You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুজিবনগরে গােপন আলােচনা এবং ‘৭৫-এর ঘটনাবলী সম্পর্কে আরাে কিছু তথ্য
[সাংবাদিক লরেন্স লিফসুজ স্বীয় রচিত বাংলাদেশ : দি আনফিনিশড রেভলিউশন’ গ্রন্থে ১৯৭১-এর মুজিবনগর এবং ১৯৭৫-এর ঢাকার ঘটনাবলী। সম্পর্কে আরও কিছু অর্থবহ বিবরণ দান করেছেন। এখানে তার অংশবিশেষ উপস্থাপন করা হলাে ।-লেখক]
“…১৯৭৫-এর সহিংস তৎপরতার প্রেক্ষিতে, বিশেষত মুজিব উৎখাত অভ্যুত্থানের কথা বিবেচনায় রাখলে, ১৯৭১ সালের ঘটনাবলীর গুরুত্ব অপরিসীম। ১৯৭১ সালে কোলকাতা এবং অন্যত্র বাঙালি কর্মকর্তাদের সাথে ৮টি গােপন যােগাযােগের অস্তিত্ব সম্বন্ধে যে সংবাদ আমরা পেয়েছিলাম, উর্ধ্বতন মার্কিন কর্মকর্তাদের সাথে কার্নেগির সাক্ষাৎকারে তা তর্কাতীতভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বাঙালি নেতৃত্বের যে অংশ পাকিস্তানের বিবেচনায় দেশদ্রোহীতার অপরাধে অপরাধী নয়, তার সাথে সামরিক জান্তার মধ্যস্থতার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র পরীক্ষামূলকভাবে চেষ্টা চালায়। কোলকাতার এসব আলােচনায় কী কী বিষয় নিয়ে কথা হয়, কারাই বা অংশ নিয়েছিলেন, এসব আজও গােপনীয় তথ্য হিসাবে বিবেচিত। কিন্তু কোলকাতার ঘটনাবলী সম্বন্ধে খুব ভালােভাবে ওয়াকিফহাল সূত্রসমূহ দাবি করেন যে, আটটি যােগাযােগই মােস্তাকের রাজনৈতিক চক্রের সাথে করা হয়েছিল। এসব সূত্রের মধ্যে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও মােশতাকের তৎকালীন কর্মচারীরা অন্তর্ভুক্ত। এটই গােপন যােগাযোেগসমূহের অধিকাংশ কোলকাতায় হয়েছিল বলে জানা গেলেও এর বাইরেও যােগাযােগ হয়েছিল বলে শােনা যায়। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের গােয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কার্নেগি গবেষকদের জানান, উনি (কিসিঞ্জার) বাঙালি প্রতিনিধিদের সাথে সরাসরি কথা বলেছেন।” সে সময় মােশতাক অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। তাই মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে তার সাথে আলাপ আলােচনা করাটা আপাত দৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হয়।
কিন্তু ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তখন বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মধ্যে বহু উপদলের প্রবণতা ছিল। তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিসিঞ্জারের অভিমত ছিল তাঁকে পাশ কাটিয়ে আলােচনা হােক। মার্কিন মদদপুষ্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তি সংগ্রামে তিনি (তাজউদ্দিন) রুশ-ভারতের সাথে মৈত্রীর কৌশলগত প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করেছিলেন। অথচ এজন্য তাঁকে সােভিয়েত ঘেঁষা ও ভারত ঘেঁষা মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে তাজউদ্দিন শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। নির্বাচনের ফল অনুযায়ী মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার কথা। কিন্তু ৭১-এর মার্চে পাকিস্তান তা মানতে অস্বীকার করে এবং সেই সাথে বর্বর নির্যাতনের ভয়াবহ মাত্রা—এসব বিবেচনা অস্থায়ী সরকারের সিদ্ধান্তকে ইস্পাতকঠিন ও তর্কাতীত করে তােলে।  আর পেছন ফেরা নয়, বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনাে আলােচনা নয়। স্বাধীনতার ব্যাপারে তাজউদ্দিন ও প্রায় সমগ্র বাঙালি নেতৃত্বের মনােভাব ছিল আপােসহীন। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, যারা যুদ্ধক্ষেত্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, কিংবা যারা নেতৃত্বে ছিলেন, তাঁদের কারাে পক্ষে পাকিস্তানের সরকারের অধীন কোনাে স্বায়ত্তশাসনের বােঝাপড়ায় অংশ নেয়া কল্পনাতীত ছিল। অথচ কিসিঞ্জার বহু দেরিতে এ ধরনের আপােসরফার পক্ষপাতী ছিলেন। যদিও বাংলাদেশ আন্দোলন নেতাদের অধিকাংশের কাছে এ ধরনের প্রস্তাব সম্পূর্ণ। অগ্রহণযােগ্য ছিল। এ প্রস্তাব যেমন দেরিতে এসেছে, তেমনি তাতে মজুরিও বড় সামান্য। যেখানে বােঝা যাচ্ছে যে, বিজয় বেশি দূরে নয় এবং বিশ্ব জনমত তাদের পক্ষে, সেখানে এরকম একটা প্রস্তাব গ্রহণ রাজনৈতিকভাবে হাস্যকর হতাে। 
গােটা প্রবাসী বাঙালি নেতৃত্বে শুধু একজনের এ বিষয়ে দ্বিমত ছিল—তিনি খন্দকার মােশতাক আহম্মদ। তাজউদ্দিনের যেমন রুশ-ভারতের কৌশলগত পক্ষপাতের নাম হয়েছিল, তেমনিভাবে মােশতাককে মার্কিন লবির শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব মনে করা হতাে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শগত বহুমুখিতায় তাজউদ্দিনকে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নয়নের প্রেক্ষিতে একজন বামঘেঁষা সামাজিকগণতন্ত্রী মনে করা হতাে। তাঁর মতে স্বাধীন বাংলাদেশে বিদেশী পুঁজিসহ ব্যাপকভাবে শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করা উচিত। আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মতাদর্শগতভাবে মােশতাকের অবস্থান ছিল তাজউদ্দিনের বিপরীত মেরুতে। তিনি খােলাখুলিভাবে অবাধ ধনতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও বিদেশী পুঁজির জন্য উত্তম শর্ত সমর্থন করতেন এবং জাতীয়করণের বিরােধী ছিলেন। ৫০ ও ৬০-এর দশকে পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পার্টির বেশ কজন সদস্যের সাথে তাজউদ্দিনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। ৫০ দশকের গােড়ায় তাজউদ্দিন এবং মাওবাদী পূর্ব বাংলা কম্যুনিস্ট পার্টি (এম-এল)-এর নেতা মােহাম্মদ তােয়াহা এক বাড়িতে থাকতেন। অপর দিকে মােশতাক ছিলেন ধর্মভীরু মুসলমান ও প্রচণ্ড কমুনিস্ট বিদ্বেষী। বাঙালি সূত্রসমূহের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে বাদ দিয়ে খন্দকার মােশতাকের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করেছিল। অত্যন্ত সাবধানে তাজউদ্দিন ও অন্যান্য নেতাদের এ ব্যাপারে অজ্ঞ রাখা হয়েছিল। এই আলােচনা চলাকালে মােশতাকের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ দুজন সহকারী ছিলেন মাহবুব আলম চাষী এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। কোলকাতায় বাংলাদেশ পর্যবেক্ষকদের কাছে এদের এই ছােট্ট দলটি ‘মােশতাক ত্রয়ী’ নামে পরিচিত ছিল।
এই সময়ের ঘটনাবলী সম্বন্ধে অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পরিচিত বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের কর্মকর্তারা বলেন যে, ১৯৭১-এ যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গোপন যােগাযােগে চাষী ও ঠাকুর মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। চার বছর পর এই তিনজনই মােশতাক, চাষী, ঠাকুর বাংলাদেশ বেতারে উপস্থিত হয়ে মুজিবের মৃত্যুর কথা ঘােষণা করেন এবং জানান যে, অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খন্দকার মােশতাক আহম্মদ ক্ষমতায় এসেছেন। প্রাক্তন কর্মকর্তাদের মতে ১৯৭১-এর আলােচনায় মােশতাক ও মার্কিনীরা এই ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন যে, পরিস্থিতি আবার পূর্ববর্তী পর্যায়ে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এসব সূত্র আরাে জানিয়েছে যে, মােশতাক ও তাঁর পররাষ্ট্র সচিব চাষী মােটামুটিভাবে পাকিস্তানের একটা আলাদা শান্তি চুক্তিতে রাজি হয়েছিলেন।  এই শান্তিচুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যদি সামরিক তৎপরতা বন্ধ করে ব্যারাকে ফিরে যায় ও নতুন আলােচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, তাহলে পাকিস্তানের অখণ্ডতা স্বীকার করে নেওয়া হবে। নিকসন প্রশাসনের কাছে এটি একটি কাক্ষিত ও যুক্তিযুক্ত সমাধান মনে হয়েছিল। কিন্তু অধিকাংশ বাঙালির কাছে পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি গণহত্যার পরে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভের আপােষহীন অঙ্গীকারের পর এ ধরনের আপোসরফা দেশের মুক্তি আন্দোলনের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল ছিল। সােজা কথায় বেঈমানী।
জানা গেছে ১৯৭১ সালের শরৎকালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মােশতাকের গােপন যােগাযােগের খবর অস্থায়ী সরকারের অন্যান্য মন্ত্রীদের কানে আসে। অস্থায়ী সরকারকে না জানিয়ে এত সব কাণ্ড হচ্ছে, এই সংবাদ পাওয়ার পর তাজউদ্দিন ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেন বলে জানা যায়। কৌশলগত স্বার্থে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়ায় ভারতও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। ফলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদ হতে মােশতাকের বহিষ্কারের প্রস্তাব করা হয়। বাহ্যিকভাবে একতার একটা চেহারা অটুট রাখার জন্য তাকে সাময়িকভাবে মন্ত্রীত্ব আঁকড়ে থাকতে দেওয়া হলেও যুদ্ধের শেষ মাসগুলােতে মােশতাকের ক্ষমতা সামান্যই ছিল। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তাকে নিউইয়র্ক যেতে দেওয়া হয়নি। স্বাধীনতার পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ হতে সরিয়ে মােশতাককে তুলনায় আরাে কম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। পাকিস্তানের পরাজয়ের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রীত্ব হতে মােশতাককে বিদায় করার সিদ্ধান্ত তাজউদ্দিনের প্রথম বড় প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে পাকিস্তানের কারাগার হতে মুজিবের মুক্তির আগে এটিই একমাএ বড় সিদ্ধান্ত যা কার্যকর করা হয়।
গােয়েন্দা ও গবেষণা বিভাগের একজন প্রবীণ মার্কিন কর্মকর্তা কার্নেগির গবেষকদের বলেন : আমরা ভেবেছিলাম কোলকাতায় আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে আপােসরফার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পরে অক্টোবরে আমরা জানতে পারি যে, সব অংশের প্রতিনিধিত্ব করা ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। ওরাও বুঝতে পেরেছিলেন যে, ওদের অবস্থা অনুরূপ… স্পষ্ট করে এর বেশি কিছু বলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মুজিবের মৃত্যুর এক বছর পর এবং নিজে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আট মাস পরে ১৯৭৬-এর জুন মাসে লরেন্স লিফসুজ মােশতাকের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। সেখানে মােশতাক ১৯৭১-এ কোলকাতায় গােপন যােগাযােগের কথা স্বীকার করেন। কিন্তু সে সময় মার্কিনীদের সাথে ঠিক কী বােঝাপড়া হয়েছিল সে বিষয়ে। স্পষ্ট করে কিছু বলতে অস্বীকার করেন। লিফসুজকে তিনি বলেন, ‘জানতে চাইলে নিকসন সাহেবকে জিজ্ঞেস করুন। আমি কিছু বলবাে না।” ক্ষমতা হতে অপসারণের এক বছর পর ১৯৭৬-এর নভেম্বরে ঢাকায় সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষ মােশতাককে গ্রেফতার করে এবং দুর্নীতির দায়ে বিচার করে। সরকারি পদমর্যাদা অবমাননার জন্য তাঁর ১,০০,০০০ টাকা জরিমানা হয়। বর্তমানে (১৯৭৭-৭৮) মুজিব হত্যার জন্য নয়, দুর্নীতির দায়ে তিনি কারাবাস করছেন। মােশতাক ও তাজউদ্দিনের পারস্পরিক বিদ্বেষ কিন্তু কখনাে প্রশমিত হয়নি। . তাজউদ্দিনের মতে মােশতাক যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের সাথে একাট্টা হয়ে গােপনে স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। এটা তিনি ভুলতে পারেননি। মােশতাকের মনেও পররাষ্ট্র মন্ত্রীর পদ হতে চট-জলদি অপসারণের অপমান এবং তার ফলে ভারতের সন্তোষের স্মৃতি স্পষ্ট ছিল। চার বছর পর মুজিবের মৃত্যুর পর যখন মােশতাক নিজে ক্ষমতা হতে অপসারিত হতে যাচ্ছিলেন, তখন ১৯৭৫-এর ৪ নভেম্বর কিছু অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রবেশ করেন।
মােশতাকের শাসনের সমাপ্তির কয়েক ঘণ্টা আগেই তার পুরনাে প্রতিদ্বন্দ্বী তাজউদ্দিন আহমদকে মুজিবের আরাে তিনজন মন্ত্রীসহ বেয়নেট চার্চ করে হত্যা করা হয়। আগস্টে ক্ষমতায় আসার পর এঁদের চারজনকেই মােশতাক জেলে পুরেছিলেন। লিফসুজের কাছে সাক্ষাঙ্কারে মােশতাক জেল হত্যার সাথে তার নিজের কোনাে সংস্রবের কথা অস্বীকার করেছেন। কিন্তু সেদিন উপস্থিত ছিলেন, কারাগার কর্তৃপক্ষের এমন কিছু সূত্র সন্দেহ করেন যে, মােশতাক এবং সেনাবাহিনীতে তার দোসররা এই জেল হত্যার নির্দেশ দেন। এদের উদ্দেশ্য ছিল শেখ সাহেবের মূল রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা যাতে আর কোনােদিন কোনাে মুজিবপন্থী রাজনৈতিক পুনরুত্থান সংগঠিত করতে না পারেন সেটা সুনিশ্চিত করা।… অন্তরালের আরেক নায়ক। ১৫ই আগস্ট-এর আগের এই সময়টাতে মােশতাকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দোসর ছিলেন মাহবুব আলম চাষী। কোলকাতার দিনগুলােতে তিনি মােশতাকের পররাষ্ট্র সচিব হিসাবে কাজ করেছেন। ১৯৫০-এর শেষ দিকে ওয়াশিংটনের পাকিস্তান দূতাবাসে তিনি কাজ করতেন। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিভাগের তখন থেকেই জানা ছিল যে, এই ব্যক্তি মার্কিন কূটনৈতিক ও একাডেমিক সহকর্মীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখেন। পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রের হাজারাে মতাদর্শগত ভাগগুলাের মধ্যে মার্কিন লবীর প্রতি চাষীর অনুরাগ সুবিদিত ছিল। কোলকাতাস্থ অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারে কর্মরত কিছু উঁচু পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অভিযােগ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে গােপন আলােচনায় চাষী ছিলেন প্রধান মধ্যস্থতাকারী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি যে আজ অন্যতম ঝানু লােক (বছর কয়েক আগে মক্কার অদূরে গাড়িতে রহস্যজনক মৃত্যু) এ কথা তর্কাতীত। তিনি ঢাকার উচু সমাজের একজন অত্যন্ত সংস্কৃতিমনা মাতব্বরও বটে। সেই হিসাবে তিনি একই সাথে একজন বুদ্ধিজীবী ও বিশেষজ্ঞের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া ছাড়াও প্রতিকূল পরিস্থিতি মােকাবেলায় পটু ধুরন্ধর তাত্ত্বিক হিসাবেও স্বীকৃত। ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তানের পররাষ্ট্র বিভাগ হতে পদত্যাগ করেন। এ সময় দক্ষিণ এশিয়া এবং গােটা তৃতীয় বিশ্বে গ্রামীণ দারিদ্র ও অনুন্নয়নের সমাধান হিসাবে ‘সবুজ বিপ্লব’কে তুলে ধরা হচ্ছিল। সর্বরােগহর মতাদর্শ হিসাবে ১৯৬০-এর শেষ দিকে এর স্বীকৃতি তখন আকাশস্পর্শী। ভারতের মতাে পাকিস্তানেও বিভিন্ন নতুন কৃষি পরিকল্পনার সাথে যুক্ত বেশ বড় আকারের সাহায্য আসে।
পাকিস্তানের উন্নয়ন দশক-এ (নামটা আন্তর্জাতিক রক্ষণশীল অর্থনীতিবিদদের দেওয়া) এই সবুজ বিপ্লবের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত ব্যাপক। মাহবুব আলম যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন, তখন তিনি তাঁর নামের শেষে চাষী জুড়ে দেন। তিনি এরপর সবুজ বিপ্লবীদের কাতারে শামিল হয়ে যান এবং চট্টগ্রাম-এর রাঙ্গুনিয়ার একটি উন্নয়ন প্রকল্প সংগঠিত করেন। এই এলাকায় এর আগে প্রবল বন্যায় কয়েক হাজার একর জমির আমন ফসল নষ্ট হয়েছিল। বাংলাদেশের কুমিল্লা মডেল হিসেবে যা পরিচিত, সেটার নিজস্ব রূপ দিয়ে চাষী রাঙ্গুনিয়ায় একটা সমবায় গঠন করেন। বেশ ভালাে সরকারি ঋণ ও বিদেশী সাহায্যের সহায়তায় প্রকল্পটিকে তিনি অচিরেই ধনতান্ত্রিক ভূমি সংস্কারের আদর্শ মডেল হিসাবে দাঁড় করিয়ে ফেলেন। | বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চাষী আবারও পররাষ্ট্র বিভাগে মুজিব নগরে যােগ দেন—এবার পররাষ্ট্র সচিব ও মােশতাকের দোসর হিসাবে। কিন্তু ১৯৭১-এ মার্কিনীদের সাথে তাদের যােগাযােগ সম্পর্কিত শােরগােলের জন্য তিনি কৃষির অপেক্ষাকৃত নিরাপদ অঙ্গনে চলে এসে অক্যুনিস্ট গ্রামীণ গণতােষ কর্মপদ্ধতির একটি তাত্ত্বিক ভিত্তি ও তার প্রয়ােগের একটা রূপরেখা দাঁড় করাবার চেষ্টা করেন। স্বাধীনতার পর মুজিবের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কুমিল্লাস্থ বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমির ভাইস চেয়ারম্যানের পদে আসীন ছিলেন। মাহবুব আলম চাষী সম্বন্ধে এত কথা বলার কারণ আছে। বেশ কিছু ওয়াকিফহাল সূত্র মুজিব বিরােধী অভ্যুত্থানে তার নেপথ্য ভূমিকার কথা বলেছেন। স্রেফ বিদ্যাচর্চার জন্যই যে শুধু পল্লী জীবনের সমাজতত্ত্বের প্রতি চাষীর আগ্রহ ছিল তা নয়, রাজনৈতিক ক্ষমতার শীর্ষদেশের প্রতি খেয়ালও এর পেছনে কাজ করেছে।
অভ্যুত্থানের আগেই চাষীর নির্দেশনা ও মধ্যস্থতায় মুজিবের বিরুদ্ধে সামরিক কৌশল বিষয়ক পরিকল্পনার জন্য কুমিল্লায় কয়েকটা বৈঠক হয়েছিল বলে অভিযােগে প্রকাশ। কুমিল্লা একাডেমি সূত্রে জানা গেছে যে, আগস্টের অব্যবহিত আগে কয়েক মাস ধরে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ওখানে ঘন ঘন যাতায়াত করতেন। তিনি চাষীর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং মােশতাকের ‘৭১-এর কোলকাতাস্থ সহকারীদের দলভুক্ত আরেকজন ব্যক্তিত্ব। তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ১৯৭৫-এ মুজিব সরকারের তথ্য প্রতিমন্ত্রীর পদে ছিলেন। যেসব সামরিক ব্যক্তিত্ব মুজিব হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত ছিলেন, মার্চের শেষে বা এপ্রিলের শুরুতে তাঁদের মােশতাক চক্রের পরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসা হয়। এর আগে মেজরদের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু দরকার ছিল সুবিধাজনক রাজনৈতিক সমর্থনের। মােশতাক ও তাঁর রাজনৈতিক চক্র তখন খুব সাবধানে এমন কিছু সামরিক যােগসূত্র খুঁজছিলেন, যেটা তাদের নিজেদের পরিকল্পনার সাথে খাপ খেয়ে যাবে। মেজর রশিদ মােশতাকের আত্মীয় বটে, কিন্তু মােশতাক চক্রের বেশি পছন্দ ছিল সিনিয়র অফিসারদের অভ্যুত্থান। চাষী জিয়ার কাছে মােশতাকের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করেন। বলে বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সূত্রে অভিযােগ করা হয়েছে। এসব সূত্র জানাচ্ছে যে, জিয়া প্রস্তাবিত পরিকল্পনা সম্বন্ধে আগ্রহ প্রকাশ করলেও প্রয়ােজনীয় সামরিক কার্যক্রমে হাত দিতে অনীহা দেখান। এরপর ১৯৭৫-এর মার্চে মেজর রশিদ তাঁর নিজের প্রস্তাব নিয়ে জিয়ার কাছে হাজির হন। তিনি জিয়াকে বলেন যে, জুনিয়র অফিসাররাই সব ঠিক ঠাক করে ফেলেছেন। শুধু তার সমর্থন ও নেতৃত্ব চাই।

জিয়া আবারাে ইতস্তত করলেন। রশিদের মতে জিয়া তাকে বলছিলেন যে, একজন সিনিয়র অফিসার হিসাবে তার (জিয়ার) এ ব্যাপারে জড়িত হওয়া উচিত নয়। কিন্তু ইচ্ছে থাকলে জুনিয়র অফিসাররা এগিয়ে যেতে পারেন। সিনিয়র অফিসার পর্যায়ে ভালাে নেতৃত্ব না আদায় করতে পেরে, জুনিয়র অফিসারদের এই চক্রান্তের সাথে মােশতাক মহল জড়িত হয়ে পড়লাে। সিনিয়র অফিসারদের অভ্যুত্থান তাদের বেশি পছন্দ হলেও সেটা অসম্ভব হওয়ায় এই অভ্যুত্থান পরিকল্পনাটাই সবচাইতে উত্তম বিকল্প। জিয়ার পরােক্ষ সম্মতি তারা পেয়ে গেছেন এটা বিশ্বাস হবার পর তারা দ্বিতীয় সারির সমর কর্তাদের নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে জিয়ার নিরপেক্ষতা বা পরােক্ষ সমর্থনের ফলে জুনিয়র অফিসাররা এ ব্যাপারে আশঙ্কামুক্ত হতে পারেন যে, জিয়া সর্বশক্তি দিয়ে এই অভ্যুত্থান ঠেকানাের চেষ্টা করবেন না। এপ্রিল-এর (১৯৭৫) পর এদের নিয়ে পরিকল্পনা পাকাপােক্ত করা হলাে।

সূত্রঃ মুজিবের রক্ত লাল – এম আর আখতার মুকুল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!