You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩রা ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ১৭ই অগ্ৰহায়ণ, ১৩৮১

ভারত মহাসাগরের নৌ তৎপরতা

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন ও ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশের বিরুদ্ধে ভারত মহাসাগরে তৎপরতা সম্প্রসারণের অভিযোগ এনেছে সোভিয়েত সেনাবাহিনী সংবাদপত্র ‘রেড-স্টার’। পত্রিকায় বলা হয়েছে, ন্যাটো দেশগুলো এই এলাকায় পুরনো ঘাঁটিগুলোকে আধুনিক করে গড়ছে এবং নতুন নতুন ঘাঁটিও তৈরি করছে। এতে সর্বাগ্রে সংশ্লিষ্ট হচ্ছে পারস্য উপসাগর, সিমন্স টাউন (দক্ষিণ আফ্রিকা) ও দিয়াগো গার্সিয়া ঘাঁটিসমূহ।
ভারত মহাসাগরকে ‘অশান্তি’ ও ‘ষড়যন্ত্রের’ ঘাঁটিতে পরিণত করার চক্রান্তের ইতিবৃত্ত একদিনের নয়। দীর্ঘদিন ধরে সুপরিকল্পিত উপায় ভারত মহাসাগরকে ঘিরে ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হয়েছে। আর এ ষড়যন্ত্রের পেছনে রয়েছে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার চেলা চামুন্ডারা। এইতো গত মাসেই সেন্টোর মহড়া অনুষ্ঠিত হলো ভারত মহাসাগরের। এই মহড়ার নাম ছিল ‘মিডলিন ‘৭৪’ ইরান-তুরস্ক, পাকিস্তান, বৃটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চাশটি রণতরী অংশ নেয়। ইতিপূর্বে পূর্ব ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করেছে মার্কিন নৌ-বহর ‘এন্টারপ্রাইজ’।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ভারত মহাসাগরকে ‘শান্তির এলাকা’ রূপে চিহ্নিত করার প্রস্তাব পাশ করা সত্ত্বেও সাম্রাজ্যবাদী চক্রের ন্যক্কারজনক লীলাখেলা বন্ধ হয়নি। বরং আরো বেড়েছে বলা চলে। ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপ মার্কিন নৌঘাঁটি নির্মাণের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত সোচ্চার। প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে বাংলাদেশ-ভারত বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে।
এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, ভারত মহাসাগরে বিদেশি ঘাঁটি স্থাপন এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণের কাছে যুদ্ধাশংকার উৎস। ভিয়েতনাম যুদ্ধের আশঙ্কাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ওকিনাওয়ার সামরিক ঘাঁটি গুলো থেকেই ভিয়েতনামি জনগণের ওপর হামলা চালানো হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের উপস্থিতির কথা ভুলে যায়নি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শুরু হয়েছে উপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন। এ সংগ্রামে জয়যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন দেশ। উপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন এবং শান্তির স্বপক্ষে জনমত সুসংবদ্ধ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সাম্রাজ্যবাদী চক্র আজ আতঙ্কিত। যেকোনো সময় তারা মরণ ছোবল দেবার বাহানায় খুঁজে বেড়াচ্ছে। ভিয়েতনামের মাটিতে প্রচন্ড মার খেয়েছে এবং দুই রাষ্ট্রের আঘাতে সাম্রাজ্যবাদী চক্র দিশেহারা হয়ে পড়েছে। তাই আবার নতুন করে শুরু হয়েছে যুদ্ধের পাঁয়তারা। আর তারই পটভূমি হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে ভারত মহাসাগরকে। তবে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে সম্রাজ্যবাদী চক্রের পক্ষ থেকে যতই ঘৃণ্য ও প্রচেষ্টা চালানো হোক না কেন শেষ পর্যন্ত ভারত মহাসাগর থেকে পাততাড়ি গুটাতেই হবে। কারণ একদিকে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব (গ্রিসের ন্যাটো সদস্য পদত্যাগ) এবং অন্যদিকে রয়েছে বিশ্বজনমত শান্তি ও প্রগতির স্বপক্ষ শক্তি রীতিমতো সুসংহত। সম্প্রতি দিল্লিতে অনুষ্ঠিত ভারত মহাসাগর সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্ব জনমতই প্রতিফলিত হয়েছে নতুন করে।

পেরুতে সিআইএ-এর তৎপরতা

আর্জেন্টিনার সিআইএ’র তৎপরতা ধরা পড়েছে বলে প্রেসিডেন্ট জুয়ান ভেলাসকো আল ভারাদোর জানিয়েছেন। সাংবাদিক সম্মেলনের দীর্ঘ বক্তৃতাদান করে প্রেসিডেন্ট বলেছেন, তার দেশের বিভিন্ন বিপ্লবী কার্যাবলীর বিরুদ্ধে সিআইএ তৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। সরকার যখন সিআইএ-এর তৎপরতা সম্পর্কে সঠিক নমুনা পান তখন পেরুতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়ে দুজন কূটনীতিবিদকে পেরু থেকে বহিস্কার করার দাবি জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্টের ভাষা সিআইএ-এর কার্যকলাপ আমরা হাতেনাতে ধরে ফেলেছি। প্রেসিডেন্ট আরো বলেছেন, টাইম ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রথম তাদের তৎপরতা শুরু করে। রাষ্ট্রায়ত্ত ফুড মার্কেটিং কোম্পানির ভিতরে সিআইএ তাদের লোক ঢুকিয়েছে এবং সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান নস্যাৎ করার জন্য তারা তৎপরতা চালাচ্ছে বলেও সরকার জানিয়েছেন। ফুড কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রবঞ্চনা মূলক কাজের খবর প্রকাশ হয়ে যাবার পর সাবেক কৃষি মন্ত্রী পদত্যাগ করেছিলেন। কৃষিমন্ত্রী ওই কাজের সঙ্গে জড়িত আছেন কিনা তা অবশ্য এখনো ধরা পড়েনি। আর্জেন্টিনার সামরিক শাসকরা বেশ কিছুক্ষণ ধরে তাদের দেশ শাসন করেছেন। তারাই গতবছরের নির্বাসিত পেরনকে দেশে ফিরিয়ে এনে ক্ষমতায় বসিয়েছিলেন। অবশ্য আর্জেন্টিনার জনগণের সমাদৃত নেতা ছিলেন পেরন। পেরনের মৃত্যু হবার পর তার স্ত্রীর জুয়ান পেরন আজ দেশের সরকার প্রধান হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন।
আমরা পূর্ব থেকেই আশঙ্কা করেছিলাম আর্জেন্টিনার রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ হতে পারে। ক্ষমতার রদবদল করার জন্য বা স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যেকোনো সময় যেকোনো সুযোগ গ্রহণ করতে পারে। অবশেষে সিআইএ পেরুর বিভিন্ন বিপ্লবী কর্মসূচি বানচালের জন্য তৎপরতা শুরু করেছে। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট সিআইএ-এর নাশকতামূলক তৎপরতার কথা সরাসরি ঘোষণা করেছেন। বস্তুতঃ সিরিয়ায় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সবচেয়ে ঘৃণ্য এবং মারাত্মক অস্ত্রবিশেষ। বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের চেতনার বিরুদ্ধে এই সংস্থাটি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। তাদের ইচ্ছার স্বার্থের পরিপন্থী সরকারের রদবদল বা অপসারণের জন্য তারা সর্বদা কাজ করে চলেছে। তাদের ইচ্ছার বা স্বার্থের পরিপন্থী সরকারের রদবদল বা অপসারণের জন্য তারা সর্বদা কাজ করে চলেছে। বিশ্বের যে কোন দেশের সামরিক অভ্যুত্থান ঘটে তার অধিকাংশ ঘটনাই সিআইএ-এর নাশকতামূলক কার্যাবলীর ফলশ্রুতি। ভিয়েতনাম, লাওস, কম্বোডিয়া এমনকি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধেও আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অন্যতম হাতিয়ার সিআইএ তৎপরতা চালিয়েছিল। আজও তারা চিলির জনগণের দাবির বিরুদ্ধে ঘৃণ্য তৎপরতায় লিপ্ত। পেরুর ফুড মার্কেটিং কোম্পানির বিরুদ্ধে সিআইএ যে নাশকতামূলক কাজ করছে তা নিঃসন্দেহে পর্যালোচনার বিষয়। ব্যক্তি মালিকানা পুরনো জোতদার জমিদার উচ্ছেদ করে যখন সম্পদ জনগণের মাঝে বন্টন করার নীতি একটি সরকার গ্রহণ করে তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সে সকল তৎপরতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে থাকে। আর্জেন্টিনার অবস্থা আজ অনেকটা তাই। এতদসত্ত্বেও বিশ্বব্যাপী আক্রমণ হতে চলেছে জনগণের মৌলিক দাবি কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। সিআইএ ষড়যন্ত্র যত ব্যাপকই হোক না কেন -জনতার রুদ্ররোষ একদিন তাকে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চল থেকে উৎখাত করবেই। পেরুর জনগণও ঐক্যবদ্ধ ভাবে সিআইএ-এর কার্যকলাপ রুখতে সক্ষম হবে।

