You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২৯শে আগস্ট, বুধবার, ১৯৭৩, ১২ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ প্রয়োগ

বাঙালী জাতি ও জাতীয়তাবাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সাম্প্রতিক বিদেশ সফরকালে একাধিকবার বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আণবিক শক্তিকে বিশ্বে শান্তিপ্রতিষ্ঠা এবং মানব কল্যাণের কাজে নিয়োজিত করার আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বশান্তির দূত শেখ ‍মুজিব এর আগেও বার বারই তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা বিবৃতিতে পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের প্রতিযোগিতা পরিহার করে সেই পারমাণবিক শক্তি এবং অস্ত্র নির্মাণখাতে ব্যয়কৃত অর্থ বিশ্বের নিপীড়িত বুভুক্ষু মানুষের কল্যাণের কাজে ব্যয় করারও আহ্বান জানিয়েছিলেন। বস্তুতঃ আণবিক বা পারমাণবিক শক্তি আমাদের কালে—বিজ্ঞানের এক বিস্ময়কর অবদান—বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় এক শীর্ষস্থানীয় আবিষ্কার। এই আণবিক বা পারমাণবিক শক্তিকে এর আবিষ্কারের পর থেকে যতটা না মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা হয়েছে—তার চাইতে অনেক অনেক গুণ বেশী করে ব্যবহার করা হয়েছে বা হচ্ছে মানবসমাজ তথা মানবতার ধ্বংস সাধনে—আজ একথা বললে অত্যুক্তি হবেনা নিশ্চয়। বিশ্বের সর্বত্র আজ যে শক্তির প্রতিযোগিতা রণোন্মাদনার প্রতিযোগিতা বৃহৎ শক্তিবর্গের নিজেদের মধ্যে অহংভাব প্রকাশের প্রতিযোগিতা—তার প্রধান এবং প্রথম কারণ ও উপকরণ হচ্ছে এই আণবিক বা পারমাণবিক শক্তি। এর আধিক্যই আজ একে অপরের উপর প্রভাব বিস্তারের কথা ভাবে। তবে আশার কথা এই যে, কিছুদিন আগে সোভিয়েত কম্যুনিস্ট পার্টি প্রধান তাঁর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর কালে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে শান্তির কাজে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহারকল্পে একটি চুক্তি সম্পাদন করেন। তাঁদের এই মহৎ উদ্যোগ অবশ্যই বিশ্বের শান্তিপ্রিয় জাতিগুলো—বিশেষ করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল জাতিগুলোর মনে নব আশার সঞ্চার করছে।
এদিকে গত সোমবার ঢাকায় বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারে পারস্পরিক সহযোগিতা সংক্রান্ত পাঁচ বছর মেয়াদী একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে কৃষি, শিল্প, প্রকৌশল ও বিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ ও তেজস্ক্রিয় বিকিরণের উৎসসমূহ ব্যবহারের কর্মসূচী প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, মৌলিক গবেষণা ক্ষেত্রে পারমাণবিক ইলেক্ট্রনিক্স বিদ্যার বিকাশ সাধন এবং আণবিক শক্তি চুল্লী স্থাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন ও গবেষণা কর্মে ও পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ক্ষেত্রে দু’দেশের সহযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিয়োজিত বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক স্থাপন ও উন্নয়ন বিজ্ঞানকর্মী ও বিশেষজ্ঞ বিনিময়, এক দেশের বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীদের অপর দেশের সম্মেলন-সিম্পোজিয়াম প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরী বইপত্র, প্রামাণ্য কাগজপত্র, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম বিনিময় প্রশিক্ষণ কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ এবং যৌথ বা সমন্বিত গবেষণা বা উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করবে।
শান্তির কাজে—মানব সমাজের কল্যাণে এবং সর্বোপরি মানবতার কাজে আণবিক শক্তির সুষম ব্যবহারের এই শুভ উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা মনে করি বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ ভারতের সাথে তাঁর ব্ন্ধুসুলভ নিকট প্রতিবেশী বাংলাদেশের এই চুক্তি সম্পাদন বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, পারস্পরিক উন্নয়ন এবং মৈত্রী সম্পর্ক সুদৃঢ়করণের পথে এক দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ এবং অপরাপর উন্নয়নশীল দেশগুলোও এ থেকে নতুন শিক্ষা নিতে পারবে।

মহান ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন

আজ ঊনত্রিশে আগস্ট। কাল এবং পরশুদিন বাদে পরদিন পয়লা সেপ্টেম্বর দেশের চারটি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদের অধীনে মাধ্যমিক (এস.এস.সি.) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে এই পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল গত ১৬ই আগস্ট। কিন্তু সারাদেশব্যাপী বেসরকারী মাধ্যমিক শিক্ষকদের ৬ দফা দাবীর পরিপ্রেক্ষিতে অব্যাহত ধর্মঘটের ফলে সে তারিখে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।
এর মধ্যে আরো সময় বয়ে গেছে। শিক্ষকদের ধর্মঘট সংক্রান্ত ব্যাপারে শেষ অবধি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষকদের সংগ্রাম পরিষদের কাছ থেকে দীর্ঘ সময় ধরে অত্যন্ত ধৈর্যের সঙ্গে তাঁদের দাবী দাওয়ার কথা শুনেছেন। তাঁদের দাবীগুলোকে সরকার নীতিগতভাবে সমর্থন করে এবং সেগুলো কিভাবে বাস্তবায়িত করা যেতে পারে সে ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যে শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে সপ্তাহখানেকের মধ্যেই আলোচনা করার আশ্বাস প্রদান করে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে ধর্মঘট প্রত্যাহার করার জন্যে শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানান।
খুশীর কথা, শিক্ষক সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুর সে আহ্বানে সাড়া দিয়ে ধর্মঘট প্রত্যাহারের কথা ঘোষণা করেন এবং ২৪শে আগস্ট থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যোগদানের ও ক্লাশ চালু করার কথা ব্যক্ত করেন। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখ এবং লজ্জার বিষয়, কিছুসংখ্যক শিক্ষক তাঁদের সেই সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তকে অন্যায় এবং অগণতান্ত্রিক বলে আখ্যায়িত করে দাবী পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চালিয়ে যাবার কথা ঘোষণা করে। এমনিভাবে সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সমাজ রাজনৈতিক দলগুলোর ন্যায় দরকষাকষির মাধ্যমে চলতে থাকেন। এদিকে সরকার তার প্রতিশ্রুতি মোতাবেক শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগের প্রতিনিধিদের নিয়ে শিক্ষকদের দাবী বাস্তবায়নের বাস্তব কর্মপন্থা নির্ণয়ের জন্যে বৈঠকের ব্যবস্থা করেছেন, অন্যদিকে এস.এস.সি. পরীক্ষার মাত্র তিন চারদিন পূর্বেও কিছুসংখ্যক শিক্ষককে পবিত্র দায়িত্ব থেকে দূরে সরে থাকতে দেখা যাচ্ছে।
দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক ধর্মঘটের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার ফলে তার অবসান ঘটায় ছাত্রসমাজ ও অভিভাবক মহল খুশী হয়েছিলেন এবং স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। কিন্তু এস.এস.সি. পরীক্ষার মাত্র তিনদিন আগেও নারায়ণগঞ্জের মতো শহর এলাকার পরীক্ষার্থীরা এডমিট কার্ড পায়নি এবং তাদের সীট কোথায় কিভাবে পড়েছে তা জানতে পাচ্ছে না বলে খবরের কাগজে প্রকাশিত খবর পেয়ে পরীক্ষার্থী ও অভিভাবক মহলের মধ্যে এক দারুণ অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। মফস্বল এলাকার অবস্থা যে কিরূপ তা এই খবর অনুসারেই অনুমান করা যাচ্ছে।
জানিনা আজ পর্যন্ত এডমিট কার্ড পরীক্ষার্থীদের হাতে না পৌঁছানোর পেছনে কি কারণ রয়েছে। এ ব্যাপারে শিক্ষা সংসদের কোন ক্রুটি আছে কিনা জানিনা। তবে এটুকু বিশ্বাস করতে বাঁধা নেই যে যেহেতু পরীক্ষা একেবারেই হাতের কাছে সুতরাং এডমিট কার্ড ইতিপূর্বেই স্ব স্ব পরী্ক্ষা কেন্দ্রে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলে যাবার কথা। সুতরাং এক্ষণে মূলতঃ দায়িত্ব পরীক্ষা কেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের। অতএব যদি এডমিট কার্ডগুলো যথাযথভাবে ইতিপূর্বে যথাস্থানে পৌঁছে যাওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষা কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের কোন প্রকার অবহেলা বা ক্রুটির জন্যে তা পরীক্ষার্থীদের হাতে না পৌঁছে থাকে তাহলে এর চেয়ে পরিতাপের এবং লজ্জার আর কি হতে পারে? সবারই জানা কথা পরীক্ষাকেন্দ্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেন বিশেষ করে শিক্ষক সমাজ। সুতরাং যেখানে সরকার নীতিগতভাবে তাঁদের দাবী সমর্থন করেছেন, দাবী পূরণের বাস্তব কর্মসূচী প্রণয়নের জন্যে শিক্ষক ও শিক্ষা বিভাগের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে সেক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবনকে ছোট করে দেখে রাজনেতিক উদ্দেশ্য হাসিলের ন্যায় দরকষাকষি করা এবং গোঁ ধরা কতখানি যুক্তিযুক্ত বা ন্যায়সঙ্গত শিক্ষক সমাজের প্রতিই আমাদের সে প্রশ্ন রইলো।
পরিশেষে, শিক্ষক সমাজের প্রতি আমাদের বক্তব্য, সমাজের সবচেয়ে সম্মানীয় ব্যক্তি আপনারা। আপনারা জাতির মেরুদন্ডের নির্মাতা। আপনাদেরকে বেশী কিছু বলার অবকাশ নেই—কেননা আপনারা শিক্ষক, আপনাদের কাছে আমরা শিক্ষা লাভ করি, সমাজ করে। অতএব অনুরোধ, জাতির ভবিষ্যত মেরুদন্ড, আপনাদেরই সন্তানদের মঙ্গল চিন্তা করে এবং দেশ ও জাতির বৃহৎ স্বার্থের কথা স্মরণ করে ব্যক্তিগত লাভালাভের জন্যে কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করে আপনাদের পবিত্র দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসুন, ত্যাগের উজ্জ্বল ও আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপন করুন। সমাজ এবং আমাদেরকে আপনাদের সে মহান ত্যাগের আদর্শে অনুপ্রাণিত হবার সুযোগ সৃষ্টি করুন। আপনাদের কাছে আমাদের কেবল এটাই প্রত্যাশা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!