You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.05.16 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | সার ও কীটনাশক ওষুধে ভেজাল | সমস্যা জর্জরিত চা-শিল্প | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৬ই মে, বৃহস্পতিবার, ২রা জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

সার ও কীটনাশক ওষুধে ভেজাল

ভেজালের দৌরাত্ম্য সর্বত্র। খাদ্যে ভেজাল। ওষুধে ভেজাল। ভেজাল ছাড়া পণ্য সামগ্রী খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু এই ভেজালের দূরত্ব যে শেষপর্যন্ত সার ও কীটনাশক ওষুধের বর্তাবে তা ছিল অকল্পনীয়। কিন্তু সে কাজটিও শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যে।
গত বুধবার স্থানীয় একটি দৈনিকে এই ভেজাল সংক্রান্ত একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদে বলা হয়েছে যে, ভেজাল মিশ্রিত সার ও কীটনাশক ওষুধ ব্যবহারের ফলে পিরোজপুর মহাকুমার শতকরা ৫০ ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।
অভিযোগে প্রকাশ, সারের সঙ্গে লবণ মেশানোর ফলে ওই সার প্রয়োগ করার পর সবুজ ক্ষেত বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। লাল কেরোসিন ও অন্যান্য দ্রব্য মেশানো দরুন কীটনাশক ওষুধ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। কাজেই ভেজাল ওষুধের কীটপতঙ্গের থেকে ফসল রক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া রয়েছে সার ওজনে কম দেয়ার প্রবণতা। জানা গেছে, সমগ্র বরিশাল জেলায় দেড় লক্ষ একর জমিতে চাষ করা হয়েছিল কিন্তু পোকার আক্রমণে ৫০ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে।
একদিকে পোকার আক্রমণ অন্যদিকে ভেজাল সার। সারে ভেজাল দেবার পদ্ধতিও অভিনব। সাদা রং সারে (ইউরিয়া) সাদা লবণ এবং লাল রং সারে (ফসফেট) লবণের মিশ্রণ চলছে অবাধে। সারের মণ ৪০ টাকা আর লবণের মণ ১৫ টাকা সুতরাং প্রতি মাসে ৫ থেকে ১০ সের লবণ মেশানোটা এমন কিছু কঠিন কাজ নয়। বাস্তবে হচ্ছে ও তাই।
কথায় বলে, সর্ব অঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেবো কিসে। বর্তমানের অবস্থা দাঁড়িয়েছে তাই। একথা কারো অজানা নয় যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। খাদ্য আমদানি করতে মোটা অংকের বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হচ্ছে। শুধু তাই নয় টাকা থাকলেও অনেক সময় খাদ্যশস্য পাওয়া যায় না। এহেন অবস্থাতে খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। অন্ততঃ বাস্তব অবস্থা সে কথাই বলে। আর সে দিক লক্ষ্য রেখেই কৃষিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। সবুজ বিপ্লবকে সার্থক করে তোলার জন্য চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিন্তু এই চেষ্টার কতটুকু অগ্রগতি হচ্ছে সেদিকে কি সংশ্লিষ্ট দপ্তর দৃষ্টি রাখছেন? যদি তাই হতো তাহলে অভিযোগের মাত্রা কমতো বলেই আমাদের ধারণা। আমরা যতদূর জানি, মফস্বলের বিভিন্ন এলাকায় সরকার মনোনীত ডিলার অথবা কৃষি অফিস সার ও কীটনাশক ঔষধ বিতরণ করে থাকেন। যদি ভেজাল দেয় তাহলে সে ভেজাল বাইরের লোক দিচ্ছে না–দিচ্ছে সরকারি কর্মচারী অথবা সরকারের তালিকাভুক্ত ডিলাররা। কাজেই এসব অসাধু ব্যক্তি দের শায়েস্তা করার দায়িত্ব বর্তায় সরকারের উপর। সরকার যদি, এইসব অসাধু ব্যবসায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে না পারেন তাহলে যে সবুজ বিপ্লবের ভবিষ্যৎ অন্ধকার এ কথা আর বিস্তারিতভাবে বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না।

সমস্যা জর্জরিত চা-শিল্প

বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান অর্থকরী ফসল হলো চা। পাটের পরেই চা-এর স্থান। এই চা রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। সে হল সম্ভাবনা। কিন্তু কার্যতঃ আমরা এখন চা শিল্পে লোকসানের অংকটাই দেখছি। পত্রিকান্তরের খবরে প্রকাশ, গত বছরের মতো চলতি বছরে প্রায় কোটি টাকার নষ্ট হতে চলেছে এবং চা শিল্প প্রায় ধ্বংসের মুখে।
বাংলাদেশের প্রায় দেড়শতাধিক (মতান্তরে ১৪৭টি বা ১৫২টি) চা বাগান আছে। উচ্চপর্যায়ের প্রতিবেদনে প্রকাশ, স্বাধীনতার পরেও ১৯৭২-৭৩ সালে ৫ কোটি ৩ লক্ষ পাউন্ড এবং ১৯৭৩-৭৪ সালে ৬ কোটি ১ লক্ষ পাউন্ড চা উৎপাদিত হয়েছে। এবং সর্বশেষ মৌসুমে বাংলাদেশ ৫ কোটি ১ লক্ষ পাউন্ড চা বিদেশে রপ্তানি করেছে। নিঃসন্দেহে ওই রপ্তানিকৃত চা থেকে আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছি।
সংশ্লিষ্ট মহল সূত্রে প্রকাশ, চা সংরক্ষণের জন্য বছরে প্রায় সাত লক্ষ চা বাক্সের প্রয়োজন। স্বাধীনতার পূর্বে দেশের চারটি কারখানাই এই চাহিদা মোটামুটি মিটিয়ে ফেলত। এখন চা বাক্সও আমদানি করতে হয়। এবং এ ব্যাপারে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ রয়েছে। কিন্তু সেই বাক্স আমদানিতেও নৈরাজ্য। ফলে সংরক্ষণের অভাবে এই দামী সম্পদ দেশে প্রচুর পরিমাণে নষ্ট হচ্ছে। এতো গেল ব্যবসায়িক ক্ষতির দিক। একে অস্থায়ী দিকও বলা যায়। স্থায়ী ক্ষতি হচ্ছে চা বাগানগুলোতে। সংস্কার করা হয়নি, উন্নতি করা হয়নি, বাগান সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয়া বা স্বল্প ব্যয়ে উন্নত মানের চা উৎপাদনের জন্য কোন পদক্ষেপ এবং সুচিন্তিত পরিকল্পনাও রাখা হয়নি। যেন এই লাভজনক ও অর্থকরী ফসলের ব্যাপারে কেমন একটা উদাসীন ভাব। তার ওপর দেড়শতাধিক চা বাগানের সম্মিলিত আয়তন ২ লাখ ৭৯ হাজার একশত ৮৭ একর ভূমির মধ্যে মাত্র ১ লক্ষ ৬ হাজার একর ভূমিতে চা গাছ রয়েছে। বাকি জমি অনাবাদি পড়ে থাকে। প্রসঙ্গতঃ বলা যায়, বাগানগুলির মালিকানাও বিভিন্ন প্রকার। কোন বাগান সরকার নিয়ন্ত্রিত, কোন বাগান বিদেশি মালিকানা এবং কিছু সংখ্যক ব্যক্তিগত মালিকানায় চিহ্নিত। এছাড়াও চা শিল্পে অবনতির প্রশ্নের শ্রমিক সমস্যার কথা আছে। চা বাগানগুলোতে যে ১ লক্ষ ২০ হাজার শ্রমিক কাজ করে তাদের উপর নির্ভর করে ৩ লক্ষ ক্ষুধার্ত মানুষ। চা শিল্পে ভাটা পড়লেও শ্রমিকরা বেকার হয়ে যাবে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষ অকাল অনাহার ও দুর্দশার মধ্যে পড়বে। মানবিক দিক দিয়েও তা বন্দিত্ব হতে পারে না।
আমরা জাতীয় উন্নতি ও সমৃদ্ধি এবং সবুজ বিপ্লব তথা কৃষি বিপ্লব নিয়ে যে আলোচনা করছি তার প্রেক্ষিতে দেখছি চা বাগানের সংস্কার নেই, যা সংরক্ষণের বাক্স সময়মত সরবরাহ করা হয় না, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে এবং সার্বিকভাবে চা শিল্প সংকটাপন্ন হচ্ছে এই সবুজ বিপ্লবের প্রমাণ? উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতীয় সম্পদের অপচয় নয়ই বরং সেই সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। কারণ, এই সম্পদই দেশকে বাঁচাতে পারে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে চা শিল্প সম্বন্ধে এযাবত পত্রপত্রিকায় প্রচুর লেখালেখিও হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মহলের চৈতন্য উদয় হয়েছে কিনা বোঝা যায়নি।
পরিশেষে তাই আমরা বলতে চাই, চা শিল্প সম্বন্ধে সংশ্লিষ্ট মহল সচেতন হোন। অতএব মালিকানার বিভ্রান্তি দূর করে বাগানগুলোর সম্প্রসারণ ও সংস্কার সাধন করা হোক। সরকারের সাম্প্রতিক শিল্পনীতির সুযোগ সুবিধাগুলি চা উৎপাদনকারী দেশ দিয়ে তাদের চা উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া হোক। এবং চা-বাগানের পাশাপাশি ওই একই খরচে লেবু, আনারস, তুলা, গোলমরিচ, রবার (এগুলো প্রধানত পাহাড়ি অঞ্চলেরই চাষ) চাষ করলে যে একদিকে উৎপাদন খরচ হ্রাস অন্যদিকে অন্যান্য মূল্যবান ফসলও পাওয়া যাবে, সেদিকেও চিন্তা রাখা হোক। সর্বোপরি সংরক্ষণের ব্যাপারে কৈফত বন্ধ করে সময়মতো চা বাক্স আনা নয়তো দেশেই তা তৈরি করার পদক্ষেপ নেয়া হোক। মোদ্দাকথা সমস্যা ও সংকটে জর্জরিত চা শিল্পকে বাঁচানো প্রয়োজন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন