বাংলার বাণী
৮ই আগস্ট, বুধবার, ১৯৭৩, ২৩শে শ্রাবণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
জোট নিরপেক্ষতা ও বাংলাদেশ
আমাদের ঘোষিত নীতিতে কোন অস্পষ্টতা নেই, তবুও যখন বৈরী প্রচারের ফলে কেউ সে নীতি সম্বন্ধে নতুন করে প্রশ্ন তোলেন তখন দ্ব্যর্থহীনভাবে সেই পুরোন বক্তব্যেরই পুনরুক্তি করতে হয়। বলতে হয় আমরা যথার্থই নিরপেক্ষ নীতিতে আস্থাশীল। আমাদের নীতি হলো সক্রিয় নিরপেক্ষতা, জোট বহির্ভূত থাকা এবং স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার নীতি। সে নীতিতে আমরা অনঢ়, অবিচল। কানাডিয়ান ব্রডকাস্টিং টেলিভিশনের প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সরকারের সেই নীতিই অত্যন্ত সুস্পষ্টরূপে বিশ্লেষণ করেছেন।
আমরা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির এ দিকটি সম্পর্কে আলোচনা করেছি; সক্রিয় জোট নিরপেক্ষতার সরকারী নীতিকে আমরা অভিনন্দন জানিয়েছি। তবুও যখন প্রশ্ন উঠে, যখন আমাদের ঘোষিত নীতিকে বিকৃত করবার অপচেষ্টা মহল-বিশেষের মধ্যে দেখা যায় তখন সেই বক্তব্যগুলোই আবার আমাদের উপস্থাপন করতে হয়। বলতে হয়, আমরা রাষ্ট্রসমূহের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে বিশ্বাসী, সামরিক জোটভুক্ত হয়ে অঞ্চলে অঞ্চলে উত্তেজনা জিইয়ে রাখার বিরোধী। আমরা সাম্রাজ্যবাদী, উপনিবেশবাদী এবং বর্ণবাদী শক্তিসমূহের আচার-আচরণের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখা এবং তার প্রেক্ষিতে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার নীতিতে অটল। শান্তিবাদী এবং গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সঙ্গে আমাদের একাত্মতার কথা শুধু আমরা ঘোষণাই করিনি; কার্যক্ষেত্রে তার ভুরি ভুরি প্রমাণ ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসী উপলব্ধি করেছে।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং তৎপরবর্তীকালের সমাজতন্ত্র বিনির্মাণের সংগ্রামে এই শান্তিকামী এবং গণতান্ত্রিক শক্তি যে সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত রেখেছে তা যথার্থ বন্ধুত্বেরই নমুনা বিশেষ। অপরদিকে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়ার শক্তি সমূহ সক্রিয় রয়েছে আমাদের স্বাধীনতা ও সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের বিরোধিতায়। তাই শুধুমাত্র জোটনিরপেক্ষতার নামে যেমন পলায়নপর একটা মনোভাব কোন কোন মহলে পরিদৃষ্ট হয় আমরা তারও বিরোধী। আর তাই বঙ্গবন্ধু সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, আমাদের জোটনিরপেক্ষতা সক্রিয় জোট নিরপেক্ষতা। শান্তির স্বপক্ষে এবং প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের অগ্রাভিযান। শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে তাই পলায়নপর নিরপেক্ষতায় আমরা বিশ্বাস করি না। আমাদের সে অগ্রাভিযান অব্যাহত থাকবে, শান্তি ও প্রগতির সংগ্রামে আমরা প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী।
নানা সমস্যা : নানা ষড়যন্ত্র
একদিকে সমস্যার পাহাড়, অপরদিকে ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল। সমস্যার আর ষড়যন্ত্রে সমগ্র বাংলাদেশ আজ আকন্ঠ নিমজ্জিত। সাম্প্রদায়িকতার সর্বগ্রাসী আগুনকে উসকে আবার গণগণে করার পাঁয়তারা লক্ষিত হচ্ছে। বন্যার করাল ছোবলও জলবন্দীদের জীবন-মরণ সমস্যার উদ্রেক করেছে। ফসল, ঘর-বাড়ী, গবাদি পশুর ক্ষতিও অন্তহীন। অন্ন-বস্ত্র খাদ্যের জন্যে দেশবাসীর আহাজারিতে বাতাস দিনদিন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি প্রতিটি মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। চোরাগুপ্তা, খুন-ডাকাতি-হাইজ্যাকিং তো আজকাল নিত্যদিনের ঘটনা। থানা আক্রান্ত হওয়ার মতো উদ্বেগজনক খবরও আমাদের দারুণ শংকিত করে তুলেছে। সর্বোপরি প্রশাসনিক অযোগ্যতার প্রমাণাদি আজ আর সবিস্তারে উল্লেখ করার অপেক্ষা রাখে না। সরকারের জাতীয়করণ নীতিকে কিভাবে কত সহজ অথচ মধুর পন্থায় বানচাল করা যায়, সেই ষড়যন্ত্রও সমানভাবে অব্যাহত রয়েছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, সমস্যা ও ষড়যন্ত্র যেন দেশময় হাত ধরাধরি করে পাশাপাশি হাঁটতে শুরু করেছে। এতো সমস্যা, এতো ষড়যন্ত্রের মওসুমে আমরা বুঝি বা শান্তি ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়তেও ভুলে গেছি। এ থেকে রক্ষা পাওয়ার কি কোন উপায় নেই? সমস্যা ও ষড়যন্ত্রের কি নেই কোন প্রতিকার?
যে সাম্প্রদায়িকতা একদা কবরস্থ হয়েছে সেই সাম্প্রদায়িকতার দগদগে ক্ষত আবার কেন দেখতে পাচ্ছি? সাম্প্রদায়িকতা আজ যেখানে রাখে না, বাংলার সেই পবিত্র মাটিতেই আবার সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ রোপণের কোশেশ করা হচ্ছে। কারা সাম্প্রদায়িক সমস্যাকে নতুন করে জাগ্রত করার ষড়যন্ত্র আঁটছে, তা আমাদের আর জানার বাকি নেই। ষড়যন্ত্রকারীদের শুধু আমরা অবগত থাকতে বলি যে, সাম্প্রদায়িকতার বিষধোয়া ছড়িয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা নামক রাষ্ট্রীয় আদর্শের বিচ্যুতি ঘটানোটা খুব সহজসাধ্য নয়। বন্যা সমস্যাকে আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে গণ্য করলেও বন্যার ভয়াবহতার সঙ্গে আমাদের জীবন-মরণের সমস্যা জড়িত। সে জন্যেই আমরা বন্যা সমস্যাকে কেন্দ্রবিন্দু করে কাউকে কোন প্রচারণা চালাবার অবকাশ দিতে নারাজ। অন্ন-বস্ত্র-খাদ্যের সমস্যা আমাদের প্রকট, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু যারা অন্ন-বস্ত্রের মতো দৈনন্দিন সমস্যাকে নিয়ে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে মত্ত তাদের সম্পর্কে আমরা দেশবাসীকে সদা সচেতন থাকার অনুরোধটুকু জানিয়ে রাখছি। কারণ, ‘ভারতের বস্ত্র বর্জন করো’ জাতীয় আন্দোলনের যারা জন্ম দিতে অতি উৎসাহী তাঁরা মূলতঃ এবং মুখ্যতঃ সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকেই এ ধরনের উদ্ভট শ্লোগানের প্রবর্তন করতে প্রয়াসী হয়েছে। অতএব, সাধু সাবধান!
আইন শৃঙ্খলা বলতে দেশে আজ কিছুর অস্তিত্ব আছে বলে তো আমাদের মনে হয় না। চারদিকে যা ঘটছে চারদিক থেকে যে সন্ত্রাসমূলক খবর পাচ্ছি, তাতে জনজীবনের নিরাপত্তামূলক কোন সক্রিয় ব্যবস্থার অস্তিত্ব খুঁজে পাচ্ছি না। গ্রামে গ্রামান্তরে আজ চরম নৈরাজ্য। ডাকাতি রাহাজানি তো আছেই। সবচেয়ে অবাক কান্ড, থানাগুলো পর্যন্ত দুষ্কৃতিকারীরা লুট করতে শুরু করেছে। পুলিশবাহিনী প্রতিরোধ ব্যূহ রচনা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। একটি স্বাধীন দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি এমন নড়বড়ে হয়, তাহলে দেশের সাধারণ মানুষের জীবন যাপনের কিংবা বেঁচে থাকার গ্যারান্টি কি? আমলাদের প্রশাসনিক অযোগ্যতার প্রমাণও আমাদের কাছে ভুরি ভুরি রয়েছে। সরকারের জাতীয়করণ নীতির নস্যাৎকারীরা অহরহ স্যাবোটাজ করে যাচ্ছে। মোদ্দা কথা, সারাদেশে আজ এমন সব অন্তহীন সমস্যা জমে উঠেছে আর এমন সব ষড়যন্ত্র অক্টোপাশের মতো ঘিরে ধরেছে যে, এর থেকে নিষ্কৃতি পেতে হলে সরকারের একটি নতুন দেশ জয়ের মতো নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। একদিনে এ সমস্যা এবং এ ষড়যন্ত্রের জন্ম হয়নি। ধীরে ধীরে এগুলো আমাদের জাতীয় জীবনকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। তাই সকল সমস্যার সমাধান যেমন ত্বরান্বিত করতে হবে, তেমনি সকল ষড়যন্ত্রের মূলোৎপাটিত না হলে আর অন্যদের শান্তি নির্বিঘ্ন হবেনা। উদ্ভূত সমস্যার সমাধান এবং ষড়যন্ত্র নির্মূলকল্পে সরকারকে আজ চুপটি মেরে বসে থাকলে চলবে না কার্যকর পন্থা বের করতে হবে। সমস্যা ও ষড়যন্ত্রের ঘটাতে হবে অবসান।
থানা হাসপাতাল প্রসঙ্গে
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনামন্ত্রী গত সোমবার পাবলিক হেলথ ইন্সটিটিউটে সমন্বিত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম বিষয়ক জেলা প্রশিক্ষক কোর্সের উদ্বোধনী ভাষণে ঘোষণা করেছেন, পল্লী এলাকার তিনশ’ ছাপ্পান্নটি থানায় হাসপাতাল স্থাপনের জন্যে সরকার ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় জমি সংগ্রহ করেছেন। থানাকে কেন্দ্র করেই দেশের ভবিষ্যত উন্নতি বিধানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এবং তাই থানাভিত্তিক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়নের জন্যে সরকার সেই অনুযায়ী স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কাঠামোগত রদবদল করবেন বলেও মন্ত্রী মহোদয় উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রত্যেক পরিবারকে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচীর মাধ্যমে থানা কেন্দ্রের অধীনে রেজিস্ট্রেশন নিতে হবে এবং সেই রেজিস্ট্রেশন কার্ডের ভিত্তিতেই জনগণের চিকিৎসা ও জন্ম নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত উপদেশাবলী দান করা হবে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষার মতো চিকিৎসাও হচ্ছে মানুষের একটি মৌলিক প্রয়োজন। বিশেষ করে আমাদের দেশে সুচিকিৎসার অভাবে এবং অবাঞ্ছিত হারে জন্মবৃদ্ধিজনিত কারণে সমাজে বিভিন্ন বিষয়ের উপরে ব্যাপক চাপ সৃষ্টি হচ্ছে এবং ফলে দিন দিন অর্থনীতি, সামাজিক, শিক্ষা ইত্যাদি প্রতি ক্ষেত্রেই নানা সমস্যার উদ্ভব ঘটছে। অপরদিকে আমাদের দেশের যথার্থ চিকিৎসার অভাবে নানা রোগ ব্যাধিতে শিশু মৃত্যুর হারও বর্তমান উন্নয়নশীল সভ্য সমাজে আমাদের মুখে কালিমা লেপন করছে। সুতরাং সরকার অনুসৃত গ্রামভিত্তিক উন্নয়ন কর্মসূচী গ্রহণ এবং থানা এলাকায় পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে আজ পল্লীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার প্রয়াস নিঃসন্দেহে আমাদেরকে আশান্বিত করে, স্বস্তির আভাস দেয়।
অল্প কিছুদিন আগেই বেশ ক’টি দৈনিকে খবর বেরিয়েছিলো, আমাদের দেশের অনেক ডাক্তার উচ্চ শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে বিদেশে গিয়ে আর ফিরে আসছেন না, আবার অনেকে অর্থের মোহে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।
সুতরাং আমাদের বক্তব্য, গ্রামের থানা এলাকায় যেসব পল্লী স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতাল স্থাপনের কর্মসূচী নেওয়া হয়েছে তা কেবল বিল্ডিং তৈরী করে দু’জন ডাক্তার, কম্পাউন্ডার নিয়োগ করে কিছু ঔষধের ব্যবস্থা করলেই চলবেনা বরং সেসব প্রত্যেকটি কেন্দ্রে যাতে পর্যাপ্ত অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডাক্তার, নার্স, কম্পাউন্ডার, আধুনিক যন্ত্রপাতি ও ঔষধপত্রে পূর্ণ হয়, যাতে করে উক্ত স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসপাতালে কর্মরত কর্মচারীরা শহরের স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও হাসপাতালের কর্মচারীদের ন্যায় সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারেন এবং তাঁরা গ্রামে চাকরী করার প্রতি উৎসাহী হন, সর্বোপরি জনগণ চিকিৎসা ও পরিকল্পনার পূর্ণ সুযোগ-সুবিধা পায় তার নিশ্চিত ব্যবস্থা করতে হবে। এবং তাহলে ডাক্তারগণ বিদেশগামী হওয়া থেকে বিরত হবেন।
জনগণকে যেন ডাক্তার ও ঔষধের জন্য বর্তমানের মত দূর-দূরান্ত থেকে স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে এসে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে না হয় বরং তারা সুচিকিৎসা পেয়ে পরিবার পরিকল্পনায় আগ্রহী হয় তেমনি কার্যকর ব্যবস্থা করতে হবে। এবং কেবল তাহলেই সরকারের অনুসৃত কর্মসূচী সফল হবে, নচেৎ নয়। সুতরাং আমাদের প্রত্যাশা, সরকার গোটা পরিকল্পনা যথার্থভাবে বাস্তবায়নে সর্বদা তৎপর থাকবেন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক