১৫ অগ্রহায়ণ ১৩৭৮ বৃহস্পতিবার ২ ডিসেম্বর ১৯৭১
আখাউড়া, পঞ্চগড়, ভুরুঙ্গামারী, কামালপুর, বনতারা, শমসের নগর ও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। এদিন মুক্তিযোদ্ধারা পঞ্চগড় আক্রমণ করে। লেঃ মাসুদ, সুবেদার খালেক, লেঃ মতিন, মেজর সদরুদ্দিন ও ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্ব দেন। পাক বাহিনী পঞ্চগড়ে রিংয়ের আকারে প্রথম ও দ্বিতীয় ডিফেন্স লাইন তৈরী করেছিল। গভীর রাতে মুজিব ব্যাটারীর যোদ্ধারা মিত্র বাহিনীর সহায়তায় পঞ্চগড় আক্রমণ করে। উল্লেখ্য, পাক সেনারা ৩রা ডিসেম্বর পঞ্চগড় ছেড়ে চলে যায়। ৬ নং সেক্টর কমাণ্ডার এম,কে, বাসার, সাব-সেক্টর কমাণ্ডার ও মুক্তিযুদ্ধের বোদা-দেবীগঞ্জ এলাকার সংগঠক সেরাজুল ইসলাম এমপিএ, নাজিম উদ্দিন আহমদ, কমরেড ফরহাদসহ মুক্তাঞ্চল তেঁতুলিয়ায় বিপ্লবী পরিষদের সদস্যগণ বিশেষ অবদান রাখেন। বিপ্লবী পরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাব কমরুদ্দিন আহমদ এমপিএ, নাজিম উদ্দিন এবং আবদুস সাত্তার প্রমুখ।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটের উইলিয়াম বি, স্যাক্সবি ও পাকিস্তানে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত জোসেফ এস, ফারল্যাণ্ডের বৈঠক হয়।
ঢাকায় বোমা বিস্ফোরণে রামপুরা বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র বিধ্বস্ত। চট্টগ্রামের বোমা বিস্ফোরণে ৫টি বিদ্যুৎ সাব স্টেশন ও ২টি পেট্রাল পাম্প বিধ্বস্ত হয়।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি ও পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর পূর্ব পাকিস্তান শাখার নেতৃবৃন্দ পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত থেকে ভারতে আক্রমণ করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রতি আবেদন জানান।
পাক সরকারের মুখপাত্র বলেন যে, চৌগাছায় স্যাবর বিমান আক্রমণকারী ভারতীয় ‘ন্যাট’ জঙ্গী বিমানের গুলীতে ভূপাতিত হয় নাই বরং শত্রুর গ্রাউণ্ড ফায়ারেই পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর দুটি স্যাবর ২২ নভেম্বর চৌগাছায় ধ্বংস হয়। মুখপাত্র বলেন, পাক বিমান বাহিনীর স্যাবর বিমান একটি নাটকে গুলী করে ভূপাতিত করে। পক্ষান্তরে আমাদের স্যাবর বিমান সমূহের ২ টি গ্রাউণ্ড ফায়ারে ধ্বংস হয়। (দৈঃপাঃ / ৭ খণ্ড পৃঃ ২৪৮)। পক্ষান্তরে ভারতের রাজ্যমন্ত্রী দাবী করেন যে, ভারতীয় ‘ন্যাট’ স্যাবর জেট বিমান গুলী করে ভূপাতিত করেছে এবং ২ জন পাক-পাইলট ভারতীয় বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় আক্ৰমণ বন্ধ করার কোন আন্তজার্তিক কূটনীতিক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনা এবং ৩০ নভেম্বর ভারতীয় প্রধান মন্ত্রীর পুর্বপাকিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার পূৰ্ব্বক প্রদেশটিকে বাংলাদেশ বিদ্রোহীদের হাতে ছেড়ে যাওয়ার আহ্বানের প্রশ্নোত্তরে পাক সরকারী মুখপাত্র বলে, ভারত সংঘর্ষ তীব্রতর করায় আমরা এক ব্যাপক যুদ্ধের দিকে ধাবিত হচ্ছি। (দৈঃ ই)
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে বুধবার কংগ্রেস কর্মীদের সভায় বলেন, গত পাঁচ বছরে ভারতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। যদি কোন দেশ আমাদেরকে আক্রমণকারী বলে চাপ সৃষ্টি করে জাতীয় স্বার্থ ভুলিয়ে দেবে বলে ভেবে থাকে, তা হলে তাঁরা তাদের স্বৰ্গে বাস করছে। তিনি আরো বলেন, সময় বদলেছে, ৩/৪ হাজার মাইল দূর থেকে বর্ণের প্রাধান্য দিয়ে তাঁদের ইচ্ছামত হুকুমনামা জানাবেন, তা মেনে নেয়া যায় না। ভারত বদলেছে। ভারত আর নেটিভ রাজ্য নয়। আজ আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য দেশের সৰ্ব্বোচ প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করবো ঐ সকল বৃহৎ দেশগুলোর ইচ্ছানুযায়ী নয়। তিনি বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে গেলেই লাখ লাখ বাঙ্গালী স্বদেশে ফিরে গিয়ে শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন শুরু করতে পারেন। অর্থাৎ ইন্দিরা গান্ধী প্রকারান্তরে পাক বাহিনীকে “বাংলাদেশ ছাড়ো” -এই আহবান জানালেন। (সংবাদপত্র)
নয়াদিল্লীর রাজনৈতিক সংবাদদাতার উদ্ধৃতি দিয়ে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছে যে, জেনারেল ইয়াহিয়া খার উপর পশ্চিমা শক্তিবর্গের চাপে রাজনৈতিক মীমাংসার যে আশা করা গিয়েছিল তা এখন সম্পূর্ণ তিরোহিত হয়েছে বলে মনে হয়। নয়াদিল্লীর মতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাকিস্তানী প্রেসিডেন্টের মীমাংসার যেটুকু সুযোগ ছিল শ্রীমতী গান্ধীকে লেখা নিকসনের চিঠিতে অবস্থার উন্নতি হওয়া দূরে থাকুক আরও অবনতি হয়েছে। গত সোমবার (২৯ নভেম্বর) সকালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ কিটিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর হাতে প্রেসিডেন্ট নিকসনের ঐ চিঠিটা দেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ ডিসেম্বর থেকে ভারতে অস্ত্র সরবরাহ সংক্রান্ত লাইসেন্সদান বন্ধ করার ঘোষণা দেন। (সংবাদপত্র)
ভয়েজ অব আমেরিকা (ডিসেম্বর ১) এক খবর প্রচারে বলেছে পূর্ববঙ্গ সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েন করার জন্য পাকিস্তান সরকারের অনুরোধটি জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট নিরাপত্তা পরিষদে বিতর্কের জন্য পাঠিয়েছেন। ইতিপূর্বে পাক রেডিওর খবর ছিল, উথান্টের নিকট লেখা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার চিঠির অনুলিপি নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি উথান্টের অনুরোধে পরিষদ সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হয়েছে। (আঃ বাঃ পঃ)
আনন্দবাজার পত্রিকায় সম্পাদকীয় ‘বাংলাদেশ ছাড়ো’তে মন্তব্য করা হয়ঃ
“যেন তিনটি দশক পার হইয়া সেই ‘কুইট ইণ্ডিয়া’ ঘোষণাটিরই প্রতিধ্বনি শোনা গেল।একটু অন্য অর্থে, অন্য পরিপ্রেক্ষিতে, পাক জঙ্গীশাহী সত্যই যদি শান্তি চাহে, তবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ ছাড়িতে হইবে। এ নোটিশটি রাজ্যসভায় পাঠ করিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী গান্ধী— ভাষা একেবারে দ্ব্যর্থহীন, আর কোনও হেঁয়ালী বা অস্পষ্টতা রহিল না। এক হিসেবে ইহাও একটি ‘‘পয়েন্ট অব নো রিটার্ন।”একটি কথায় বাংলাদেশ আর ভারতের স্বার্থে এক হইয়া মিশিয়া গিয়াছে।…প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজন যতটুকু, ঠিক ততটুকুই করিতে পারি -বাকীটা মুক্তিবাহিনীর ভার। উপরন্তু চাপ দেওয়ার জন্য পিণ্ডিচক্রের হাতে সবচেয়ে বড় কবুজা মুজিবর রহমান- তাঁহার প্রাণ। পশ্চিম পাকিস্তানে প্রবাসী বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী সম্প্রদায়ের কথাও ভাবিতে হইবে।……নিকসনের ভ্রুকুটিকে যিনি তুচ্ছ করিয়াছেন তিনি দরকার হইলে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রপুঞ্জের ন্যাক্কারজনক পাঁয়তারা ও ভূমিকাও উপেক্ষা করবেন।….. শ্ৰীমতী গান্ধীর বিবৃতির পর আর সন্দেহ মাত্র রহিল না যে ভারত আজ এ পথেরই পথিক, হয়তোবা তাহাকে চলিতে হইবে একলাই। তাহার সহায় তাহার মনোবল, তাহার সহায় বাংলাদেশবাসী।”
হংকং থেকে এশিয়ান নিউজ সার্ভিসেস জানাচ্ছেন, প্রেসিডেন্ট নিকসন আগামী ২১ ফেব্রুয়ারী পিকিং যাচ্ছেন বলে ঘোষিত হওয়ার পর চীন যাওয়ার জন্য ৩০ হাজার মার্কিন পর্যটক ভিসার জন্য আবেদন করেছে।
ভারত ও মিশর সফর শেষে লণ্ডনের হীথরো বিমান বন্দরে বৃটিশমন্ত্রী রিচারড উড বলেন, ‘পূর্ববঙ্গ থেকে আগত শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে ভারত যে ভূমিকা পালন করেছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। বৃটিশ পূর্ববাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়। তবে যুদ্ধ এখন উভয় দেশের দোর গোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছে। (আঃ বাঃ পঃ)
বিপ্লবী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবার প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে মুজিবনগর থেকে এক ঘোষণায় বলেন, এটি একটি নিছক সুপরিকল্পিত চক্রান্ত এবং খিড়কি দিয়ে জঙ্গী শাসকচক্রকে রক্ষা করার অপপ্রয়াস মাত্র। তিনি পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন যে, আমাদের বিজয়ের এই চরম মুহূর্তে পর্যবেক্ষক হয়ে যিনিই বাংলাদেশে আসুন না কেন তার ভাগ্যে খারাপ কিছু ঘটলে এই প্রস্তাবের উদ্যোক্তারাই তার জন্য দায়ী হবেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বলেছেন, যখন ইয়াহিয়া খান হানাদার সৈন্যবাহিনী দিয়ে বাংলাদেশে অভূতপূর্ব গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন যাঁরা নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। এখন তাঁরাই পর্যবেক্ষক দল পাঠাবার নাম করে জঙ্গী জনতাকে বাঁচাতে অগ্রণী হয়েছেন। “ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের এই চূড়ান্ত পর্যায়ের সংগ্রামের মুখে আমরা কোন রকমের হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করব না”। (আঃ বাঃ পঃ)।
তিনটি পাক স্যার জেট বৃহস্পতিবার (২ ডিসেম্বর) দুপুরে (১২-৩৫মিঃ) হঠাৎ আগরতলা বিমান ঘাঁটি এলাকার উপর ছোঁ মেরে নেমে এসে চারদিকে বোমা ফেলে যায়। শহরেও ঝাঁকে ঝাঁকে পাক কামানের গোলা এসে পড়তে থাকে। গোলায় মারা গিয়েছেন পাঁচজন, আহত চল্লিশজন। উল্লেখ্য এই উপমহাদেশে বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে এই প্রথম পাকিস্তান আগরতলা শহর ও বিমান ঘাঁটির চারপাশে স্থল ও আকাশ পথে আক্রমণ করল। গত বুধবার (ডিসেম্বর ১) রাত ৮ টা থেকেই পাকিস্তানী কামান তিন দিক থেকে আগরতলা শহর ও শহরতলি লক্ষ্য করে অবিরাম গোলাবর্ষণ করে চলেছে। (আঃ বাঃ পঃ)
তিনটি পাকিস্তানী স্যার জেটের আগরতলার উপর আক্রমণ চালানোর ঘটনায় ভারতের লোকসভায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। (সংবাদপত্র)
পাক-প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান রুশ নেতাদের কাছে পাঠানো একটি ননাটে ২২ নভেম্বর থেকে পূর্ববাংলায় ভারতের অঘোষিত যুদ্ধের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। পাকিস্তান রেডিও কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের উক্তি উদ্ধৃত করে এই খবর প্রচার করেছে। বার্তাটি কবে পাঠানো হয়েছে রেডিও তা বলেনি। (আঃ বাঃ পঃ)
বাংলাদেশকে মোটামুটি চারটি পৃথক সেক্টরে ভাগ করা হয়। এসব সেক্টরে ভারত এবং পাকিস্তানীদের অবস্থান ছিলো নিম্নরূপঃ
(এক) উত্তর পশ্চিম সেক্টরঃ যমুনার পশ্চিম এবং পদ্মার উত্তরের অঞ্চল এই এলাকার অন্তর্ভুক্ত। সেক্টরের আওতাধীন জেলাগুলো ছিল রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী এবং পাবনা। মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহের অধীনে পাকিস্তানের ১৬ ডিভিশন এই সেক্টরে সর্বত্র এবং বিশেষ করে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, হিলি ও রংপুরে দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছিল। হেড কোয়ার্টারস ছিল নাটোর।
পাকিস্তানী ১৬ ডিভিশনের মোকাবেলায় ভারত তার ৩৩ কোরের (লেঃ জেনারেল থাপা) অধীনে দুটি মাউন্টেন ডিভিশনকে নিয়োজিত করে। এই ডিভিশনগুলোর সহায়ক হিসাবে নিয়োজিত ছিল ডিভিশনাল গোলন্দাজ বাহিনী, একটি মাঝারি ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং হালকা উভচর ট্যাংকের (পিটি-৭৬) আর একটি রেজিমেন্ট। ভারতীয় ডিভিশনগুলো ছিলঃ উত্তরে কুচবিহার জেলার ৬ মাউন্টেন ডিভিশন, বালুরঘাট এলাকায় ২০ মাউন্টেন ডিভিশন এবং শিলিগুড়ি এলাকায় ৭১ ব্রিগেড। বাংলাদেশে অভিযানের দায়িত্ব পালন ছাড়াও ৩৩ কোরকে সিকিম ও ভুটানের মধ্য দিয়ে সম্ভাব্য চীনা আগ্রাসন প্রতিহত করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল (দুই) পশ্চিম সেক্টরঃ পদ্মার দক্ষিণ এবং পশ্চিম এলাকা নিয়ে গঠিত এই সেক্টরের জেলাগুলো হচ্ছে কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল এবং পটুয়াখালী। এই সেক্টরে মেজর জেনারেল এম, এইচ, আনসারীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের ৯ পদাতিক ডিভিশন মোতায়েন করা হয়। সদর দপ্তর যশোর।
ভারতীয় পক্ষে ছিল জেনারেল রায়নার কমান্ডে নবগঠিত ২ কোর। এই কোরের আওতায় দুটি ডিভিশন ছিলঃ মেজর জেনারেল দলবীর সিং এর নেতৃত্বে ৯ পদাতিক ডিভিশন এবং মেজর জেনারেল মহিন্দর সিং বারার-এর নেতৃত্বে ৪ মাউন্টেন ডিভিশন। জেনারেল রায়নার সহায়তায় আরো ছিল দুটি ট্যাংক রেজিমেন্ট এবং ডিভিশনের সহায়ক গোলন্দাজ বাহিনী।
