You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৬ই নভেম্বর, শনিবার, ১৯৭৪, ২৯শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

সাফল্যমন্ডিত সফর

মিশর ও কুয়েতে নয় দিনের রাষ্ট্রীয় সফর শেষে গত বৃহস্পতিবার ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেছেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিমান বন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপ করার সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন তাঁর মিশর ও কুয়েত সফর সফল হয়েছে। মিশর ও কুয়েতের জনগণ বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণের জন্য উদ্বিগ্ন। আলাপ করার সময়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, তিনি ভিক্ষা করতে যাননি। বাঙালী একটি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি এবং লাখো মানুষের আত্মদানের মাধ্যমে এই জাতি গঠিত হয়েছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি আছে এবং বন্ধু হিসেবে তারা বাংলাদেশকে সাহায্য করবে।
গভীর আত্মপ্রত্যয়ে উদীপ্ত প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে যে বক্তব্য রেখেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ফীতির আঁচ, খাদ্য সংকট, বন্যা ও নানান সমস্যা সংকটে আজ বাংলাদেশ জর্জরিত। আপাতঃ দৃষিটিতে তাই স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গবন্ধুর এ সফরের সঙ্গে অনেকে অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রশ্নটিকেও টেনে আনতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে যে তা নয় বঙ্গবন্ধুর বক্তব্য থেকেই তা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশ সকল দেশের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রার্থনা করে এটা ঠিকই তবে তা তাঁর নিজস্ব স্বকীয়তা, সত্তা ও স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেছে যে, সকলের বন্ধুত্বই আমাদের কাম্য। জোটনিরপেক্ষ শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানের নীতিতে বাংলাদেশ বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধুর গতিশীল নেতৃত্বের ফলে বাংলাদেশ মাত্র তিন বৎসর সময়ের মধ্যে বিশেষ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আরব বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার মূলে রয়েছে একটি বিশিষ্ট কার্যকারণ। বাংলাদেশের মতো আরব বিশ্বের দেশগুলোও উন্নয়নশীল দেশ। বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের সম্পদ ও কাঁচামাল সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক স্বার্থে যাতে ব্যবহৃত না হয়, সেদিকে উন্নয়নশীল দেশগুলো আজ সচেতন হয়েছে। গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতি তাদের সম্পদ ও কাঁচামাল সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক স্বার্থে যাতে ব্যবহৃত না হয়, যে জন্য তিনি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর এ আহ্বানকে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদানকারী সকলেই সেদিন অভিনন্দন জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তরিকভাবেই কামনা করেন যে, বাংলাদেশ এবং আরব বিশ্ব সহ সকল উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের সার্বিক সাফল্য ও স্বাবলম্বীতা অর্জনের জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতা। মিশর ও কুয়েত সফরকালে বঙ্গবন্ধু পারস্পরিক সাহায্য ও সহযোগিতার কর্মসূচী তথা আন্তর্জাতিক বিষয়াদি নিয়ে নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করেছেন।
বঙ্গবন্ধুর কুয়েত সফরকালেই কুয়েতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে সিমেন্ট কারখানা, তৈল শোধনাগার, সার কারখানা এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পে প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। কুয়েত বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলোর প্রয়োজনীয় কাঁচামাল সংগ্রহের জন্য আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে। কুয়েতের একটি অর্থনৈতিক প্রতিনিধিদল এ মাসেই বাংলাদেশে সফরে আসছেন। এ ছাড়া কুয়েত বাংলাদেশ ব্যাংকে ৬০ লক্ষ কুয়েতী দিনার অর্থাৎ ২ কোটি মার্কিন ডলার জমা রাখার একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। যৌথ উদ্যোগের প্রকল্প সহ বিভিন্ন প্রকল্প নির্ধারণের ব্যাপারে বাংলাদেশ ও মিশরে যুক্ত উপদেষ্টা কমিটিও গঠিত হয়েছে। কাজেই এ সাহায্য ও সহযোগিতা কোনো কৃপা প্রদর্শন নয়। বরং দুই ভ্রাতৃপ্রতীম দেশের একের প্রতি অন্যের দায়িত্ব পালন। এ দায়িত্ববোধে উদ্দীপ্ত হয়েই বাংলাদেশ আরব বিশ্বের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের প্রতি অকুন্ঠ সমর্থন জানিয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও জানাবে। জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভ করার পর বঙ্গবন্ধু’র ইরাক, মিশর ও কুয়েত সফর আরব বিশ্বের নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের প্রতি আন্তরিক ভালোবাসা, শুভেচ্ছা ও সমর্থন জানানোরই প্রতিফলন।

আবার পাটকলে অগ্নিকান্ড

পাট পুড়লে কপাল পোড়ে। কিন্তু এই সর্বনাশা কপাল পোড়ার কবল থেকে কি আমাদের নিষ্কৃতি নেই? গত বৃহস্পতিবার ভোরে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরের মদনগঞ্জে অবস্থিত বাওয়া জুট মিলে দ্বিতীয় দফায় এক মারাত্মক অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়েছে। এই অগ্নিকান্ডের ফলে প্রায় তিন লক্ষাধিক টাকার পাট, পাটজাতদ্রব্য এবং কলের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। বাওয়া জুট মিলের এক নম্বর বেচিং বিভাগ থেকে আগুনের সূত্রপাত। অগ্নিকান্ডের সঠিক কারণ নির্ধারণ করা না গেলেও দমকল বাহিনীর মতে, বৈদ্যুতিক গোলযোগের জন্যই নাকি এই অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়েছে বলে প্রকাশ। জুট মিলে আগুন লাগার খবর পেয়ে দমকল বাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয় এবং বেশ কয়েক ঘন্টা অবিরাম পরিশ্রম করার পর প্রজ্জ্বলিত আগুন নির্বাপণ করা সম্ভব হয়। বর্তমানে এক নম্বর মিলের সব রকম কাজ-কর্ম বন্ধ রয়েছে। কারণ অগ্নিকান্ডের ফলে এক নম্বর মিলটিতে রক্ষিত শুধু কাঁচা পাট এবং পাটজাত দ্রব্যেরই ক্ষতি সাধিত হয়নি; মিল ভবনটিরও প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়েছে। বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা লন্ড ভন্ড হয়েছে এবং এগারোটি মেশিনের যন্ত্রপাতিও হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত। চারটি মেশিন সম্পূর্ণরূপে এবং সাতটি মেশিনের আংশিক বিনষ্ট হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা দরকার যে, বাওয়া জুট মিলে এবারই প্রথম অগ্নিকান্ড সংঘটিত হলো না, বাহাত্তর সালের শেষের দিকেও আরো একবার এই মিলটি অগ্নিকান্ডে বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। বাংলার বাণীর প্রতিবেদনে প্রকাশ, প্রথম অগ্নিকান্ডের ফলে বাওয়া মিলে সাড়ে চার কোটি টাকার পাট এবং অন্যান্য দ্রব্যাদির ক্ষতি হয়েছিল।
পাট কল কিংবা পাট গুদামে অগ্নিকান্ডের খবর আমাদের কাছে নতুন নয়। ইতিপূর্বেও বহুবার বহুভাবে পাট ভস্মীভূত হয়েছে। যখনই পাট পুড়েছে, তখনই প্রকৃত ঘটনা উদ্ধারের জন্য ‘উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় এই যে, আজ অবধি আমরা সুনির্দিষ্টভাবে পাট পোড়ার প্রকৃত হদিস জানতে পারিনি। পাটে আগুন লাগানোর সঙ্গে জড়িত দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি প্রদানের কথাও এ পর্যন্ত শোনা যায়নি। একের পর এক পাট পোড়ার মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটেছে, একের পর এক তদন্ত কমিশন বসানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কখনো জনসমক্ষে তুলে ধরা হয়নি।
বাওয়া জুটমিলে সংঘটিত অগ্নিকান্ডের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্যও হয়তো তদন্ত কমিশন বসানো হবে। কারণ, কোটি কোটি টাকার পাট কি কারণে পুড়ে ছাই হয়ে গেল, তা নির্ণয় করা আবশ্যক। বৈদ্যুতিক গোলযোগই কি এই অগ্নিকান্ডের একমাত্র কারণ, না অন্য কোনো গূঢ় রহস্য এর মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে, তা নির্ণীত করাও সরকারের একান্ত কর্তব্য। বাওয়া জুটমিল একটি রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতি-অবনতির সঙ্গে জাতির ভবিষ্যত জড়িত। শুধু তা-ই নয়, পাট আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আমদানীর অন্যতম প্রধান উৎস। এ পাট, সোনালী আঁশ যদি এমনিভাবে দিনের পর দিন পুড়ে ছাই হতে থাকে তাহলে জাতির ভাগ্যে অমানিশার অন্ধকার ঘনিয়ে উঠা কিছু মাত্র অস্বাভাবিক নয়। অগ্নিকান্ডের ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থের পাটই যে শুধু কবরস্থ হয়েছে তা নয়, বাওয়া জুটমিলে বেশ কয়েকটি মেশিনেরও ঘটেছে মৃত্যু। এবং কয়েকটি মেশিনের যে ক্ষতি সাধিত হয়েছে, সেগুলোকে সারাই করতেও একেবারে নগণ্য অর্থ কিংবা কম ধকল পোহাতে হবে না। তাই আমরা এই অগ্নিকান্ডের মূল কারণ খুঁজে বার করার প্রতি সরকারের মনোযোগার্ষণ করছি। যদি দৈব দুর্ঘটনার ফলে এই অগ্নিকান্ড সংঘটিত না হয়ে থাকে, তাহলে এই অগ্নিকান্ডের নৈপথ্যে কোনো কারসাজি রয়েছে কিনা, তা খুঁটিয়ে তলিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তাও একেবারে অনস্বীকার্য নয়। একের পর এক পাট কলে কিংবা পাটগুদামে অগ্নিকান্ডের ব্যাপারটিকে কোনোক্রমেই স্বাভাবিক কিংবা অনিবার্য বলে আমরা মাথা পেতে মেনে নিতে পারি না। সত্য সন্ধানীর মতো অনুসন্ধান করলে হয়তো ঝুলির বিড়াল বেরিয়ে যাওয়াও বিচিত্র কিছু নয়। তাই আমরা পাটকলে অগ্নিকান্ডের ঘটনাকে কিছুতেই সহজিয়া পন্থায় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য বলে ভাবতে পারিনা। আমরা জানতে চাই, পাট কলে অগ্নিকান্ডের প্রকৃত কারণ কি। বার বার এ ধরনের অগ্নিকান্ড আমাদের মনকে সন্দেহ যুক্ত করে তুলেছে। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিশন গঠন করে বাওয়া জুট মিলের অগ্নিকান্ডের মূল কারণ বের করা হোক এটাই আমাদের কাম্য। দোষী ব্যক্তিদের শাস্তিবিধানের ব্যবস্থা করলে ভবিষ্যতে পাটে আগুনের মতো গর্হিত ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা সম্ভব বলেই আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!