You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৪শে সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার, ৮ই আশ্বিন, ১৩৮০

এ অভিযান অভিনন্দনযোগ্য

সম্প্রতি দেশের কয়েকটি জেলায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহ একটি ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে বলে সংবাদে প্রকাশ। সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে পুলিশ, রক্ষী বাহিনীর সহযোগিতায় এ তৎপরতা চলছে। উদ্দেশ্য সমাজবিরোধী দুষ্কৃতিকারী, ছিনতাইকারী ও কালোবাজারিদের সমাজ দেহ থেকে উচ্ছেদ করা। যে সকল এলাকায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে তা হলো খুলনা, মাদারীপুর, বরিশাল ও পটুয়াখালী। জানা গেছে, এ অভিযান শুরু হবার পর থেকে উল্লেখিত এলাকাসমূহের সমাজ বিরোধী শক্তির তৎপরতা হ্রাস পেয়েছে। এবং বহু সংখ্যক দুষ্কৃতিকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন এলাকা থেকে বহু সংখ্যক অস্ত্রশস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। আরো জানা গেছে, সমাজ বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করায় এলাকার জনসাধারণের নিরাপত্তাহীন জীবনে আশার সঞ্চার হয়েছে। বস্তুতপক্ষে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে নিদারুণ অধঃপতন ঘটেছিল এই অভিযান সেক্ষেত্রে একটি আশাব্যঞ্জক পদক্ষেপ। একশ্রেণীর মানুষ সেনাবাহিনী, পুলিশ, রক্ষী ও রাইফেল বাহিনীর এই তৎপরতাকে নিঃসন্দেহে অভিনন্দিত করবে। অন্য এক শ্রেণীর মানুষ যাদের সংখ্যা অত্যন্ত স্বল্প তারা এ ধরনের তৎপরতার বিরুদ্ধে মন্তব্য করবে। কিন্তু দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে একটি কঠোর সঙ্গবদ্ধ অভিযান পরিচালনা করা যে অপরিহার্য তা আর ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ অস্বীকার করবে না। বরং তাঁদের দাবি -সরকার অবিলম্বে দেশের সকল প্রকার সমাজবিরোধী শক্তিসমূহকে কঠোর হস্তে দমন করুক। দেরীতে হলেও সরকার এমন একটি পদক্ষেপ নিয়েছেন বলে আমরা আশাবাদী। আমরা আশাবাদী যে যদি সরকার দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য এমন একটি পদক্ষেপ যথাযথ গ্রহণ করতে পারেন তাহলে দেশবাসী তাদেরকে সম্পূর্ণ সমর্থন ও সহযোগিতা প্রদান করতে এগিয়ে আসবে। দেশের ভিতরে আজ সকল প্রকার সমাজ বিরোধী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশপ্রেমিক মানুষকে খুন করছে, সম্পদ লুট করছে, ব্যাংক ও থানা লুট শুরু করেছে। এমনই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে দেওয়া কোনোক্রমেই উচিত নয় বরং একটি বৈধ সরকারের পক্ষে এটা একটা মারাত্মক হুমকিস্বরূপ ও অবমাননাকর। আমরা বহু পূর্বেই সরকারকে একটি শক্তিশালী অভিযান পরিচালনার আহ্বান জানিয়েছিলাম। দেশের শত্রুরা যেভাবে দিনদিন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তাদের অবিলম্বে তাদেরকে রোধ করার প্রয়োজনীয়তাও আমরা অনুভব করেছিলাম। সরকার যদি প্রাথমিক অবস্থায় এসকল দুষ্কৃতিকারীকে নির্মূল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন তাহলে তারা সঙ্ঘবদ্ধ হবার সুযোগ হারিয়ে ফেলতো। আজ সমাজ বিরোধী শক্তি সঙ্গবদ্ধ এবং পরিকল্পিত উপায়ে তৎপর। এমতবস্থায় আর বিলম্ব করা মোটেই উচিত নয়। তাই আমাদের বক্তব্য দেরীতে হলেও সরকার আইন শৃংখলার প্রশ্নে যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তা অভিনন্দনযোগ্য। তবে সত্যিকার দোষী ব্যক্তিরাই যাতে ধরা পড়ে তার নিশ্চয়তা বিধান করা উচিত। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে যাতে করে দেশ প্রেমিক কর্মীদেরকে হয়রানি করা না হয় তার দিকে সতর্ক কন্ট্রোল ব্যবস্থা অবশ্যই রাখতে হবে। সমাজ বিরোধী সকল শক্তিসমূহকে নির্মূল করার অভিযান সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ুক এটা আমরা চাই। তবে তা হতে হবে অবশ্যই দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক সংগঠনের সহযোগিতায়। কেননা আমরা বিশ্বাস করি, কোন অভিযানই সত্যিকার অর্থে স্থায়ীভাবে কার্যকরী হয় না যদি না তা রাজনৈতিক তৎপরতায় পরিচালিত হয়। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা আপাততঃ অবস্থা আয়ত্ত্বে আনতে পারে কিন্তু স্থায়ীভাবে কোনদিন তা পারে না।

