You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
২২শে আগস্ট, বুধবার, ১৯৭৩, ৫ই ভাদ্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

শিল্প বিনিয়োগের তফসীল

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম গত সোমবার প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার শিল্প বিনিয়োগ তফসীল ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষণানুযায়ী দেখা যায় যে, প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় বেসরকারী শিল্প খাতে মোট ১২১ কোটি ৬০ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করা হবে। মোট বিনিয়োগ অর্থের মধ্যে ৭২ কোটি ৮৮ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা ১১টি বৃহ শিল্পের ১১৭টি খাতে বিনিয়োগের জন্যে নির্ধারিত হয়েছে। তার মধ্যে প্রথম বছরের অনুমোদিত কর্মসূচীতে ১৮ কোটি ১৪ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা সহ ৩০ কোটি টাকা ব্যয়বরাদ্দ করা হয়।
এই বিনিয়োগ তফসীলে নতুন শিল্প কারখানায় ৫ বছরের জন্যে ট্যাক্স হলিডে, পুঁজি বিনিয়োগে বৈদেশিক সহযোগিতা সীমিতকরণ, ঋণ পরিশোধের সময় ৫ বছর বর্ধিতকরণ ও শিল্পে অনুন্নত এলাকায় ঋণ সমতা অধিকতরকরণ নীতিও গ্রহণ করা হয়। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, ট্যাক্স হলিডে মূলতঃ একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির ধারক হলেও বাংলাদেশের নবগঠিত ও বিকাশোন্মুখ শিল্প ব্যবস্থার ক্ষেত্রে এটা একটা ইনসেন্টিভ হিসেবেই কাজ করবে। বর্তমানের প্রেক্ষিতে অবশ্য সেরূপ কিছু ধারণা করাটা হয়তো বা অসঙ্গত কিছু হবে না। অন্যদিকে পুঁজিবিনিয়োগে বৈদেশিক সহযোগিতা সীমিত করার ফলে বর্তমানের প্রেক্ষিতে হয়তো বা কিছুটা অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে। তবে এতে প্রকারান্তরে শিল্পবিনিয়োগে দেশীয় অংশ গ্রহণকেই উৎসাহিত করার প্রচেষ্টা চালান হয়েছে। অবশ্য সে প্রচেষ্টা কতদূর ফলপ্রসূ হতে পারে সেটাই এখন লক্ষণীয়। শিল্পে অনুন্নত এলাকায় ঋণ সমতা অধিকতরকরণের নীতিটিও সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এই ঋণসমতা আনয়নের সঠিক হার নির্ধারিত হলে হয়তো বা অনুন্নত এলাকাগুলোতে সঠিকভাবে শিল্প কারখানা স্থাপনে পুঁজি বিনিয়োগে নবতর উদ্যোগ অবশ্যই আশা করা যাবে।
এই বিনিয়োগ তফসীলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে উল্লেখিত ১১টি প্রধান শিল্পের মধ্যে খাদ্য ও সংশ্লিষ্ট শিল্পখাতে ২০ কোটি ৮১ লাখ টাকা, বস্ত্র শিল্পখাতে ১১ কোটি ২৫ লাখ টাকা, বনজ দ্রব্য ও আসবাবপত্র শিল্পখাতে ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা, কাজগ মুদ্রণ এবং প্রকাশনা শিল্পখাতে ৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা, চামড়া ও রবার দ্রব্য খাতে ৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা, রাসায়নিক ও ওষুধপত্র শিল্পখাতে ১০ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, খনিজ দ্রব্য, তেল ও গ্যাস খাতে ৪ কোটি ৬১ লাখ টাকা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে ৩৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা, বিবিধ শিল্পে ৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকা, সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রিজে ৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা এবং শ্রেণীভুক্ত নয়, এমন শিল্পখাতে ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। তবে এর মধ্যে বস্ত্রশিল্প খাতে বরাদ্দের পরিমাণটা কিন্তু তুলনামূলকভাবে অনেক কম হচ্ছে বলেই নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে। তেমনি রাসায়নিক ও ঔষুধপত্র শিল্পখাতের ব্যয় বরাদ্দের পরিমাণটাও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। অন্যান্য খাতে বরাদ্দ কাজ চালিয়ে নেয়ার মতোই।
প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার যে শিল্পগুলো উন্নয়ন তালিকায় অগ্রাধিকার লাভ করেছে, সেগুলো অবশ্য সঠিকভাবেই তাদের স্থান পেয়েছে। কিন্তু সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে এসব শিল্পগুলোর চাহিদানুযায়ী কাঁচা মালের যোগান দেওয়া। শিল্প বিনিয়োগ তফসীলে সেক্ষেত্রে কোন দিক নির্দেশ নেই।

কালাকানুন যাচ্ছে—

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আইয়ুব আমলের কুখ্যাত প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিলের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, এই মর্মে একটি সংবাদ গত সোমবার ঢাকার প্রায় সব ক’টি দৈনিকেই প্রকাশিত হয়েছে। একটি সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান ‘উপযুক্ত সূত্রের বরাত দিয়ে এই খবর পরিবেশন করেছেন। এতে বলা হয়েছে যে, এই কালাকানুন বাতিল সংক্রান্ত সরকারী ঘোষণাটি যে কোন দিন প্রকাশত হতে পারে।’
বস্তুতঃ এই কালাকানুন তথা প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্সটি অনেক আগেই তুলে নেয়া উচিত ছিলো। দেশ স্বাধীন হবার সাথে সাথেই আর আর সব কালাকানুনের সাথে এই আইনটিও ধুয়ে-মুছে যাওয়া উচিত ছিলো। কেননা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ অতীতে তাঁদের অন্য সব আন্দোলন আর সংগ্রামের সাথে সাথে এই কালাকানুনটির বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করেছিলেন—সোচ্চার হয়েছিলেন। তাঁদের আর সব আন্দোলন ও সংগ্রামের মতো এই আন্দোলন ও সংগ্রামকালেও তাঁরা দেশের সাধারণ মানুষের সাথে সাথে মেহনতি সাংবাদিকদেরও দৃঢ় নৈতিক ও সক্রিয় সমর্থন পেয়েছিলেন। এদেশের সংবাদপত্র শিল্পে কর্মরত সাংবাদিক সহ সকল কর্মচারীর বৃহত্তর অংশটি সব সময়ই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এই কালাকানুন বিরোধী সংগ্রাম থেকে শুরু করে স্বাধীনতা সংগ্রামে নৈতিক ও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন।
মূলতঃ সেদিন সাংবাদিক সমাজ তাঁদের সকল সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের যতখানি সমর্থন আর সাহায্য পেয়েছিলেন—আজও ঠিক তেমনি সাংবাদিক সমাজ যখন দেশের মানুষের দাবীর সাথে প্রতিধ্বনি করে প্রেস এ্যান্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স বাতিলের দাবী তুলেছেন—আর বঙ্গবন্ধুর সরকার তাতে সায় দিতে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তখন সারাদেশের মানুষের সাথে সাংবাদিকরাও তাঁর সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবেন অবশ্যই। অবশ্য এর সাথে সাথে তাঁরা এও আশা করবেন যে, এই আইন বাতিলের পর কোন প্রকারের আমলাবাজী ঘাপলাই হোক—আর যা-ই হোক সংবাদপত্রের কন্ঠরোধ করার মতো এই ধরনের অন্য কোন আইন যেন এদেশের বুকে, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে প্রণীত না হয়। আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র ভারত বা অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো সংবাদপত্র প্রতিনিধি, সাংবাদিক প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি ও সরকারী প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে প্রেস কাউন্সিল গঠন করে সংবাদপত্র, সাংবাদিক ও সরকারের মধ্যে সমঝোতার একটি সেতুবন্ধন অবশ্যই রচনা করা যায়।
অন্যদিকে সরকার যখন এই আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, তখন এটা যত তাড়াতাড়ি ঘোষিত হয়, ততই মঙ্গল। কেননা ১লা সেপ্টেম্বর হচ্ছে এই কালাকানুনটির ‘দীপ্ত দশক পূর্তির’ দিন। কাজেই সেই দশক পূর্ণ হবার আগেই সাংবাদিক সমাজের তথা দেশের মানুষের দাবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই ৩১শে আগস্টের মধ্যে এই কালাকানুন বাতিলের সরকারী ঘোষণা প্রকাশিত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কেননা তাতে সরকারের মর্যাদা বাড়বে—কমবে না কিছুই এবং গোটা দেশবাসীকে কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ করবেন সরকার।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!