You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.10.25 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | জাতিসংঘ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কার দাবী | লন্ডনে বোমাতঙ্ক | যাদুঘরে চুরি | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৫শে অক্টোবর, শুক্রবার, ১৯৭৪, ৭ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

জাতিসংঘ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কার দাবী

সারা দুনিয়ায় সোচ্চার প্রতিবাদকে অগ্রাহ্য করে প্রিটোরিয়া সরকার সেই গোড়া থেকেই যে বর্ণবৈষম্যবাদী নীতি অনুসরণ করে আসছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার উন্নতি হওয়ার পরিবর্তে আরো অবনতির দিকে এগিয়ে চলেছে। সেদেশের অভ্যন্তরে সংখ্যাগরিষ্ঠ কালো আফ্রিকানদের উপর নির্যাতন যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে গণ-প্রতিরোধ। অধিকতর সংগঠিত হয়ে তারা বর্ণবৈষম্যবাদী সরকারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিরোধ জোরদার করে তুলছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সকল খবর যে বাইরে প্রকাশিত হতে পারে এমন নয়। তবুও ছিটেফোঁটা যে সকল খবর সরকারী সতর্ক দৃষ্টি গলিয়ে বাইরের জগতে প্রকাশ পায় তাতেই তাবৎ দুনিয়ার লোক আঁতকে উঠে। সারাদেশে রাজনৈতিক কারণে যত লোক কারারুদ্ধ হয়ে আছে অনুমান করা হয় সভ্য জগতে যে কোনো দেশের রাজনৈতিক বন্দীদের চাইতে তার সংখ্যা অনেক বেশী। বলাবাহুল্য, এরা সবাই কালো আফ্রিকান। পেশা এবং শ্রমদানের ক্ষেত্রেও কালো আফ্রিকানদের যে নির্লজ্জভাবে বঞ্চিত করা হয় তার খবর সবার জানা। দেশের সাংবিধানিক নিয়মেই কালো অধিবাসীদের সেখানে ব্যবহার করা হয় দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে। ভোটদান এবং রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নেও খোলাখুলিভাবে তাদের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
আমাদের এই অঞ্চলের মানুষ প্রিটোরিয়া সরকারের বর্ণবৈষম্যবাদী নীতির বিরুদ্ধে বরাবর প্রতিবাদ জানিয়ে এসেছে। বর্ণবৈষম্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সদা সংগ্রামের প্রত্যয় নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ তার অভ্যুদয় কাল থেকেই এ সবের বিরুদ্ধে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে আসছে। জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন এবং ইসলামিক সম্মেলনেও সরকারীভাবে আমাদের বক্তব্য পেশ করা হয়েছে।
এবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কারের প্রস্তাব আসবে এটা আগে থেকেই নিধারিত ছিল। তারই প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু যখন জাতিসংঘে তাঁর জাতির তরফ থেকে প্রথম ভাষণ দেন তখন তিনি বর্ণবৈষম্যবাদ প্রশ্নে বাংলাদেশের বক্তব্য অত্যন্ত স্পষ্ট এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় পেশ করেন। বঙ্গবন্ধুর সেই বক্তব্যের আলোকেই সেখানে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি জনাব এস.এ. করিম আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘ থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার বহিষ্কারের প্রস্তাব করেছেন।
শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাই নয় তার প্রতিবেশী রোডেশিয়ায়ও চলেছে সেই একই ঘৃণ্য নীতি। এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও কিছুটা রেখে-ঢেকে নিগ্রোদের অধিকার সংরক্ষণে বৈষম্য করা হচ্ছে। উগ্র বর্ণবৈষম্যবাদী শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাজ্যেও তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে সরকারী স্নেহাশ্রয়েই। দক্ষিণ আফ্রিকাকে বহিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য দেশেও যাতে করে জাতিসংঘ সনদ মর্যাদার সঙ্গে অনুসৃত হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অবশ্য কর্তব্য। নইলে জনাব করিমের ভাষায় বলা যায়, খোদ জাতিসংঘের উপরই মানুষের আস্থা হ্রাস পাবে।

লন্ডনে বোমাতঙ্ক

লন্ডনে দেখা দিয়েছে বোমাতঙ্ক। গত বিশ মাসের খতিয়ান নিলে দেখা যাবে, সমগ্র ইংল্যান্ডের নানাস্থানে একটি নয়, দু’টি নয়, শতাধিক বোমা বিস্ফোরিত হয়েছে। বোমা বিস্ফোরণের ফলে প্রায় পঁচিশ ব্যক্তির প্রাণবায়ু নিভে গেছে এবং বোমার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন পাঁচশ নাগরিক। লন্ডনে বোমা বিস্ফোরণের সাম্প্রতিকতম ঘটনাটি ঘটেছে গত মঙ্গলবার। সেন্ট্রাল লন্ডনে বিস্ফোরিত এই বোমাবাজিতে তিনজন আহত হয়েছেন, দু’জন আহতের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। এই বোমা যেখানে বিস্ফোরিত হয় তার মাত্র পঞ্চাশ গজ অদূরে একটি ক্লাবে আহার করছিলেন রক্ষণশীল দলের নেতা মিঃ এডোয়ার্ড হীথ। বোমা তাঁর গা স্পর্শ করেনি, মিঃ হীথ অক্ষত রয়েছেন। মিঃ হীথের ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে, অল্পের জন্য তিনি প্রাণে বেঁচে গেলেন, মিঃ হীথ অবশ্য পুলিশের এক প্রশ্নোত্তরে বলেছেন যে, ‘তাঁকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষিপ্ত হয়েছে, তিনি এ রকমটি মনে করেন না।’ পুলিশ কিন্তু সে জন্য ব্যাপারটিকে একেবারে হেলাফেলা করে দেখছেন না। বোমা বিস্ফোরিত এলাকাটি পুলিশ অবরোধ করে রেখেছেন। কারণ মঙ্গলবারের বোমা বিস্ফোরিত স্থানটির চার শত গজ দূরেই মাত্র দশ দিন আগে সামরিক বাহিনীর একটি ক্লাবে বোমা ফাটে, ফলে ক্লাবটির অংশ বিশেষের অস্তিত্ব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। লন্ডনে বোমাবাজির জন্য আইরিশ রিপাবলিকনা আর্মীর উপর দোষারোপ করা হয়েছে। ইতিপূর্বেকার বোমাবাজির সঙ্গেও ‘ঈরার ভূমিকা ছিল বলে সন্দেহ করা হয়ে থাকে।’ তবে সন্দেহটা অমূলক নাও হতে পারে, কারণ আয়ারল্যান্ডের একাংশ আজও সমাধানহীন গোলক ধাঁধার আবর্তে খাবি খাচ্ছে। উত্তর আয়ারল্যান্ডের সংকট থেকে বৃটেনের গা বাঁচানো সম্ভব নয়। এবং সম্ভবতঃ এ কারণেই সমগ্র ইংল্যান্ডব্যাপী বোমাবাজির ঘটনা একের পর এক ঘটেই চলেছে। বৃটেন সরকার যদি আয়ারল্যান্ড সমস্যার সত্যিকার সমাধান চান, তাহলে গড়িমসি নীতির অবসান ঘটাতে হবে। নইলে আয়ারল্যান্ডে বিভেদ নীতির ফলাফল খুব সুখকর হবে না। অন্ততঃ লন্ডনে বোমাবাজির ঘটনা থেকে এ অমঙ্গলের ইঙ্গিতেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বৃটিশ সরকার কি এই প্রকাশ্য হানাহানি বন্ধ করে একটা স্থায়ী সমাধানের জন্য অগ্রণী হতে পারেন না?

যাদুঘরে চুরি

ছোট্ট একটি খবর : এপ্রিল মাসে মহাস্থান যাদুঘর থেকে যে কতিপয় মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী চুরি গিয়েছিল আজো তা উদ্ধার করা হয়নি। চুরি যাওয়া জিনিসগুলোর মধ্যে রয়েছে গুপ্ত আমলের ৩টি স্বর্ণ ও আটাশটি রৌপ্য মুদ্রা, পাঁচটি ব্রোঞ্জের জগন্ধাত্রী, গণেশ, পিঙ্গলা, বিষ্ণু ও বৈষ্ণবী মূর্তি এবং সোনায় কোটিং দেওয়া একটা মন্দিরের চূড়া। স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রাগুলো বিক্রি করলে হয়তো হাজার পাঁচেক টাকা তারা পাবে যারা এগুলো চুরি করেছে। তবে সবচাইতে বিস্ময়কর ঠেকেছে রিপোর্টটি পড়ে এবং তা হলো অদ্যাবধি এই জিনিসগুলো উদ্ধারের কোনো চেষ্টাই করেননি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। হয়তো এ জন্যই তারা তৎপরতা দেখাননি যে, আর্থিক মূল্যের দিক দিয়ে যা যৎসামান্য তা উদ্ধারে অযথা সময় অপচয় করে কি লাভ? হতে পারে; তবে আমরা এটুকু বুঝি পাঁচ হাজার বছরের একটি পুরাতন তাম্র মুদ্রার আর্থিক মূল্য যত নগণ্যই হোক না কেন, মানব সভ্যতার ইতিহাস রক্ষায় তার দাম অপরিসীম এবং এই বোধটুকু যাদের নেই তারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত একটি পুরাকীর্তি সংরক্ষণাগারের গুটি কয়েক দ্রব্যসামগ্রী কেন, গোটা যাদু ঘরটা বিনষ্ট হয়ে গেলেও খুব বেশী একটা তৎপর যদি না হন তবুও আমরা বিস্মিত হবো না। অথচ বাংলাদেশে পুরাকীর্তিমালা সংরক্ষণাগারের সংখ্যা খুবই নগণ্য এবং ঢাকা যাদুঘর সহ রাজশাহীর বরেন্দ্র মিউজিয়াম, ময়মনামতী, মহাস্থানগড় প্রভৃতি গুটিকয়েক স্থানে আমাদের পর্যায়ক্রমিক অতীত ইতিহাসকে সংরক্ষিত করে রাখার যে চেষ্টা চালানা হচ্ছে সেক্ষেত্রে মাঝে-মধ্যে এই ধরনের চুরি যাওয়ার ঘটনাকে কোনোক্রমেই হালকাভাবে দেখা যায় না এবং চুরি যাওয়া জিনিস উদ্ধারের দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত, তারা সে দায়িত্ব পালন না করলেও আমরা বিচলিত না হয়ে পারি না। এক্ষেত্রে বক্তব্য আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছেও। সংগৃহীত পুরাকীর্তি সংরক্ষণের নামে নিশ্চয়ই কর্মচারীদের বেতন বাবদ একটা মোটা অংকের অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। তাই যদি হবে আপনারা তাহলে যাদুঘরগুলোর সংরক্ষণের সুব্যবস্থা করছেন না কেন? আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির এই নৈরাজ্যের দিনে কেন একজন মাত্র নিরস্ত্র দারোয়ানের হাতে এর দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া হয়? আমরা দেখতে চাই যে উদ্দেশ্যে যাদুঘরগুলো স্থাপিত হয়েছিল সেই মহৎ উদ্দেশ্য যেন ব্যর্থ না হয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন