বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩১শে ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ১৫ই পৌষ, ১৩৮১
চিনির মূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গে
আখের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার জিনিস দর ১ টাকা ৪০ পয়সা বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত গত ৩০শে ডিসেম্বর থেকে কার্যকরী হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর এই প্রথমবারের মতো চিনির দাম বাড়লো তা নয়। এর আগেও তিন দফায় দাম বাড়ানো হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পর চিনির দাম ছিল সের প্রতি তিন টাকা। তিন টাকা থেকে হল ৪ টাকা। তারপর চার টাকা থেকে হলো পাঁচ টাকা। আর এবারে তা বেড়ে হলো ৬ টাকা ৪০ পয়সা।
কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধি জনিত কারণে যেকোনো পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এটাই হলো স্বাভাবিক নিয়ম। এ নিয়মে কেনাবেচা চলে। সুতরাং জিনিসের প্রতি এক টাকা ৪০ পয়সা মূল্যবৃদ্ধিকে জনসাধারণ স্বাভাবিক নিয়ম বলে মেনে নিতে পারতো। বাস্তবে কিন্তু তা হচ্ছে না। কারণ স্বাভাবিক নিয়মের পথ ধরে এখন আর সবকিছু চলছে না। সরকার যদি কোনো পণ্যের মূল্য এক টাকা বৃদ্ধি করেন তাহলে বেসরকারি পর্যায়ে তার দাম বৃদ্ধি হয় ৪ টাকা। অর্থাৎ সোজা ভাষায় তিন-চারগুণ দাম বেড়ে যায়। কাজের বর্তমান অবস্থা যেকোনো পন্যের মূল্য বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকারকে এ দিকে নজর দেওয়া উচিত। এটা সবাই জানেন, বর্তমানে রেশনিং ব্যবস্থার সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন গুটিকয়েক শহরের অধিবাসীরা। মফঃস্বল এলাকাতে সংশোধিত রেশনিং ব্যবস্থা চালু থাকা সত্ত্বেও সব সময় প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে তাই দেশের বৃহৎ সংখ্যক জনসাধারণকে খোলা বাজারে যেতে হয়।
হয়তো কেউ কেউ বলবেন যে, চিনি তো সবার প্রয়োজনে লাগেনা। লাগেনা এটা ঠিকই তবে তাদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়। তাছাড়া চিনির সঙ্গে গুড়ের সম্পর্কটিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এটির দাম বাড়লে অন্যটির দামও বাড়ে। দাম বাড়ার প্রতিযোগিতার ফলে ৭৫ পয়সা আর গুড় বর্তমানে ১০ টাকা সেরে বিক্রি হচ্ছে।
দেশের চিনি পরিস্থিতির সর্বশেষ চলচ্চিত্র আমরা পাচ্ছি তা এমন কোন হতাশা ব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে না। চলতি মৌসুমে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ১ লাখ ৩২ হাজার টন। দেশের চৌদ্দটি চিনিকলে এ পর্যন্ত নির্ধারিত লক্ষ্যে অনুযায়ী শতকরা ২৫ ভাগ আখ মাড়াই সম্পন্ন হয়েছে। তবে এবারে বেশিরভাগ চিনিকলের মাড়াইকৃত আখ থেকে চিনি আহরণের পরিমাণ আশানুরূপ নয়। কারণ, বন্যা, অতিবৃষ্টি, বিভিন্ন রোগ ও কীটপতঙ্গের আক্রমণের ফলে আখের ফলন ভালো হয় নি। কোন কোন এলাকার মিলগুলোতে উৎপাদন কম হলেও সামগ্রিকভাবে যে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ব্যর্থতা অর্জিত হবে তেমন কোন কারণ আপাততঃ দেখা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট মহল আশা করছেন যে, নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারলেও পাক আমলের চেয়ে এবারে চিনি উৎপাদন বেশি হবে। উল্লেখ্য যে, অতীতে কোনো এক মৌসুমে সর্বোচ্চ চিনি উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ১২ হাজার টন। এ থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, চিনি উৎপাদনের দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যদি আরও সচেতন হন তাহলে তিনি নিয়ে ভাবনার কিছু থাকেনা। অন্ততঃ বিদেশের বাজারে বিক্রি করে আমরা বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করতে পারি। তেমন সম্ভাবনাও রয়েছে প্রচুর। আর যদি তা হয় তাহলে কাঁচামালের মূল্য বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে দফায় দফায় দফায় আবার তেমন কোনো প্রয়োজনীয়তা থাকেনা। আভ্যন্তরীণ বাজারের মূল্যস্ফীতির রেখে প্রয়োজনে কিছুটা লোকসান দিয়েও তা পুষিয়ে নেয়া যায়। কাজেই যে কোন মুহূর্তে ঝট করে দাম না বাড়িয়ে সংকটের কারণগুলোকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। বর্তমানে চিনির উৎপাদনে এখন কিছু সমস্যা রয়েছে যেগুলো দূর করতে পারলে উৎপাদন খরচও কমে যাবে। যেমন আখের উৎপাদন বৃদ্ধি, নিয়মিতভাবে চিনিকলগুলোতে আখ সরবরাহ, চিনিকল এলাকায় যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়ন ও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ আদেশ কার্যকর করতে পারে দাম দিয়ে আর অতটা মাথা ঘামাতে হবে না।
পরিশেষে আমরা কথাই বলবো যে, এমনিতেই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধিতে জনসাধারণ দিশেহারা। তার ওপর গোদের ওপর বিষফোঁড়া মতো চিনির দাম বাড়ার হাত থেকে জনসাধারণ রেহাই পেতে পারে যদি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চিনি উৎপাদনের পরিপ্রেক্ষিতে বক্তব্য আমরা রেখেছি সেদিকে লক্ষ্য রাখেন।
কলেজ ও কলেজ শিক্ষায় অচলাবস্থা
দেশের বেসরকারি কলেজগুলোর অবস্থা বর্তমানে চরমে উঠেছে। একটি সুষ্ঠু শিক্ষানীতির অভাবে কলেজ গুলো আজ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। কিছুদিন পূর্বে বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ এবং সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে কিছু তথ্য পরিবেশন করেছিলেন। সেই তথ্য থেকে জানা যায়-দেশের ২০০ কলেজ ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে এবং প্রায় তিন হাজার শিক্ষক বেকার হয়ে পড়েছেন। এছাড়া প্রায় ৭০০ কলেজ নিদারুণ আর্থিক সংকটে পড়ে বন্ধ হবার উপক্রম হয়েছে। কলেজ শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দ আরো বলেছেন দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কলেজের ছাত্র ভর্তির সংখ্যা এবং সংখ্যা ৫০ থেকে ৭৫ জন হ্রাস পেয়েছে। শিক্ষক সমিতির নেতৃবৃন্দের দেওয়া তথ্যের সবটুকু সত্য-অসত্যের যাচাই না করলেও বস্তুতঃ ধরে নেয়া যায় দেশের বেসরকারি কলেজ ও কলেজ শিক্ষার বর্তমান অবস্থা এমনই একটি অচল অবস্থার মধ্যে এসে পড়েছে। বেসরকারি কলেজের প্রাণ মূলতঃ ছাত্র বেতন এবং সরকারি সাহায্য। ছাত্র ভর্তির সংখ্যা যখন অস্বাভাবিকভাবে হ্রাস পায় তখন সরকারি সাহায্য দ্বারাও কলেজকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবু শিক্ষার সম্প্রসারণ এর প্রশ্নের সরকারি নীতির যদি সুষ্ঠ ভাবে প্রয়োগ করা হয় তাহলে সংকট উত্তরণ সম্ভব হবে। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে গত তিন বছরেও আমাদের জাতীয় শিক্ষা নীতি ঘোষণা করা হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল প্রভৃতি বিদ্যায়তনের শিক্ষকদের জীবন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ স্থবির হয়ে পড়েছে। শিক্ষাঙ্গনের এহেন বন্ধ্যাত্ব মোচনের জন্য ইতিপূর্বেও আমরা আমাদের অভিমত জানিয়েছি। আমাদের বিশ্বাস -জাতীয় শিক্ষা নীতি ঘোষণা ও তার দ্রুত বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গৃহীত না হলে সার্বিক অর্থে শিক্ষাঙ্গনে বিদ্যমান সঙ্কট অবস্থার অবসান ঘটবে না। আরে কাজে যত বিলম্ব হবে ততই গোটা জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। দেশের হাজার হাজার ছাত্র তাদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবনের সাবলীল গতি হারিয়ে নৈতিক অধঃপতনের দিকে ধাবিত হবে। ছাত্রদের জ্ঞানদানের মহান ব্রত নিয়ে যারা শিক্ষকতা জীবন বেছে নিয়েছিলেন সেই হাজার হাজার শিক্ষক তাদের মহান আদর্শ থেকে সরে এসে স্ব স্ব সামাজিক ও আর্থিক জীবন প্রতিষ্ঠার জন্য অশিক্ষা সুলভ তৎপরতায় লিপ্ত হবেন। একটি জাতির জীবনে এটা মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে বাধ্য। আমাদের কর্তৃপক্ষ দেশের শিক্ষাব্যবস্থার সংকট মোচনের জন্য নিশ্চয়ই কোনো পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবছেন বলে আমরা মনে করি। বেসরকারি কলেজ গুলোকে অবিলম্বে যদি সরকারি আর্থিক সাহায্য দিয়ে টিকিয়ে রাখার ন্যূনতম নিশ্চয়তা প্রদান করা না হয় তাহলে দেশের সকল বেসরকারি কলেজ অনিবার্যভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। স্থানীয় জনসাধারণের সাহায্য ও সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে মফস্বলের কলেজগুলো। দেশের প্রায় প্রতিটি থানাতেই উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ স্থাপিত হয়েছে। বহু থানাতে বিজ্ঞান বিভাগ সহ ডিগ্রী কলেজও হয়েছে। সার্বিক অর্থনৈতিক সংকটের দরুন কলেজগুলোতে ছাত্র ভর্তি সংখ্যা হ্রাস পেলেও দেশের এই সকল কলেজে হাজার হাজার অধ্যায়নরত ছাত্র সম্পূর্ণ অনিশ্চিত জীবন যাপন করছে। শিক্ষকরাও এটি অনিশ্চিত মানসিকতা নিয়ে কাল কাটাচ্ছেন। দেশের বেশ কয়েকটি কলেজে অনার্স এম,এ ও এম,কম ক্লাস চালু করা হয়েছে। এরা নিজেদেরকে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচয় দান করছে। শিক্ষানীতির অভাবের ধরুন এই সকল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও এতে অধ্যায়নরত ছাত্ররাও একটি নিদারুণ অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে রয়েছে। আমাদের সরকার বিশেষ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের গোটা শিক্ষাঙ্গনে নেমে আসা মারাত্মক সংকট মোকাবেলার জন্য অবিলম্বে কার্যকরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলে আমরা আশা করি। বেসরকারি কলেজগুলোর দুরবস্থা মোচন ও তাতে অধ্যায়নরত হাজার হাজার ছাত্রের জীবনের অনিশ্চয়তা দূরীকরণের জন্যেও কর্তৃপক্ষ সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলেও আমাদের বিশ্বাস রয়েছে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক