You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব

বাঙালির হাজার বছরের রাজনীতির আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি তাে শুধু একজন ব্যক্তি ছিলেন না, ছিলেন সারা বাংলাদেশের সংগ্রামী চেতনার প্রতীক।১ চিরকালের উপেক্ষিত। বাঙালি তাঁর নেতৃত্বেই ইস্পাতকঠিন ঐক্যে সংঘবদ্ধ হয়েছে এবং লাভ করেছে। একটি স্বাধীন-সার্বভৌম মানচিত্র ও গৌরবদীপ্ত পতাকা। এজন্য অন্নদাশঙ্কর রায় তাকে ‘নেতাজি সুভাষ বসুর পর বাংলার সর্বশ্রেষ্ঠ বীর’ বলে অভিহিত করেছেন।
বাঙালি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এক অবিচ্ছিন্ন সত্তা। বাঙালির আবাসভূমি খ্রিস্টপূর্বকালে বঙ্গাঃ, পুণ্ড, গৌড়াঃ; ঐতরেয় আরণ্যক-এ বঙ্গাঃ; রামায়ণমহাভারত-এ বঙ্গ; চর্যাপদ-এ বঙ্গাল দেশ; শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের আমলে ‘বাঙ্গালা কিংবা ইংরেজ শাসনে ‘বেঙ্গল’ নামে পরিচিতি হলেও, কোনােকালেই স্বতন্ত্র স্বাধীন ভূখণ্ড ছিল না। দীর্ঘকালের ইতিহাস-পরিক্রমায় বাংলার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছেন অনেক স্বাধিকার-প্রমত্ত তেজোদীপ্ত মানুষ। তাদের বীরত্ববিদ্রোহ বাঙালির চেতনায় স্বাজাত্যবােধ ও স্বাধিকার-চেতনা অগ্নিমশাল। প্রজ্বলিত করলেও, তা শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার পথ খুঁজে পায়নি।
কালে কালে অধিকারের প্রশ্নে বাঙালি জেগে উঠলেও, সূর্যের তেজে চিরঅম্লান স্বাধীনতার বীজ এই জাতির চেতনায় প্রথম উপ্ত হয়েছিল ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর; এবং সেটা হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে, যার অন্যতম প্রধান নেতা ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। তখন এদেশের ছাত্রসমাজকে তিনি সংগ্রামী চেতনায় উজ্জীবিত করেছিলেন; ‘প্রকৃতপক্ষে বাংলার ছাত্র আন্দোলনের
————————
১। আবুল ফজল, শেখ মুজিব : তাঁকে যেমন দেখেছি, পঞ্চম মুদ্রণ, বাতিঘর, চট্টগ্রাম : ২০১৮; পৃ.
———————-
তিনিই প্রতিষ্ঠাতা।১ ভাষা আন্দোলনের চেতনার তরুণ সমাজের অস্তিত্বের মর্মমূলে প্রােথিত করে তার লালন, বিকাশ ও মহীরুহে রূপদানের ক্ষেত্রে তিনি পালন করেন অগ্রসেনানীর ভূমিকা। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর অবদানের কথা স্বীকার করেও বলা যায়, শেখ মুজিবই স্বাঙালির বাধিকার-সংগ্রামের মূল নেতা এবং স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মহানায়ক। পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসেবে বাংলার জনগণের কাছে পরিচিতি লাভ করলেও, সাতচল্লিশের দেশভাগের পর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা জাগ্রত হওয়ার প্রথম সােপান, অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন থেকেই পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকায় তাঁর বর্ণাঢ্য ও সক্রিয় রাজনৈতিক জীবনের গােড়াপত্তন ঘটে।
ভাষা-সংস্কৃতির গৌরবে বলীয়ান, দীর্ঘকালের ঐতিহ্য-সমৃদ্ধ বাঙালি জাতি আপন অস্তিত্বের অহংকারে তীব্র আক্রোশ আর বীরত্বের হুংকারে প্রথম জেগে উঠেছিল ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে। বাঙালির এই জাগরণের মূলে ছিল মাতৃভাষার প্রতি গভীর দরদ ও ভালােবাসা। দুর্যোগ-দুঃশাসনকবলিত বাঙালির বাঙালিত্বের অহমিকা এমন বজ্রকঠিনরূপে আর কখনাে প্রকাশ পায়নি। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ ও অন্যতম শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন বাংলা মায়ের তেজোদীপ্ত সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ‘৫৪-র নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরােধী আন্দোলন, ‘৬৬-র ৬ দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০-এর নির্বাচন এবং সর্বোপরি ‘৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদান করে তিনি হয়ে ওঠেন এ ভূখণ্ডের মুক্তিকামী মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। শুধু তাই নয়, বাঙালির স্বাধিকার সংগ্রামের মূল নায়ক ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী প্রধান নেতা হিসেবে তিনি ইতিহাসে লাভ করেছেন গৌরবােজ্জ্বল স্থান। নিজের সংগ্রামী জীবনের শ্রেষ্ঠ ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জনের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বাংলার কোটি কোটি মানুষের কাছে লাভ করেছেন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি এবং জাতির জনকের মর্যাদা।
————–
১। মুহম্মদ এনামুল হক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মমতাজউদদীন আহমদ, প্রসঙ্গ বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, চতুর্থ প্রকাশ, বিশ্বসাহিত্য ভবন, ঢাকা : মার্চ ২০১৫; পৃ. ১২১
—————-

 সূত্র: ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব কতিপয় দলিল -ড. এম আবদুল আলীম

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!