আবাদি জমি যেন মরুভূমিতে পরিণত না হয়

দেশটি আমাদের নদীমাতৃক হলেও এমন অনেক স্থান আছে, যেখানে চরাভূমির সৃষ্টি হলে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে হয়। পানি সেচের সুগম ব্যবস্থা সম্পন্ন না হলে লক্ষ লক্ষ একর আবাদি জমি মরুভূমিতে পরিনত হয়ে যেতে পারে। প্রতিবছরই দেশের বিস্তৃত অঞ্চলের চর পড়ে যায় এবং চর পড়ে গেলে পানি সেচের সাহায্য নিতে হয়, নইলে সেই সব অঞ্চলের জমি থেকে শস্য উৎপন্ন করা সহজ ব্যাপার হিসেবে গণ্য হয় না। গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের ইনটেক চ্যানেলের উৎসমুখে যে বিরাট চর পড়েছে, তা নাকি গতবারের সৃষ্ট চোরের চেয়ে আকৃতিগত দিক থেকে দ্বিগুণ পরিমাণের। এই চর কাটার ড্রেজার ডিভিশন গঠিত হয়েছে। কিন্তু এই বিরাট চরটি কেটে পানি সেচের ব্যবস্থা করতে বেশ সময় অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। কারণ, ড্রেজারের সংখ্যা প্রতুল নয়। তিন থেকে চার মাসের মধ্যে যে চরটি অনায়াসে কাটা যেতে পারে, সে জায়গায় আরও কিছু সময় অযথা অতিক্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। সামান্য কিছু পাইপ এবং যন্ত্রাংশ সময়মতো না পৌঁছানোর জন্যই এই অনভিপ্রেত বিলম্ব। অথচ আগামী জানুয়ারি মাসের মধ্যেই ইনটেক চ্যানেলের উৎসমুখ পরিষ্কার করা দরকার। উৎসমুখ পরিষ্কার করে অবিলম্বে পানি সেচ চালু করা না যায়, তাহলে আবাদি জমি গুলোর অবস্থা ও সঙ্গীন হয়ে উঠবে, উৎপাদন হবে বিঘ্নিত। এই অবস্থায় চর কাটার ড্রেজারের সংখ্যা বাড়ানোর প্রতিও মনোযোগী হওয়া দরকার। গঙ্গা-কপোতাক্ষ সেচ প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ নাকি বেশ মন্থর গতিতে চলছে। এই মন্থর গতির ফলে তিন লাখ একর জমিতে পানি সেচের প্রতিবন্ধকতা দেখা দিয়েছে। যেকোনো কাজে মন্থর গতি কখনো সুফল দেয় না। সেচ প্রকল্পের মতো একটি জরুরী কাজে গতির মন্থরতা জাতীয় জীবনের উন্নয়নের যাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে না পারে, সে জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দৃষ্টি দেয়া একান্ত বাঞ্ছিত বলে আমরা মনে করি। গঙ্গা কপোতাক্ষের মতো দেশের একটি বৃহত্তম সেচ প্রকল্প চালু করতে প্রায় একটি যুগের পরিশ্রম ব্যয়িত হয়েছে। কিন্তু তাতেও যদি সেচ প্রকল্পের কাজে সৃষ্টি হয় বিঘ্ন, তাহলে উৎপাদন ক্ষেত্রে সমস্যা এড়ানো খুব একটা সহজ ব্যাপার হবে বলে আমাদের মনে হয় না। কাজেই সেচ ব্যবস্থা যে কোন মূল্যে চালু রাখতে হবে। চর কাটার কাজে প্রয়োজন মতো বেশিসংখ্যক ড্রেজার ব্যবহার করতে হবে। উৎপাদন বাড়ানোর সঙ্গে যেখানে জাতীয় অর্থনীতির উন্নয়নের সম্পর্ক, সেখানে সামান্য কারণে লক্ষ লক্ষ আবাদি জমি মরুভূমিতে পরিণত হবে, তা আমরা মাথা পেতে মেনে নিতে পারিনা।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!