You dont have javascript enabled! Please enable it! ভাষা আন্দোলনকারীর সাক্ষাৎকার- রওশন আরা বাচ্চু - সংগ্রামের নোটবুক

রওশন আরা বাচ্চু

রওশন আরা বাচ্চু বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯৫২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের দ্বিতীয় বর্ষ দর্শনের ছাত্রী ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ঐতিহাসিক ছাত্রী মিছিলে তিনি অংশগ্রহণ করেন। পুলিশের লাঠি চার্জে আহত হয়েছিলেন তিনি। ছাত্রীদের দাবি অনুযায়ী, তাঁদের প্রথম গ্রুপটিই ১৪৪ ধারা প্রথম ভঙ্গ করতে সক্ষম হয়। এই গ্রুপেই রওশন আরা বাচ্চু অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। রওশন আরা বাচ্চু ১৯৪৭ সালে পিরােজপুর গার্লস্ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করে বরিশাল বি,এম. কলেজে ভর্তি হন। সে কলেজে থেকে আই,এ পাস করে ১৯৪৯ সালের নভেম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনে অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে অনার্স পাস করে শিক্ষকতায় কুলাউড়া গার্লস্ জুনিয়র হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষিকা পদে যােগ দেন। ১৯৬৫ সালে তিনি বি, এড এবং ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাসে এম,এ ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রশ্ন : বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তখনকার রক্ষণশীল পরিবেশে কি মানসিকতা নিয়ে আপনারা ছেলেদের পাশাপাশি আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন? এটা কি কোন আকস্মিক ঘটনা ছিল না পরিকল্পিত ছিল?
উত্তর : ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় আমি বরিশাল বিএম কলেজের ছাত্রী ছিলাম। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের ঢেউ আমাদের মফস্বলের কলেজকেও আন্দোলিত করে। বলতে গেলে তখন থেকেই রাষ্ট্রভাষার দাবি সম্পর্কে মানসিকভাবে সচেতন হই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর বেতন বৃদ্ধির প্রতিবাদে শুরু হয় ‘ননা ফি ক্যাম্পেইন’ আন্দোলন। এ আন্দোলনে সীমাতভাবে হলেও আমরা ছাত্রীরা কম বেশি জড়িত হই। তখন থেকেই ক্যাম্পাসের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের প্রতিবাদ সভায় আমরা উপস্থিত থাকতে শুরু করি। এরপর সরকারের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে আন্দোলন হয়, এ আন্দোলনে এবং সে সময় অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক ছাত্র কনভেনশনে আমরা ছাত্রীরা অংশ নেই। এভাবে মেয়েদের মধ্যে আন্দোলনের একটা স্বতঃস্ফূর্ত চেতনা গড়ে ওঠে। তখনকার পরিবেশ অবশ্য খুবই রক্ষণশীল ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেদের সঙ্গে মেয়েরা সরাসরি কথা বলতে পারত না। প্রােক্টরের অনুমতি নিয়ে কথা বলতে হতাে। এমনি রক্ষণশীল পরিবেশে যখন ১৯৫২-র ২৭ জানুয়ারি ‘একমাত্র উর্দু রাষ্ট্রভাষা হবে’ এ ধরনের এক তরফা ঘােষণা আসে তখন আমাদের চেতনার মর্মমূলে আঘাত আসে। এ আঘাতের ফলেই রক্ষণশীলতার সকল বাধা ডিঙ্গিয়ে আমরা আন্দোলনে শরীক হই। তাই আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণকে পুরােপুরি পরিকল্পিত বলা না গেলেও একে কোন আকস্মিক ঘটনা বলা ঠিক হবে না। এর নেপথ্যে মানসিক প্রস্তুতি ছিল।
প্রশ্ন : আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার জন্য মেয়েরা কি ধরনের কাজ করতেন?
উত্তর : সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কর্মসূচি অনুযায়ী আমরা স্কুল কলেজের মেয়েদের সংগঠিত করা, পােস্টার লিখা, চাঁদা উঠানাে প্রভৃতি কাজগুলাে করেছি।
প্রশ্ন : মেয়েদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রচেষ্টা সম্পর্কে আপনার স্মৃতি থেকে কিছু বলুন।
উত্তর : একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়েরা ছােট ছােট দলে ভাগ হয়ে মেয়েদের স্কুলে এবং কলেজে যায় সংগঠিত করে ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় নিয়ে আসার জন্য। সভা শুরু হওয়ার পূর্বে প্রবল ক্ষোভের মধ্যেও একটা অনিশ্চিত ও থমথমে ভাব বিরাজ করছিল। সভা শুরু হলাে কিন্তু ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার প্রশ্নে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় শাফিয়া আপাসহ আমরা সবাই সভা বয়কট করে মেয়েদের কমন রুমে চলে যাই। আমরা পূর্বাপর ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার পক্ষে ছিলাম। এ ব্যাপারে দ্বিধা সৃষ্টি হওয়ায় আমরা সভা বয়কট করে চলে যাই। পরে অবশ্য ছাত্রদের অনুরােধে আন্দোলনের ঐক্যের স্বার্থে ফিরে আসি। গ্রুপে গ্রুপে ভাগ হয়ে মিছিলের প্রচেষ্টা শুরু হলাে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটের সামনে সারি বেঁধে দাঁড়ানাে সশস্ত্র পুলিশ। ছেলেদের গ্রুপ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ তাদের গেইট থেকে ট্রাকে তুলে নিচ্ছিল। ফলে ছেলেরা আর এগুতে পারছিল না। এর পরে শাফিয়া আপাসহ আমরা মেয়েরা পর পর দু’তিনটি গ্রুপে বের হই। আমাদের ধারণা ছিল তখনকার রক্ষণশীল পরিবেশে পুলিশ মেয়েদের এগিয়ে যেতে বাধা দেবে না বা লাঠিচার্জ করবে না। গেইটের বাইরে গিয়ে আমরা তেমন বাধা পেলাম না। আমরা গেইট থেকে বের হওয়ার সময় স্কুল কলেজের ছাত্রীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে রেখে এসেছিলাম। আমাদের এগিয়ে যাওয়া দেখে আরাে মেয়েরা বের হতে শুরু করে। এভাবে কিছুটা মিছিলের আকার ধারণ করে। কিছু ছেলেও দেয়াল টপকে মিছিলের পেছনের দিকে যােগ দিচ্ছিল। আমরা মেডিকেলের বর্তমান প্রবেশ দ্বারের কাছে আসতেই শুরু হয় পুলিশের লাঠিচার্জ আর কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ। লাঠির আঘাত এসে পড়ে আমার গায়ে। আকস্মিক আঘাতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাই মাটিতে। রাস্তার পাশে রেস্টুরেন্টের কাছে ছিল কয়েকটি ভাঙ্গা রিকশা, কিছু ভেবে না পেয়ে কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জ থেকে আত্মরক্ষার জন্য সেখানে গিয়ে আত্মরক্ষার চেষ্টা করি। এরপর ছুটে যাই সাইন্স অ্যানেক্সের কম্পাউন্ডে এস, এম হলেন প্রভােস্ট ডক্টর ওসমান গণির বাসভবনের দিকে। কিন্তু সেখানে আশ্রয় নিয়ে গিয়ে কাঁটাতারের বেড়ায় আটকা পড়ে যাই। এমনি অসহায় অবস্থায় কে এসে যেন কাঁটাতারের বেড়া থেকে আটকানাে শাড়ি ছাড়িয়ে দেন। কাঁটাতারের আঁচড়ের ব্যথা নিয়ে ওসমান গণির বাসভবনের দিকে গিয়ে দেখি সেখানে বাসভবনের বারান্দায় সুফিয়া, শামসুন নাহার ও সারা তৈফুর রয়েছে। ওরা আমার আগেই সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। ওরাই আমার প্রাথমিক শুশ্রুষা করে। অনেকক্ষণ পর পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হলে অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর সহায়তায় আমরা হােস্টেলে ফিরে আসি। একুশে ফেব্রুয়ারি পরবর্তী দিনগুলােতেও চাঁদা তােলা এবং আহতদের সেবার কাজে ছাত্রীরা যে ভূমিকা রেখেছিল তাকে কোনক্রমে খাটো করে দেখা যায় না।

সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৭
সূত্র: ভাষা আন্দোলন সাতচল্লিশ থেকে বায়ান্ন মােস্তফা কামাল