যাঁদের জীবন বিনিময়ে বেঁচে আছি
নাসির উদ্দিন ইউসুফ
ঘুম নেই। চোখের ক্লান্ত পাতা দু’টো ভারী হয়ে নেমে আসে চোখের ওপর। চারদিকে চেপে বসা অন্ধকার। রাত দুটো। চোখ দু’টোর ঠিক পাতার নিচে ওদের ছায়া। নড়ে চড়ে উঠে আসে। ওরা হেঁটে বেড়ায়। আমি ঘুমোতে পারি না। এমনি করে নিদ্রাহীন রাতগুলো যায়। ঐ তো মানিক, একগাল দাড়ি….। ঐ যে দৌড়ে আসছে অসংখ্য বুলেটবিদ্ধ বুক নিয়ে কিশোর টিটো। আর, আর এইখানে সন্তপর্ণে রক্তাক্ত বুকে নিঃশব্দে নৌকা চালিয়ে যায় তিতাসের মাঝি। আমি বেঁচে আছি। শুয়ে আছি ভাজহীন শুভ্ৰ বিছানায়।
আমার কষ্ট হয়। হাতের তালু ঘেমে ওঠে। পল্টনের বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। বুকের ভেতরের একটা ঘুণ পোক ক্রমশ বেপরোয়া হয়ে ওঠে, ক্ষত তৈরি করতে থাকে।
বসে থাকি আমি। ঘুমোতে পারি না। চোখ বুজলেই আলো আধারিতে চোখের পাতার কোল ঘেঁষে নিঃশব্দে নৌকা চালিয়ে যায় তিতাসের নাম না জানা মাঝি। বুক হতে তার অবিরল করেছে রক্তস্রোত। আমি তিতাসের নাম না জানা মাঝির জীবনের বিনিময়ে বেঁচে আছি। গুলিটা আমার বুকে লাগতে পারতো। আমাকে এক ধাক্কায় পাটাতনের ওপর শুইয়ে দিয়ে সে নিরাপদ জায়গায় দ্রুত নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল। অন্ধকারে এক ঝাঁক গুলি ওকে ছিটকে পানিতে ফেলে দেয়। আমি অন্ধকারে তার রক্ত পানিতে মিশে যেতে দেখেছিলাম। আমি এখনো সেই রক্তের উষ্ণ গন্ধ পাই। এখনো নদী দেখলে আমার কষ্ট হয়।
আমরা বায়ান্নজন গেরিলা ঢাকায় আসছিলাম। আখাউড়া-ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া সড়কের পূবদিকের সীমান্ত গ্রাম মনিঅন্দ-এ আমাদের শিবির। ট্রেনিং শেষ-এখন ঢাকায় যাচ্ছি। আমরা আখাউড়া- ব্ৰাহ্মণবাড়িয়া রেললাইনের একটি ছোট্ট কালভার্ট অতিক্রম করেছি। আর একটু এগোলে সাইদাবাদ পুল। ওটা সিএন্ডবি রোড। ওখানে কড়া পাহারা আছে রাজাকারদের। আগেই যোগাযোগ হয়েছিল তাদের সাথে। যেতে অসুবিধা নেই। ওরাই পার করে দেবে না দিলে ওরা জানে ক্যাম্প উড়িয়ে দেয়া হবে। সিএন্ডবি রোড তখনো দখলদার বাহিনীর হাতে।
সীমান্ত এলাকার অনেক বাঙালি রাজাকার এমনিভাবে সাহায্য করেছে মুক্তিযোদ্ধাদের। ঐ তো দেখা যাচ্ছে সাইদারবাদ ব্রিজ। আমাদের সামনে ফরিদপুরের দল।
আমরা তাদের পেছনে। রাত কত হবে? প্ৰায় একটার কাছাকাছি। ঐ ভয়াবহ স্থানটি পার হলে আমরা নিরাপদ। কিন্তু তখনো আমরা জানতাম না সেদিন দখলদার বাহিনী রাজাকারদের সরিয়ে নিজেরাই ব্রিজের দায়িত্ব নিয়েছে। যখন বুঝতে পেরেছি তখণ অনেক দেরি হয়ে গেছে। অন্ধকার ভেদ করে প্রচণ্ড শব্দে শত্রুর স্বয়ংক্রিয় মেশিনগান আর মর্টারের শেলে আমরা বিপর্যন্ত। অতর্কিত আক্রমণে আমরা দিশেহারা। মৃত্যু চিৎকার আর কান্নাকে ছাপিয়ে শত্রুর গোলার আওয়াজ। আমার নৌকার মাঝি ত্বরিতগতিতে নৌকা ঘুরিয়ে- পিছে ফেলে আসা একটা মাটির চারের আড়ালে নৌকা নেয়ার জন্য দ্রুত বেয়ে যাচ্ছে।
নৌকার চারদিকে পানিতে টুপটাপ গুলির শব্দ। আমি নৌকা হতে দেখতে চাচ্ছি। কোথায় আমাদের দলের অন্য নৌকাগুলো। মাঝি ততক্ষণে মাটির চারের কাছে নৌকা এনে বাঁক নিয়েছে। হঠাৎ সে আমাকে ধাক্কা মেরে শুইয়ে দিয়ে চিৎকার করে উঠলো-শুইয়ে পড়েন। গায়ে গুলি লাগতে পারে। আমি ও ওকে পাল্টা বলতে যাচ্ছি এমন সময় এক ঝাক গুলি ওকে উড়িয়ে নিয়ে পানিতে ফেলে দিলো। আমাদের নৌকা তাল সামলাতে সামলাতে মাটির চারের আড়ালে চলে গেল। আমি দেখলাম মাঝির শরীর পানিতে দাপাদাপি করছে। কিছুক্ষণ পর দেহটি আর দেখা গেল না।
সে মাঝিটির নাম জানা হয়নি। কোনোদিন জানা হবে না। অথচ আমি বেঁচে আছি, সেই মাঝির জীবনের বিনিময়ে। বেঁচে আছি ঠিকই। কিন্তু অনেকের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারি না। পারি না মানিকের মা’র সামনে যেয়ে দাঁড়াতে।
যুদ্ধের সময় মানিকের মা আমাকে বলেছিল-‘মানিক আমার একমাত্র ছেলে ওকে একটু দেখো।’ আমি মানিকের মা’র কথা রাখতে পারিনি। মানিক চলে গেল। মানিকেরা মরে যায়-তারপর আসে স্বাধীনতা।
নভেম্বর চৌদ্দ তারিখ’৭১ সালে। ঢাকা-আরিচা রোডের ভায়াডুবি ব্রিজ অপারেশন। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে আমরা ঐ ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেই। পঞ্চান্ন জনের একটি দল নিয়ে আমরা আক্রমণ পরিকল্পনা করলাম। অপারেশনের নেতৃত্বে আমি। ব্রিজ দখল করতে দুই মিনিট সময় লেগেছিল সেদিন সাবু। মাত্ৰ পাঁচজন-সাবু, ওয়াজেদ, আশরাফ, হাকিম আর আমি ব্রিজ দখলের জন্য ব্রিজের দিকে এগোলাম। তখন রাত পৌনে দশটা। রাস্তার ঢালু ধরে এক নাগাড়ে প্রায় তিনশত গজ ক্রল করে আমরা ব্রিজের কাছে চলে এলাম।
পেছনে আরো পঞ্চাশ জন যোদ্ধা অপেক্ষা করছে আমাদের বিজয়ের জন্য। আমরা দেখলাম মাত্র পনেরো গজ দূরে দখলদার বাহিনীর প্রহরী দু’জন হাঁটছে। গড়িয়ে আমরা রাস্তায় উঠে এলাম। বাধানো রাস্তার ওপর পাশাপাশি শুয়ে আমরা আক্রমণ শুরু করলাম। ওয়াজেদের দুই ইঞ্চি মর্টার শেল অব্যৰ্থ লক্ষ হানলো শত্রুর বাংকারে। আশরাফের এলএমজি, সাবুর এলএমজি আর আমার প্রিয় চাইনিজ রাইফেল সমানে গর্জে উঠলো। সময় নির্ধারণ ছিল এক মিনিট। এক মিনিটের মধ্যে দখল করতে হবে ব্রিজ। এক মিনিট পার হয়ে গেল। তখনো শত্রুর দু’একটি গুলি বিক্ষিপ্তভাবে ছুটছে। সাবু হঠাৎ লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে তার এলএমজি হাতে নিয়ে অনবরত গুলি করতে করতে ছুটে গেল ব্রিজের ওপর। আমরা তাকে যন্ত্রচালিতের মতো অনসুরণ করলাম। সাবুর মুখ দিয়ে তখন শুধু ‘ইয়া আলী’ ধ্বনি। শত্রু সৈন্য পালাতে লাগলো। সাবু তাদের ধাওয়া করতে করতে হত্যা করছে। দ্রুত আমরা কাজ শুরু করলাম।
মানিকগঞ্জের দিকে ফ্লাঙ্ক-১ এবং ঢাকার দিকে ফ্লাঙ্ক-২। মানিক আর সাবু ফ্লাংক-২এ। আমি তখন ব্রিজের চার্জ বসাতে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখলাম মানিকগঞ্জের দিক হতে ছুটে আসছে শত্রু সৈন্যের গাড়ি। ভীত হয়ে পড়লাম। ফ্লাঙ্ক-১ কী করলো? ওরা কী পারলো না ঠেকাতে! আমি দৌড়ে গেলাম ফ্লাঙ্ক-২ এ, দেখি সাবু তার এল এমজি নিয়ে ট্রেঞ্চ এ বসে। দ্রুত ছুটে আসছে শত্রুর গাড়ি। গুলি ছুড়লো সাবু এবং সঙ্গে আরো ক’জন। শত্রুর গাড়ি এখন বেসামাল। ওরা বুঝলো ফাঁদে পড়ে গেছে। তাই বেপরোয়া হয়ে গাড়ি চালিয়ে পালাতে চাচ্ছে ঢাকার দিকে। প্ৰচণ্ড গোলাগুলির মাঝে আমি হঠাৎ লক্ষ করলাম মানিক নেই। আমি চিৎকার করে সাবুকে জিজ্ঞেস করলাম মানিক কোথায়?
সাবু শুধু বললো পানিতে দেখ। সাবু আবার ট্রিগার টিপলো সামনে- শত্রুর গাড়িতে। মানিকের লাশ পানি থেকে তুললাম। তখনো শরীর গরম, বিশ্বাস হয়নি মানিক মারা গেছে। বিশ্বাস আজো হয় না। চোখ বুজলে দেখতে পাই গালভর্তি দাড়ি, হো হো করে হাসছে মানিক। মানিক মরে গেল। আমরা বেঁচে রইলাম। দেশ স্বাধীনতা পেলো। মানিকরা মরে গেলে দেশ স্বাধীনতা পায়। অথচ ওরা স্বাধীনতা দেখে না। না দেখে বোধহয় ভালোই হয়েছে। কারণ স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধার লাশ রাস্তায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকে।
স্বাধীনতা দেখতে চেয়েছিল টিটো। কিশোর টিটো। এক ঝাক বুলেট বুকে নিয়ে সাভারের মাটিতে শুয়ে আছে টিটো। বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে চৌদ্দই ডিসেম্বর টিটো শহীদ হয়।
তেরই ডিসেম্বর ‘৭১। ২৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল হতে পিছু হটে আসছে। তাদের লক্ষ্য ঢাকা। ঢাকার শক্তি বৃদ্ধি করে বোঝাপড়া করা। তেরই ডিসেম্বর ভোর রাত। পূবের আকাশ ফর্সা হয়ে এসেছে।
আমরা আগে থেকে খবর পেয়ে ওঁৎ পেতে বসে আছি, যদি ও জানি শত্রু বাহিনীর অন্যতম দুর্ধর্ষ রেজিমেন্ট এই তেত্রিশ পাঞ্জাব। তবুও আমরা প্রায় চারশত যোদ্ধা নিয়ে ওদের মোকাবেলা করার জন্য বসে আছি সাভারের উপকণ্ঠে। প্ৰায় তিনশত গজব্যাপী অ্যামবুশ। আমি দু’টি এলএমজি এবং সত্তর জন রাইফেলধারী যোদ্ধা নিয়ে মেইন বডিতে। ফ্লাঙ্ক -১ ও ফ্লাঙ্ক-২ এ রয়েছে শতাধিক করে যোদ্ধা কাভার দেয়ার জন্য। রিজার্ভে রয়েছে আরো শতাধিক।
ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইলে মার খাওয়া ক্লান্ত শত্রু সৈন্য ধীরপায়ে এগিয়ে আসছে। মাত্র পঞ্চাশ গজ দূরে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সব শক্ৰ আমাদের তিনশত গজ এম্বুশের ভেতর ঢুকলে তবে গুলি শুরু হবে। কিন্তু চোখের সামনে এত শত্রু দেখে ঠিক থাকতে পারলো না সুবেদার মোহাম্মদ আলী। পুরো শত্রু বাহিনী অ্যামবুশে ঢোকার আগেই গুলি ছুড়লো। ত্বরিতগতিতে পজিশন নিলো শত্রু। শুরু হয়ে গেল প্ৰচণ্ড যুদ্ধ। আমি পরিকল্পনা পরিবর্তন করে ফ্লাঙ্ক-১ কে মূল বডি হিসেবে কাজ করার নির্দেশ দিয়ে মূল বডিতে পেছনে ছুটে নিয়ে এলাম ফ্লাঙ্ক- ১ এর আরো ডানে। এখন আমার অবস্থান ফ্লাঙ্ক-১। দুর্ধর্ষ সেই রেজিমেন্টের সঙ্গে পেরে ওঠা কষ্টসাধ্য। মাঝে মাঝেই ওরা আমাদের অবস্থানকে দু’ভাগে চিড়ে বের হয়ে যেতে চাচ্ছে- আমাদের পেছন দিকে। আমি ফ্লাঙ্ক-২ কে আরো কাছে এসে গুলি করার নির্দেশ দিলাম। পাঞ্জাবিদের মূল মেশিনগান পোস্ট আমরা দেখছি কিন্তু কিছুটা নিচে থাকাতে কায়দা করতে পারছিলাম না। একমাত্র ফ্লাঙ্ক-২ এর পক্ষে সম্ভব ওদের মেশিনগান নিস্তব্ধ করা।
পাশে আরিফকে বললাম তুমি যেয়ে নুরুকে বলো ঐ এমজিম্যানকে খতম করতে। আরিফ কিশোর টিটোকে পাঠালো। টিটো যে আমার পাশেই যুদ্ধ করছে আমি জানি না। কারণ টিটো এত ছোট ছিল যে তাকে আমরা অপারেশনে নিতাম না। ওকে দিয়ে অন্যান্য কাজ করাতাম। টিটো আমাদের সঙ্গে এসেছিল কুমিল্লার মনিঅন্দ থেকে। যেদিন আমরা সাইদাবাদে প্ৰচণ্ড মারা খাই পাক বাহিনীর অর্তকিত আক্রমণে। সেদিন রাতে দেখতে এসেছিলেন অধিনায়ক খালেদ মোশাররফ, ক্যাপ্টেন হালিম এবং আরো অনেকে। সাতাশটি লাশ সাজানো ছিল পাহাড়ের নিচে। খালেদ মোশাররফ এসে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে আমাদের দিকে তাকালেন। তারপর মুখ ফিরিয়ে সামনে দূরে সিএন্ডবি রোড, আরো দূরে তিতাসের দিকে তাকিয়ে থাকলেন অনেকক্ষণ।
সেদিন তিনি কী দেখেছিলেন কে জানে। তার কিছুদিন পয়ে কসবা অঞ্চলে শত্রুর মটারের স্প্লিন্টার এসে তার কপালে বিজয় তিলক এঁকে দিয়ে যায়। খালেদের সেটাই ছিল শেষ যুদ্ধ।
সে রাতে মনিঅন্দে খালেদ আমাদের শুনিয়েছিলেন স্বাধীনতার কথা। মৃত্যুকে অতিক্রম করে কেমন করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে হয় তার কথা আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো সব ভুলে সেই সব কথা শুনেছিলাম। সেই খালেদ স্বাধীন দেশে ‘৭৫ সালে তারই সেনাবাহিনীর হাতে নিহত হন-কারণ স্বাধীনতা এসে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের মরে যেতে হয়। যেমন স্বাধীনতা আনতে হলে মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন দিতে হয়। খালেদ বলতেন-‘স্বাধীন দেশ মৃত যোদ্ধাকে ভালোবাসে।’ মনিঅন্দে সেই রাতে কর্নেল খালেদ ফিরে যাওয়ার সময়, ক্যাপ্টেন হালিম, কিশোর টিটো আর নিজামকে আমাদের সঙ্গে দিয়ে দেন। সেদিন টিটো লাফ দিয়ে উঠে ওপাশের নরুর উদ্দেশে চিৎকার করে জানালো আমার নির্দেশ।
যুদ্ধের নিয়ম সে কিশোর জানতো না। মৃত্যুর কথা তার অজানা। শত্রুর এমজির এক ঝাক গুলি টিটোর বুক চিরে ফেললো। পড়ে গেল টিটো। মাত্র দশ গজ সামনে, টিটো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। আমরা টিটোর কাছে পৌঁছতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু শত্রুর প্ৰচণ্ড গুলিতে এগুনো অসম্ভব।
হঠাৎ দেখলাম দ্রুত এক অপ্রতিরোধ্য গতিতে নুরু পেছন দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে পাক বাহিনীর এমজিম্যানের দিকে। কী অবিশ্বাস্য গতি। মনে হয় মুহুর্তের মধ্যে নুরুর শত্রুর ঠিক পেছনে মাত্র বিশ গজের মধ্যে চলে এল এবং নির্ভুল নিশানায় হত্যা করলো টিটোর ঘাতক তিনজনকে। এই ফাকে আমরা টিটোকে নিরাপদে নিয়ে এলাম। নুরু তখন বেপরোয়া হয়ে সহযোদ্ধাদের নিয়ে একের পর শক্র হনন করছে।
কিশোর টিটোর মৃত্যু নুরুকে পাগল করে দিয়েছে। শত্রু তখন বিচ্ছিন্ন এবং বিপর্যন্ত। আরিফ এবং আরো ক’জন টিটোকে নিয়ে ক্যাম্পে ফিরলো। তাকে চিকিৎসা করা দরকার। তখন ক্যাম্পে আরো পাঁচজন আহত হয়ে ফিরে এসেছে। টিটোর রক্তে ভেসে যাচ্ছে ধূসর উঠান। টিটাে চিৎকার করে বললো-বাচ্চু ভাই, আমি স্বাধীনতা দেখতে চাই। আমাকে বাঁচান। আমি স্বাধীনতা দেখে মরতে চাই।
টিটোকে বাঁচাতে পারিনি। টিটো মরে গেল। টিটো এখন সমাহিত আছে সাভার ডেইরি ফার্মের গেটে। স্বাধীনতা মৃত যোদ্ধাকে ভালোবাসে।
টিটো বাঁচলে কি দেখতো এই স্বাধীনতা? হয়তো দুঃখ পেতো সে। হয়তো চায়ের দোকানে কাজ করতো। কিশোর যুবক হয়ে জীবন লড়াইয়ে নামতো। দেখতো তারই সহযোদ্ধা নিজাম, সুঠাম কালো দীর্ঘদেহী দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা নিজাম স্বাধীনতার পরে ’৭৪ সালে মানিকগঞ্জের রাস্তায় পড়ে মরে থাকলো। নিজামকে রক্ষীবাহিনী গুলি করে মেরেছিল। স্বাধীনতার জন্য টিটোকে মরে যেতে হয়।
স্বাধীনতা পেয়ে গেলে নিজামদের মরে যেতে হয়। আর নুরু? সেই দুর্ধর্ষ নুরু? সে ৩৩ পাঞ্জাবের এক মেজরকে হত্যা করে তার টুপি আমাকে উপহার দিয়েছিল। সে এখন কোথায়? তাও আমি জানি না।
নুরু এক ডাকাতের নাম। ‘৭১-এ যুদ্ধের সময় তাকে ধরে মেরে ফেলতে গিয়েছিলাম। সে প্ৰাণভিক্ষা চেয়ে বলেছিল ‘আমাকে একবার বাঁচার সুযোগ দিন, দেখবেন আমি কেমন করে খান সেনা জবাই করি।’ নুরু তার কথা রেখেছিল। আমরা কথা রাখতে পারিনি। নুরুর কোনও খবর আমি জানি না। জানি না সেই মুন্সির কথা। যে সারারাত মানিক আর টিটোর লাশ বুকে নিয়ে কোরআন খতম করেছিল। সে কোথায়? কোথায় আমাদের সেই আত্মত্যাগী যোদ্ধারা। যারা তাদের কথা রেখেছিল। তারা কি বেঁচে আছে? না মারা গেছে অথবা মৃত্যুর প্রতিক্ষায় আছে।
অথবা আমার মতো রাতে ঘুমহীন, চোখের পাতা এক হয় ঘুম আসে না। ঘুম নেই কিন্তু জেগেও তো নেই। স্বাধীনতা জীবিত গেরিলা চায় না। স্বাধীনতা ভালোবাসে মৃত যোদ্ধাদের।
মানিক, জুয়েল মারা গেলে স্বাধীনতা আসে। স্বাধীনতা এলে মারা যায় মুক্তার নিজামরা। তাই কি আমাদের ঘুম নেই, অথচ জেগেও নেই। কবি শামসুর রাহমান গেরিলা কবিতায় ‘৭১ সালে লিখেছিলেন-
‘তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছে হাত ধরে, পরস্পর
এখন তো সেই ভবিষ্যৎ ঘুম নেই আমার…
লক্ষ যোদ্ধার, মায়ের সন্তানের, প্রেমিকার, স্ত্রীর…
চৌদ্দ কোটি মানুষই কি ঘুমহীন?
ঘুম নেই, অথচ জেগেও তো নেই।