক ফোর্স’ পাঠানোর কথা লোক গণনা কমিশন বলেছেন। জানিনা এতে করে সমস্যার কতটুকু সুরাহা হবে। কিন্তু দায়সারা এই দায়িত্ব পালনে লোক গণনার আসল ‍উদ্দেশ্য যে সফল হতে পারে না তা বলাই বাহুল্য।
আসলে আমাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের গুরুত্ব সম্বন্ধে আমরা যত বেশী উদাসীন থাকছি, দায়িত্ব পালনে আন্তরিকতাও তেমনি আমাদের মধ্যে লোপ পাবে। এই সর্বগ্রাসী দায়িত্বহীনতায় যখন সমগ্র জাতি ভুগছে তখন লোক গণনা কমিশনের এই দায়সারা দায়িত্ব পালন কিছু ব্যতিক্রম নয়। স্বাধীনতাত্তোর কালে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণহানি ও সম্পদ ক্ষয়ের একটা হিসেব বের করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রায় সব্বাই সারগর্ভ বক্তৃতা করেছেন। কিন্তু দায়িত্ব পালনে আগ্রহী হতে কাউকে দেখা যায়নি। উন্নয়নশীল দেশে এ সকল দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবেই সরকারের উপর বর্তায়। কিন্তু সময় অতিক্রমের সাথে সাথে আমরা ত্রিশ লক্ষ শহীদ, দু’লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি আর কয়েক শ’ কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্টের একটা চিত্র তুলে ধরেই স্বাধীনতা সংগ্রামে ক্ষয়ক্ষতির একটা মোটামুটি হিসেব নিরুপণ করি।
লোক গণনার চূড়ান্ত হিসাব দাখিলের সময়সীমা বর্ধিত করার কোনো অবকাশ আছে কিনা আমাদের জানা নেই। কিন্তু যেহেতু এই সঠিক পরিসংখ্যানের উপর আমাদের ভবিষ্যত অর্থনীতি নির্ভরশীল সুতরাং দায়সারাভাবে সেই দায়িত্ব পালনের চাইতে বরং আরো কিছু সময় নিয়ে সঠিক তথ্যাদি নিরুপণই শ্রেয় বলে আমরা মনে করি। লোক গণনা কমিশন তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সঠিক পরিসংখ্যান নিশ্চিত করতে আগ্রহী হবেন এটাই আমরা আশা করি।

দুর্নীতি আর ভুয়ার হাত থেকে মুক্তি চাই

জাতির জনক একবার আক্ষেপ করে বলেছিলেন : দুর্নীতি, দুর্নীতি আর দুর্নীতি-দুর্নীতিতে দেশ ভরে গেলো—সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে এই দুর্নীতি। দুর্নীতির—জ্বালায় আমি অস্থির হয়ে গেছি। কিন্তু কেবল কি দুর্নীতি! এর সাথে যুক্ত হয়েছে ভুয়া। ভুয়া ভয়া আর ভুয়া। ভুয়া আমাদের বর্তমান সমাজ জীবনকে এমনভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে যে, আমাদের আশঙ্কা হয়, একদিন আমাদের গোটা জাতীয় আর সামাজিক অস্তিত্বই যেন ভুয়ায় পরিণত না হয়। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা, ভুয়া ব্যবসায়ী, ভুয়া শ্রমিক, ভুয়া কৃষক, ভুয়া লেখক, ভুয়া সাংবাদিক, ভুয়া লাইসেন্স, ভুয়া পারমিট—কোথায় নেই! ভুয়ার সর্বশেষ চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হলো গতকালকের এক সহযোগী দৈনিকের পাতায়। খবরে প্রকাশ, ঢাকা শহরের ৪০ হাজার সিগারেট কার্ডের মধ্যে ২২ হাজারই ভুয়া এবং একজন প্রাক্তন মন্ত্রী এ তথ্য প্রকাশ করেছেন। এর আগে ছিলো ভুয়া রেশন কার্ড। কর্তৃপক্ষীয় সূত্রেই বলা হয়েছিল যে, প্রায় ১৪ লক্ষ বাসিন্দা অধ্যুষিত ঢাকা নগরীতে রেশন কার্ডের সংখ্যা ছিল ১৯ লক্ষ। যাহোক কারফিউ জারী করে সেই ভুয়া রেশন কার্ডের সুরাহা হয়েছিল। তারপর শোনা গেছিল একমাত্র আদমজী জুটমিলেই বছরে ৬ কোটি টাকা ভুয়া শ্রমিকদের বেতন দিতে হয়। সে ব্যাপারেও নাকি কি একটা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। জুয়া লাইসেন্স ও পারমিটধারী জুয়া ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধেও মাঝে মাঝে কিছু কিছু ব্যবস্থা নেবার কথা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু ভুয়া তাঁতী হয়ে যারা সূতো কেলেংকারীর সাথে জড়িত, ভুয়া কৃষক হয়ে যারা সার, বীজ, সেচের সরঞ্জাম ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ কেলেংকারীর সাথে জড়িত তথা জাতীয় জীবনে আর যে সব ভুয়া আছে, তাদের সম্পর্কে কোনো ব্যবস্থা নেবার কোনো কথাই তো শোনা যাচ্ছে না। এখন ভুয়া এসেছে সিগারেট কার্ডে। অর্থাৎ ভুয়ার হাত থেকে আমাদের যেন নিস্তার নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই ভুয়ার মালিক কারা? নিশ্চয়ই গ্রামের নিরীহ মানুষরা নন—যারা এই আকাল আর আক্রার দিনে দু’বেলা দু’মুঠো অল্পের জন্য হা-পিত্যেশ করে ঘুরে মরেন, যারা নিরক্ষর এবং অনেক সময় নিজের নামটাও সই করতে পারেন না, তারা নন। যারা এ সব লাইসেন্স-পারমিট কার্ড ইস্যু করার কর্তাদের তো দূরের কথা—জায়গাগুলোও চিনেন না, কোনোদিন কোনো কর্তাব্যক্তির ‘সু’ তো নয়ই—নজরে আসার কথাও চিন্তা করতে পারেন না, নিশ্চয়ই তারা নন। তবে কারা? অবশ্যই যারা দেশের মালিক-মোখতার, যাদের দোর্দন্ড প্রতাপে আজ দুর্নীতিই সমাজ জীবনের মুখ্যনীতিতে পরিণত হতে চলেছে, যাদের অঙ্গুলি হেলনে হাজার হাজার ভুয়া আজ আসল এবং আসলরা আজ ভুয়ায় পরিণত হবার উপক্রম হয়েছেন, যারা নির্বাচন কালে দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে আত্মনিয়োগ করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কামিয়াব হয়ে এসেছেন, যারা যখন-তখন প্রশাসনযন্ত্রের উপর, প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম, যারা সরকারের অভ্যন্তরে সময় মতো চাপ ও প্রয়োজন মতো নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে তৎপর থাকেন তারাই। অথবা তাদের নিজস্ব লোকজনরাই। কাজেই যে প্রাক্তন মন্ত্রী এ তথ্যটি প্রকাশ করেছেন—বিলম্বে হলেও এহেন তথ্য প্রকাশের জন্যে আমরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাবো এবং এর সাথে সাথে তাঁর কাছে কয়েকটি প্রশ্নও করবো। তিনি যখন মন্ত্রী ছিলেন, এসব ভুয়া কার্ডের একটিও কি তখন ইস্যু হয়নি? তিনি যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন কেন এসব ব্যাপারে বাঁধা দেন নি? তিনি যখন মন্ত্রী ছিলেন, তখন কেন এ তথ্যটি প্রকাশ করলেন না? হয়তো বা এসব প্রশ্নের কোনো জবাব পাওয়া যাবেনা—যেমন যায়নি অতীতে আরো অনেক অনেক প্রশ্নের।
যা হোক ভুয়া আর দুর্নীতিতে যখন দেশের এ অবস্থা—আমাদের অর্থনীতির এই হাল তখন আমরা প্রশ্ন করতে চাই সরকারকে, আপনারাই যখন জানেন দুর্নীতি আর ভুয়াতে আমরা সমুদ্রের অতলান্তে ডুবে যাচ্ছি, তখন আপনারা কেন আর চুপ করে আছেন? কেন কার্যকরী ব্যবস্থা নিচ্ছেন না এর হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর? ভয়টা কোথায়? আপনাদের তো কোনো ভয় থাকার কথা নয়। দেশের মানুষ তাদের সার্বিক ভালো-মন্দ করার দায়িত্ব তো আপনাদেরই হাতে তুলে দিয়েছে-আপনারা সেই দায়িত্ব সম্পাদন করতে দ্বিধাগ্রস্ত কেন? জাতির জনক তো কেবল জাতির জনকই নন, তিনি এদেশের সরকার প্রধান—প্রধানমন্ত্রী। দুর্নীতির জ্বালায় অস্থির হবার কথা তো তাঁর নয়—তাঁর তো এর বিরুদ্ধে বলিষ্ঠভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করার কথা। প্রয়োজনবোধে দু’একজনকে প্রকাশ্যভাবে বিচার করে চরম দন্ডদানের কথা। আমাদের বিশ্বাস সেই সময়—সেই প্রেক্ষিত এখন এসে গেছে—অন্ততঃ আমাদের সামাজিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রশ্নে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন