ভাষা আন্দোলনে সাতক্ষীরা
পশ্চাৎপদ অঞ্চলও আন্দোলনে সক্রিয়
সাতক্ষীরা খুলনা জেলার আরও দূরবর্তী মহকুমা শহর। যােগাযােগব্যবস্থা সমস্যাসংকুল। সাতক্ষীরার রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রধান দুটো দল জাতীয় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ। এ ছাড়া ছিল হক সাহেবের কৃষক প্রজা পার্টি ও কিছুসংখ্যক বিচ্ছিন্ন কমিউনিস্ট নেতা-কর্মী। রাজধানীর সঙ্গে যােগাযােগ দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ- কি কলকাতা, কি ঢাকা।
বিভাগােত্তরকালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সাতক্ষীরার রাজনৈতিক আবহে মুসলিম লীগের ছিল আধিপত্য। গণতন্ত্রী বা প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর অভাব ছিল লক্ষ করার মতাে। এ পর্যায়ে উল্লেখযােগ্য রাজনৈতিক নাম সুশােভন আনােয়ার আলী। এ ছাড়া ছিলেন স্বনামখ্যাত ছাত্রনেতা শামসুল হক, যিনি তখন সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্র।
এমন পশ্চাৎপদ অবস্থা সত্ত্বেও ১৯৪৮ সালে সাতক্ষীরা কলেজের ছাত্ররাই প্রধানত ভাষা আন্দোলনের স্থানিক প্রকাশ ঘটান সংক্ষিপ্ত ছাত্রধর্মঘট এবং বিক্ষোভ মিছিল ও সভার মাধ্যমে। অনেকটা নিয়ম রক্ষার মতাে করে।
পরবর্তী পর্যায়ে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করেন পূর্বোক্ত আনােয়ার আলী, সৈয়দ কালাম বখত। সাতক্ষীরার স্বনামখ্যাত বটতলায় এদের চেষ্টায় ভাষার দাবিতে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে একাধিক উপলক্ষে। এ আন্দোলনে স্থানীয় কলেজের প্রাধান্য থাকলেও স্কুলের ছাত্ররা এতে অংশ নিয়েছে। এমনকি অংশ নিয়েছেন কোনাে কোনাে ছাত্রী- যেমন গােলেরা বেগম, সুলতানা প্রমুখ। যথারীতি গ্রেপ্তার হন আনােয়ার আলী ও সৈয়দ বখত।
তবে ১৯৫২-এর ফেব্রুয়ারিতে ভাষা আন্দোলন অধিকতর সংগঠিতভাবে শুরু হয়। এবার নেতৃত্বে যথারীতি সাতক্ষীরা কলেজ। এখানকার ছাত্রনেতারাই বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করেন। মিছিল যথারীতি বের হয় শহরের পথপরিক্রমায়। কিন্তু এই শান্তিপূর্ণ, সাদামাটা মিছিলও সহ্য হয়নি মুসলিম লীগ প্রশাসনের। এমনকি উগ্র লীগ নেতাদের।
পুলিশ এবং মুসলিম লীগ দলের মাস্তান বাহিনী মিছিলে হামলা চালায়। মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। এরপর আর আন্দোলন সুসংগঠিত রূপে তৎপর হতে পারেনি।
সাতক্ষীরায় ভাষা আন্দোলন (১৯৫২) এ পর্বেও বলিষ্ঠ রূপে প্রকাশ পেতে পারেনি, যেমন প্রশাসনিক দমননীতির কারণে, তেমনি অভ্যন্তরীণ সাংগঠনিক দুর্বলতায়। সাতক্ষীরার নেতৃস্থানীয় বেশ কিছু ছাত্র ঢাকায় বা নিকটস্থ জেলা শহরে শিক্ষা গ্রহণের জন্য চলে যাওয়ায় এবং নতুন যােগ্য নেতৃত্ব গড়ে না ওঠায় আন্দোলন বলিষ্ঠ চরিত্র অর্জন করতে পারেনি। যেমন ১৯৫০-এ ঢাকায় চলে যান মীর মঞ্জুর আলী। যশাের কলেজে পড়তে চলে যান শেখ আমানুল্লাহ, যেখানে তিনি ভাষা আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। এ আন্দোলনের এ দুর্বলতার কারণে সাতক্ষীরায় শহীদ মিনার নির্মাণও বিলম্বিত হয়েছে। চেষ্টা যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু উগ্র প্রশাসনিক দমননীতি এবং মুসলিম লীগদলীয় যুবকদের হামলার কারণে শহীদ মিনার তৈরি বারবার ব্যাহত হয়েছে।
১৯৬২ সালে চেষ্টা চলেছে শহীদ মিনার নির্মাণের। এরপর ১৯৬৬ সালে সাতক্ষীরা কলেজে নির্মিত হয় শহীদ মিনার। পরবর্তী সময়ে একাধিক শিক্ষায়তনে শহীদ মিনার গড়ে তােলা হয়। এরপর একাত্তরে সেসব ভেঙে ফেলা হয়, ১৯৭২ সালে সেগুলাে নতুন করে নির্মাণ করা হয়। এমন এক ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে সাতক্ষীরায় শহীদ রাজ্জাক পার্কে স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়েছে।
সূত্র: ভাষা আন্দোলন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া – আহমদ রফিক