You dont have javascript enabled! Please enable it! বাঙলার বুকে ট্যাঙ্ক ব্যাটল | মুসা সাদিক | ব্যাটল অব শিরোমণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙলার বুকে ট্যাঙ্ক ব্যাটল

মুসা সাদিক

আজ থেকে ৩৮ বছর আগে ‘৭১ সালে বাঙালির রক্তে ভেজা শত শত রণাঙ্গনে আমি মুজিবনগর সরকারের তথ্য অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলাম। সেই সঙ্গে আমি স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট হিসেবে রণাঙ্গনে এক কঠিন দায়িত্ব পালন করেছি। ট্যাংক ও কামানের গোলাবর্ষণ এবং শত সহস্ৰ গোলাগুলির মধ্যে জীবনমৃত্যুর দোলায় দোদুল্যমান ছিল আমার জীবন। জীবনের মায়া উপেক্ষা করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ও মিত্রবাহিনীর সঙ্গে এক রণাঙ্গন থেকে উল্কার বেগে ছুটে যেতে হতো আরেক রণাঙ্গনে। আমার চোখের ওপর বঙ্গজননীর তরতাজা শত সহস্ৰ বীর সন্তানকে রণাঙ্গণে ফুলের মতো ঝরে পড়তে দেখেছি। বুকের তপ্ত রক্ত গল গল করে ঢেলে দিয়ে জন্মভূমির বুকে বুক রেখে শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে দেখেছি। বঙ্গ জননীর বীরদের বীরত্বে কথা, আত্মদানের কথা আমি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে সপ্তাহে দুদিন ‘রণাঙ্গন ঘুরে এলাম’ ও ‘মুক্তাঞ্চল ঘুরে এলাম’ শিরোনামে স্বকণ্ঠে দেশবাসী ও বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে প্রচার করেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বহু সংবাদ বিবিসি, রেডিও অস্ট্রেলিয়া, আকাশবাণীতে প্রচারিত হয়েছে এবং বিশ্বের পত্র-পত্রিকায় আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়েছে। রণাঙ্গনের সংবাদদাতার দায়িত্ব পালন ছাড়াও রণাঙ্গনে অনেক গোপন সামরিক সংকেত আমাকে বহন করতে হয়েছে এবং দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের দখলকৃত এলাকার পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান ও প্রতিরক্ষা ব্যুহ সম্পর্কে আমার অনেক গোপন তথ্য রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনীর ও বাংলাদেশ বাহিনীর সেনা নায়কদের রণকৌশল নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ সহায়তা দিয়েছে। অধিকৃত এলাকায় ও রণাঙ্গনে আমাকে বহুবার জীবনের চরম বুকি নিতে হয়েছে এবং বহুবার নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে আল্লাহর রহমতে ফিরে এসেছি। যুদ্ধের শেষে ‘৭১-এর ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে যশোরের চাঁচড়ায় পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে তাদের চরম নির্যাতনে অজ্ঞান ও মুমূর্ষ অবস্থায় ক্যাপ্টেন হুদা ও তার বাহিনী পাকবাহিনীর ওপর আকস্মিক হামলা করে তাদের ফেলে যাওয়া বাংকার থেকে আমাকে প্রায় মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।

মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত রণাঙ্গনে জীবন দেয়া-নেয়ার সেই মর্মস্পর্শী পূণ্যময় দিনগুলোর একটি ঘটনা এখানে তুলে ধরলাম।

ঢাকার রেসকোর্সে লে. জেনারেল নিয়াজী যখন আত্মসমৰ্পণ দলিলে দস্তখত দিচ্ছে, সেই ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সর্ববৃহৎ ট্যাংক লড়াই হয়ে গেল খুলনার শিরোমণিতে। যশোর ক্যান্টনমেন্টে তখন পত পত করে উড়ছে স্বাধীন বাংলার পতাকা । ১০৭ ব্রিগেড নিয়ে ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ ৭ ডিসেম্বর ছেড়ে এসেছেন পাকিস্তানিদের দুর্ভেদ্য যশোর ক্যান্টমেন্ট। ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, যশোর, পটুয়াখালী, বরিশালের সকল পাকিস্তানি ফোর্স এসে জড়ো হয়েছে খুলনায়। তারা আশা করেছিল রূপসা, পশুর দিয়ে মার্কিন সপ্তম নৌবহর নিয়ে যাবে তাদেরকে, পাকিস্তানে। সেই আশায় জেনারেল নিয়াজীর অর্ডার অমান্য করে তারা যুদ্ধ বহাল রাখলো। ১০৭ ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ খুলনা প্রবেশের দ্বারমুখ শিরোমণিতে সমবেত করলো যশোর ক্যান্টনমেন্ট ও পুটিয়াখালী, বরিশাল, ফরিদপুর, কুষ্টিয়ার সম্মিলিত ফোর্সকে। বরিশাল, পটুয়াখালির ফোর্সকে রাখলেন সাতক্ষীরা নাভোরনের দিক থেকে আগত নবম সেক্টর কমান্ডার মেজর জয়নাল আবেদীনের বাহিনীকে ঠেকাতে।