(তিন) উত্তর সেক্টরঃ এই সেক্টর গঠিত হয়েছিল ময়মনসিংহ ও ঢাকা জেলার কিছু অংশ নিয়ে। পাকিস্তানের পক্ষে এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিল ব্রিগেডিয়ার এ কাদের। তাঁর নেতৃত্বে ছিল ৯৩ ব্রিগেড, ৩১ বালুচ ও ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, আধাসামরিক বাহিনী। কমলপুর, খকশীগঞ্জ, জামালপুর এবং হাতিবান্ধা, শেরপুর, জামালপুর বরাবর যে এলাকা রয়েছে তার প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছিল লেঃ কঃ সুলতান মাহমুদের নেতৃত্বে ৩১ বালুচ রেজিমেন্ট। এই সুলতান মাহমুদই বাঙালী হত্যার প্রধান হোতা।
এই সেক্টরের বিপরীতে ভারতীয় মেঘালয় এলাকায় ছিল ১০১ কম্যুনিকেশন জোন। এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং- তাঁর অধীনে ছিল ব্রিগেডিয়ার হরদেব সিং ক্লেয়ারের নেতৃত্বে ৯৫ মাউন্টেন ব্রিগেড গ্রুপ এবং ২৩ পদাতিক ডিভিশন থেকে আনীত একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ান। ভারতীয় বাহিনীকে সহযোগিতা করেছে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে টাঙ্গাইল এলাকার সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধারা।
(চার) ইষ্টার্ন সেক্টরঃ এ সেক্টরের জেলাগুলো হচ্ছে সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম। পাকিস্তান এই সেক্টরে ১৪ ডিভিশন এবং ৩৯ অস্থায়ী ডিভিশন মোতায়েন করেছিল, নেতৃত্ব দেয় মেজর জেনারেল আব্দুল মজিদ। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার এলাকার দায়িত্বে ছিল পাক ৩৯ পদাতিক ডিভিশন। কমাণ্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল রহিম খান।
ভারতের পক্ষে এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিল লেঃ জেঃ স্বগত সিং এর নিয়ন্ত্রণাধীন ৪র্থ কোর। তাঁর অধীনে ছিল মেজর জেনারেল কৃষ্ণরাও (৮ম মাউন্টেন ডিভিশন) মেজর জেনারেল গণজালভেস (৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন) মেজর জেনারেল আর ডি হিরার অধীনে ২৩ মাউন্টেন ডিভিশন। বাংলাদেশের ৮টি ব্যাটালিয়ন এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর ১ থেকে ৫ নম্বর সেক্টরের সকল ট্রুপসকে লেঃ জেঃ সগত সিং এর অধীনে ন্যস্ত করা হয়। অভিযান সংক্রান্ত দায়িত্ব ছাড়াও ৪র্থ কোরের ওপর আগরতলা শহর, বিমান ঘাঁটি এবং ঐ এলাকার বিমান বাহিনীর সকল প্রতিষ্ঠান রক্ষার ভার ছিল। (১০ খঃ ৩৮-৩৯ পৃঃ)
জেনেভায় অবস্থিত ইন্টারন্যাশনাল কমিশান অব জুরিস্টিস্ কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান সত্বেও তারা (পাকিস্তানী) চুপ করে ছিল। বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধারা সাফল্য অর্জন করছে। জাতিসংঘের পক্ষে এখন চুপ করে থাকাই বাঞ্ছনীয়। বাংলাদেশ শীঘ্রই স্বীকৃতিলাভ করবে। মুক্তিযোদ্ধারা শীঘ্রই বাংলাদেশ পুনর্দখল করবে। (“দি গার্ডিয়ান”, ২ ডিসেম্বর)। একই দিনে অন্য একটি প্রতিবেদনে ‘দি গার্ডিয়ান’ –এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের পুত্র শেখ জামালের একটি আলোকচিত্র প্রকাশিত হয়। চিত্র-পরিচিতিতে বলা হয়, শেখ জামাল বাংলাদেশ গেরিলাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন। তাঁর ইউনিট পূর্ববঙ্গ সীমান্ত পার হয়ে দশ মাইল ভিতরে গিয়ে যুদ্ধে নিয়োজিত রয়েছে।
Reference:
একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী