বাংলার বাণী
ঢাকা : ১লা নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৩, ১৫ই কার্তিক, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
যৌথ এশীয় শান্তি-নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজন অপরিসীম
মস্কোতে বিশ্বশান্তি সম্মেলন শুরু হয়েছে গত পঁচিশে অক্টোবর হতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ মহাসম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেছে। এর উদ্বোধন করেছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক লিওনিদ ব্রেজনেভ। কমরেড ব্রেজনেভ উদ্বোধনী বক্তব্য দিতে বিলম্ব করেছিলেন মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে অত্যধিক ব্যস্ত থাকার দরুণ। পরে তিনি তাঁর মহামূল্যবান বক্তৃতা করেছেন বিশ্ব কংগ্রেসের অধিবেশনে। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যা সম্পকে তিনি তাঁর মতামত প্রকাশ করেছেন। পৃথিবীর বিভিন্ন মহাদেশ, উপমহাদেশ ও অঞ্চল সম্পর্কেও তিনি মতামত ব্যক্ত করেছেন। এশিয়া মহাদেশের সমস্যা ও এর সমাধান সম্পর্কে কমরেড ব্রেজনেভ আলোকপাত করেছেন। সর্বোপরি যৌথ এশীয় শান্তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার প্রতিও তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন। এশীয় যৌথ নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘এশিয়ার যৌথ নিরাপত্তা প্রচেষ্টার মাধ্যমে যে সকল কর্মসূচী গৃহীত হবে তা অবশ্যই চীনের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবেনা।’ এ ব্যাপারে যে প্রোপাগান্ডা রয়েছে তিনি তার কথা উল্লেখ করে জোরের সঙ্গে বলেন—‘চীনকে অংশ গ্রহণ করতে না দেওয়া বা ‘বিচ্ছিন্ন’ করে রাখার ব্যাপারে আজ পর্যন্ত কেউ কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করেনি। সোভিয়েত ইউনিয়ন এশীয় নিরাপত্তা সুদৃঢ়করণের ব্যবস্থার ক্ষেত্রে গণপ্রজাতান্ত্রিক চীনের অংশ গ্রহণের প্রতিও স্বাগত জানাবে।’ বস্তুতঃপক্ষে এশীয় শান্তি নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্যে বাংলাদেশের আগ্রহ ও উদ্যোগ কোনো অংশেই কম নেই। জন্মের পর থেকেই বাংলাদেশ এশীয় যৌথ নিরাপত্তার জন্যে তার সুস্পষ্ট বক্তব্য রেখেছে। এ ব্যাপারে মহান ভারতের উদ্যোগও স্মরণীয়। এতদসত্ত্বেও এশিয়ার যৌথ নিরাপত্তার প্রশ্নে গণপ্রজাতান্ত্রিক চীনের অংশ গ্রহণকে আমরাও অস্বীকার করি না। তবে অবশ্যই চীনকে শান্তি ও সহযোগিতার বাস্তব মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। চীনের মনোভাব সম্পর্কে কমরেড ব্রেজনেভ আরো বলেছেন—‘আন্তর্জাতিক আবহাওয়া দূষিতকরণ ও আন্তর্জাতিক উত্তেজনা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা থেকে চীন বিরত থাকতে অস্বীকার করেছে। তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি ভূ-খন্ড সংক্রান্ত অবাস্তব দাবীও জানিয়ে চলেছে। এখানে মূলতঃ লক্ষণীয় হচ্ছে চীনা নেতৃবৃন্দের বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে মৌলনীতির অভাব। তারা বলেন, তারা সমাজতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্যে কাজ করছেন। কিন্তু বাস্তবে কংগ্রেসের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর আন্তর্জাতিক মর্যাদা ক্ষুন্ন করার এবং আগ্রাসী সামরিক জোট ও ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের ঘনিষ্ঠ অর্থনৈতিক গোষ্ঠীর শক্তিবৃদ্ধির ক্ষেত্রে উৎসাহ দানের পথ অনুসরণ করে চলেছেন।’ বিশ্বশান্তি কংগ্রেসের এ অধিবেশন বর্তমান বিশ্বের রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির মানদন্ডে অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। তাছাড়া কমরেড ব্রেজনেভের ভাষণের আন্তর্জাতিক মূল্যায়নও অত্যন্ত সারগর্ভ। বিশ্বের সকল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বশান্তি কংগ্রেস সোচ্চার। তাদের শান্তির সংগ্রাম পৃথিবীর নিপীড়িত নির্যাতিত মুক্তিকামী মানুষের স্বপক্ষে। এ সংগ্রাম চালিয়ে নিতে কংগ্রেসে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো বদ্ধপরিকর। বিভিন্ন মহাদেশীয় ও উপমহাদেশীয় সমস্যা ও তার সমাধান সম্পর্কে কংগ্রেসে আলোচনা হয়েছে। আমাদের এশিয়া মহাদেশের প্রশ্নটিও সেখানে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে। এশিয়ার মানুষের ভাগ্যে ও তার প্রগতির জন্যে এশিয়াবাসীই চিন্তা করবে। এর জন্যে যৌথ এশীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার আবশ্যকতা অত্যন্ত বেশী প্রয়োজন। বাংলাদেশ তার জন্মলগ্ন থেকেই সে মতামত ব্যক্ত করেছে। সম্প্রতি আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাপান সফরে গিয়েও এশীয় যৌথ নিরাপত্তার কথা জোর দিয়ে উল্লেখ করেছিলেন। বাংলাদেশের জন্ম ও ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর পরিপ্রেক্ষিতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তথা গোটা এশিয়ার যৌথ নিরাপত্তার প্রশ্নটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনার অপেক্ষা রাখে বলে আমরা মনে করি। এশিয়ায় শান্তি ও সহযোগিতা বৃদ্ধির ব্যাপারে এই দু’টি দেশের ভূমিকা পূর্বের চেয়ে আরও জোরদার হবে বলেও আমাদের বিশ্বাস। এশিয়ার প্রতিটি দেশকে তাই এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করার সংগ্রামে যৌথভাবে এগিয়ে আসার উপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করি।
বাংলার প্রতি অনীহা দূর করুন
শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা তথা বাংলা ভাষায় উচ্চশিক্ষা দানের দাবীটি বহুদিন আগেই স্বীকৃতি হয়েছিলো। স্বাধীনতার আগে উপনিবেশবাদী পাকিস্তানী শাসকরাও বাঙালীর এই প্রাণের দাবীর কাছে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে এবং উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম সহ জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহারই অন্যতম জাতীয় আদর্শ ও মূলনীতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও বাংলাকে উচ্চ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে, সরকারী বেসরকারী পর্যায়ের সর্বত্র অফিস-আদালতে বাংলা চালু করতে তথা জাতীয় জীবনের সর্বত্র বাংলার অবাধ গতি করতে দেশের মানুষের যত আগ্রহ আর উদ্যম থাকুক না কেন একশ্রেণীর উচ্চশিক্ষিত লোক, যাদের বেশীর ভাগই সচিবালয়ের বড় বড় চেয়ারগুলো দখল করে রয়েছেন, তাঁদের আন্তরিক অনীহা আর অবজ্ঞার সব কিছুই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে। কেননা বিজাতীয় চেতনায় এরা উদ্বদ্ধ, জাতীয়তাবোধ ও জাতীয় চেতনা তাই এখনো এদের কাছে ‘দুর্বোধ্য’।
অন্যদিকে জাতীয় ভাষাকে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে পরিস্ফূটিত করে তোলার দায়িত্বের সিংহভাগ কিন্তু শিক্ষা দপ্তর তথা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ও শিক্ষা বোর্ডগুলোর উপর বর্তায়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা বোর্ডগুলো কি সেই দায়িত্ব পরিপূর্ণভাবে পালনে তৎপর? বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলেও শিক্ষা বোর্ডের কার্যকর আসনে যারা অধিষ্ঠিত হন, তারাও অবশ্য সচিবালয় থেকেই আসেন। তাই এই শিথিলতা কিনা কে জানে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, মাতৃভাষায় উচ্চ শিক্ষার হার সবার জন্যে খুলে দেওয়ার প্রয়োজনে পর্যাপ্ত বই চাই। স্বাধীন বাংলাদেশে গত দু’বছরে আজো উচ্চশিক্ষার জন্যে প্রার্থিত সংখ্যক বাংলা পাঠ্য পুস্তক প্রকাশের কোন উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। ফলে মাতৃভাষায় উচ্চ শিক্ষার দ্বার কাগজে কলমে খুলে দেওয়া হলেও বাস্তবে তা বন্ধই থেকে যাচ্ছে। একশ্রেণীর লোকের টালবাহানা এবং পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বাংলা পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক ছাত্র-ছাত্রীরা প্রয়োজনীয় বই পাচ্ছেন না। স্বাধীনতার কয়েক বছর আগ থেকেই বাংলা মাধ্যমে উচ্চ মাধ্যমিক ও ডিগ্রী ক্লাশে পড়াশোনা শুরু হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর এদিকটায় ছাত্র-ছাত্রীদের উৎসাহ আরো অনেক গুণ বেড়েছে। কিন্তু তাতে করে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার ক্ষেত্রে এখন সংকটের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কেননা কলেজের ডিগ্রী ক্লাশে যারা বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে এসেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে হঠাৎ ইংরেজীর মোকাবেলা করতে গিয়ে তাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পড়াশোনা করাটাও অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তবে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করাটাকে অনেকটা ঐচ্ছিক করে তোলা হয়েছে। যাঁরা বাংলা মাধ্যমে পড়তে চান তাঁদের সেই সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু পাঠ্য বই না থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের ভীষণ দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়। এমতাবস্থায় বাংলা ভাষার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংখ্যক পাঠ্য বই প্রকাশনার জন্যে একটি কেন্দ্রীয় সেল গঠন করা উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে অগ্রণী হতে হবে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই কেন্দ্রীয় সেলকে সহযোগিতা করার জন্যে উপসেল গঠন করতে হবে এবং এই সেল বাংলায় সকল বিষয়ের পুস্তক প্রণয়ন ছাড়াও অফিস-আদালতে বাংলাকে সার্বিক চালু করার জন্যে কাজ করবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক