বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৫ই অক্টোবর, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ২৮শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা
কিছুদিন আগেই চিনি কল কর্পোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, মিল জোন এলাকায় কার্যকারীভাবে বেআইনী গুড় তৈরী বন্ধ করা গেলে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও আগামী মৌসুমে ১ লাখ ৩২ হাজার টন চিনি উৎপাদনের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে। কারণস্বরূপ কর্মকর্তা ব্যক্তি আরও উল্লেখ করেন ১৯৭৩-৭৪ সালে ১ লাখ ৪৫ হাজার একর জমিতে ইক্ষু চাষ করা হয়েছিল। এবার ১৯৭৪-৭৫ সালে সে জায়গায় ১ লাখ ৭৫ হাজার একর জমিতে ইক্ষু চাষ করা হয়েছে। তাছাড়া গত বছরের তুলনায় এবার যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছুটা উন্নতি সাধিত হয়েছে। ১৮টি লোকোমোটিভ ও ১৮০০ ওয়াগন পাওয়া যাবে। যার ফলে যোগাযোগ এবং আখ পরিবহন সমস্যা অনেক হ্রাস পাবে। আখের দামও বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে চাষীরাও পূর্বাপেক্ষা সন্তুষ্ট ও উৎসাহ বোধ করছে। অর্থাৎ চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আয়ত্তের মধ্যেই।
এরই প্রেক্ষিতে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন ভিত্তিক কিছু খবর তুলে ধরা যায়। বিশেষ প্রতিবেদন সূত্র জানিয়েছে যে, দেশের সর্বাধিক আখ উৎপাদনকারী এলাকার শহরে-বন্দরে, গঞ্জে-গ্রামে, ফুটপাতে অলি-গলিতে বেশুমার আখ বিক্রি হচ্ছে। সাম্প্রতিক বন্যায় ও অতিবর্ষণে বাংলাদেশ চিনি মিল কর্পোরেশনের আওতাভুক্ত আবাদকৃত ৫৬ হাজার একর জমির আখ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যার ফলে ঐ আখগুলোর একটা গতি করা প্রয়োজন। অপরপক্ষে মিলে উৎপাদন শুরু হতে এখনও মাস দেড়েক দেরী। অতএব আখচাষীরা আখ কেটে হয় গুড় বানাচ্ছে নয়তো বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রতিবেদন সূত্রটি আরও জানাচ্ছে, রংপুরের গোবিন্দগঞ্জ থানা, দিনাজপুরের সেতাবগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁও, রাজশাহীর বানেশ্বর ও হরিয়ান, বগুড়ার ক্ষেতলাল, শিবগঞ্জ, গাবতলী, শেরপুর, সারিয়াকান্দি থেকে প্রতিদিন ট্রাকে, বাসে, রিকশা, গোমহিষের গাড়ী ও নৌকা যোগে গড়ে ন্যূনতম দু’হাজার মণ আখ চালান হয়ে সৈয়দপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, সান্তাহার, নওগাঁ, নাটোর, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ, ঢাকা প্রভৃতি জেলার বাজারে বিক্রি হচ্ছে। আখ বিক্রির এত ব্যাপক হার আগে কখনও দেখা যায়নি।
এর অবশ্য কারণও আছে। প্রথম কারণ বন্যাকবলিত আখ দেড় মাস পরে চিনি উৎপাদনে যাবার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলবে বলেই চাষীরা তা কেটে গুড় বানাচ্ছে বা বিক্রি করছে। দ্বিতীয়তঃ মিলের (সরকারী) মূল্য হলো—মণ প্রতি আখ ৮ টাকা। অপর পক্ষে বাজারে সেই আখ ১৫ থেকে ২০ টাকা মণ দরে চাষীরা বিক্রি করতে পারছে। তৃতীয়তঃ দুঃখ দারিদ্রের কঠোর কষাঘাতে জর্জরিত কৃষককূল জঠরজ্বালা নিবারণের জন্যই লাভজনক হারে আখ বিক্রির প্রতি ঝুঁকেছেন। এবং ক্ষুধার্ত মানুষ আখ চিবিয়ে পেটের জ্বালা মেটাবার প্রয়াস পাচ্ছে। অর্থাৎ সোজা কথায়—আখ বিক্রির বাজার গরম। এবং একশ্রেণীর ফড়িয়া বা দালালরা মিল রেটের চেয়ে বেশী দামে দেদার আখ কিনছে। কৃষকদের কিছু লাভ তো থাকবেই, কিন্তু সিংহভাগ পাচ্ছে ফড়িয়া বা দালালরা।
একেতো ৪টি চিনি মিলের নিজস্ব এলাকায় আখের ফলন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং বাকী ১১টি মিলের আখ আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তার উপর পেটের দায়ে আখ চাষীরা এন্তার আখ কেটে বেশী দামের বিনিময়ে তা বাজারজাত করছে। এবং এইভাবে আখ বেচে তারা প্রথমতঃ মিল রেটের চেয়ে বেশী টাকা পাচ্ছে এবং একশ্রেণীর মৌসুমী ফড়িয়াদের পেট মোটা হচ্ছে। এরপরও বেআইনীভাবে গুড় তৈরী করার শর্ত সাপেক্ষে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ভরসা আমরা করতে পারি কি করে? জবাবটা সংশ্লিষ্ট মহলকেই দিতে হবে।
পরিষ্কারভাবে আমরা তাই বলতে চাই—প্রতিটি ব্যাপারে গালভরা কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে কোনো লাভ হবে না। চিনির উৎপাদন লক্ষ্য অর্জন করতে হলে সংশ্লিষ্ট মহলকে কার্যকরীভাবে কতকগুলো পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমতঃ মিল এলাকায় উৎপাদিত আখের উপর মিলের নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। প্রয়োজনবোধে আখ চাষীদের দিতে হবে সন্তোষজনক দাম। দ্বিতীয়তঃ আখচাষী ও মিল মালিকের মধ্যে কাজ-কারবার চালাবার জন্য মধ্যস্বত্বরূপী ফড়িয়া বা দালালদের কুতৎপরতা নির্মূল করতে হবে। ওরা চাষীদের বিভ্রান্ত করে। তৃতীয়তঃ মিলের উৎপাদন মৌসুম শুরু না হওয়া পর্যন্ত চিনি কর্পোরেশন হাত-পা টি নাড়াবেন না—এ হবে না। প্রয়োজনবোধে কয়েক মাস আগে থেকে ন্যায্য দামে সংশ্লিষ্ট এলাকার আখ বা আখ জমি কিনে নিতে হবে। এতএব কথার ভাওতাবাজি বন্ধ করে কাজের গোড়া মজবুত করাই এখন একান্ত বাঞ্ছনীয়। নচেৎ লক্ষ্যমাত্রা আরও দূরে সরে যেতে বাধ্য।
বেলুচ মুক্তিযোদ্ধাদের জবাব?
মিঃ ভুট্টোর আত্মসমর্পণের আহ্বানের জবাব সারা পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে ব্যাপক বোমাবাজির মাধ্যমে দেয়া হয়েছে। সরকারী কর্মকর্তারা এই ব্যাপক বোমাবাজির জন্য বিরোধী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে দোষারোপ করে অভিযোগ এনেছেন যে, এই সকল ‘সন্ত্রাসবাদীদের’ আফগানিস্তানে প্রশিক্ষণ দিয়ে পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। ‘সন্ত্রাসবাদীদের’ বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
আজ ১৫ই অক্টোবর বেলুচ মুক্তি সংগ্রামীদের জন্য নির্ধারিত আত্মসমর্পণের শেষ দিন। মিঃ ভুট্টো নিজে এই সময় সীমার কথা উল্লেখ করে সমস্ত গেরিলাদের হুমকি দিয়েছিলেন তারা যদি নির্দিষ্ট সময়ে সরকারের কাছে অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ না করেন, তবে তাদের অবস্থানগুলোতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করা হবে। তিনি নিজে অবশ্য সেই সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করেননি। বহুদিন হতেই বেলুচিস্তানের জনবসতি পূর্ণ এলাকাগুলোতে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে। নিরীহ নিরস্ত্র অসংখ্য নাগরিক প্রাণ হারিয়েছেন পাক সেনাদের উচ্ছৃঙ্খল গুলিবর্ষণ এবং বেপরোয়া আক্রমণের ফলে। পাশাপাশি শক্তিবৃদ্ধি পেয়েছে প্রতিরোধ আন্দোলনের।
জাতিসংঘের চলতি অধিবেশনে আফগানিস্তানের প্রধানমন্ত্রী সর্দার দাউদ পাকিস্তানে এই গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বমানবতাকে সোচ্চার হবার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। খোদ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদেরই বিরোধী দলীয় নেতা আবদুল ওয়ালী খান পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে ঐ একই অভিযোগ এনেছেন। এমনকি বেলুচিস্তানে গণনির্বাচন সরকার বাতিল করে যে আকবর বুগতিকে গভর্ণর নিয়োগ করা হয়েছিল এবং তার মাধ্যমে বেলুচিস্তানের গণআন্দোলনকে স্তব্ধ করার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়েছিল সেই আকবর বুগতিও মিঃ ভুট্টোকে ছেড়ে কথা কইছেন না। বেলুচিস্তানে গণনির্যাতন এবং ব্যাপক হত্যায় নিন্দা করে তিনিও জনগণের নির্ধারিত সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং মুক্তিসংগ্রামীদের সঙ্গে একটা সমঝোতায় আসবার আহ্বান জানিয়েছেন।
কিন্তু কে শোনে বিবেকের কথা। দিনের পর দিন পাকিস্তান সরকার আরো মরিয়া হয়ে উঠছে। শুধু বেলুচিস্তানে নয় পাকিস্তানের আর তিনটি প্রদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে দাবিয়ে দেয়ার জন্যও চলছে সুপরিকল্পিত নির্যাতন। গণতান্ত্রিক ঐক্যে ফাটল ধরাবার জন্য সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে অহরহ।
সারাদেশ ধীরে ধীরে একটি বিস্ফোরণোন্মুখ আগ্নেয়গিরির রূপ নিতে চলেছে। সেখানকার প্রধান প্রধান শহরগুলোতে ব্যাপক বোমাবাজি আন্দোলনের চরম রূপ গ্রহণেরই আলামত। প্রতিবেশী একটি দেশে এই রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং গণহত্যার খেলা স্বাভাবিকভাবেই আমাদের উদ্বিগ্ন না করে পারে না। আমাদের নিজেদেরও সেই একই প্রকার নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল। এছাড়া সেখানকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে এই এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টি করবে না তাই বা কে বলতে পারে। আমরা বিগত দিনে দেখেছি পাকিস্তান তার আভ্যন্তরীণ সমস্যার মুখে সব সময়েই একটা সীমান্ত সংঘর্ষ অথবা সীমিত যুদ্ধে লিপ্ত হবার চেষ্টা করেছে। উদ্দেশ্য দেশের জনগণের দৃষ্টিকে অন্যত্র সরিয়ে দেয়া। এবারও সেই প্রবল গণআন্দোলনের মুখে তারা ভারত এবং আফগানিস্তানকে তাদের আভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্য দায়ী করে চলেছে। আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের হুমকিও দেয়া হয়েছে।
আমরা বিশ্বাস করি, এখনো পাকিস্তান সরকারের সময় আছে তারা তাদের সমস্যার একটা গণতান্ত্রিক সমাধানে উপনীত হবার চেষ্টা করুক। পাকিস্তানী জনগণ তাদের আশা আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী তাদের সুখ এবং সমৃদ্ধি অর্জনে যে মত ও পথ অনুসরণ করতে চাইবে আমরা মনে করি সে পথেই তাদের অগ্রসর হবার সুযোগ দেয়া উচিত। শুধু শুধু হুমকি আর বেপরোয়া বোমাবর্ষণ সংকটকে অধিকতর জটিলই করে তুলবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক