You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৫ই এপ্রিল, শুক্রবার, ২২শে চৈত্র, ১৩৮০

পরলোকে পম্পিডু

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জেস পম্পিডু আর নেই। গত মঙ্গলবার রাতে সীন নদীর তীরে তার অবসরযাপনকালীন বাসভবনে মারা গেছে। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল বাষট্টি বছর। সে দিক থেকে হয়তোবা পরিণত সময়ই তিনি মারা গেছেন, একথা বলা যেতে পারে। তাছাড়া এ নশ্বর জগতে মানুষ যখন মরণশীল তখন জর্জেস পম্পিডুর মৃত্যুও একদিন অবশ্যই অবধারিত ছিল। মানুষ মরে সেই তো স্বাভাবিক। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যাদের মৃত্যু কখনো কখনো দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রের স্বাভাবিক গতি ও ইতিহাসকে অন্যদিকে মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। পম্পিডুর মৃত্যুতে ফ্রান্স আজ অনেকটা সেই অবস্থার মুখোমুখি। একজন স্বাধীনচেতা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন, রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে জর্জেস পম্পিডু সারা বিশ্বে যে সম্মান অর্জন করেছেন তাঁর দেশ ফ্রান্সের সম্মান বিশ্ব রাজনীতিতে অক্ষুন্ন তো বটেই আর ও গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই পম্পিডুর মৃত্যুর বিশ্ববাসীর কাছে একটি নিদারুণ শোকাবহ ঘটনা। বিশেষ করে কাছে তো বটেই। কেননা ইউরোপের লুপ্ত গৌরব ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে জর্জেস পম্পিডুর উদ্যোগ এক বিরাট অবদান রেখে গেছে।
জর্জেস পম্পিডুর মৃত্যুতে বিশ্ববাসীর সাথে সাথে আমরা বাঙালিরা ও শোকাহত এইসব তার বলিষ্ঠ কার্যক্রম স্বাধীনচেতা মনোভাব আর ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা থেকেই উৎসারিত। দাগলের একনিষ্ঠ অনুসারী জর্জেস পম্পিডুর দাগলে পন্থা অনুসরণের মাধ্যমেই স্বাধীনচেতা নীতি নিয়ে গত পাঁচ বছরের মধ্যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফ্রান্সের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভিয়েতনাম সমস্যার সমাধানে, সাধারণ বাজার প্রশ্নে, মুদ্রা সংকটের প্রেক্ষিতে এবং পারমাণবিক অস্ত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার সীমিত করণের কাজে তিনি যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন, সে কথা বিশ্ব ইতিহাসে চিরদিনই সমাদৃত হয়ে থাকবে। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল চার্লস দাগলে পঞ্চম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ কালে সারাবিশ্বে বিশেষ করে পশ্চাৎ শিবিরে ফ্রান্সের গৌরব ও স্বাতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের যে নীতি গ্রহণ করেছিলেন, দাগলে পরবর্তীকালে একনিষ্ঠ উত্তরাধিকারী হিসেবে সেই ভাবমূর্তি অব্যাহত রেখেছেন। তিনি ফ্রান্স তথা ইউরোপের ওপর থেকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অহেতুক মুরুব্বিয়ানা অনেকাংশেই খর্ব করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। আর সেজন্যই মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ফ্রান্সের বিরুদ্ধে সম্প্রতিকালে অনেক বেসামাল উক্তি করতে শোনা গেছে।
যা হোক প্রেসিডেন্ট জর্জেস পম্পিডুর আকস্মিক মৃত্যুতে ফ্রান্সের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তো বটেই আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটা শূন্যতার সৃষ্টি হবে। ফ্রান্সের জনগণ চিরদিনই এই ব্যক্তিত্বসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ককে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করবেন। তার মৃত্যুতে ফ্রান্সে দাগলেবাদের অবলুপ্তি হয়তো ঘটবে না, তবে তা হয়তো ক্ষুণ্ন হতে পারে। কেননা দাগলে অনুস্বত মধ্যপন্থা নীতিকে আগের মত হুবহু অনুসরণ করার লোক পম্পিডুর মত আর কেউ থাকলেন না। তবে ইদানিং কালে ফ্রান্সের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী পিয়েরে জোবার্টের নাম এ প্রসঙ্গে উচ্চারিত হতে পারে। তিনি অনেকটা জর্জেস পম্পিডুকে অনুসরণ করেই দাগলেবাদী বলে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু জোবার্ট এখনো সে ক্ষেত্রে পম্পিডুর মত অতটা শক্তিসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারেননি-যাতে করে ফ্রান্সের বর্তমান আভ্যন্তরীণ সংকট এর প্রেক্ষিতে বামপন্থীরা যেটুকু জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন তার সার্বিক মোকাবিলা করতে পারেন।
জর্জেস পম্পিডুর মৃত্যুর পর ফ্রান্সের বামপন্থীরা এখন অনেকটা এগিয়ে আসার সুযোগ পাবেন এবং সে সুবাদে ডানপন্থী বামপন্থী বিরোধ তীব্রতর হবারও একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। যেখানটায় ডান ও বাম এর মাঝে একটি মধ্যপন্থি হিসেবে শক্তির ভারসাম্য রক্ষা করে সকল বিরোধ এগিয়ে যাবার উৎস ছিল এবং দাগলে ও পম্পিডু আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে তা রক্ষা করে চলতে সক্ষম হয়েছিলেন, জোবার্ট বা আর কারও পক্ষে এই মুহূর্তে তা রক্ষা করা সম্ভব নাও হতে পারে। ফ্রান্সের সংবিধান ২০ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে হবে। এক্ষণে সে নির্বাচনে ডানপন্থীরা কতটুকু এগোতে পারবেন এবং বামপন্থীরা তাদের কতটুকু কোণঠাসা করতে সক্ষম হবেন, সে কথা খুব বেশি নিশ্চিত করে বলা যায় না। কেননা দেশের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট দাগলেপন্থীদের যতটুকু অসুবিধায় ফেলেছে ডানপন্থীদেরও কম ক্ষতি করেনি। বামপন্থীরা সংকটের নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়াতে সক্ষম হয়েছেন।
যা হোক, কারা এবার ফ্রান্সের শাসন ক্ষমতায় আসবেন, তা নির্ধারণের ভার ফ্রান্সবাসীর উপর। আমরা কেবল এই মুহূর্তে ফ্রান্সের জনগণ যাতে তাদের এই জাতীয় শোক, সংকট ও শূন্যতা যথার্থ ভাবে কাটিয়ে উঠতে পারেন, সে কামনাই করবো সমবেদনা জানাবো শোকাহত ফ্রান্স বাসীকে এবং জর্জেস পম্পিডুর পরিবারবর্গকে। কামনা করব তার আত্মা শান্তি লাভ করুক।

খাদ্য সমস্যা জাতীয় সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করুন

আমাদের বর্তমান অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে গত পরশুদিন দেশের খাদ্য পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এত জরুরি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। মন্ত্রিসভার কয়েকজন সদস্য ছাড়াও আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। দেশের বর্তমান উদ্বেগজনক খাদ্য পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করাই এই বৈঠকের লক্ষ্য ছিল বলে জানা গেছে। খাদ্যমন্ত্রী শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার পরিস্থিতির বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। খাদ্য সংকট মোকাবেলার জন্য অন্যান্য আনুষাঙ্গিক সরকারি পদক্ষেপ কার্যকরী করা হলেই পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে বৈঠকের নেতৃবৃন্দ অভিমত পোষণ করেছেন। দেশের প্রত্যেকটি মানুষ যাতে খাদ্য গ্রহণের নিশ্চয়তা পায় তার ওপর বৈঠক সবিশেষ জোর দিয়েছেন। আমাদের খাদ্য মন্ত্রী জানিয়েছেন যে, চালের ব্যবসায়ীরা তার নিকট যে কথা দিয়েছে তাতে করে তারা সাধারণের কাছে সরাসরি চাল বিক্রি করবে এবং কয়েকটি স্থান সরেজমিনে পরিদর্শন সময়ের বাস্তবতা দেখতে পেয়েছেন। বাজারে চালের সরবরাহ বা যোগানও নাকি বেশ উল্লেখযোগ্য। মজুতদার, মুনাফাখোর ও চোরাচালানী দমনের জন্য ইতিমধ্যে সরকার যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা প্রয়োজনে আরো তীব্র করা হবে বলেও বৈঠকে উপস্থিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন। দেশের খাদ্য দ্রব্যের মূল্য পরিস্থিতি আজ নিদারুণ উদ্বেগজনক। সারা দেশের মানুষ আজ এই মারাত্মক পরিস্থিতির শিকারে ওষ্ঠাগতপ্রাণ হয়ে উঠেছে। প্রতিদিন প্রতিটি জিনিসের মূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তাতে করে ভুক্তভোগী মানুষ তাদের সকল সম্ভাবনাময় অনুষদের কথা আর ভাবতে পারছে না। একটি পরিবারের যে মাসিক ব্যয় বাজেট থাকে তা সম্পূর্ণভাবে ব্যাহত হয়েছে নির্দিষ্ট আর মানুষ যারা তাদের প্রাণ আজ ওষ্ঠাগত। গ্রাম-গ্রামান্তরে একটা হাহাকারের গুমোট কান্না দিনদিন প্রকট হয়ে উঠতে চলেছে। এহেন অবস্থা থেকে জাতিকে পরিত্রাণ দেবার দায়িত্ব সরকারের। সরকার তার সাধ্যমত এ পরিস্থিতির মোকাবেলা করবেন। দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দলগুলোর এ ব্যাপারে মহান কর্তব্য রয়েছে। অথচ আমরা পূর্বাপর লক্ষ্য করছি এই নিদারুণ অবস্থার মোকাবেলার জন্য যে উদ্যোগ ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক তা উৎসাহব্যঞ্জক নয়। দেরিতে হলেও সরকার মজুতদার, মুনাফাখোর বিরোধী পদক্ষেপ নিয়েছেন। একে আরোও কার্যকর করা প্রয়োজন। চাউল সরবরাহের বেশ ঘাপলা রয়েছে। জানা গেছে, অনেক ক্ষেত্রে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় নাকি চাউল সরবরাহে বাধা আসছে। এটা যদি সত্যি হয় তাহলে বিষয়টি পর্যালোচনা করা উচিত। জেলার প্রয়োজনের অতিরিক্ত অবশ্যই ঘাটতি এলাকায় দ্রুত পৌঁছাতে হবে। এটা আঞ্চলিকতার ব্যাপার নয়, জাতীয় কর্তব্যবোধের পরিচায়ক। চাউল সরবরাহে বেশ কিছু যানবাহন জনিত ঘাপলা রয়েছে। নৌকা পথে সরবরাহ সহজ ও স্বল্প ব্যয়সাপেক্ষ হলেও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। অন্যদিকে রেল পথেও সমস্যা রয়েছে। ইতিপূর্বে আমরা খুলনা থেকে সিরাজগঞ্জ চাউল আনার সময় ছ’শ বিশ মন চুরি হতে দেখেছি। অর্থাৎ রেলপথ ও নিরাপত্তার অভাব রয়েছে। এছাড়া সরবরাহে আয় যেসকল অসুবিধা রয়েছে তাও দূর হওয়া আবশ্যক। সর্বত্রই একটা সতর্কতামূলক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হওয়া দরকার। খাদ্য পরিস্থিতিকে জাতীয় সমস্যা মনে করে ত্বরিৎ এবং বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত সরকারের। যারা খাদ্যদ্রব্যের মজুদ ও অধিক মুনাফা এবং চোরাচালানিতে লিপ্ত তাদেরকে উদাহরণ মূলক শাস্তি এই মুহুর্তে দিতে হবে, তা হলে জনমনে একটা আশার সঞ্চার হবে বলে আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!