ঐতিহাসিক শিরোমণি। বত্রিশটি ট্যাংকসহ চার সহস্রাধিক অভিজ্ঞ পাঞ্জাবী আর্মিকে মহাযুদ্ধের ছকে সাজালো শিরোমণিতে। যশোরকে ঠেকাতে হবে। কমান্ডে থাকলো যশোর ক্যান্টমেন্টেরে কমান্ডার ১০৭ ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ। ১৬ ডিসেম্বর শীতের বিকেলের শেষ সূর্য পশ্চিম গগনে অস্ত গেল। সন্ধ্যা গড়িয়ে শিরোমণির বুকে রাত এল। পায়ে পায়ে শিরোমণিতে এসে উঠে দাড়ালো সেই কামান্ডো। লিডার, এসএলআর চলে যার নিশ্চিত নিশানায়। যার ত্ৰাসে ১০৭ ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ এর যশোর ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে দিয়ে এসে খুলনায় বসে তার ফোর্স কমান্ড করতেন। সেই তিনি ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ এর জানের দুশমন মেজর মঞ্জুর।

১৬ ডিসেম্বর রাত ন’টায় শিরোমণির মাটি গর্জে উঠলো। মাটি কাঁপিয়ে গর গর করতে করতে পাঞ্জাবীদের ট্যাংক মঞ্জুরের মুক্তিযোদ্ধাদের দুটি পজিশন নিমেষে গুড়িয়ে দিয়ে গেল।

শিরোমণির চার পাশের আম-কাঠালের গাছ নারিকেল ঘেরা ও অন্যান্য গাছগুলোর তালপালা কামানের গোলায় ভেঙে ভেঙে পড়তে লাগলো। আহত নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ফিল্ড হসপিটালের কমীরা ছুটছে যশোরের দিকে। কামানের শব্দে, ট্যাংকের গর্জনে, আহতের আর্তনাদে শিরোমণি সে দিন কাঁপতে লাগলো।

কামানের গোলা, ট্যাংকের গর্জন আর মর্টার শেলিং-এ তেঁতে, পুড়ে, ফেড়ে ফেড়ে যাচ্ছে শিরোমণির জমিন। গোলার আগুনে ঝলসে উঠছে শিরোমণির আকাশ। ভূমিকম্পের মতো কেঁপে উঠছে খুলনা শহর। ১০৭ ব্রিগেড মরণ ছোবল হানছে মুঞ্জরের বাহিনীর ওপর। তাদের কমান্ডারের শত পরাজয়ের শোধ শিরোমণিতে তারা তুলে নেবে আজ। বত্রিশটির ও বেশি ট্যাংকের কমান্ডে আছে ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ এর। রোমেল-মন্টগোমারির মিসরের বুকে সেই বিশ্ববিখ্যাত আল আমিনের ট্যাঙ্ক ব্যাটল বহুবার পড়েছি। কমান্ডো মেজর মঞ্জুর ও ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ এর শিরোমণির ট্যাংক ব্যাটল দেখেছি। আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতারের ওয়ার করেসপন্ডেন্ট হিসেবে আমি ও ভারতীয় দুজন সাংবাদিক ৮ নম্বর সেক্টরে আসি। ছিলাম ১৬ ডিসেম্বরের সেই বিভীষিকাময় ওয়ার ফিন্ড শিরোমণির কাছে।

যুদ্ধ চলছে। ঘন্টা পার হচ্ছে। ৯টার পর ১০টা। ১০টার পর ১১টা। মিনিটগুলো তখন সব ঘন্টার মতো। এক মিনিট অসাধ্য সাধন করা। এ পক্ষ ভাবছে, ওরা সারেন্ডার করবে এক্ষুণি। ওরা ভাবছে, এরা সারেন্ডার করবে এক্ষুণি। কিন্তু না, ১০৭ ব্রিগেড শিরোমণির মাটি কামড়ে পড়ে আছে। এক ইঞ্চি পিছু হটেনি। পিছু হটেনি মুক্তিযোদ্ধারাও। এক মিনিট এক মিনিট করে অনেক রক্ত ঝরলো শিরোমণির বুকে।

অনেক মৃত্যু। পাঁচ ঘন্টা পার হয়ে গেল এইভাবে। রাত যত বাড়তে লাগলো পাকিস্তানিদের আক্রমণও তীব্রতর হতে থাকলো। এইভাবে গেল আরো একঘন্টা। দীর্ঘ ছয়ঘন্টার বিরামহীন সংঘর্ষ এগিয়ে চললো। ৮ নম্বর সেক্টরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাংকারে আহত হচ্ছে। সাখীরা বাংকারের মধ্যে বসে ক্ষত স্থানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিচ্ছে আর আহত অবস্থায় বাংকারে দাঁড়িয়ে থ্রিনটথ্রি, এসএলআর-এর ট্রিগার সমান গতিতে চেপে যাচ্ছে। দূর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে দিয়ে কেউ নিয়ে আসছে এঁক মগ পানি, আগ্রাবর্তী কোনো ট্রেঞ্চে যুদ্ধরত সঙ্গীদের জন্য। বিরাম নেই কারো, নেই কারো দিকে চোখ ফেরানোর অবকাশ। সব চোখ সামনে, শত্রুর নিশানায়, হানাদার বাঙ্কারে। এইভাবে চললো সেই মরণযুদ্ধ শিরোমণির বুকে।

রাত তিনটা বেজে কয়েক মিনিট। মুক্তিযোদ্ধাদের ও মিত্রবাহিনীর পজিশন, ডিফেন্স অকস্মাৎ যেন দুলে উঠলো! ক্যাজুয়ালটির পরিমাণ হঠাৎ বেড়ে গেল। রাত তিনটের মধ্যে মোট ক্যাজুয়ালটি দাঁড়ালো মিত্রবাহিনীর একজন অফিসারসহ ৭ জন নিহত ও ৩০ জনের মতো আহত। ৩১ জনমুক্তিযোদ্ধা নিহত ও চারগুণের মতো আহত। এর অধিকাংশ ক্যাজুয়ালটি হলো শেষ দুঘন্টায়। রাত ৩-১০ মিনিট-এ মিত্র বাহিনীর কাছে সেক্টর কমান্ডার পর পর দুটি সিগন্যাল পাঠালেন ‘এয়ার সাপোর্ট’ এর জন্য। রাত শেষ হওয়ার আগেই আঘাত হানতে মিত্ৰ বাহিনীর পাইলটরা জঙ্গী বিমান চড়ে দমদমে প্রস্তুত হয়ে আছে। অর্থাৎ রাতে সম্ভবত এয়ার সাপোর্ট আসবে না।

শিরোমণি থেকে মঞ্জুর-হুদার জিপ ফুল স্পিডে ঢুকলো যশোর ক্যান্টনমেন্টে। ট্যাংক ব্যাটল শুরু হওয়ার পর এই প্ৰথম তাদের দেখলাম। বিচলিত মনে হলো। আমার মনে প্রশ্ন জাগলো ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ-এর কাছে তিনি কী শেষ ব্যাটেলে পরাজিত হতে চলেছেন? তারা ঢুকলেন মিত্র বাহিনীর কমান্ডারের রুমে। ঠিক দশ মিনিট পরে বেরিয়ে এলেন তারা। দুজনেই ছুটছেন জিপের দিক। আমরা তিনজন দৌড়ে ধরলাম মেজর হুদাকে। জানতে চাইলাম। উঠতে উঠতে মঞ্জুর সাহেবকে ইঙ্গিতে দেখিয়ে শুধু বললেন ‘হি হ্যাজ টেকেন ফুল কমান্ড। অল ফোর্সেস, ইনকুডিং এ্যালাইড ফোর্সেস নাউ এ্যাট হিজ ডেসপোজাল।’

তাদের জিপ ছুটে বেরিয়ে গেল শিরোমণির দিকে। পরে শুনেছিলাম ওখানে মিত্রবাহিনীর কমান্ডারের সঙ্গে যুদ্ধ পরিস্থিতি ও পরিকল্পনা নিয়ে সেক্টর কমান্ডার ও মেজর হুদা উভয়েই ওপেনিয়ন ডিফার করেছিলেন। শিরোমণিতে মিত্রবাহিনীর ২০/২২ টি ট্যাঙ্কসহ সমমানের শক্তি এবং কমান্ডে ট্রেন্ড মুক্তিবাহিনীর থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ ছয়ঘন্টা যুদ্ধ করতে হবে এবং এয়ার সাপোর্ট ব্যতীত শিরোমণির পাকিস্তানি ট্যাংক ব্যাটেলিয়নের সামনে মুক্তিযোদ্ধাদের দাঁড়িয়ে মার খেয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই, ওয়ার ফিন্ডের সেই বিশেষ সিচ্যুয়েশনে সেক্টর কমান্ডার মঞ্জুর এবং অভিজ্ঞ সাব সেক্টর কমান্ডার মেজর হুদা উভয়ে যখন মঞ্জুরের পক্ষে ফুল কমান্ড চাইলেন এবং ৮ নম্বর সেক্টরের মিত্রবাহিনীর কমান্ডার মঞ্জর রিকোয়েস্ট করলেন ‘টু পুট অল এ্যালাইড ফোর্সেস এ্যাট মাই ডেসপোজাল’ তখন মিত্রবাহিনীর কমান্ডার হেজিটেট করছিলেন। মেজর মঞ্জর কোমরের বেল্ট খুলে দিয়ে বলেছিলেন (ব্যাটল ফিল্ড থেকে ফিরে না আসা, বিজয় ব্যতীত) ‘মাই সানস আর রেডি টু প্রুফ মন্টগোমারি হেয়ার এগেন।’ ইন্ডিয়ান কমান্ডার অয়ারলেসে মেজর জেনারেল দলবীর সিং-এর ক্লিয়ারেন্স নিয়ে শেক হ্যান্ড করে সকল এ্যালাইড ফোর্সের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন সেক্টর কমান্ডার মঞ্জুরের ওপর। মেজর মঞ্জুর কমান্ড পাওয়ায় মিত্রবাহিনীর কর্নেল অত্যন্ত উদ্দীপ্ত হয়ে মঞ্জুরের সঙ্গে বুকে বুক মিলিয়ে ফেললেন। অভিনন্দন জানিয়ে বললেন ইউ আর রাইট কমান্ডার ফর দি রাইট মোমেন্ট।’

তৎক্ষণাৎ তিনি এ্যালাইড ফোর্সের সদর দপ্তর থেকে ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জয়নাল আবেদীনের কাছে ওয়ারলেসে দুটি বিশেষ কোড সিগন্যাল পাঠিয়ে দ্রুত বের হয়ে গেলেন শিরোমণির দিকে। পথে তার এক বিশ্বস্ত যোদ্ধার কাছে এক লাইনের পত্র দিয়ে গেলেন তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েকে সম্বোধন করে। যদি তিনি শহীদ হন তাহলেই প্রাপককে পত্রটি দেওয়ার জন্য। মিসেস রানা ইয়াসমীন ও ছেলে মেয়েদের ‘শেষ বিদায়’ এবং ‘খোদা হাফেজ’ দিয়ে লেখা সেই ছোট পত্রে তিনি লিখেছিলেন ‘পবিত্র কুরআন শরীফে শহীদের মর্যাদা সর্বোচ্চ। শহীদের মর্যাদার ওপরে কোনো মোমিন-মুসলমানের আর কোনো সর্বোচ্চ মর্যাদা ইসলাম ধর্মে নেই। আমার শহীদ হওয়ায় আমার মর্যাদার জন্য তুমি ও আমার সন্তানরা গৌরবান্বিত হবে ও সব সময় গর্ব করবে।’

রাত পৌনে চারটার দিকে অকস্মাৎ নাভারন সাতক্ষীরা রোডের মুখে মেজর জয়নাল আবেদীন, ক্যাপ্টেন মেহেদী পাক ডিফেন্স ভেঙে তছনছ করে ঢুকে পড়লেন ভেতরে। পাকিস্তানি কর্নেল আফরোজের স্মার্ট, ওয়েল ইকুইপড ফোর্সকে একেবারে তাড়া করে নিয়ে চললো দুর্ধর্ষ মেজর জয়নাল আবেদীনের বাহিনী ও মিত্রবাহিনী। কয়েক মাইল দৌড়ে এসে দুইটি ট্যাঙ্ক মিত্র বাহিনীর হাতে খুইয়ে খুলনার একেবারে শহরের মুখে চাঁচড়ায় এসে ডিফেন্স গড়লো পাক কর্নেল আফরোজ। অপর দিকে ১

কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী ফোর্স নিয়ে গেল ফাহামউদ্দিন সেনহাটির পশ্চিমের গোয়ালপাড়ার শত্রু সৈন্যদের ওপর আঘাতে হানতে। বোরহান উদিনের অধীনে ১ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা চন্দনী মহল, শোলপুর ও রাজাপুরে পজিশন নিয়ে ৭নং জেটি এবং সদর হসপিটালের পাক সেনাদের ব্যস্ত রাখছে। নোমাউল্লাহর অধীনে ১ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী বীজ খামারে পজিশন নিয়ে খুলনা রেডিও স্টেশনের শত্রু বাহিনীকে হানছে মারণ আঘাত।

আফজালের অধীনে ৯ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা সাচিবুনিয়ায় পজিশন নিয়ে খুলনা লায়ন্স স্কুলের পাক সৈন্যদের ওপর আঘাত করছে। কুতুবউদ্দিনের অধীনে ১ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসী কুলাটিয়ায় পজিশন নিয়ে শত্রুদের গল্লামারী রাস্তা ব্যবহার রোধ করে দিয়েছে। নৌবহরে ৬ পাউন্ডের গানসহ ও রূপসা নদীবক্ষে শিপইয়ার্ড আক্রমণ করছে। টুটপাড়ার দিক থেকে মেজর জয়নাল আবেদীন, নেভাল কমান্ডো রহমতউল্লাহ। লে. আরেফিন ও বাবার আলী পাক হানাদারদের বৃষ্টির মতো গুলির মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তাদের বাহিনী নিয়ে। এখানে আমাদের ২১ জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতর আহত হয়। শত্রুপক্ষে বহু জীবনহানি হয়। খুলনা শিপইয়ার্ডে আমাদের মুক্তিবাহিনী ও নৌ-বাহিনীর ওপর শত্রুপক্ষ প্রবলভাবে গুলিবর্ষণ শুরু করলো অকস্মাৎ খিজির ও লে. আরেফিনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাল্টা ফায়ার শুরু করে। শত্রুদের ফেলে যাওয়া একটা ক্ষুদ্ৰ বার্জের ওপর পাওয়া দুটি সিক্স পাউন্ডের গান (শত্রুরা ফায়ারিং পিন খুলে নিয়ে যায়) পিনের পরিবর্তে একটি ছেনি ব্যবহার করে বাঁশের মুগুরের সাহায্যে পিটিয়ে পিটিয়ে খিজির শত্রুর পজিশনে ফায়ার চালাতে থাকেন। আল্লাহর আশ্চর্য রহমত যে প্ৰত্যেকটি ফায়ার অব্যৰ্থ নিশানায় আঘাত করে শক্রকে ঘায়েল করে। ফলে শত্রুরা পনেরো মিনিটের মধ্যে শিপইয়ার্ড ত্যাগ করে পালাতে থাকে। কিন্তু তাদের পালাবার প্রাক্কালে মুক্তিযোদ্ধারা উল্লসিত হয়ে বাঙ্কার পজিশন ছেড়ে দ্রুত বেরিয়ে আসে। সেই ভুলের মাসুলে এক শত্রু গোলার আঘাতে এক জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় ও ১৬ জন গুরুতর আহত হয়। মেজর মঞ্জুরের পরিকল্পনা অনুসারে ১৬ ডিসেম্বর ভোর ৪টা অবধি সমগ্র খুলনার চারপাশ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সাড়াশি আক্রমণ জোরদার করে তোলে।

এদিকে ১৬ ডিসেম্বর রাত ৪টায় শিরোমণির ট্যাংক ব্যাটেলের পুরো কমান্ডে আসেন মেজর মঞ্জুর। খুলনার চারদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের যে সাড়াশি আক্রমণ, সকল শক্তি নিয়োগ করে কর্নেল আফরোজকে যে পিছু হটিয়ে আনা ও শিরোমণির ট্যাংক ব্যাটেলে মঞ্জুরের ওপর বাংলাদেশ ও এ্যালাইড ফোর্সেস তথা সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় ৯ পদাতিক ডিভিশনের প্রথম কলামের কমান্ড ন্যস্ত এবং সে বিষয়ে ইষ্টার্ন কমান্ডার জগজিৎ সিং আরোরার সম্মতি একই পরিকল্পনায় ঘটতে থাকে।

এতোক্ষণে, মঞ্জুর প্রস্তুত হন ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ এর চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে।

শিরোমণির ডান দিকের এফএফ কলামটাকে ফ্রন্ট লাইনের পেছনে সেকেন্ড ডিফেন্স-এ আনেন। কমান্ড দেন মেজর হুদাকে। ফ্রন্ট লাইনের এ্যালাইড ফোর্সকে শিরোমণির ডানের ডিফেন্সে পাঠান। বাম দিকের দুটি ও পেছনের কমান্ডো কলাম তিনটিকে ফ্রন্ট লাইনের ডিফেন্সে-এ বসান। ডানে পেছনে সে স্থানে চলে যায় এ্যালাইড ফোর্স। মেইন রোডের নিচে ঘাপটি মেরে বসে থাকা মিত্রবাহিনীর ট্যাংকগুলোর চারটিকে সংকেত অনুযায়ী শিরোমণি খুলনার মেইন রোডে ও অন্য বারোটিকে ডানদিকের নিচু বেত গাছের পাশ দিয়ে হেভি ক্যাজুয়ালটি মেনে নিয়েও দুর্ভেদ্য পাক ডিফেন্সের পেছনের পজিশনে ক্ষিপ্ৰ গতিতে পৌছে যাওয়ার জন্য তীক্ষ্মভাবে প্ৰস্তত করেন। প্ৰত্যেকটা ট্যাংকের পেছনে জুড়ে দেন শহীদ হতে প্ৰস্তুত ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডোকে। পুরো ফ্রন্টকে নতুন ষ্ট্রাটেজিতে সাজানোর মধ্যেই এক জন মিত্রবাহিনীর ও তিন জন মুক্তিবাহিনী গুরুতর আহত হলো। মুক্তিবাহিনীর দুজন পরে শহীদ হলেন।

ডেট লাইন : শিরোমণি, ১৭ ডিসেম্বর রাত ৪টা ৫০ মিনিট।

সেক্টর কমান্ডর মেজর মঞ্জুর ইন কমান্ড।

সামনে পঁচিশটিরও বেশি পাকিস্তানি ট্যাঙ্ক, দেড় শতাধিক কামান, কয়েকশ মর্টার। প্ৰতি সেকেন্ডে উদগীরণ করে চলেছে হাজার হাজার গোলা, সীসা ও বারুদের দলা।

ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ ইন কমান্ড।

কী হলো? চারদিকের সেই কামানোর গোলা, বারুদের গোলা আর ট্যাংকের গর্জনের মধ্যে দিয়ে এসএলআর উঁচিয়ে কার হাত সবার আগে উঁচু হয়ে ছুটছে?

কমান্ডো মেজর মঞ্জুর। মেঘের মতো তাকে জড়িয়ে, উল্কার মতো ছুটছে স্যুইসাইডাল ঝটিকা কমান্ডোরা। তাদের সামনে পড়ছে কামানের গোলা, পেছনে পড়ছে স্প্লিন্টার ওপরে পড়ছে ঝালকানো বারুদের দলা। এঁকে বেঁকে, কাত হয়ে, গড়িয়ে লাফিয়ে-উহ, অবিশ্বাস্য! অবিশ্বাস্য একটা গোলাকার মাংসপিণ্ডের মতো হয়ে তার ঝটিকা কমান্ডোদের নিয়ে দৃষ্টির ওপারে কোথায় গেলেন তিনি? অর্ডার অনুযায়ী মিত্রবাহিনীর চারটি টি-৭২ ট্যাংক শিরোমণির মেইন রোড দিয়ে ও ডান দিকে থেকে বারোটি মিত্রবাহিনী টি-৭২ ট্যাংক মাটি কামড়ে ছুটলো তার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্ৰগতিতে। ছুটলো আরো ১২ জন করে স্যুইসাইডাল কমান্ডো প্ৰতি ট্যাংকের গায়ে গা মিশিয়ে। ফ্রন্ট লাইনের কমান্ডো কলামটা যত লম্বা পা ফাঁক করা যায়, লাফিয়ে ছুটে গোল কমান্ডারের গতিপথের দিকে। ওদের জীবনের যেন কোনো মায়া নেই। যেন কোনো হঁশ নেই। যেন জীবনের শেষ রাতের শেষ খেলা খেলছে ওরা এ জীবন তুচ্ছ করে এ বাংলা মাকে ভালোবেসে!

১৭ ডিসেম্বর সেই ভোর রাত সোয়া পাঁচটার দিকে শিরোমণির বুকে মঞ্জুর তার কমান্ডারদের নিয়ে পাকিস্তানি ব্যুহের মধ্যে হারিয়ে গেলেন। তিনি ও তার কমান্ডোরা

বেঁচে আছেন না শহীদ হলেন, কেউ জানে না! চরম বিপর্যয় ও বিপদের এই মুহুর্তে মেজর হুদা সেকেন্ড লাইনকে তৎক্ষণাৎ ফ্রন্ট লাইন আগলাতে বললেন। মিত্র বাহিনীর আর্টিলারির ছত্রছায়ায় হানাদারের গোলাগুলি বৃষ্টির মধ্যে ভারী অস্ত্ৰ-শস্ত্র তুলে যার শরীরে যতো শক্তি ছিল তত বেগে দৌড়ে গেল ফ্রন্ট লাইনের বাঙ্কারে, পজিশনে। ডানদিক থেকে ঝড়ের বেগে ছুটে গেছে দুই ডজন ট্যাংকসহ মিত্রবাহিনী। তিন মাইল জুড়ে দুপক্ষের কামান ও ট্যাংকের গোলা বর্ষণে শিরোমণি, কাঁপতে লাগলো। আশপাশের গাছপালার ডাল, নারিকেল গাছের মাথা ভেঙে পড়তে লাগলো। কামানের গোলা, ট্যাংকের গোলায় দিনের আলোর মতো ঝলসে ঝলসে উঠছে শিরোমণির আকাশ-জমিন। বাতাসের প্রতি পরমাণু বারুদের গন্ধে ভারী হয়ে উঠেছে। তার মধ্যে ৩০০ গজ সামনে শত্রু ব্যুহের কোন দিকে কোন গহবরে তাদের কমান্ডার হারিয়ে গেছে সেদিকে তাকিয়ে সবার চোখ সজল হয়ে উঠেছে। এক অজানা আশংকায় দুলে উঠছে বুক। ততক্ষণে হায়াৎ এর কামানের গোলা, ট্যাংকের গর্জন আর মর্টার শেলিং এর ব্যুহের মধ্যে বজ্রের কড় কড় আওয়াজে উল্কার বেগে ঢুকে পড়েছেন কমান্ডো মেজর মঞ্জুর তার সুইসাইডাল কমান্ডো স্কোয়াড নিয়ে। পাকিস্তানি কর্নেল-ব্রিগেডিয়ারদের বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতে চোখের নিমিষে গুড়া গুড়া হয়ে গেল হায়াৎ এর ডিফেন্স, দুর্ভেদ্য বাঙ্কার ভেঙে ফেটে চৌচির। জ্বলন্ত পাকিস্তানি এম-২৪ ট্যাংক থেকে ভীত বিহবল সব হানাদাররা বেরিয়ে মুখ থুবড়ে মাটিতে পড়ছে। শিরোমণি পেছনে ফেলে হায়াৎ খানেরা পেছনে দৌড়াচ্ছে। একজন কমান্ডো দৌড়ে এসে খবর পৌছে দেয় ‘খানরা ভোগে যাচ্ছে’। ‘জয় বাংলা’ বলে মুক্তিসেনারা দ্বিগুণ তেজে শত্রুদের ধাওয়া করে নিয়ে চলে। এ সময় ভোর পৌণে ছটায় এল মিত্রবাহিনীর জঙ্গি বিমানের বহর। তুমুল বোমা বর্ষণ ও রকেট হামলায় হানাদার বাহিনীকে গুঁড়িয়ে পুড়িয়ে ফেললো। পাঁচ সহস্ৰাধিক আত্মসমর্পণ, শত শত আহত ও ১৫৭ টি মৃতদেহ রেখে ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ শিরোমণির মাটিতে হাঁটু গেড়ে ভারতীয় ৯ পদাতিক ডিভিশনের এবং মেজর মঞ্জুরের কাছে আত্মসমৰ্পণ করলো।

শিরোমণির সেই অবিশ্বাস্য ট্যাংক ব্যাটলে জয় লাভকরা আল্লাহর রহমত ছাড়া সম্ভব হতো না। চোখে না দেখলে এটা কি করে সম্ভব হলো কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না। সে জন্যেই বোধ হয়। ভারতের দেরাদুন ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমী ও ব্রিটেনের স্যান্ডহার্ষ্ট আর্মি রয়্যাল মিলিটারি একাডেমীসহ অন্যান্য দেশের আর্মি একাডেমীতে ‘ট্যাংক ব্যাটল অফ শিরোমণির’ ওপর একটা চ্যাপ্টার পড়ানো হয়।

সেই ব্যাটল ফিল্ডে অন্যান্যের সঙে আমি ছিলাম বলেই বলছি, বিশ্ববিখ্যাত আল আমিনের ট্যাংক ব্যাটলের যে ভয়াবহতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে পড়েছি, শিরোমণির ট্যাংক ব্যাটল তার অপেক্ষা কোনো অংশে কম ভয়াবহ বা অবিশ্বাস্য ছিল না। ইতিহাসে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আল আমিন ট্যাংক ব্যাটলের নাম যদি থাকে, থাকবে বাংলার মুক্তিযুদ্ধের শিরোমণির’ ট্যাংক ব্যাটলের নাম। আর তার পাশে ঝলমল করে জ্বলবে বাংলার বীর, বাংলার নেপোলিয়ন বোনাপার্ট কমান্ডো মেজর মঞ্জুরের নাম।

এত তোড়জোড়, এত শক্তি সমাবেশের পর এই পরাজয়ে ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ এর অধীন পাকিস্তানি সেনাদের মনোবল শেষ হয়ে যায়। তারা প্ৰস্তুত হয় আত্মসমর্পণের জন্য। যদিও রীতি অনুযায়ী ওদের ইস্টার্ন সেক্টরের কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজীর অর্ডার অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর দুপরে আত্মসমৰ্পণ করা সামরিক বিধি ছিল এবং সে বিধি ভঙ্গ করে পুরোদস্তর এক রাত ও অর্ধদিন যুদ্ধ চালাবার দায়ে মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য ছিল, তবু তাদেরকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেওয়া হলো পরাজিত হওয়ার পর। তারা ঢাকার একদিন পর ১৭ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১০টায় আত্মসমৰ্পণ করে। সকালেই খুলনা সার্কিট হাউজের ওপর সর্ব প্রথম পতাকা তোলেন মেজর জয়নাল আবেদীন ও নেভাল কমান্ডো রহমত উল্লাহ।

কিন্তু পাক হানাদারদের পোড়ামাটি নীতির ফলে আত্মসমর্পণের অব্যবহিত পূর্বে হানাদাররা সকালেই খুলনা অয়্যারলেস টাওয়ার বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয় ও ব্যাংকের নোট ও পাটের গুদামসহ অন্যান্য সম্পদে আগুন ধরিয়ে দেয়। অন্যান্য জেলা থেকে খুলনা অভিমুখী মহাসড়ক সমূহের সকল ব্রিজ, খুলনা শহরের বড়ো বড়ো সরকারি অফিস ও প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি মালখানা ও অন্যান্য পণ্যের গুদাম ঘরসমূহ ধ্বংস করে, পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে পরাজয়ের পূর্ব মুহুর্তে হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ-সম্পত্তি ধ্বংস করে ও পুড়িয়ে ছাই করে দেয় হানাদার পাকিস্তানিরা।

খুলনা সার্কিট হাউজের সামনে সকাল সাড়ে বারোটায় এসে হাজির হন। ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ ও তার বাহিনীর সিনিয়র অফিসাররা। সারেন্ডারং সেরিমনি হবে ১-৩০ মিনিটে। উপস্থিত হলেন মেজর জলিল, মেজর মঞ্জুর, মেজর জয়নাল আবেদীন। হেলিকপ্টারে এসে নামলেন মিত্রবাহিনীর ভারতীয় ৯ পদাথিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল দলবীর সিং ১ টা ১১ মিনিটে।

সার্কিট হাউজের সামনে একটি টেবিল একটি চেয়ার। ময়দানের প্রান্তে মিত্রবাহিনীর ১১টি এনফেবিয়াস ও টি -৭২ ট্যাংক। চেয়ারে বসলেন মে. জে. দলবীর সিং। তার সামনে প্রায় দশগজ দূরে দুই সারিতে এটেনশান পজিশনে দাঁড়ালো ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ এবং তার অন্য সিনিয়র অফিসাররা। মে. জে. দলবীর সিং এর এ্যাটাচি থেকে একজন ষ্টাফ বের করলেন পূর্বাহ্নে টাইপ করা ‘সারেন্ডার ইন্সট্রমেন্ট’। কাঠের ছোট টেবিলটার ওপর রেখে সেটি পড়লেন তিনি। পড়া শেষে তাকালেন ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ এর দিকে। ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ ও তার সহকর্মী অন্য অফিসাররা সেল্যুট দিয়ে বুক টান করে দাঁড়ালো। মে. জে. দলবীর সিং ইনষ্ট্রুমেন্টটি টেবিলের ওপর রাখলেন। ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ এবং তার সাথী আরো আটজন অফিসার দু’কদম সামনে এসে রিভলবারসহ বেল্ট খুলে নিচু হয়ে ময়দানে মাটির ওপর রাখলো। ব্যাজেস অফ র‍্যাঙ্কস খুলে দেওয়ার সময় ছিপছিপে লম্বা, টুকটুকে ফর্সা চেহারার ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ-এর চোখ দিয়ে পানি নেমে এল। তার দুজন অফিসার ভেউ ভেউ করে কাঁদতে থাকলো।

ব্রিগেডিয়ার হায়াৎ ও তার যে অফিসার ও জওয়ানরা বাংলার হাজার মা বোনের ইজ্জত লুটছে নয় মাস, যে রিভলবারে, রাইফেলে লক্ষ বাঙালি জননী, বধূর বুক খালি করেছে, ১৭ ডিসেম্বর সকালে সেই উদ্ধত দানবেরা নত মস্তকে দাঁড়ালো। হাতের অস্ত্র বাংলার পূত-পবিত্র মাটির ওপর রাখতে হলো। জান বাঁচাতে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে হলো বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সামনে।

সারা খুলনাবাসী তখন সার্কিট হাউসের চতুর্দিকে থেকে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুলছে। সেই মুহুর্মুহ ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মধ্যে হানাদার বাহিনীর কমান্ডার হায়াৎ ১টা ৫৫ মিনিটে স্বাক্ষর করলো সারেন্ডারিং ইনষ্ট্রুমেন্টের ডান দিকে, মে. জে. দলবীর বামদিকে স্বাক্ষর করলেন এবং বললেন ‘আমরা গ্যারান্টি দিচ্ছি যে, POW (Prisioner of War)-দের প্রতি জেনেভা কনভেনশনের সকল রুলস পরিপূর্ণভাবে পালন করবো’। সার্কিট হাউস ময়দানের চারপাশে তখন উদ্বেলিত জনতার উল্লাস ধ্বনি ‘জয় বাংলা’। আকাশ ভেদ করে গগন বিদ্যাহী আওয়াজে যেন নেমে আসছে লক্ষ কণ্ঠস্বরে ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’’।