You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৬ই সেপ্টেম্বর, সোমবার, ৩১শে ভাদ্র, ১৩৮০

আজ মহান শিক্ষা দিবস

স্বাধীনতার মূল লক্ষ্য অর্জনে পরিচালিত স্তরানুক্রমিক আন্দোলনের এ এক রক্তক্ষয়ী দিন। সতেরোই সেপ্টেম্বর। কুখ্যাত হামদুর রহমান কমিশনের রিপোর্টের প্রতিবাদে এবং গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে এ দিনটি ছিল বাংলাদেশের সচেতন ছাত্র গোষ্ঠীর স্মরণীয় অভ্যুত্থানের দিন। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে হরতাল। দুপুরের কিছু আগে থেকেই মিছিল মিছিল আর মিছিল। স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে মিছিলে ছাত্র সমাজের সঙ্গে যোগ দিয়েছে বাংলার মেহেনতি মানুষ। প্রতিপক্ষও প্রস্তুত। বন্দুক-বেয়নেট উঁচিয়ে টহলদানরত সান্ত্রী। কোন সতর্কবাণী নেই অকস্মাৎ একঝাঁক গুলি। ঢাকার রাজপথে লুটিয়ে পড়ল বাবুল,মোস্তফা, ওয়াজিউল্লাহ সহ আরো অনেকের নিষ্প্রাণ দেহ।
সেই বাষট্টি সালের এক বীরত্বপূর্ণ দিনের ঐতিহাসিক ঘটনা। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে গড়ে উঠেছিল প্রতিরোধ। নবপর্যায়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনা। সারাদেশে সংগ্রামের জোয়ার। সতেরোই সেপ্টেম্বরের ঘটনা। সে জোয়ারে সংযোজন করল নুতন তরঙ্গের।
ভারত বিভাগোত্তরকাল থেকেই পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসক সম্প্রদায় বাংলাদেশের সংস্কৃতি, শিক্ষা, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিকাশের বিরুদ্ধে যে কূ’ট ষড়যন্ত্র চালিয়ে আসছিল হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট তারই একটা অংশ বিশেষ। দেশের একটা বিশেষ শ্রেণীর হাতে উচ্চ শিক্ষা লাভের সমস্ত সুযোগ কুক্ষিগত রাখার সুদূর প্রসারী লক্ষ্য নিয়ে এবং ছাত্রসমাজকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখবার মানসে সামরিক জান্তার নির্দেশে বিচারপতি হামদুর রহমান এই রিপোর্ট পেশ করেন। ছাত্রসমাজের আন্দোলনের মুখে অবশ্য সে রিপোর্ট কার্যকরী হতে পারেনি কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় বৈষম্য স্বাধীনতা পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশে অব্যাহত থাকে।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে সেই পুরনো শিক্ষা ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের মহান উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রধান প্রগতিশীল শিক্ষকবিদ, বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ক’মাস আগে সে কমিটির সুপারিশ জনগণ এবং সরকারের বিবেচনার জন্য প্রকাশ করেছে দেশের শিক্ষাবিদ বুদ্ধিজীবী তথা সমাজের সচেতন অংশের পরামর্শ এবং প্রস্তাবসমূহ পরীক্ষার পর এটি চূড়ান্ত রিপোর্ট সরকারের অনুমোদনের জন্য পেশ করবেন।
আমরা আশা করব অধিক বিলম্ব না করে যথাশীঘ্র সম্ভব শিক্ষা কমিশনের চূড়ান্ত রিপোর্ট প্রকাশ এবং বাস্তবায়নে সুদৃঢ় ও পদক্ষেপ গ্রহণ করা হোক। কারণ গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থাই একমাত্র আগামীদিনের সমাজ গঠনে সুদক্ষ কারিগর সৃষ্টি করতে পারে। আর সেই নয় সমাজ নির্মাণের সাফল্যই শিক্ষা দিবসের মহান শহীদদের বিদেহী আত্মাকে তৃপ্তি দিতে পারে।

মিশর ও সিরিয়ায় স্বীকৃতি

মিশর ও সিরিয়া বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন গত শনিবার জাতীয় সংসদের শারদীয় অধিবেশনের শুরুতেই সদস্যদের বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে একথা ঘোষণা করেন।
মিশর ও সিরিয়ায় স্বীকৃতি আরব বিশ্বে বাংলাদেশের কূটনৈতিক বিজয়েরই ফলশ্রুতি। বাংলাদেশ জন্মলগ্ন থেকেই সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সাথে শত্রুতা নয় -এ নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে এগিয়ে গেছে। অথচ আরবে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা ভুল ধারণার সৃষ্টি হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। আরে ভুল ধারণার উৎস হল পাকিস্তানি অপপ্রচার। পাকিস্তানি অপপ্রচার সত্ত্বেও আরো বিশ্বের তিনটি দেশ ইরাক, দক্ষিণ ইয়ামেন ও লেবানন ইতিপূর্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি জানিয়েছে। ইরাক, দক্ষিন ইয়ামেন ও লেবাননের স্বীকৃতির পর পরেই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ আশা করেছিল যে, আরব বিশ্বের অন্যান্য দেশও তিনটি দেশের পদাঙ্ক অনুসরণ করবে। কিন্তু তা হয়নি। অবশ্য মিশর বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না জানালেও মিশরের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। মিশরের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বিশিষ্ট মিশরীয় সাংবাদিক জনাব হাসনান হাইকেলও বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন এবং তাদের বক্তব্য থেকেও স্পষ্ট বোঝা গিয়েছিল যে, বাংলাদেশকে মিশরের শিগগিরই স্বীকৃতি জানাবে মিশর তখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না জানালেও বাণিজ্যিক লেন-দেনে আগ্রহের সঙ্গেই এগিয়ে এসেছে।
আরব বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ যে একটা সম্মানজনক আসন দখল করতে সক্ষম হয়েছে তা ইতিপূর্বেই আন্দাজ করা গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভ্রাম্যমাণ দূত আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফরে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা সুষ্ঠু ধারণার সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।
আরব বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মনোভাব যে নমনীয় হয়ে এসেছে তারই পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল কাবুলে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের প্রস্তুতি বৈঠকে। সে বৈঠকে বাংলাদেশকে আলজিয়ার্স সম্মেলনে যোগদানের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। সকলেই বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির স্বপক্ষে মতামত দিয়েছিলেন সেদিন।
বাংলাদেশকে বিশ্বের একটি একশ’টিরও বেশি দেশ এ পর্যন্ত স্বীকৃতি জানালেও আরব বিশ্ব এতদিন পর্যন্ত যেন কোথায় একটা প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল ছিল। আর প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করতে পাকিস্তান সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন এবং এখনো করছেন। কিন্তু আলজিয়ার্স সম্মেলনের পর ভুট্টো সরকার তথা বাংলাদেশবিরোধী গোষ্ঠীসমূহের হীন প্রচেষ্টা একেবারে খড়কুটোর মতোই ভেসে গেল।
যা আন্দাজ করা গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত তাই হলো। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলজিয়ার্স সম্মেলনে যোগদান করে ফিরে আসার পর সকলেই আশা করেছিলেন যে, আরব বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে এবারে সানন্দে স্বীকৃতি জানাবে। এবং তাই হয়েছে মিশর ও সিরিয়ায় মত দুটি দেশের স্বীকৃতি তারই জ্বলন্ত প্রমাণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আলজিয়ার্স সম্মেলনে যোগদান করে বাংলাদেশকে শুধুমাত্র আরব বিশ্বের স্বীকৃতি আনতেই সাহায্য করেন নি -জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ বিষয়েও চূড়ান্তভাবে সফলকাম হয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে যা মনে হচ্ছে তাতে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ লাভ এখন একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। আলজিয়ার্স সম্মেলনেও বাংলাদেশের সদস্য ভুক্তির বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সর্দার শরণ সিং বলেছেন, জাতিসংঘে বাংলাদেশের আসন লাভের প্রশ্নটিকে এখন কেবল আনুষ্ঠানিকতা হিসাবে দেখা হবে।
একথা স্বীকার করতে কোন সংকোচ নেই যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর মাত্র দুই বছরেরও কম সময়ের মধ্যে যে অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছে তা নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য এবং তাৎপর্যপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এ কৃতিত্বের দাবিদার।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!