বিক্ষুব্ধ বেলুচিস্তান

বেলুচিস্তানের স্বাধীকার আন্দোলনকে দমন করার জন্য ইরানি সৈন্য আমদানি করা হয়েছে। পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনী বেলুচিস্তানের ঘরে ঘরে অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা সেখানে। ইসলামাবাদের লেলিয়ে দেয়া সৈন্যরা হাজার হাজার বেলুচকে বন্দিশিবিরে আটকে রেখেছে।
বেলুচিস্তানের জনসাধারণ পাকিস্তানি বাহিনীর সীমাহীন অত্যাচার অবিচারের ফলে শেষ পর্যন্ত ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওদের এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বেলুচিস্তানের পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি এক প্রচারপত্রে জনগণকে শহরে-বন্দরে, রাস্তায় রাস্তায়, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে, কলকারখানায় দুর্গ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন। প্রচারপত্র বলা হয়েছে,’বেলুচিস্তানের মানুষ জেগে ওঠ, লড়াইয়ে নেমে পড়ো। ইসলামাবাদের পাঠানো হায়নাদের যেখানে পারো মোকাবিলা করো। ঘেরাও করো। পাকিস্তানের এই চরম শত্রুদের ঝাড়ে বংশ খতম করে প্রতিশোধ নিতে হবে। শিশু ও মা বোনের রক্তের বদলা নিতে হবে। শত্রুর বিরুদ্ধে আজ সকল ফ্রন্টে লড়াই চালাতে হবে।’
পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির নামে প্রকাশিত প্রচারপত্রে আরও বলা হয়, সিভি আর কোয়েটার কাছে বন্দিশিবিরে হাজার হাজার যুবক বৃদ্ধ বেলুচ পচছে। দেশমাতৃকার শ্রেষ্ঠ সন্তান ও রাজনৈতিক নেতাদের মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগে জেলে ঢোকানো হয়েছে। সাবেক গভর্নর গাণ্ডস বখশ বেজেঞ্জো, মুখ্যমন্ত্রী আতাউল্লাহ খান মেঙ্গল, মন্ত্রী গুগোল নাসির খান নাসির সরদার আব্দুর রহমান, ডেপুটি স্পিকার মওলা শামসুদ্দিন, পার্লামেন্ট সদস্য খায়ের বখশ মারী এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের অপরাধ তারা জনতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বেলুচিস্তানের বহু এলাকায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা হয়েছে। খাবার পানিতে বিষ মেশানো হচ্ছে। বাড়িতে পুরুষদের ধরে নেয়ার পর মেয়েদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে আকবর বুগতির আদেশে তাঁদের ধর্ষণ করা হচ্ছে।
পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রচারপত্রে যা বলা হয়েছে তাতে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আজকের বেলুচিস্তানের মাটিতে ভুট্টো সরকার সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন। ভুট্টো সাহেব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছেন, জাতীয় সংবিধান দিয়েছেন বলে যতই গালিগালাজ করুন না কেন বেলুচিস্তানে গণতন্ত্রের ‘গ’ ও নেই। পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী বেলুচ জনসাধারণের স্বাধিকারের দাবিকে দমন করার জন্য কামান, বন্দুক আর মেশিনগান হাতে তুলে নিয়েছে। শুধু তা-ই নয় সেখানে ইরানি সৈন্য ও আমদানি করা হয়েছে। উদ্দেশ্য জনতার কন্ঠকে স্তব্ধ করে দেয়া। কিন্তু প্রশ্ন হলো আজকের দুনিয়ায় মুক্তিপাগল মানুষকে কামান বন্দুক দিয়ে স্তব্ধ করে দেয়া যায় না।
বাংলাদেশের মাটিতেও পাকিস্তানি জল্লাদ বাহিনী নজিরবিহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ছিল কিন্তু তাতেও বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে দমন করা সম্ভব হয়নি। ভুট্টো সরকার বেলুচিস্তানে যে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছেন, তাতে আর যা-ই হোক বেলুচদের দমন করা যাবেনা। অত্যাচারের স্টিমরোলার চালিয়ে নয় -ভাই হিসেবে সহযোগিতা ও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এবং বেলুচ জনতার ন্যায় সঙ্গত দাবি-দাওয়া মেনে নেওয়ার মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হতে পারে। আর তা যদি ভুটান সরকার না করেন তাহলে বেলুচিস্তান যে আরেক বাংলাদেশে রূপান্তরিত হবে তা ইতিহাসের গতিধারা মাধ্যমেই স্পষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়।

অসাধু ব্যবসায়ীদের অশুভ পাঁয়তারা

গতকালকের ‘বাংলার বাণী’তে খবর বেরিয়েছে -মূল্য নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী ব্যবস্থা নেই,তাই অসাধু ব্যবসায়ীরা আবারো তৎপর হয়ে উঠেছে -গোপনে চালের মজুদ চলছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, গত দু-তিন সপ্তাহ থেকে রেশনে চাল দেওয়া হচ্ছে না। রেশনের দোকানে চাল আসছে, চাল দেওয়া হবে, এমনিতর আশা-নিরাশার অনিশ্চয়তার মধ্যেও মোটামুটি বাজারদর ঠিকই ছিল। কিন্তু যেই খাদ্যমন্ত্রী ঘোষণা করলেন আগামী ৬ই অক্টোবর থেকে রেশনে পুনরায় চাল দেওয়া শুরু হবে ঠিক সেই মুহূর্তেই মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীরা মওকা বুঝে ফেললেন। তাঁরা নিশ্চিত হলেন আগামী ৬ তারিখের মধ্যে কৃত্রিম খাদ্য সংকট সৃষ্টি করে অধিক মুনাফা অর্জন করা যায় কিনা। যেমন ভাবা তেমন কাজ -গোপনে তাঁরা চাল মজুদ করতে শুরু করলেন। আর এর ফলে ইতিমধ্যে চালের দাম বেড়ে গেল, মাত্র চার পাঁচ দিন আগে যা ছিল তার চাইতে মণ প্রতি দশ বিশ টাকা করে।
আমরা ইতিপূর্বে বহুবার সব জিনিসের বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করার দিকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে লিখেছি। শুধু তাই নয়, আমরা সতর্কবাণী উচ্চারণ করে একথা বলেছি যে, অসাধু ব্যবসায়ীরা সরকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে লুকোচুরি খেলেন। অর্থাৎ সরকারকে বোকা বানিয়ে তাদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে অসাধু ব্যবসায়ীরা সর্বদা অত্যন্ত সজাগ এবং তৎপর। সুতরাং এইসব মুনাফাখোর অসাধু ব্যবসায়ীদেরকে দৃঢ়হস্তে দমনের আহ্বানও আমরা জানিয়েছি একাধিকবার।
যাই হোক, একই কথার পুনরাবৃত্তি করে বলি, সময় বয়ে যায় নি। এখনো সময় আছে। আমাদের সুনিশ্চিত বিশ্বাস, দুষ্কৃতিকারী অসাধু ব্যবসায়ী প্রভৃতিকে সমূলে উৎপাটিত করার কার্যকর ব্যবস্থা নিলে আজও তাদের অসাধু প্রচেষ্টা নিবৃত্ত করা কঠিন নয়। এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের অশুভ পাঁয়তারার হাত থেকে শান্তিপ্রিয় জনগণকে রক্ষা করা তেমন অসাধ্য কিছু নয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!