You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বানী
ঢাকাঃ ১৮ই সেপ্টেম্বর, বুধবার, ২রা আশ্বিন, ১৩৮০

আরো কিছু মৃত্যুঃ আমাদের লজ্জা

যোগাযোগমন্ত্রী যাই বলুন দুর্ঘটনাটি মারাত্মক। শতাধিক লোক নিহত হবার খবর বেরিয়েছে। আহতের সংখ্যা নিরূপণ করা যায়নি। সরেজমিনে অবস্থাটা তদন্ত করে দেখবার জন্য রেলওয়ের বড় কর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শনে গিয়েছেন। এদের মধ্যে জানা গিয়েছে যে সিগন্যালম্যান এর কাজে শৈথিল্য প্রদর্শন এর জন্যই নাকি এত বড় একটা ট্রেন দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জ গামী একটি মালবাহী ট্রেনের সঙ্গে সিরাজগঞ্জ থেকে ঈশ্বরদী গামী একটি যাত্রীবাহী ট্রেনের সংঘর্ষে প্রথমটির দুটো সেলুন এবং দ্বিতীয়টির তিনটি বগি সম্পূর্ণ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়।
দুর্ঘটনা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের একটা রুটিনের মত হয়ে পড়লেও গত পরশুর ট্রেন দুর্ঘটনা গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে সাধারণ মানুষের মনে। লঞ্চ দুর্ঘটনা, বাস দুর্ঘটনা এবং রাস্তায় বগীর নিচে মানুষের চাপা পড়া -এগুলি আর আমাদের মনে দাগ কাটে না। কিন্তু একবার কি দায়িত্বশীল কর্তাব্যক্তিরা ভেবে দেখেছেন প্রতিদিনকার ডাকাতি, খুন, গুপ্তহত্যার সঙ্গে এই দুর্ঘটনার খবর গুলো মিশে মানুষের মনে নিরাপত্তাহীনতার কি বিষ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। হিসেব করে কি তারা দেখেছেন ব্যক্তিবিশেষের কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় জাতীয় সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। যে মানুষগুলো একেবারে খামাখা মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের পরিবারকে কোন ভাষায় সান্তনা দেবার কথা তারা ভাবছেন?
জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে যে একটা ‘খেলা খেলা’ মনোভাবের প্রতিফলন ঘটছে তার অবসানের জন্য সরকারকে এবং দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সচেতন হতে আমরা আহ্বান জানাই। প্রতিটি মানুষের স্বাভাবিক মৃত্যু যেমন অবশ্যম্ভাবী তেমনি প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তার প্রতি দৃষ্টি রাখার দায়িত্বও সমাজের। প্রোটিনের অভাবে কত শিশু কঙ্কালসার হয়ে পড়ছে, কত মানুষ চিকিৎসার অভাবে অকালে প্রাণ হারাচ্ছে, এ নিয়ে সেমিনারে তো কথার খই ছিটাবার লোকের অভাব নেই; কিন্তু দিনে দিনে যে তরতাজা মানুষগুলোর গুটিকয়েক লোকের খামখেয়ালি আর কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় মৃত্যুবরণ করেছেন তাদের সম্পর্কে কি কার্যকর কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়না। বাংলাদেশ ছাড়া আর কয়টি দেশে এমন দুর্ঘটনা আর অস্বাভাবিক মৃত্যুর মিলবে।
যারা মারা গেছেন তাদের পরিবারবর্গকে আমরা কি সান্ত্বনা জোগাবো শুধু ছোট মাথায় লজ্জাকে বুকে ধরে সমাজের হয়ে নিজেদের অক্ষমতায় ক্ষমা প্রার্থনা ছড়া? আমরা তাই করছি সমাজের এই নির্বিকার অতা আর স্বেচ্ছাচারিতার মাশুল জোগাতে আরো কত ব্যক্তিকে যেমন প্রাণ দিতে হয় কে জানে?

এ ভেলকির নায়ক কারা!

অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে যে, রাজধানীর অধিকাংশ রেশন দোকান গত দুই সপ্তাহ ধরে গ্রাহকদের মধ্যে চাল ও ভোজ্য তেল সরবরাহ করছে না। দোকান গুলো সপ্তাহের শুরুতে দু-একদিন গ্রাহকদের মধ্যে চাল সরবরাহ করে পরে বন্ধ করে দিচ্ছে। আবার কোন কোন রেশনের দোকান সপ্তাহের মাঝামাঝি একটা দিনে সামান্য পরিমাণ চাল গ্রাহকদের মধ্যে নামেমাত্র সরবরাহ করে তা বন্ধ করে দিচ্ছে। তাছাড়া শহরের বেশ কিছুসংখ্যক রেশন দোকান গ্রাহকদের মধ্যে সারা সপ্তাহে একেবারেই চাল সরবরাহ করছে না। ফলে নাগরিক সাধারণের মধ্যে চরম বিক্ষোভ দেখা যাচ্ছে।
চাল ও তেল সরবরাহে এই অনিয়মের কৈফিয়তস্বরূপ রেশন দোকানদাররা গ্রাহকদের জানিয়ে দিচ্ছে যে, সপ্তাহের বরাদ্দকৃত পরিমাণ জিনিস তারা পাচ্ছে না।
এরই প্রেক্ষিতে অনুসন্ধান করে রেশনিং অফিসের জনৈক কর্মকর্তার কাছ থেকে জানা গেছে, খাদ্য বিভাগের সরকারী গুদামগুলোতে চাহিদামাফিক চাল মওজুত নেই। সূত্র থেকে আরো জানা যায়, শহরে প্রতি সপ্তাহের যেখানে প্রায় ৪০ হাজার মণ রেশনের চাল নাগরিকদের মধ্যে সরবরাহ করতে হয় সেখানে এখন ২০ হাজার মণ চাল রেশন দোকান গুলোতে তারা সরবরাহ করছেন। কারণ চালের অভাব রয়েছে। ভোজ্য তেলেরও সেই অবস্থা।
এহেন অবস্থায় নাগরিক সাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি এসেছে। কারণ সংশ্লিষ্ট সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষদের সংবাদ সূত্রে জানানো হচ্ছে, দেশে বাড়তি খাদ্য রয়েছে এবং আগামী ফসলের সময় পর্যন্ত সঞ্চিত খাদ্য ভাণ্ডারে ঘাটতি পড়বে না। অনাদিকে রেশনিং কর্তৃপক্ষ জানানো হচ্ছে যে, তাঁরা দোকানগুলোর বরাদ্দকৃত চাল ও তেল সরবরাহ করতে পারছেন না। অথচ জনসাধারণের কাছে এই উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্বন্ধে তারা কিছু বলছেনও না। আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে চাল ঢাকায় এসে পৌঁছুবে কিনা কতৃপক্ষ তাও নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। মাঝখান থেকে নির্দোষ জনগণ একটা ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে অসহায় বোধ করছে এবং অক্ষম আক্রোশে রেশনের দোকানে নিত্য বচসা করছে।
ঘোলা পানিতে মাছ মারা যাদের অভ্যাস, তারা এই সুযোগে আরো তৎপর হয়ে উঠেছে। দোকানে সরবরাহ কম -এই অজুহাতে দু-একদিন রেশনে চাল সরবরাহ করে তা বন্ধ করে দিয়ে অবশিষ্ট চাল ব্যবসায়ীদের কাছে চড়া দামে বিক্রি করে দোকানদাররা বেশ দু’পয়সা কামাই করছে।
এখন প্রশ্ন হ’লো -একদিকে চাল উদ্বৃত্ত আছে এবং অন্যদিকে চাল নেই এমন অবস্থার উদ্ভব হলো কি করে? যদি বা এই পরিস্থিতি উদ্ভবের কোন যথাযথ কারণ থেকেও থাকে তবে তা লুকিয়ে রেখে সমস্ত পরিস্থিতিকে এমন করে ঘুলিয়ে তুলে একশ্রেণীর অসাধু মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের সামনে কালোবাজারির পথ খুলে দেওয়ার আবশ্যকতা কি? এমন নাজুক পরিস্থিতির উদ্ভব প্রাক্কালে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি কেন? সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা, খামখেয়ালিপনা এবং অহেতুক দায়িত্বজ্ঞানহীনতা ও কর্মবিমুখতার ফলে লক্ষ লক্ষ নাগরিক আজ অর্ধাহার ও অনাহারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এমনিভাবে দেশের প্রতিটি সমস্যাকে যারা অধিকতর দুরূহ, দুর্বিষহ ও জটিলতর করে তুলে নাগরিক জীবনের চরম সমস্যা ও সংকটের সৃষ্টি করছে সেসব ভেলকিবাজ দের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক

গত সোমবার থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ও হল সংসদগুলোর নির্বাচনও স্থগিত রাখা হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য। উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল চাকসুর আসন্ন নির্বাচনে অংশগ্রহণের ছাত্রসংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনার পর এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। বলা হয়েছে যে, উপাচার্য উক্ত আলোচনাকালে নির্বাচনের সময় শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে ছাত্র নেতৃবৃন্দের সাথে মতৈক্যে উপনীত হতে পারেননি তাই এ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, চাকসুর সভাপতি হিসেবে উপাচার্য সাহেব কার্যকাল শেষ হয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে বর্তমান চাকসুও বাতিল ঘোষণা করেছেন।
উপাচার্যের এসব ঘটনায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র-ছাত্রী ক্ষুব্ধ হয়েছেন। প্রতিবাদ জানানো হয়েছে তাদের সকলের পক্ষ থেকেই। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সোমবার বিকেলেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এক প্রতিবাদ সভায় মিলিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় খোলা ও ২৭শে সেপ্টেম্বর পূর্ব নির্ধারিত তারিখ অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানিয়েছেন। রব-বাদী ছাত্রসংগঠন, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন সহ অন্যান্য ছাত্র সংগঠনও সেই একই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন।
বস্তুতঃ নির্বাচনের মুখে উপাচার্যের এহেন ব্যবস্থাগ্রহণ সকল মহলকেই বিক্ষুব্ধ ও উদ্বিগ্ন করেছে। নিতান্ত অগণতান্ত্রিক পন্থায় ও মানসিকতার বশবর্তী হয়েই এহেন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তা’ছাড়া রমজানের বন্ধ ও সমাগত। রমজান আসার আগেই এহেন পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে উপাচার্য অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টির উদ্যোগ নিয়েছেন মাত্র। এতেই বোঝানো হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্বাভাবিকতার টিকিয়ে রাখতে সম্পূর্ণরূপে ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। জনমনে তাই অতি স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন দেখা দেবে।
অন্যদিকে নির্বাচনকালীন গোলমাল হবার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেখানে সামগ্রিক পরিস্থিতি আয়ত্তে এনে বিশ্ববিদ্যালয় খুলেছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এহেন ঘোষণা অজানা হুমকির কাছে নতি স্বীকার এর মানসিকতা পূর্ণ নয় কি? এতে কি প্রমাণিত হয় না যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য স্বায়ত্বশাসন ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে পারছেন না এবং পূর্ণ অযোগ্যতারও প্রমাণ দিচ্ছেন। আমরা দাবী করব অবিলম্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় খোলা হোক ও যথারীতি নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হোক।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!