বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৫ই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ২৯শে কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকা ঘোষণা করা হোক
এবার শুধু ভারত নয়, বিশ্বের চৌদ্দটি দেশে জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইমের কাছে যৌথ আহ্বান জানিয়ে বলেছেন যে, ভারত মহাসাগরকে শান্তির এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হোক এবং ভারত মহাসাগরের বুকে কোনো বৃহৎ শক্তিই যেন আর সামরিক পাঁয়তারা না করে। এর কারণ নামটি ভারত মহাসাগর হলেও এই মহাসাগরটি এশিয়া ও আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে প্রসারিত। ভারত মহাসাগরের বুকে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের টহলদারিতে এই মহাসাগর তীরবর্তী দেশগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই আতঙ্কিত ও শংকিত হয়েছে। ভারত মহাসাগরে মার্কিন টাস্কফোর্সের অব্যাহত উপস্থিতি যে কোনোক্রমেই ন্যায়সঙ্গত নয়, তা ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী শরণ সিং সংসদের শীতকালীন অধিবেশনে সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন। ভারত মহাসাগরের বুকে যদি মার্কিন নৌবহরের আনাগোনা থাকে, তাহলে অন্যান্য বৃহৎ শক্তিরও এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষিত হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বৃহৎ শক্তিগুলো ঐক্যমতে পৌঁছুতে পারছেন না বলেই ‘শান্তি এলাকা’ও বাস্তব চেহারা পরিগ্রহ করতে পারছে না। চৌদ্দটি দেশ জাতিসংঘের মহাসচিবের কাছে যে প্রস্তাব উত্থাপন করেছে তাতে বলা হয়েছে, ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকা ঘোষণা করে ১৯৭১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাব বাস্তবায়িত করা হোক। একাত্তর সালের প্রস্তাবের নীতি ও উদ্দেশ্যাবলী গ্রহণ করে নেওয়ার জন্যও সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবের খসড়ায় ভারত মহাসাগরে বৃহৎ শক্তিবর্গের উপস্থিতি সম্পর্কে ‘একটি তথ্যপূর্ণ বিবৃতি’ প্রকাশের জন্যে মহাসচিবকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এই প্রস্তাবের খসড়া প্রণয়নের উদ্যোক্তা দেশগুলো হচ্ছে অস্ট্রেলিয়া, বাহরাইন, গায়ানা, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, মাদাগাস্কার, মালয়েশিয়া, মৌরিতানিয়া, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সুদান, তাঞ্জানিয়া, সংযুক্ত আরব প্রজাতন্ত্র ও জাঞ্জিবার।
এ প্রসঙ্গে বলা দরকার যে, মিসর এবং ইসরাইল এখন যুদ্ধ বিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এরপরও যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত মহাসাগরের জল ঘোলা করার জন্যে এই দরিয়ার বুকে সামরিক দাপাদাপি অব্যাহত রাখে, তাহলে ভারত মহাসাগরে শান্তির টলটলে জলের আশা করা নিতান্তই দূরাশা। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধ বিরতির ফলে অনেকেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়েছিলেন, কিন্তু মার্কিন নৌবহরের মতিগতি তো বোঝা যায় না, তাই ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর এ মহাসাগরকে শান্তির এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ না করে কোনো উপায় থাকে না। ফলে এই মহাসাগর নিয়ে ব্যাকুলতার জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক। ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইমের কাছে চৌদ্দটি দেশ যে প্রস্তাব পেশ করেছে তাতেও এ কথাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, ভারত মহাসাগর থেকে বৃহৎ শক্তির সামরিক তৎপরতার অবসানই সবার কাম্য। কারণ শান্তিকামী কোনো দেশই চায়না, বৃহৎ শক্তিগুলো ভারত মহাসাগরকে সামরিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিক। বৃহৎ শক্তিগুলোর প্রতি তাই চাপ প্রয়োগের জন্য বাস্তব কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। এবং এটাই হবে স্বাভাবিক পদক্ষেপ।
জীবনরক্ষাকারী ঔষধ রক্ষা করুন
জীবনরক্ষাকারী ও জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ঔষধ আজ বাংলাদেশের বাজারে নেই চললেই চলে। একখানা প্রেসক্রিপশনে একটা ঔষধের বদলে সাতটা বিকল্প ঔষধের নাম থাকলেও রাজধানী ঢাকা নগরীর বড় ছোট কোনো ঔষধের দোকানেই তার যে কোনো একটি ঔষধ যে পাওয়া যাবে, তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। গত পরশুর স্থানীয় একটি ইংরেজী দৈনিকে দেশের বর্তমান ভয়াবহ ঔষধ সংকট সম্পর্কে যে করুণ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তাকে নিঃসন্দেহে আশঙ্কাজনক বলে উল্লেখ করা যেতে পারে।
উক্ত খবরে বলা হয়েছে যে, বর্তমানে ঢাকার বাজারে হেলমসিড, বেরিন, সিটমিন, সোলুকর্টেক্ট, প্যাথড্রিন, কর্ডনেব্রেন, ম্যালিডন কডলিভার অয়েল, কডলিভার ক্যাপসুল, অলিভ অয়েল ইত্যাদি ঔষধগুলো রীতিমতো দুষ্প্রাপ্য। রাজধানী নগরীতেই যদি এই অবস্থা হয়, তবে দেশের অন্যান্য এলাকার অবস্থার কথা সহজেই অনুমেয়। তদুপরি এসব ঔষধগুলো কিন্তু বিদেশ থেকেও আমদানীকৃত নয়। দেশেই এগুলো উৎপাদিত হয়। গ্ল্যাক্সো ল্যাবরেটরী, আলবার্ট ডেভিড বা ফাইজার কোম্পানীই প্রধানতঃ এ জাতীয় জীবনরক্ষাকারী ও জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ঔষধগুলোর প্রস্তুতকারক। এমতাবস্থায় দেশে উৎপাদিত ঔষধের যখন এই অবস্থা, তখন বিদেশ থেকে আমদানীকৃত ঔষধের কি অবস্থা ঘটতে পারে, সেটাও সহজেই অনুমান করা যায়।
জীবনরক্ষাকারী ও জরুরী ঔষধের যখন এই সংকট, তখন তেজগাঁওস্থ কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের তালাবন্ধ ও সীলকৃত গুদাম থেকে প্রায় সাড়ে ৫ লক্ষ মেস্কোফরম ট্যাবলেট চুরি হয়ে গেছে বলেও অন্য একটি বাংলা দৈনিকে কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে। এই মেস্কোফরম ট্যাবলেট পেটের পীড়া, আমাশয় ইত্যাদি অসুখে বর্তমান ঔষধ সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশের জন্য একটি মহৌষধ। অথচ সেই ঔষধ চুরি হয়ে গেছে। গুদামের টিনের ছাদ খুলে কে বা কারা নাকি সেই পাঁচ লাখ ঔষধ পাচার করে দিয়েছে। ঔষধ পাচার হবার সময় কর্তৃপক্ষ টের পাননি। টের পেয়েছেন ঔষধগুলো চলে যাবার পর। আর সেই প্রেক্ষিতেই ঔ কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের একজন কর্মকর্তাকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাজারে যখন ঔষধের এই তীব্র অভাব তথা দুষ্প্রাপ্যতা, তখন কালোবাজারে চড়াদামে নাকি প্রথমোক্ত পর্যায়ের কিছু কিছু ঔষধ পাওয়া যাচ্ছে। চড়াদাম অর্থাৎ নির্ধারিত মূল্যের দু’থেকে তিনশ’ ভাগ বেশী দামে। তদুপরি এখন শীতকাল আসছে। সাধারণতঃ শীতের মওসুমটাই হচ্ছে ঔষধ ব্যবহারের বিশেষ করে বাঙালীর জন্য ঔষধ ব্যবহারের মওসুম। আর এই মওসুমেই যদি ঔষধের এমন সংকট হয়, তবে অবস্থাটা কি হতে পারে। তাছাড়া আজকের দিনে দেশের বাজারে কোথাও অন্য ভিটামিন ঔষধতো নেই-ই।
বস্তুতঃ ঔষধের এই সংকট দেশ স্বাধীন হবার আগেও ছিলো। তবে স্বাধীনতার পরে সংকট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। এর কারণ যতটা না বৈধ তার চাইতে শতেক গুণ বেশী অবৈধ। অদৃশ্য কালোহাতের কারসাজিও এখানে তীব্র কঠিন বেড়াজালের মতো কাজ করছে। এহেন পরিস্থিতিতে দেশের মানুষ যেন রোগের সময় একটু ঔষধ খেয়ে স্বস্তি নিয়ে মরতে পারেন, সেদিকটায় কি কর্তৃপক্ষ নজর দেবেন?
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক