You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.04.25 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সর্বাত্মক অভিযানে সেনাবাহিনী | স্বাগতম প্রেসিডেন্ট নে উইন | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৫শে এপ্রিল, শুক্রবার, ১২ই বৈশাখ, ১৩৮১

সর্বাত্মক অভিযানে সেনাবাহিনী

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার, চোরাচালান বন্ধ, সমাজবিরোধী ও রাষ্ট্র বিরোধীদের গ্রেফতার, খাদ্যশস্য ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র মজুত ও মুনাফাখোরী রোধে দেশব্যাপী সর্বাত্মক অভিযানে অসামরিক কর্তৃপক্ষের সাহায্যে অবিলম্বে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন।
বাংলাদেশ রাইফেলস, জাতীয় রক্ষীবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে একই সাথে সেনাবাহিনী এই অভিযান চালাবে।
দেশব্যাপী ব্যাপক তল্লাশি অভিযান চালানোর হুকুম দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সশস্ত্রবাহিনীকে আইন-শৃঙ্খলা লঙ্ঘনকারী ও মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে কারবারিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।
এই অভিযান চলাকালে সর্বপ্রকার ধর্মঘট, লক-আউট, শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভ সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের ব্যাপারে সম্মিলিত শান্তিরক্ষা বাহিনী অবৈধ অস্ত্রধারীদের কোন ব্যক্তি অথবা যাদের কাছে বেআইনি অস্ত্র পাওয়া যাবে অথবা বেআইনি অস্ত্র বহন করবে তাদের আটকের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে।
মজুতদারী মুনাফাখোরীদের বিরুদ্ধে অভিযানে খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্রের মজুমদার ও মুনাফাখোরদের প্রতি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া চোরাচালান বন্ধে অভিযানে সেনাবাহিনী সমুদ্রবন্দরের আঞ্চলিক বরাবর এলাকাসহ সীমান্ত এলাকায় তাদের তৎপরতা জোরদার করবে।
দেশের সামগ্রিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য খাদ্যশস্যের মূল্যস্ফীতি, কথায় কথায় কাজ বন্ধ একশ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, মজুতদার ও মুনাফাখোরদের রাজত্বের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন বলে যা শোনা যাচ্ছিলো তাই শেষ পর্যন্ত সত্যে পরিণত হয়েছে। বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্য সেনা বাহিনীকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুবার বলেছেন, বাংলার মানুষ শান্তিতে ঘুমুতে চায় ও মোটা কাপড় পেলেই তারা খুশি। অথচ স্বাধীনতা লাভের পর এ পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। দিনের-পর-দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে গিয়েছিল। এদের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেনা বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়াতে অবস্থার পরিবর্তন যে হবে এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এ ক্ষেত্রে কতকগুলো প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই দেখা দেয়। সেগুলো হলো সেনাবাহিনী ময়দানে অবতীর্ণ হওয়ার পর হয়তো মজুতদার, মুনাফাখোর আইন শৃঙ্খলা ভঙ্গ কারীর পিছু হটবে। জিনিসপত্রের দাম কমবে। গত একুশে এপ্রিল ‘বাংলার বাণী’তে প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে আমরা বলেছিঃ মজুদ পণ্য সামগ্রী এবং খাদ্যদ্রব্য সেক্রেটারিয়েটে মজুত হয়ে থাকা ফাইলপত্রও একটা সমস্যা বা কারো কারো কাছে সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। উদ্ধার দুটোই করতে হবে। সুষ্ঠু সরবরাহ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দর বেঁধে দেবার মত নেতা মন্ত্রীদের মুখ বেঁধে দেয়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছেন। শুধু তাই নয় বিভিন্ন সরকারি সংস্থা গুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ হাজার রকমের। বিদেশ থেকে মাল আমদানি করার পর তা চাঁটগা বা চালনা অথবা সীমান্ত এলাকায় পড়ে থাকে দিনের পর দিন। তারপর যদিও বা তার রাজধানীতে আসে তাও গুদামে পচে। মাল পচে পাট পচে অযত্নে-অবহেলায়। সবুজ বিপ্লবের কথা বলা হলেও দেশের সর্বোচ্চ বীজ সার পাওয়ার পাম্প সময় মতো পৌঁছে না। ইত্যাকার নৈরাজ্য চলছে সর্বত্র। অর্থাৎ সোজা কথায় দায়-দায়িত্ব টা আমার নয়-সব দায়িত্ব সরকারের। এখানে একজন সৎ ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে আমার কোন করণীয় নেই-এমন একটা মনোভাবের জন্ম হয়েছে। এ দায়িত্ববোধ কে জাগাতে হলে একদিকে যেমন কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বনে প্রয়োজন তেমনি আবার রাজনৈতিকভাবেও এগিয়ে আসা উচিত।
পরিশেষে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রতি আমরা সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। দেশের অভ্যন্তরে খাদ্যশস্য যে নেই এমন নয়। খাদ্যশস্য মজুত ও মুনাফাখোরদের হাতে রয়েছে। তাছাড়া অনেক সঙ্গতিসম্পন্ন গৃহস্থ ও খাদ্যশস্য গোলাজাত করে রেখেছেন। সেনাবাহিনীর ভয় হয়তো এসব খাদ্যশস্য খোলাবাজারে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সেই খাদ্যশস্য যদি আবার সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে যায় তাহলে তার পরিণতি হবে মারাত্মক। অবশ্য সেনাবাহিনীর সমুদ্র বন্দর ও দেশের আঞ্চলিক বরাবর এলাকাসহ সীমান্ত এলাকায় তাদের তৎপরতা জোরদার করবে বলে বলা হয়েছে। তবু বিষয়টির প্রতি আরও সর্তকতা অবলম্বন প্রয়োজন রয়েছে।
পরিশেষে মনে রাখা দরকার দেশের সমস্যার সবটাই প্রশাসনিক নয়। এর বিরাট অংশ অর্থনৈতিক। কিছুটা রাজনৈতিক। বেসামরিক প্রশাসন যন্ত্রটাকে সবল সক্ষম ও সক্রিয় করে তোলার জন্য বর্তমান পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলো। এর সুফল কিছুটা পাওয়া যাবে। এ ব্যাপারে কারো মনে সংশয় থাকবার কথা নয়। কিন্তু এই সুফল স্থায়ী হবে না, যদি না দেশে প্রায় পতনোন্মুখ অর্থনীতির চাকাকে সচল করে তোলা যায়-বঙ্গবন্ধু ও সরকারের প্রতি যে সাধারণ জনসমর্থন রয়েছে তাকে সংহত করে কাজে লাগানো না হয়। আমরা এ দু’টি বিষয়ের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।

স্বাগতম প্রেসিডেন্ট নে উইন

বাংলাদেশের মাটিতে বার্মার রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল নে উইনকে স্বাগতম। আজ শুক্রবার তিন দিন ব্যাপী সফর উপলক্ষে জেনারেল নে উইন ঢাকা আসছেন। বাংলাদেশে বর্মী রাষ্ট্রপ্রধানের এটাই প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর। ইতিমধ্যে রাজধানী ঢাকায় জেনারেলক নে উইনকে বিপুলভাবে সম্বর্ধিত করার জন্য সব রকম প্রস্তুতি পর্ব সমাধা করা হয়েছে। বার্মা বাংলাদেশের অন্যতম নিকটতম প্রতিবেশী দেশ। এ পর্যন্ত এশিয়ার কোন রাষ্ট্রপ্রধান স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেননি। বার্মার রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল নে উইনই এশিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশ সফর করেছেন। বাংলাদেশে আগমনের আগে জেনারেল নে উইন ভারত এবং পাকিস্তান সফর সম্পন্ন করেছেন। বাংলাদেশ সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হবেন এবং এ বৈঠকের পরই দু’দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। বার্মা ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও পারস্পরিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনায় প্রাধান্য লাভ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ও বার্মা দুটি সৎ প্রতিবেশী দেশ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আগ্রহী। বাংলাদেশ ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সম্প্রতি যে ত্রিপক্ষীয় দিল্লি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট নে উইনের ভারত, পাকিস্তান এবং সর্বশেষে বাংলাদেশ সফর একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এশিয়া মহাদেশের এই অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা কল্পে প্রেসিডেন্ট নে উইন বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হবেন। এই দু’দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার কয়েকটি নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। পর্যবেক্ষক মহল অনুমান করছেন যে, নাফ নদীতে দু’দেশের মধ্যে সীমানা নির্ধারণের বিষয়টি নিয়েও আলোচনার অবতারণা হতে পারে। পাকিস্তান আমলে এই নাফ নদী ও সীমানা নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তির উদ্রেক হয়েছিল। বার্মায় পাট উৎপন্ন হয়, অতএব সেখানে পাট কল স্থাপনের ব্যাপারে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। তাছাড়া ঢাকা এবং রেঙ্গুনের মধ্যে সরাসরি বিমান চলাচলের বিষয়টির প্রতিও একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে। বাংলাদেশের সঙ্গে বার্মার প্রায় পৌনে দুই শত মাইল সীমান্ত রয়েছে। প্রেসিডেন্ট নে উইনের সফরের পর তাই স্বাভাবিক নিয়মেই আশা করা যেতে পারে যে, এই দুটি নিকটতম প্রতিবেশী দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা হবে। শুধু সীমান্ত নয়, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রেসিডেন্ট নে উইন বার্মায় সমাজতান্ত্রিক নীতি এবং বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করছেন। বাংলাদেশও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি অনুসরণ করছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানকারী দেশ গুলোর মধ্যেও বার্মা প্রথম সারির দেশ। কাজেই এ দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্কটা খুবই স্বাভাবিক। আমরা আশা করি বাংলাদেশে ও বার্মার মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নটা প্রতিষ্ঠিত হোক, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এই দুটি দেশ যেন সহযোগিতামূলক মনোভাবকে অটুট রাখতে সক্ষম হয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন