You dont have javascript enabled! Please enable it!

সক্রিয় রাজনীতিতে দবিরুল ইসলাম এবং
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

“স্কুলে অধ্যয়নের সময় থেকেই দবিরুল ইসলাম সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সােহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের তিনি সমর্থক ছিলেন। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। দবিরুল ইসলাম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং দিনাজপুর
অঞ্চলের সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।” (১২)
এভাবেই দবিরুল ইসলামের রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরেছেন শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. হারুন-অর-রশিদ। তার গবেষণাগ্রন্থ ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ থেকে আরও জানা যায়,
“বঙ্গবন্ধু ও দবিরুল ইসলামের পরিচয় কলকাতায় পাকিস্তান আন্দোলনকালে। সে সময়ে দবিরুল ইসলাম নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ ও বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সক্রিয় কর্মী ছিলেন। মুসলিম লীগের সােহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের সমর্থক হিসেবে তিনি কলকাতায় লীগ অফিসে আবুল হাশিমের রাজনৈতিক ক্লাসেও যােগ দিতেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে পড়ার সময় তিনি বঙ্গবন্ধুর সহপাঠী ছিলেন।”[/১৩] /
অর্থাৎ দেশভাগের পূর্ববর্তী সময়ে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম ছাত্রদের উপর আবুল হাশিমের প্রভাব ছিল প্রচণ্ড ।
“১৯৪৩ এর দিকে আবুল হাশিম সাহেব মুসলিম লীগের সেক্রেটারী হওয়ার পর মুসলিম ছাত্রদের মধ্যে একটা দারুণ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এর পর থেকে মুসলমান ছাত্রদের মধ্যে মুসলিম লীগের প্রভাব খুব বৃদ্ধি পায়। নাজিমুদ্দীন এবং আবুল হাশিমকে কেন্দ্র করে কিছুটা ব্যক্তিগত এবং কিছুটা আদর্শগত কারণে ছাত্রেরা বিভক্ত হয়। ছাত্রদের মধ্যে দেশভাগের পূর্বেঢাকা জেলায় মােটামুটিভবে শাহ আজিজের প্রভাবই বেশি ছিল।” (১৪)
দেশভাগের পরপরই পূর্ববাংলার উপর সদ্য সৃষ্ট পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ইচ্ছেমাফিক চাপিয়ে দেওয়া নানা বৈষম্য দূর করতে তৎপর হয়ে ওঠেন এখানকার সচেতন ছাত্র সমাজ থেকে রাজনীতিতে আসা ছাত্ররা। তারা যখন উপলব্ধি করলেন, ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’এর সক্রিয় কর্মী হিসেবে তারা ব্রিটিশরাজের থেকে স্বাধীনতা পেয়েছেন বটে কিন্তু সেই সংগঠনই নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে বাংলার স্বার্থে
৪০

আর কাজ করছে না, তখন তারা নতুন একটি ছাত্র সংগঠন সৃষ্টির জন্য তৎপর হয়ে ওঠেন। এভাবেই প্রতিষ্ঠা পায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ; যা পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ নাম ধারণ করেছে। এই সংগঠনের অর্জন এবং ঐতিহ্য বাংলাদেশের ইতিহাসে অমূল্য। এর কারণ হলাে, সমাজের অসঙ্গতি দূর করার জন্য গঠিত হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। এই ছাত্র সংগঠনের কর্মী ও নেতারা ‘লােক-দেখানাে রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। না। সংগঠনের প্রত্যেক সদস্য বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য থাকতেন সদা তৎপর। তারা সারা দেশ চষে বেড়াতেন বাংলার মানুষের সমস্যার সমাধানের তাগিদে। সংগঠনের নেতা ও কর্মীরা ছিলেন বিনয়ী। সততা, সাংগঠনিক নীতিআর্দশ ও সংযম নিয়ে চলতেন বলেই তারা সকলে পূর্ববাংলার আপামর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছিলেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ কখনওই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক’সর্বস্ব না থেকে সংগঠন পরিচালিত হতাে সকল জেষ্ঠ্য নেতা ও তৃণমূলের কর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করে। সারা বাংলায় ছড়িয়ে থাকা তৃণমূলের কর্মীদের সাথে এক হয়ে কেন্দ্রীয় নেতারা সংগঠনকে পরিচালনা করতেন। একারণেই দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পরামর্শকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দিনাজপুরের ছাত্র নেতা দবিরুল ইসলাম। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী পড়লেই বােঝা যায়, রাজনীতিতে আসার সময় থেকেই বঙ্গবন্ধু তার প্রত্যেক সহকর্মীকে কতটা সম্মান ও গুরুত্ব দিতেন। এজন্যই তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে তার সঙ্গে দবিরুল ইসলামের প্রতিটি ঘটনাবহুল বিষয় তুলে রেখেছেন নিজের জীবনী গ্রন্থে। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ গ্রন্থটি থেকে জানা যায়,
“বঙ্গবন্ধু তার স্মৃতিকথায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সম্পৃক্ততার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, একই মাসে দিনাজপুরে গ্রেপ্তার হওয়া ও কারা অভ্যন্তরে নির্যাতনের শিকার , ১৯৪৯ সালে ছাত্রলীগের সম্মেলনে সভাপতি পদে বন্দি অবস্থায় নির্বাচিত হওয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গে দবিরুল ইসলামের নাম উল্লেখ করেছেন (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ. ৮৮ , ১১০, ১১৩-১৪, ১২৬)। তাতে দেখা যায় যে, ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার পূর্বে এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু যেসব পূর্বর্তন নেতাকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন, দবিরুল ইসলাম ছিলেন তাদের অন্যতম (পৃ. ৮৮)। পূবেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, তিনিছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।” [১৫]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগ থেকেই দিনাজপুরে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় উত্তর বঙ্গে ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলামের খ্যাতি ছিল তুঙ্গে। [১৬]
এ জন্যই সদ্য সৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রে ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত গণতান্ত্রিক যুবলীগের কর্মী সম্মেলনে দিনাজপুরের ছাত্রনেতা হিসেবে ডাকা পড়ে
৪১
দবিরুল ইসলামের। সেই সম্মেলনে দিনাজপুর থেকে তার নেতৃত্বে আরও যােগ দেন। মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (পরবর্তীতে জাতীয় অধ্যাপক), এম আর আখতার মুকুল (চরমপত্রখ্যাত সাংবাদিক), আব্দুল রহমান চৌধুরী, রিয়াজুল ইসলাম, মাে. কিবরিয়া এবং মােহাম্মদ হবিবর রহমান। গণতান্ত্রিক যুবলীগের এই কর্মীসম্মেলনে আগুনঝরা বক্তব্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাদের মনােযােগ আকর্ষণ করেন দবিরুল ইসলাম। (১৭) উচ্চশিক্ষা গ্রহণের তাগিদে দিনাজপুর শহর ছেড়ে ঢাকায় আসার পরপরই দবিরুল ইসলাম রাজনীতির নতুন প্রাঙ্গণে নব উদ্যোমে কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। রাজনীতিতে সময় দেওয়ায় পড়ালেখায় বিঘ্ন ঘটলেও দেশের মানুষের ন্যায্য দাবির প্রশ্নে ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলাম ছিলেন অনড়।
৪২
দেশভাগ: নতুন দেশে নতুন ছাত্র সংগঠন –
‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’
নব গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (১৮) সূত্রপাত সম্পর্কে এম আর আখতার মুকুল তার স্মৃতিচারণগ্রন্থ ‘রূপালী বাতাস’এ বলেছেন,
“পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূচনায় যে ক’টা দল কাজ করছিল সেগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, তমুদুন মজলিশ, পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ। আজাদী লাভের কিছুদিনের মধ্যেই প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগ দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর এক পক্ষ জনাব শাহ মােহাম্মদ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার খাজা নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভার সমর্থক হিসেবে কাজ করতে শুরু করে। অন্য পক্ষ মেসার্স শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল হামিদ চৌধুরী, মরহুম দবিরুল ইসলাম, মরহুম আব্দুল আজিজ, মােল্লা জালাল উদ্দিন, খালেক নেওয়াজ খান, গােলাম মাহবুব প্রমুখের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের নামে এ প্রদেশে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য ঝাপিয়ে পড়ে। আমরা এ দলের সক্রিয় সমর্থক হিসেবে দিনাজপুরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে উজ্জীবিত করতে সক্ষম হই। দিনাজপুরের কৃতিসন্তান মরহুম দবিরুল ইসলামের পরেই ছাত্রলীগ সংগঠনের জন্য জনাব আব্দুর রহমান চৌধুরী ছিলেন অন্যতম। (১৯)
ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের সফল পরিণতি হিসেবে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর পূর্ববাংলায় ছাত্রদের একটি নতুন রাজনৈতিক সংগঠন সৃষ্টির প্রয়ােজনীয়তা তুলে ধরতে গিয়ে শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. হারুন-অর-রশিদ মূল্যায়ন করেছেন এভাবে,
“বাংলার মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের সন্তানরা ক্রমান্বয়ে পাশ্চাত্যের ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করলে, তাদের ভেতর দেশ, সমাজ, আপন সম্প্রদায় সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি হতে থাকে। বিভিন্ন জিলা শহরে মুসলমান ছাত্রদের সংগঠন প্রতিষ্ঠা পায়। …একই বছর (১৯৩৩ সালে) কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক প্রতিনিধিসম্মেলনে খান বাহাদুর আসাদুজ্জামানকে সভাপতি এবং আবদুল ওয়াসেককে সাধারণ সম্পাদক করে ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্র সমিতি’ গঠিত হয়। এই ছাত্রসংগঠন ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারকার্যে অংশ নেয়। এরপর ১৯৩৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সমগ্র বাংলার মুসলিম ছাত্রপ্রতিনিধিদের এক

৪৩
সম্মেলনে আবদুল ওয়াসেককে সভাপতি ও শামসুল রহমানকে সাধারণ সম্পাদক করে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সহযােগী সংগঠন নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনসহ পাকিস্তান আন্দোলনে ছাত্রদের এ সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যাই হােক, বঙ্গীয় মুসলিম লীগের মত ছাত্রলীগও অভ্যন্তরীণভাবে সােহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম বনাম নাজিমুদ্দীন-আকরম খ গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বস্তুত এটি ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত উঠতি মধ্যবিত্ত ও ভূমি-স্বার্থনির্ভর রক্ষণশীল শ্রেণির মধ্যকার এক ধরনের মেরুকরণ। আনােয়ার হােসেন, নূরুদ্দিন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শাহ আজিজুর রহমান তখনকার দিনে প্রভাবশালী ছাত্রনেতা ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ছাত্রলীগের সর্বশেষ কাউন্সিল ১৯৪৪ সালে শাহ আজিজুর রহমানের নিজ জেলা কুষ্টিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। সে কাউন্সিলে নাজিমুদ্দীন-আকরম খাঁ গ্রুপ সমর্থক শামসুল হুদা চৌধুরী সভাপতি এবং শাহ আজিজুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। অপরদিকে, প্যানেল নির্বাচন নিয়ে বিভক্তি দেখা দেয়ায় বঙ্গবন্ধু ও নূরুদ্দিন আহমেদ তাদের অনুসারীদের নিয়ে কাউন্সিল অধিবেশন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে গিয়ে তাদের সাংগঠনিক প্রাধান্য অব্যাহত রাখেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন ইসলামিয়া কলেজকেন্দ্রিক ছাত্ররাই ছিল কলকাতায় মুসলিম ছাত্রলীগের মূলশক্তি এবং এরা সবাই ছিল সােহরাওয়ার্দী সমর্থক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও কিছুকাল শাহ আজিজ-শামসুল হুদার নেতৃত্ব অক্ষুন্ন থাকে, শুধু সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ রাখা হয়। তারা নাজিমুদ্দীন ও নুরুল আমিনের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ সরকারের কাছ থেকে সর্বপ্রকার সমর্থন ও পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করতে থাকেন। পক্ষান্তরে, সােহরাওয়ার্দী সমর্থক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের ওপর চালানাে হয় জেলজুলুম-গ্রেপ্তারসহ নানা নির্যাতন। এ-রকম এক রাজনৈতিক পটভূমিতে বঙ্গবন্ধু সমমনা পূর্বের ছাত্রনেতা কর্মীদের নিয়ে নতুন ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।” (২০)
নতুন একটি ছাত্র সংগঠন গঠন সম্পর্কে ১৯৬৯ সালে বামপন্থি রাজনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানিয়েছিলেন,
“দেশ ভাগের মুসলিম লীগের মধ্যে আমাদের তখন অত্যন্ত অসহায় অবস্থা। শহীদ সাহেব যে পার্লামেন্টারী পার্টির নির্বাচনে হেরে গেলেন তার পেছনে কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ ছিলাে। পাঞ্জাবে নােতুন নেতা নির্বাচনের কোন প্রয়ােজন হয় নি। মামদোতই সেখানে নির্বাচন ছাড়া প্রধানমন্ত্রী থেকে গেলেন কিন্তু পূর্ববাঙলার জন্য নােতুন নির্বাচন দেওয়া হলাে। এর কারণ কেন্দ্র থেকে শহীদ সাহেবকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র।
৪৪
১৯৪৮ সালেই আমরা আর মুসলিম লীগ না করা স্থির করেছিলাম। কিন্তু সে চেষ্টা আমরা প্রথম পর্যায়ে মুসলিম লীগের মধ্যে থেকেই করতে চেয়েছিলাম। এর জন্যে ১৯৪৮ সালে ১১০/১২ জন পুরাতন কাউন্সিলারদের সই নিয়ে আকরাম খানের বিরুদ্ধে আমরা একটা রিকুইজিশন মিটিং আহ্বান করেছিলাম। আকরাম খান তখন কলতাবাজারে থাকতেন। আমি নিজে তার বাড়ীতে গিয়ে সই শুদ্ধ মিটিং এর দরখাস্ত দিলাম এবং দরখাস্ত প্রাপ্তির একটা রশিদ তার থেকে চাইলাম। তিনি যথারীতি আমাকে একটা রশিদ দিলেন। এর পর দিনের আজাদে দেখলাম যে তিনি মুসলিম লীগ কাউন্সিলকেই সম্পূর্ণ বাতিল করে দিয়েছেন এবং আমরা যে ১১০/১২ জনের সই দিয়েছিলাম তাদের নাম কাগজে ছাপিয়ে তিনি ঘােষণা করেছেন যে আমরা কেউ আর মুসলিম লীগ কাউন্সিলের সদস্য নই।
এর পর নারায়ণগঞ্জে মুসলিম লীগ কর্মীদের সভা হয়। সেখানে রশিদ বই ইত্যাদি নিয়ে আলােচনা হয়।
১৯৪৮ এর ফেব্রুয়ারী (?) ৪ তারিখে আমরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করি। তাতে নঈমুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক মনােনীত করা হয়।” (২১)
প্রায় দুইশ’ বছর ব্রিটিশদের অধীনে থাকার পর স্বাধীনতা পাওয়া রাষ্ট্র পাকিস্তানে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠনের বিষয়টি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অসামাপ্ত আত্মজীবনীতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন এভাবে,
“নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের নাম বদলিয়ে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ করা হয়েছে। শাহ আজিজুর রহমান সাহেবই জেনারেল সেক্রেটারি রইলেন। ঢাকায় কাউন্সিল সভা না করে অন্য কোথাও তারা করলেন গােপনে। কার্যকরী কমিটির সদস্য প্রায় অধিকাংশই ছাত্র নয়, ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। ১৯৪৪ সালে সংগঠনের নির্বাচন হয়েছিল, আর হয় নাই। আমরা ঐ কমিটি মানতে চাইলাম না। কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ ও জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু ছাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। তারা এই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত নয়। আমি ছাত্রলীগ কর্মীদের সাথে আলাপ-আলােচনা শুরু করলাম। আজিজ আহমেদ, মােহাম্মদ
তােয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল হামিদ চৌধুরী, দবিরুল ইসলাম, | নইমউদ্দিন, মােল্লা জালালউদ্দিন, আবদুর রহমান চৌধুরী, আবদুল
মতিন খান চৌধুরী, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আরও অনেক ছাত্রনেতা একমত হলেন, আমাদের একটা প্রতিষ্ঠান করা দরকার। ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি তারিখে ফজলুল হক মুসলিম হলের এ্যাসেম্বলি হলে এক সভা ডাকা হল , সেখানে স্থির হল একটা ছাত্র প্রতিষ্ঠান করা হবে। যার নাম
৪৫
হবে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। নইমউদ্দিনকে কনভেনর করা হল। অলি আহাদ এর সভ্য হতে আপত্তি করল। কারণ সে আর সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান করবে না। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম দিলে সে থাকতে রাজি আছে। আমরা তাকে বােঝাতে চেষ্টা করলাম এবং বললাম, “এখনও সময় আসে নাই। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও দেশের আবহাওয়া চিন্তা করতে হবে। নামে কিছুই আসে যায় না। আদর্শ যদি ঠিক থাকে, তবে নাম পরিবর্তন করতে বেশি সময় লাগবে না। কয়েক মাস হল পাকিস্তান পেয়েছি। যে আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তান পেয়েছি, সেই মানসিক অবস্থা থেকে জনগণ ও শিক্ষিত সমাজের মত পরিবর্তন করতে সময় লাগবে।” প্রতিষ্ঠানের অফিস করলাম ১৫০ নম্বর মােগলটুলী। মুসলিম লীগ নেতারা কয়েকবার চেষ্টা করেছেন এই অফিসটা দখল করতে, কিন্তু শওকত মিয়ার জন্য পারেন নাই। আমরা মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স ক্যাম্প নাম দিয়ে সাইন বাের্ড লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অফিসও করা হল।… …ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠান গঠন করার সাথে সাথে বিরাট সাড়া পাওয়া গেল ছাত্রদের মধ্যে। এক মাসের ভিতর আমি প্রায় সকল জেলায়ই কমিটি করতে সক্ষম হলাম। যদিও নইমউদ্দিন কনভেনর ছিল, কিন্তু সকল কিছুই প্রায় আমাকেই করতে হত। একদল সহকর্মী পেয়েছিলাম, যারা
সত্যিকারের নিঃস্বার্থ কর্মী।” [22/ ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী রাজনীতিবিদ এবং পূর্ব । পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদ জানিয়েছেন,
“একমনা ছাত্র নেতৃবৃন্দের সহিত প্রাথমিক আলােচনা করিয়া ১৯৪৮ সালের ৪ঠা জানুয়ারি অপরাহ্নে ফজলুল হক হল মিলনায়তনে এক ছাত্র কর্মীসভা আহ্বান করি। সেই মুহুর্তে ঘটনাচক্রে ফেনী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক নাজমুল করিম উপস্থিত ছিলেন। আমরা তাহাকেই সভাপতি করিয়া সভার কাজ আরম্ভ করি। সভায় নূতন ছাত্রসংগঠন সাম্প্রদায়িক না অসাম্প্রদায়িক হইবে এই প্রশ্নে উপস্থিত অনেকের সহিত আমার মতানৈক্য দেখা দেয়। আমি সংগঠনের অসাম্প্রদায়িক নামের পক্ষে ছিলাম। যাহা হউক, অধিকাংশের মতের পক্ষে স্বীয় প্রস্তাব প্রত্যাহার করিয়া অবশেষে আমরা সর্বসম্মতিক্রমে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করি। জনাব নঈমউদ্দিন আহমদকে ও আমাকে আহ্বায়ক করিয়া যথাক্রমে পূর্ব পাকিস্তান ও ঢাকা শহর কমিটি গঠন করা হয় এবং নিম্নলিখিত ব্যক্তিদের সদস্য করিয়া পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। ১। নঈমুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী) আহ্বায়ক, ২। আবদুর রহমান চৌধুরী
৪৬
(বরিশাল), ৩। শেখ মুজিবুর রহমান (ফরিদপুর), ৪। অলি আহাদ (কুমিল্লা) , আহ্বায়ক ঢাকা শহর কমিটি ৫। আজিজ আহমদ আজিজ (নােয়াখালী), ৬। আবদুল মতিন (পাবনা), ৭। দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর), ৮। মফিজুর রহমান (রংপুর), ৯। শেখ আবদুল আজিজ (খুলনা), ১০। নওয়াব আলী (ঢাকা), ১১। নূরুল কবির (ঢাকা সিটি), ১২। আবদুল আজিজ (কুষ্টিয়া), ১৩। সৈয়দ নূরুল আলম (ময়মনসিংহ),
এবং ১৪। আবদুল কুদ্স চৌধুরী (চট্টগ্রাম)। (২৩)
অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন সম্পর্কে বামপন্থি রাজনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন,
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক নেতৃস্থানীয় ছাত্র একটি নতুন প্রতিষ্ঠান গঠনে ১৯৪৮এর প্রথম দিকেই উদ্যোগী হন। নিজেদের মধ্যে কিছু প্রাথমিক ঘরােয়া আলােচনার পর সমগ্র প্রদেশের ছাত্রদের প্রতি একটি নতুন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের আহ্বান জানিয়ে ১৯৪৮এর মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে তারা পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি আবেদন নামে একটি সার্কুলার প্রচার করেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে সাকুলারটি একটি উল্লেখযােগ্য দলিল। …সার্কুলারটিতে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লিগ অস্থায়ী অর্গনাইজিং কমিটির নিম্নোক্ত সদস্যবৃন্দ স্বাক্ষর দান করেন:
নাইমউদ্দিন আহমদ বি.এ. অনার্স কনভেনর (রাজশাহী), আবদুর রহমান চৌধুরী বি.এ. (বরিশাল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা), আবদুল কুদুস চৌধুরী বি.এ. অনার্স (চট্টগ্রাম), শেখ মুজিবর রহমান বি.এ. (ফরিদপুর), আজিজ আহমদ বি.এ. (নােয়াখালী), আবদুল আজিজ এম.এ. (কুষ্টিয়া), সৈয়দ নূরুল আলম বি.এ. (মােমেনশাহী), আবদুল মতিন বি.এ. (পাবনা), দবিরুল ইসলাম বি.এ. (দিনাজপুর), মফিজুর রহমান (রংপুর), অলী আহাদ (ত্রিপুরা), নওয়াব আলী (ঢাকা), আবদুল আজিজ (খুলনা), নূরুল কবীর (ঢাকা সিটি)। …নঈমুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক নিযুক্ত করে উপরােক্ত যে কমিটি গঠিত হয় সেই কমিটি নতুন ছাত্রপ্রতিষ্ঠানটিকে গঠন করতে
উদ্যোগী হয়।” [২৪] সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে পরিবর্তিত রাজনৈতিক আবহে ‘নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগ’এর স্থলে আরেকটি নতুন ছাত্র সংগঠনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। সেই প্রেক্ষিতেই ১৯৪৮ সালে নতুন ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’এর প্রথম আহ্বায়ক কমিটির সভা বসে। সভায় রাজশাহীর ছাত্র নেতা নঈমুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে সংগঠনের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়। নবগঠিত এ কমিটিতে ফরিদপুরের ছাত্র নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, কুমিল্লা থেকে আসা অলি আহাদ
৪৭
এবং দিনাজপুরের ছাত্র নেতা দবিরুল ইসলামসহ বিভিন্ন জেলার মােট ১৪ জন ছাত্র প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত হন। নবগঠিত রাষ্ট্রে নতুন একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার এই ঘটনাটি ছিল পূর্ববাংলার ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী ঘটনা। কারণ সম্পূর্ণ নিজেদের একটি ছাত্র সংগঠন পেয়ে বাংলার ছাত্রমহলে সাড়া পড়ে যায়। সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের এই আহ্বায়ক কমিটির নেতাদের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা, মেধা ও শ্রম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ গঠনের পথে কয়েক ধাপ এগিয়ে নেয়। মূলত সাধারণ ছাত্রদের থেকে সাড়া পেয়েই আহ্বায়ক কমিটির নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম আওয়ামী লীগ’ গঠনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। [২৫] |
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি ও গবেষক গােলাম কুদ্ছ তার ভাষার লড়াই ও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নামীয় গবেষণাগ্রন্থে জানিয়েছেন,
“মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সরকার শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বাধীন ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’-কে নানাভাবে সহযােগিতা প্রদান করলেও সােহরাওয়ার্দী – আবুল হাশিমের অনুসারী বিবেচনায় নবপ্রতিষ্ঠিত ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’-এর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে শুরু করে। নেতৃবৃন্দের পেছনে সরকারি গােয়েন্দা লাগিয়ে দেয়া হয়। এতদসত্ত্বেও শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্যান্যদের ব্যাপক সাংগঠনিক তৎপরতার ফলে স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রদেশব্যাপী জেলা পর্যায়ে কমিটি গঠিত হয় এবং তৃণমূল পর্যায়েও বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। এই সংগঠনটি ৪৮ এবং ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।” [২৬]

৪৮
পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলন :
ভাষা আন্দোলনে দিনাজপুর

“ভাষা আন্দোলনে পিছিয়ে ছিল না রাজনীতি সচেতন দিনাজপুরের মানুষ। দিনাজপুরে বিভিন্ন মত ও পথের মধ্যে প্রাধান্য ছিল বাম মতাদর্শের রাজনীতির। এদের লক্ষ্য ছিল ভােগ্যপণ্য থেকে শুরু করে ভাষার মতাে যেকোনাে বিষয় নিয়ে সরকারবিরােধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তােলা। এমন এক সম্ভাবনাময় রাজনৈতিক পরিবেশের কারণে দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলন রীতিমতাে বিস্ফোরক চরিত্র অর্জন করে। পাকিস্তান গণপরিষদে ব্যবহারিক বাংলার দাবি বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ফেব্রুয়ারির (১৯৪৮) শেষ দিক থেকেই দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্ব শুরু। যথারীতি এ ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের। এ খবর আবার ঘটা করে প্রকাশিত হয় কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায়। ভাষা আন্দোলনের সূচনাকালেই কয়েক পা এগিয়ে ছিল দিনাজপুর। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৪৮ সালের ৩ মার্চ দিনাজপুর শহরে পূর্ণাঙ্গ হরতাল পালিত হয়। স্কুল-কলেজের ছাত্রদের বিক্ষোভ প্রকাশ পায় মিছিলে , স্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। একই দিন বিকেলে জনসভা হয় কংগ্রেস ময়দানে খান বাহাদুর আমিনুল হকের সভাপতিত্বে। সভা শেষে ২১ মার্চের কর্মসূচি পালনের প্রস্তুতিপর্ব চলতে থাকে গােপনে, কিছুটা প্রকাশ্যেও। পরিস্থিতি লক্ষ্য করে বিচলিত প্রশাসন ১১ মার্চের কর্মসূচি ভণ্ডুল করতে হঠকারী পদক্ষেপ নেয়, অর্থাৎ ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে সভা-সমাবেশ ও মিছিলে সংগঠিত হয়। এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন মীর্জা নুরুল হুদা ছােটি, দবিরুল ইসলাম, আসলেহ উদ্দিন আহমেদ, গােলাম রহমান প্রমুখ। পুলিশ এঁদের আটক করে। কিন্তু তাতে আন্দোলন বন্ধ হয়নি। পরবর্তী পর্যায়ে আবদুল হক, মুস্তাফা নুরুল ইসলাম, মতিউর রহমান চৌধুরী প্রমুখের চেষ্টায় এবং
সাধারণ ছাত্রদের স্বতঃস্ফুর্ত তৎপরতায় আন্দোলন সচল থাকে।” [২৭]
নবগঠিত রাষ্ট্রে পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বাংলার উপর নানা নির্দেশ জারি করতে থাকে। ব্রিটিশদের হাত থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য পূর্ববাংলার যেসব শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণ এককালে পাকিস্তান আন্দোলন করেছিলেন

৪৯
তাদের বােধােদয় হতে বেশি সময় নিলাে না যে বাংলার মানুষ কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা পায়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের নিত্যনতুন নির্দেশের কবলে পড়ে ঐ তরুণেরা তাই আবারও পথে নামেন। নতুন রাষ্ট্রের অলিগলি, রাজপথ কাঁপতে থাকে নতুন সব আন্দোলনের শ্লোগানে। দিনাজপুরের ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলাম এসব আন্দোলনের বেশ কয়েকটির সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। যার অন্যতম হলাে ভাষা আন্দোলন, ছাত্রদের উপর জুলুম প্রতিরােধ আন্দোলন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভুক কর্মচারীদের আন্দোলনের সমর্থক হিসেবে ছাত্র আন্দোলন। এই তিনটি আন্দোলন একই সময়ে চলমান ছিল। তিন আন্দোলনেই সক্রিয় ভূমিকা রাখায় ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ দিনাজপুর রেল স্টেশন থেকে গ্রেফতার হন ছাত্র নেতা দবিরুল ইসলাম। যাই হােক, প্রথমে আলােচনা করা যাক ভাষা আন্দোলনে ছাত্র নেতা দবিরুল ইসলামের অবদানের বিষয়ে। এক্ষেত্রে আগে দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নিই এম আর আখতার মুকুলের স্মৃতিচারণ থেকে,
“১৯৪৮ সালে পূর্ববাংলায় প্রথম ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এ আন্দোলনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমুদুন মজলিশ ছাড়াও গােপনে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশন সক্রিয়ভাবে সমর্থন যােগাতে থাকে। আটচল্লিশ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলনের শ্লোগান ছিলাে, উর্দু আমরা চাই না – ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। সুদীর্ঘ চার বছর পর এ শ্লোগানের পরিবর্তন ঘটে। তখন পরিবর্তিত অবস্থায় শ্লোগান হলাে – ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, উর্দু-বাংলা ভাই ভাই। আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনের জোয়ার দিনাজপুরেও এসে হাজির হলাে। আমরাও এ ব্যাপারে পিছপাও হলাম না ।” [২৮]
অন্যদিকে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার ভাষা আন্দোলনে দবিরুল ইসলামের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন ইতিহাসের গবেষক মাে. সােহেল রানা তার ঠাকুরগাঁও জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থে। সেখান থেকে যে তথ্য উঠে আসে তা হলাে,
“১৯৪৮ সালের ১১ মার্চের ভাষা আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র ছড়িয়ে
পড়লেও ঢাকায় ঘােষিত মার্চ মাসের কর্মসূচি প্রদেশটির কিছু কিছু শহরে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পালন করা হয়। যার অন্যতম ছিল ঠাকুরগাঁও মহকুমা শহর। ফজলুল করিম, আব্দুর রশীদ মােক্তার, ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলামসহ আরও অনেকেই ঠাকুরগাঁও মহকুমার ভাষাআন্দোলনকে জোরদার করে তােলেন।” [২৯]
এছাড়া তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে একই গ্রন্থ থেকে জানা যায়,
“তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল দিনাজপুর জেলা শহর। তাই ঠাকুরগাঁও মহকুমার ছাত্ররা দিনাজপুরেই এই আন্দোলনে বেশি জড়িয়েছিলেন। দিনাজপুর জেলায় ভাষা আন্দোলনের
৫০
মূল নেতৃত্বে ছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের কৃতীসন্তান দবিরুল ইসলাম, এফ.এ. মােহাম্মদ হােসেন এবং ডা. আব্দুল মালেক। এককথায় বলা যায়, তৎকালীন বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ভাষা আন্দোলনকে বেগবান করেছিলেন মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি দবিরুল ইসলাম। মূলত তার নেতৃত্বেই বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এবং তা
পরবর্তীতে বৃহৎ আন্দোলনে রূপ নেয়।” [৩০]
১৯৪৮ সালে দবিরুল ইসলাম, নূরুল হুদা কাদের বক্স, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল প্রমুখের নেতৃত্বে ৩১) দিনাজপুরে ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। কিন্তু এই আন্দোলনের পুরােধা ব্যক্তিত্ব এবং ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলাম ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলনে রাজপথের সম্মুখ সাড়িতে থাকতে পারেনি। এসময় তিনি দিনাজপুর জেলা কারাগারের ৯নং সেলে বন্দি ছিলেন। এ বিষয়ে ঠাকুরগাঁও পরিক্রমা: ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে,
“১৯৫২ সালে যাদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন বেগবান হয়েছিল, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি (১৯৪৯ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত) , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আইন বিভাগের ছাত্র, সাবেক এমএলএ, পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (যুক্তফ্রন্ট), ভাষাসৈনিক মরহুম দবিরুল ইসলাম তাদেরই একজন। ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে সরকারের নির্যাতনের শিকার হন তিনি। পুলিশ তাকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে দিনাজপুর জেলা কারাগারে পাঠায়। ঠাকুরগাঁওয়ে ভাষা আন্দোলনে দবিরুল ইসলামের সহযােদ্ধা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ১৯৫২ সালে দিনাজপুর কারাগারে একই ৯নং সেলে বন্দি, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ভাষাসৈনিক ফজলুল করিম বলেন, ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে দবিরুল ইসলাম কারাবন্দি হন। দিনাজপুর কারাগারে তার উপর নির্মম নির্যাতন চালানাে হয়। এতে তার হার্টের একটি ভাল নষ্ট হয়ে যায়। এ কারণে তিনি
অল্প বয়সে ধুকে ধুকে মারা যান।” [৩২]
দিনাজপুর থেকে প্রকাশিত দৈনিক উত্তরবাংলা পত্রিকার সাংবাদিক ও গবেষক মাে. জোবায়ের আলী জুয়েল তার বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে দিনাজপুর’ শীর্ষক কলামে জানিয়েছেন,
“১৯৪৮ সালে দিনাজপুর শহরের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মূখ্য ভূমিকায় ছিল দিনাজপুর শহরের ছাত্র ও যুবসমাজ। তঙ্কালীন জেলায় উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুরেন্দ্র নাথ কলেজ (বর্তমান সরকারি মহিলা কলেজ), জেলা স্কুল, মহারাজা গিরিজানাথ হাই স্কুল, গােলাপ বাগ মাদ্রাসা, দিনাজপুর একাডেমি স্কুল, গভর্মেন্ট গার্লস স্কুল ও সারদেশ্বরী গার্লস হাই স্কুলের শিক্ষার্থীরা ভাষা আন্দোলনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। …জেলা ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা
সভাপতি দবিরুল ইসলাম ছিলেন দিনাজপুরে সে সময় জনপ্রিয় তুখােড়
৫১
ছাত্রনেতা। তার মেধা ছিল অসাধারণ, কণ্ঠশক্তি, কর্মশক্তি ও জনমত সংগঠনে মায়াময়ী সম্মােহনী শক্তিও। …১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে দিনাজপুরে বৃহত্তর হরতাল পালিত হয়েছিল। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে নবগঠিত মুসলিম আওয়ামী লীগ দিনাজপুর জেলা শহর শাখার নুরুল হুদা মির্জার নেতৃত্বে গঠিত প্রগতিশীল ছাত্রকর্মী, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ও শহরের অন্যান্য স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা ঐক্যবদ্ধভাবে পালন করেন হরতাল। …খবর আসে ঢাকায় ছাত্রদের ওপর গুলি চালানাে হয়েছে। …এই খবর পেয়ে নুরুল হুদা মির্জা (ছােটী ভাই), আসলেউদ্দিন, ছাত্রনেতা আব্দুল হাফিজের নেতৃত্বে সন্ধ্যায় বের হয় বিক্ষোভ মিছিল। …এসময় অ্যাডভােকেট রহিমউদ্দিন আহমেদ, নুরুল হুদা মির্জা ছােটী, দবিরুল ইসলাম, গােলাম রহমান, নাসিম চৌধুরী, এম আর আখতার মুকুল ও তৎকালীন বিপ্লবী রাজনৈতিক নেতা অনিল রায় নিরাপত্তা আইনে বন্দি হন।” [৩৩)
৫২
জুলুম প্রতিরােধ দিবস।
১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলন অগ্নি বিপ্লবে রূপ নেয়। দিনাজপুর জেলাও এর বাইরে ছিল না। সেই উত্তাল দিনগুলােতে দিনাজপুরের ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন অনলবর্ষী বিপ্লবী বক্তা নুরুল হুদা (ছােটি ভাই), এম আর আখতার মুকুল, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা দবিরুল ইসলামসহ অনেকেই। এসময় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিসহ ছাত্রছাত্রীদের অন্যান্য দাবিতে আন্দোলন শুরু হলে পাকিস্তান সরকারের জুলুম নির্যাতন নেমে আসে ছাত্রদের উপর। লেখক এবং স্বাধীনবাংলা বেতারকেন্দ্রের চরমপত্রখ্যাত সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল তার চল্লিশ থেকে একাত্তর’ [৩৪] গ্রন্থে বলেছেন,
“আমি তখন দিনাজপুর রিপন কলেজে (বর্তমান সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) বি.এ. ক্লাসের ছাত্র। ১৯৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলনের জের শেষ হতে না হতেই রাজশাহী কলেজে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য এক ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। এ আন্দোলনের নেতা ছিলেন জনাব গােলাম রহমান। সবেমাত্র বি.এ. পরীক্ষা দিয়েছেন। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে রাজশাহী কলেজের ছাত্র আন্দোলন মারাত্মক আকার ধারণ করলে রাজশাহী কলেজ ও ছাত্রাবাসগুলাে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলাে। আর শুরু হলাে বেপরােয়া গ্রেপ্তার। গােলাম রহমানকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘রাটিকেট (বহিস্কৃত) করা হলাে। এছাড়া রাজশাহী কলেজ থেকে বেশ কিছুসংখ্যক ছাত্রকে জোরপূর্বক টিসি দেওয়া হলাে। এদের তখন অন্য কলেজে ভর্তি হওয়া এক বিরাট সমস্যা। কিন্তু আমরা এসব ছাত্রদের দিনাজপুর কলেজে ভর্তি হবার আমন্ত্রণ জানালাম। অধ্যক্ষ ড. গােবিন্দচন্দ্র দেবের উৎসাহে আমরা এসময় দিনাজপুরে প্রস্তাবিত সুরেন্দ্রনাথ কলেজের চঁদা তােলার জন্য জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। তাই আমাদের অনুরােধে রাজশাহী কলেজ থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রদের দিনাজপুরে ভর্তি করা হলাে। এসময় আমাদের নেতা ছিলেন দবিরুল ইসলাম আর আমরা প্রায়
সবাই ছিলাম হাশেমাইট’-পন্থী”। (৩৫)
এই একই বিষয়ে এম আর আখতার মুকুল তার স্মৃতিচারণগ্রন্থ ‘রূপালী বাতাস’-এ[৩৬] উল্লেখ্য করেছেন,
“১৯৪৮ সালে পূর্ববাংলায় প্রথম ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ….
৫৩
আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনের জোয়ার দিনাজপুরেও এসে হাজির হলাে। আমরাও এ ব্যাপারে পিছপাও হলাম না। কিন্তু হঠাৎ করে শহরে ১৪৪ ধারা জারি করা হলাে। …১৪৪ ধারা পর্যন্ত লঙ্ঘন করলাম। কিন্তু ছাত্র বলেই হােক অথবা যেকোনাে কারণেই হােক, আমাদের বিরুদ্ধে কোনাে ব্যবস্থা নেওয়া হলাে না। এসময় দিনাজপুরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন জনাব হাসান তােরাব আলী , আই.সি.এস। …(তিনি বদলি হয়ে যাবার) সপ্তাহখানেকের মধ্যে এক বাঙালি ডি.এম. দিনাজপুরে এসে হাজির হলেন। … এর মধ্যে রাজশাহী কলেজে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া আদায়ের জন্য এক ছাত্র আন্দোলন দানা বেঁধে উঠলাে। এ আন্দোলনের নেতা ছিলেন অদলীয় ছাত্রনেতা জনাব গােলাম রহমান। … রাজশাহী কলেজের ছাত্র আন্দোলন মারাত্মক আকার ধারণ করলে রাজশাহী কলেজ ও ছাত্রাবাসগুলাে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলাে। শুধু তাই-ই নয়, জনাব গােলাম রহমানকে কয়েকজন সহকর্মীসহ রাজশাহী থেকে বহিষ্কার করা হলাে। আমরা এদের দিনাজপুরে আশ্রয় নেবার জন্য আমন্ত্রণ জানালাম। এদের উপস্থিতির জন্যই রাজশাহীর ছাত্র জুলুমের প্রতিবাদে দিনাজপুরে তীব্র ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠলাে। এ আন্দোলনের সময় মরহুম দবিরুল ইসলাম, জনাব নুরুল হুদা কাদের বকশ ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আমাকেসহ বেশ কয়েকজনকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হলাে। আমাদের গ্রেফতারের খবর ঢাকায় এসে পৌছাবার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগমহলে দারুণ উত্তেজনা দেখা দিলাে। আমাদের সাহায্যার্থে যেসব ছাত্রনেতা সুদূর দিনাজপুরে দৌড়ে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে মেসার্স শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুল হামিদ চৌধুরী, মরহুম আজিজ ভাই অন্যতম ছিলেন। কিন্তু এরা দিনাজপুরে পৌছাবার মাত্র আটচলিশ ঘণ্টার মধ্যে এদের দিনাজপুর থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর কয়েক দিনের মধ্যেই দিনাজপুর জেলে আমাদের উপর লাঠিচার্জ করা হয়। স্বাধীনতা লাভের পর পাকিস্তানের জেলের ভিতরে রাজবন্দীদের উপর লাঠিচার্জের ঘটনা এটাই প্রথম। আর এদিকে ঢাকার তৎকালীন প্রাদেশিক জেলমন্ত্রী ঘােষণা করে বসলেন যে, ‘বিভাগপূর্ব যুগে যারা সরকারবিরােধী রাজনীতি করতেন তারা স্বাধীনতা অর্জনের জন্যই রাজনীতি করতেন, আর আজ যারা সরকারবিরােধী রাজনীতি করছেন তারা অর্জিত স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার জন্যই রাজনীতি করছেন। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা জেল থেকে ছাড়া পেলাম। দিনাজপুরে তখন ছাত্র আন্দোলন চরমে উঠেছে। আমাদের
মুক্তিলাভের ফলেই এ অবস্থার সৃষ্টি হলাে।”
রাজশাহী সরকারি কলেজের আন্দোলন সম্পর্কে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উল্লেখ করেছেন,
“এই সময় রাজশাহী সরকারি কলেজে ছাত্রদের উপর খুব অত্যাচার হল।

৫৪
এরা প্রায় সকলেই ছাত্রলীগের সভ্য ছিল। একুশজন ছাত্রকে কলেজ থেকে বের করে দিল এবং রাজশাহী জেলা ত্যাগ করার জন্য সরকার হুকুম দিল। অনেক জেলায় ছাত্রদের উপর অত্যাচার শুরু হয়েছিল এবং গ্রেফতারও
করা হয়েছিল।” (৩৭)
এদিকে রাজশাহী সরকারি কলেজের ছাত্রদের উপর অত্যাচার ও বহিষ্কারসহ সারা দেশের অন্যান্য স্থানের ছাত্রদের উপর সরকারের নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠের বিশাল ছাত্র জমায়েতে বক্তব্য রাখেন ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরুল ইসলাম ও অলি আহাদ।[৩৮]
জুলুম প্রতিরােধ দিবসের ঘটনাসমূহ রাজনীতিবিদ অলি আহাদের গ্রন্থ ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫’ থেকে জানা যায়,
“ছাত্র দলন ও দমননীতি, ছাত্রনির্যাতন ও গ্রেফতার এবং পুলিশ ও মুসলিম লীগের গুণ্ডামীকে নীরবে সহ্য করা সম্ভব ছিল না। তাই আমরা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ সাংগঠনিক কমিটি ১৯৪৮ সালের ১০ ডিসেম্বরের বৈঠকে ১৯৪৯ সালের ৮ জানুয়ারি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানব্যাপী শিক্ষায়তনগুলিতে ছাত্র ধর্মঘট, ছাত্রসভা অনুষ্ঠান মারফত “জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালনের আহ্বান জানাই। যথারীতি ধর্মঘট পালনের পর বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা দলে দলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়াম মাঠে সমবেত হয়। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সভার কার্য শুরু হয়। জনাব শেখ মুজিবুর রহমান, জনাব দবিরুল ইসলাম ও আমি বক্তৃতা করি। সরকারকে অবিলম্বে জুলুম বন্ধ করার আহ্বান জানাইয়া এক মাসের মধ্যে প্রয়ােজনবােধে কর্মসূচী ঘােষণা করিবার প্রস্তাব গৃহীত হয়। দিনাজপুরে অপ্রতিরােধ্য ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নেতা দবিরুল ইসলাম, নূরুল হুদা কাদের বখস ও এম.আর. আখতার (মুকুল) কারারুদ্ধ হন। কারাগারে তাহাদিগকে দিনাজপুর কারারক্ষী বাহিনী বেদম প্রহার করে। শেখ মুজিবুর রহমান, আব্দুল হামিদ চৌধুরী, আবদুল আজিজ দিনাজপুর পদার্পণ করলে জেলা প্রশাসক ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাহাদিগকে দিনাজপুর
ত্যাগের নির্দেশ দেন।” (৩৯)
বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ’এ জুলুম প্রতিরােধ দিবস’কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে শিক্ষাবিদ ও গবেষক ড. হারুন-অর-রশিদ বলেছেন,
“১৯৪৮ সালের শুরুতে (৪ঠা জানুয়ারি তারিখে) ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা হলেও, তখন পর্যন্ত পাকিস্তানে কোনাে বিরােধী দল প্রতিষ্ঠা পায়নি। ছাত্রলীগ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নসহ মুসলিম লীগ সরকারের গণ-বিরােধী নীতিমালার বিরােধিতা করতে থাকে। সে কারণে এর নেতাকর্মীদের ওপর নেমে আসে
৫৫
অবর্ণনীয় সরকারি জুলুম-নির্যাতন। সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালের ৮ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রধর্মঘট ও সভাসমাবেশ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালিত হয়।” [৪০]

‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস’ সম্পর্কে বাংলাদেশের বামপন্থী রাজনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর বলেছেন,
“রাজশাহীতে ছাত্র ফেডারেশনের আবুল কাসেম এবং অন্য কয়েকজন ছাত্রের বহিষ্কার এবং ঢাকা ও প্রদেশের অন্যত্র বহু ছাত্রের উপর নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার প্রতিকারের উদ্দেশ্যে ৮ই জানুয়ারি, ১৯৪৯, ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস উদযাপনের আহ্বান জানানাে হয়। ঢাকা কলেজে আংশিক ধর্মঘট হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেদিন পূর্ণ ধর্মঘট হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ময়দানে বেলা ২টার সময় মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে একটি সাধারণ ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান, দবিরুল ইসলাম প্রভু তি বক্তৃতা দেন। ছাত্রদের দাবিসমূহ বিবেচনা করে সেগুলিকে স্বীকার করে নেওয়ার জন্যে সরকারকে এক মাসের সময় দেওয়া হয়।” [৪১]
৫৬
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত
কর্মচারীদের আন্দোলন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীরা বেশ কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেকদিন ধরে আলােচনা চালাচ্ছিলেন। কিন্তু তাদের দুরাবস্থার প্রতিকারের জন্য কর্তৃপক্ষ কোন ব্যবস্থা না নেওয়ায় কোন উপায় না দেখে এক মাসের নােটিশে ১৯৪৯ সালের ৩ মে থেকে কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেন। [৪২]
এই আন্দোলন সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে,
“আমরা রাতে ঢাকা এসে পৌছালাম। ১৫০ নম্বর মােগলটুলীতে যেয়ে শুনলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভােগী কর্মচারীরা ধর্মঘট শুরু করেছে এবং ছাত্ররা তার সমর্থনে ধর্মঘট করছে। নিম্নবেতনভােগী কর্মচারীরা বহুদিন পর্যন্ত তাদের দাবি পূরণের জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদননিবেদন করেছে একথা আমার জানা ছিল। এরা আমার কাছেও এসেছিল। পাকিস্তান হওয়ার পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রেসিডেন্সিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। এখন এটাই পূর্ব বাংলার একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্র অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কর্মচারীদের সংখ্যা বাড়ে নাই। তাদের সারা দিন ডিউটি করতে হয়। পূর্বে বাসা ছিল, এখন তাদের বাসা প্রায়ই নিয়ে যাওয়া হয়েছে, কারণ নতুন রাজধানী হয়েছে, ঘরবাড়ির অভাব। এরা পােশাক পেত, পাকিস্তান হওয়ার পরে কাউকেও পােশাক দেওয়া হয় নাই। চাউলের দাম ও অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। চাকরির কোনাে নিশ্চয়তাও ছিল না। ইচ্ছামত তাড়িয়ে দিত, ইচ্ছামত চাকরি দিত। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রথমে সংঘবদ্ধ হােন, তারপর দাবিদাওয়া পেশ করেন, তা
হলে কর্তৃপক্ষ মানবে না। তারা একটা ইউনিয়ন করেছিল, একজন ছাত্র তাদের সভাপতি হয়েছিল। আমি আর কিছুই জানতাম না। জেলায় জেলায় ঘুরছিলাম। ঢাকায় এসে যখন শুনলাম, এরা ধর্মঘট করেছে তখন বুঝতে বাকি থাকল না, কর্তৃপক্ষ এদের দাবি মানতে অস্বীকার করেছে। তবু এত তাড়াতাড়ি ধর্মঘটে যাওয়া উচিত হয় নাই। কারণ, এদের কোনাে ফান্ড নাই। মাত্র কয়েকদিন হল প্রতিষ্ঠান করেছে। কিন্তু কি করব, এখন আর উপায় নাই। সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম, ছাত্ররা এদের প্রতি সহানুভূতিতে ধর্মঘট শুরু করে দিয়েছে। কর্মচারীরা শােভাযাত্রা বের করেছিল। ছাত্ররাও করেছিল।” [৪৩]
৫৭
অন্যদিকে অলি আহাদ এই ধর্মঘটকে বর্ণনা করেছেন এভাবে,
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভুক কর্মচারীদের ধর্মঘট সমর্থনে আমরা (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ১৯৪৯ সালের) ৩রা মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ে সহানুভূতিসূচক ছাত্র ধর্মঘট পালন করি। ১৯৪৮ সালের ৩০শে জুন গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় কর্মপরিষদের আহ্বায়ক আবদুর রহমান চৌধুরী আমার (সংগঠনের ঢাকা শহর কমিটির আহ্বায়ক অলি আহাদ) অনুরােধে ৫ই মার্চ কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে পুনরায় ছাত্র ধর্মঘট ও সভা অনুষ্ঠানের কর্মসূচী ঘােষণা করেন। …১৯৪৯ সালের ১০ই মার্চ আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় জনাব দবিরুল ইসলাম ও জনাব আবদুল হামিদ চৌধুরীর যুক্তিপূর্ণ বক্তৃতার পর ধর্মঘটী নিম্নবেতনভুক কর্মচারীবৃন্দ কাজে যােগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রকৃতপক্ষে সাধারণ ছাত্রগণ অবিরাম ধর্মঘট খুব প্রীতির চোখে দেখিতেছিল না। ইহাই আমাদিগকে ভাবাইয়া তুলিয়াছিল। অতএব ধর্মঘট প্রত্যাহার সময়ােচিত ও বাস্তবসম্মত ছিল। পরিতাপের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাদের সদিচ্ছাকে ভুল বুঝিলেন এবং বেলা ১টার মধ্যে কর্মে যােগদানের কথা ছিল এই মিথ্যা অভিযােগ ও অজুহাতে অত্যন্ত অন্যায়ভাবে ধর্মঘটী কর্মচারীদের যােগদানপত্র প্রত্যাখ্যান করিলেন। শুধু তাই নয়, ১১ই মার্চ হইতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘােষণা করা হইল। … ছাত্রাবাসগুলির ডাইনিং হল বন্ধ করিয়া দেওয়ায় আমরা কতিপয় ছাত্র
ব্যতীত অন্যান্য আবাসিক ছাত্ররা হল ত্যাগ করে।” [৪৪]
একই বিষয়ে বামপন্থি রাজনীতিবিদ, গবেষক ও লেখক বদরুদ্দীন উমরের বর্ণনা থেকে জানা যায়,
“৫ই মার্চ পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের আহ্বান এবং উদ্যোগে পূর্ণ। ছাত্রধর্মঘটের পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বেলা ১২-৩০ মিনিটে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ছাত্রেরা স্থির করেন যে কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া কতৃ পক্ষ যতদিন না স্বীকার করেন ততদিন পর্যন্ত তারা সহানুভূতিসূচক ধর্মঘট অব্যাহত রাখবেন। তারপর সেই সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নকর্মচারী ও ছাত্রদের ধর্মঘট পরিচালনার ভার বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র কর্ম পরিষদের উপর অর্পণ করা হয়। বেলা ২-৩০ মিনিটের সময় এই সভা শেষ হলে ছাত্রেরা ভাইস চ্যান্সেলরের (অধ্যাপক সৈয়দ মােয়াজ্জেম হুসাইন) বাড়ির সামনে মিছিল সহকারে উপস্থিত হন এবং বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকেন। সে সময় ভাইস চ্যান্সেলরের বাসায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টারও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ছাত্রদের জানান যে সেদিন বিকেল পাঁচটায় বিশ্ববিদ্যালয় একজিকিউটিভ কাউন্সিলের বৈঠক বসলে তিনি তাদেরকে ধর্মঘট ইত্যাদির বিষয় অবহিত করবেন। একজিকিউটিভ কাউন্সিল সেইদিনকার বৈঠকে ছাত্রদেরকে নিম্বকর্মচারী ধর্মঘটে অংশ গ্রহণকারী বলে ঘােষণা করে তাদের
৫৮
বিরুদ্ধে যথােপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বনের হুমকি দেন। …৯ই মার্চ বেলা ১২৩০ মিনিটে আবদুর রহমান চৌধুরীর সভাপতিত্বে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি সভা হয়। তাতে স্থির করা হয় যে ছাত্রেরা মিছিল করে ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে যাবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত না কর্তৃপক্ষ লিভিতভাবে ধর্মঘটি নিম্নকর্মচারীদের দাবি দাওয়া স্বীকার করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তারা ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে অবস্থান ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন। এই সিদ্ধান্ত অনুসারে সভার পর ছাত্রেরা মিছিল সহকারে ভাইস চ্যান্সেলরের। বাসভবনে উপস্থিত হন। কিন্তু সেখানে রাত্রি ৯-৪৫ মিনিট পর্যন্ত অপেক্ষা করেও একজিকিউটিভ কাউন্সিল অথবা ভাইস চ্যান্সেলরের কাছ থেকে কোন লিখিত প্রতিশ্রুতি অথবা আশ্বাস পাওয়া গেল না। …১০ই মার্চ বেলা বারােটায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র এবং নিম্নকর্মচারীদের একটি যৌথ সভা হয়। সেই সভায় ছাত্র লীগের নেতৃবৃন্দ কর্তৃপক্ষের কথা বিশ্লেষণ করে সকলকে বুঝিয়ে দিতে চেষ্টা করেন যে ছাত্র এবং ধর্মঘটীরা প্রকৃতপক্ষে জয় লাভ করেছেন কাজেই এরপর তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করা উচিত। কর্মপরিষদের বিশিষ্ট সদস্য দবিরুল ইসলাম ধর্মঘটী কর্মচারীদের কাছে এ ব্যাপারে বিশেষভাবে আবেদন জানালেন এবং ওজস্বিনী ভাষায় তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে কর্তৃপক্ষ তাদের অঙ্গীকার রক্ষা না করলে ছাত্রেরা তাদের বুকের রক্ত দিয়ে ধর্মঘটীদের দাবি-দাওয়া আদায় করে দেবেন। ছাত্রনেতাদের এই বক্তৃতা ও প্রতিশ্রুতির পর নিম্নকর্মচারীরা তাদের ধর্মঘট প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন এবং বেলা ১টার সময় নিজ নিজ কাজে যােগ দান করতে যান।…কিন্তু ধর্মঘটীদের ধর্মঘট প্রত্যাহার ও কাজে যােগদানের সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদেরকে কাজে যােগ দিতে বাধা দেন। সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে এবং পরদিন সংবাদপত্রের মাধ্যমে একটি বিবৃতি প্রচার করে ভাইস চ্যান্সেলর বলেন যে ১০ই মার্চ বেলা ১১টার মধ্যে কর্মচারীদের কাজে যােগদানের কথা ছিল। তারা ঐ সময়ে কাজে যােগদান
করায় তিনি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। পরদিন থেকে একজিকিউটিভ কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত মতাে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ রাখার কথাও তিনি ঘােষণা করেন। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব দিন ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে ছাত্রদের আলাপের সময় বেলা ১১টার মধ্যে কর্মচারীদের কাজে যােগদানের কোন কথাই হয় নি। কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের সাথে তাদের মৌখিক চুক্তি ভঙ্গ করার পর ছাত্র কর্মপরিষদ সেদিনই একটি বৈঠকে মিলিত হন এবং নতুন পরিস্থিতিতে পূর্ব নির্ধারিত পথেই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া স্থির করেন। রাত্রি ৯টায় সেদিন ফজলুল হক হলের ছাত্রদের একটি সভা হয় এবং তাতে দবিরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদ পরিস্থিতির উপর বক্তৃতা দেন। …১১ই মার্চ কর্মপরিষদের পক্ষ থেকে তারা একটি বিবৃতি তৈরি করেন এবং সেটি সংবাদপত্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। …সেদিন রাত্রেই ১০টা থেকে ৩-৩০ পর্যন্ত সলিমুল্লাহ হলে

৫৯
কর্মপরিষদের একটি দীর্ঘ বৈঠক বসে। ইতিমধ্যেই কর্তৃপক্ষ হল বন্ধ করার সিদ্ধান্তও ঘােষণা করেন। …১৩ই মার্চ… বেলা ১টার পর সলিমুল্লাহ হলে কর্মপরিষদের আর এক বৈঠক বসে। তাতে স্থির হয় যে অধিকাংশ ছাত্র হল ছেড়ে চলে গেলে সকলকেই তারা হল ত্যাগ করতে বলবেন। ১৪ তারিখে সকাল ৯টায় ঢাকা হল প্রাঙ্গণে তাজউদ্দিন আহমদ প্রভৃতি অল্পসংখ্যক ছাত্র একত্রিত হয়ে স্থির করেন যে, সকলে হল ত্যাগ করে চলে যাওয়ার জন্যে যেভাবে তৈরি হয়েছে তাতে তাদের পক্ষেও আর হলে থাকা সঙ্গত নয়।
এই সিদ্ধান্ত অনুসারে এর পর তারা সকলেই হল ত্যাগ করেন।” [৪৫]
১৯৬৯ সালের ২৬ এপ্রিল গবেষক বদরুদ্দীন উমরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তাজউদ্দীন আহমদ জানান,
“১১ই মার্চ খুব ভাের থেকে ছাত্রেরা পিকেটিং এর জন্যে বেরিয়ে পড়ে। …ছাত্রেরা নিজের হল থেকে batch by batch বেরিয়ে পিকেটিং এর জন্যে বেরিয়ে পড়লাে। তারা সেদিন মিছিল করে সকালের দিকে বের হয়নি। সকালে কোন মিটিংও হয়নি। প্রথম batch এ শামসুল হক, মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ এবং আরও অনেকে গ্রেফতার হন। আমি এবং ফজলুল করিম সকালে রমনা পােস্ট অফিসের সামনে গিয়ে দেখি যে ১৩/১৪ জন ছাত্রসহ তােয়াহা সাহেবকেও S.P. গফুর আটকে রেখেছে। আমরা তােয়াহা সাহেবের সাথে সামান্য কথা বলে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে পড়লাম। পরে তােয়াহা সাহেব S.P. গফুরের সাথে অনেকক্ষণ তর্কাতর্কি করে সেখান থেকে কেটে পড়েছিলেন। ১১ই মার্চ বিকেলের দিকে ১-৩০ মি:-২টার মধ্যে ইউনিভার্সিটি আমতলায় মিটিং হয়। বক্তাদের মধ্যে দবিরুল ইসলামের কথা মনে আছে।”[৪৬]
৬০
ছাত্র আন্দোলনের দায়ে গ্রেফতার:
ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলাম
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভুক কর্মচারীদের আন্দোলন দমাতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৪৯ সালের ১১ মার্চ থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটি ঘােষণা করেন। এসময় সুরেন্দ্রনাথ কলেজে আয়ােজিত ছাত্রলীগের এক সম্মেলনে যােগ দিতে দবিরুল ইসলাম ১৩ মার্চ রাতে দিনাজপুর রেল স্টেশনে এসে পৌছালে সেখান থেকেই পূর্ববঙ্গ বিশেষ ক্ষমতা অর্ডিন্যান্স বলে গ্রেফতার হন। [৪৭] |
“১৯৪৯ সালের ১৫ই মার্চ অনুষ্ঠিতব্য দিনাজপুর জিলা মুসলিম ছাত্রলীগ সম্মেলনে যােগদানের উদ্দেশ্যে ছাত্র নেতা দবিরুল ইসলাম সেখানে গেলে ১৩ই মার্চ বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। বন্দি অবস্থায় তার ওপর চালানাে হয় অমানবিক নির্যাতন। বঙ্গবন্ধু কিছু কর্মী নিয়ে
দিনাজপুর ছুটে যান।” [৪৮]
সরকার থেকে দবিরুল ইসলামকে গ্রেফতারের কারণ সরাসরি না জানালেও এটা স্পষ্ট ছিল যে, রাজশাহী সরকারি কলেজে ছাত্র বহিষ্কারের প্রতিবাদসহ অন্যান্য দাবিদাওয়া সংক্রান্ত আন্দোলনের ফলস্বরূপ চালানাে পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালন, দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁওয়ে ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভুক্ত কর্মচারীদের ন্যায্য আন্দোলনের সমর্থক ছাত্র কর্মপরিষদের অন্যতম সদস্য হওয়া, তার গ্রেফতারের পেছনে ইন্ধন যুগিয়েছে। ১৩ মার্চ গ্রেফতার করে তাকে ১০ মাসেরও বেশি সময় বিনা বিচারে দিনাজপুর কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এসময় তার উপর চালানাে হয় অমানবিক নির্যাতন। [৪৯]
ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলামের গ্রেফতার সম্পর্কে গবেষক, কলামিস্ট বিলু কবীর তার ‘চিরদিন তােমার আকাশ’ কলামে দবিরুল ইসলাম ভাষা আন্দোলনের অজানা কুশীলব’ শীর্ষক কলামে জানিয়েছেন,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানাে নেতৃবৃন্দের মধ্যে অন্যতম নেতা হওয়ায় ১৯৪৯ সালের ১৩ই মার্চ, রােববার , রাত ৮ ঘটিকার সময় দিনাজপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে পুলিশ দবিরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে। সারারাত সেই ২৭ বছর বয়সী তরুণ নেতাকে রেলওয়ে জিআরপি অফিসে রাখা হয়। পরদিন দুপুরে তাকে দিনাজপুর কারাগারে পাঠানাে হয়। পাকিস্তানের পেটোয়া পুলিশ বাহিনী তার ওপর এতটাই শারীরিক নির্যাতন চালায় যে, তাকে শেষ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।[ ৫০]

৬১
অন্যদিকে এম আর আখতার মুকুল জানিয়েছেন,
“আঙ্গুল গুনলে ঠিক ৪৮ বছর। আমি বিস্মৃতির অন্তরালে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের কথা বলবাে। ১৯৪৮ সালে আমি ছিলাম দিনাজপুর রিপন কলেজে (শাখা) বিএ ক্লাসের ছাত্র। এ বছর ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলাে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ। আমি এই ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। দিনাজপুর জেলায় আমাদের নেতা ছিলেন দবিরুল ইসলাম আর কেন্দ্রীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ইংরেজ আমলের অন্তিম সময়ে আমরা ছিলাম সােহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেমের অন্ধ সমর্থক। তাই আমাদের ‘হাশেমাইট” হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সেই সুবাদে আমরা নব্যসৃষ্ট পাকিস্তানে বিরােধী দলীয় রাজনীতিবিদদের ‘ভ্যান গার্ডে’ পরিণত হলাম। ফলে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের আঘাত এলাে আমাদের উপর। বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেফতার করা হলাে দিনাজপুর কলেজের বেশ ক’জন ছাত্রনেতাকে। আমি ছাড়াও এদের মধ্যে ছিলেন সর্বজনাব দবিরুল ইসলাম, মির্জা নরুল হুদা কাদের বকশ, আসলেউদ্দীন, কেশব সেন ও উপেন দাস প্রমুখ। সে এক অদ্ভুত ব্যাপার। কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান ও ভারতে একই সঙ্গে রেলওয়ে ধর্মঘট আহ্বান করলে এক নাজুক অবস্থার সৃষ্টি হয়। অযথা কিছু কর্মী গ্রেফতার ও ধর্মঘট ব্যর্থ হয়। কিন্তু এ সময় কমরেড হাজী
৬২
মােহাম্মদ দানেশের সমর্থক হাজার হাজার কৃষক এসে দিনাজপুর-রুহিয়া সেকশনে যে মাইলখানেক রেলওয়ে লাইন উঠিয়ে নিয়ে চলে গিয়েছিলাে, সেই মামলায় আটক ছাত্রনেতাদের আসামী করা হলাে। মামলায় আমাদের সাজা হয়ে গেলাে।”
৬৩
দিনাজপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৪৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান তখনও বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পাননি। সেসময় তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের অন্যতম সাংগঠনিক সম্পাদক। বঙ্গবন্ধু নিজে ছাত্রনেতা হয়েও সংগঠনের সকল ধরনের দায়-দায়িত্বের ভার তিনি যেন স্বেচ্ছায় নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। [৫১] অন্য ছাত্রনেতা-কর্মীরাও নির্দ্বিধায় সেসব কাজের ভার তার উপর অর্পণ করে নিজেরা নিশ্চিন্তে থাকতেন। বঙ্গবন্ধু সমসাময়িক ছাত্র নেতাদের মধ্যে অনেকের চেয়ে বয়সে জ্যেষ্ঠ হলেও [৫২] নিজেকে সংগঠনের কোন বড়াে নেতা’ ভাবতেন না। এজন্য তিনি নিজেকে ছাত্রসংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করেননি। বরং সংগঠনের সকল নেতাকর্মীকে সহকর্মী হিসেবে অভিহিত করতেন। এজন্যই তিনি পূর্ববাংলার যেখানেই সংগঠনের যে কোন স্তরের নেতাকর্মীর উপর পুলিশি নির্যাতনের খবর পেয়েছেন, সেখানেই ছুটে গিয়েছেন, সেই গ্রেফতারনির্যাতনের প্রতিবাদ করেছেন, বন্দি নেতাকর্মীদেরকে কারাগার থেকে উদ্ধারে তৎপর হয়েছেন। তেমনিভাবে দবিরুল ইসলামসহ অন্যান্য ছাত্রনেতাদের গ্রেফতারের খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু দিনাজপুরে গিয়ে হাজির হন। এই ঘটনার কথা বঙ্গবন্ধু তার অসামাপ্ত আত্নজীবনী’তে লিখে রেখেছিলেন এভাবে,
“১৯৪৯ সালে জানুয়ারি অথবা ফেব্রুয়ারি মাসে দিনাজপুরেও ছাত্রদের গ্রেফতার করা হয়েছিল। জেলের ভিতর দবিরুল ইসলামকে ভীষণভাবে মারপিট করেছিল – যার ফলে জীবনের তরে তার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়েছিল। ছাত্ররা আমাকে কনভেনর করে ‘জুলুম প্রতিরােধ দিবস পালন করার জন্য একটা কমিটি করেছিল। একটা দিবসও ঘােষণা করা হয়েছিল। পূর্ব বাংলার সমস্ত জেলায় জেলায় এই দিবসটি উদ্যাপন করা হয়। কমিটির পক্ষ থেকে ছাত্রবন্দিদের ও অন্যান্য বন্দিদের মুক্তি দাবি করা হয় এবং ছাত্রদের উপর হতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার করতে অনুরােধ করা হয়। এই প্রথম পাকিস্তানে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির আন্দোলন এবং জুলুমের
প্রতিবাদ। এর পূর্বে আর কেউ সাহস পায় নাই।” [৫৩]
এ বিষয়ে রাজনীতিবিদ অলি আহাদ তার জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ‘৭৫’ নামক গ্রন্থে বলেছেন,
“দিনাজপুরে অপ্রতিরােধ্য ছাত্র আন্দোলনের সূচনা হইলে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নেতা দবিরুল ইসলাম, নূরুল হুদা কাদের বক্স ও এম.আর. আখতার (মুকুল) কারারুদ্ধ হন। কারাগারে তাহাদিগকে দিনাজপুর কারারক্ষী বাহিনী বেদম প্রহার করে। শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল হামিদ
৬৪
চৌধুরী, আবদুল আজিজ দিনাজপুর পদার্পণ করিলে, জেলা প্রশাসক ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাহাদিগকে দিনাজপুর ত্যাগের নির্দেশ দেন।” [৫৪]

৬৫
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার : কর্ম পরিষদের ছাত্রনেতাগণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্নবেতনভুক কর্মচারীদের আন্দোলন দমাতে একজিকিউটিভ কাউন্সিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। একইসঙ্গে কর্তৃপক্ষ হল বন্ধ করারও সিদ্ধান্ত নিলে হলের ডাইনিং বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে আবাসিক ছাত্ররা বাড়ি ফেরার প্রস্তুতি নিলে ছাত্র কর্ম পরিষদের নেতাকর্মীরাও হল ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। এরই মধ্যে সংবাদপত্রে খবর বের হয় নিম্নবেতনভুক কর্মচারীদের আন্দোলনকে বেগবান করার অপরাধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ২৯ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ও দবিরুল ইসলামসহ ছাত্র কর্মপরিষদের ২৭ জন সদস্যকে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি প্রদান করেছেন।
“এই সময় আমি ও কয়েকজন কর্মী দিনাজপুর যাই। কারণ, কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেফতার করে জেলে রেখেছে এবং দবিরুল ইসলামকে জেলের ভিতর মারপিট করেছে। ১৪৪ ধারা জারি ছিল। বাইরে সভা করতে পারলাম না। ঘরের ভিতর সভা করলাম। আমরা হােস্টেলেই ছিলাম। আবদুর রহমান চৌধুরী তখন ছাত্রলীগের সেক্রেটারি ছিল। আমরা যখন ঢাকা ফিরে আসছিলাম বােধহয় আবদুল হামিদ চৌধুরী আমার সাথে ছিল। ট্রেনের মধ্যে খবরের কাগজে দেখলাম, আমাদেরসহ সাতাশজন ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করেছে। এর মধ্যে দিনাজপুরের দবিরুল ইসলাম, অলি আহাদ, মােল্লা জালালউদ্দিন (এখন এডভােকেট), আবদুল হামিদ চৌধুরীকে চার বৎসরের জন্য আর অন্য সকলকে বিভিন্ন মেয়াদে। তবে এই চারজন ছাড়া আর সকলে বন্ড ও জরিমানা দিলে লেখাপড়া করতে পারবে। মেয়েদের মধ্যে একমাত্র লুলু বিলকিস বানুকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তিনি ছাত্রলীগের মহিলা শাখার কনভেনর ছিলেন।” [৫৫] রাজনীতিবিদ অলি আহাদ রচিত ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫ গ্রন্থ থেকে বহিষ্কৃত ছাত্রদের নাম জানা যায়, তারা হলেন,
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালে ২৯শে মার্চ (১৯৪৯) বিশ্ববিদ্যালয় এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল নিম্নলিখিত ২৪ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ছাত্রদের অপরাধ- তাহারা নিম্নবেতনভুক কর্মচারীদের ধর্মঘটের সমর্থনে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করিয়াছিল।

৬৬
(ক) ৪ বৎসরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বহিষ্কার:
(১) দবিরুল ইসলাম (আইন ছাত্র), ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ, (২) আবদুল হামিদ চৌধুরী (এম.এ. ক্লাস), (৩) অলি আহাদ (বি.কম. দ্বিতীয় বর্ষ), (৪) আবদুল মান্নান (বি.এ. ক্লাস), (৫) উমাপতি মিত্র (এম.এস.সি. পরীক্ষার্থী), (৬) সমীর কুমার বসু (এম.এ. ক্লাস)।
(খ) বিভিন্ন হল হইতে বহিষ্কার:
(১) আবদুর রহমান চৌধুরী (আইন ছাত্র), সহ-সভাপতি, সলিমুল্লাহ
মুসলিম হল ছাত্র সংসদ, (২) মােল্লা জালালউদ্দিন আহমদ (এম.এ. ক্লাস), (৩) দেওয়ান মাহবুব আলী (আইন ছাত্র) , (৪) আবদুল মতিন (এম.এ. ক্লাস), (৫) আবদুল মতিন খান চৌধুরী (আইন ছাত্র), (৬) আবদুর রশিদ ভূঁইয়া (এম.এ. ক্লাস), (৭) হেমায়েত উদ্দিন আহমদ (বি.এ. ক্লাস), (৮) আবদুল মতিন খান (এম.এ. পরীক্ষার্থী), (৯) নূরুল ইসলাম চৌধুরী (এম.এ. ক্লাস), (১০) সৈয়দ জামাল কাদেরী (এম.এস.সি. ক্লাস) , (১১) আবদুস সামাদ (এম.কম. ক্লাস), (১২) সিদ্দীক আলী (এম.এ. ক্লাস), (১৩) আবদুল বাকী (বি.এ. ক্লাস), (১৪) জে. পাত্ৰনবিশ (এম.এস.সি ক্লাস), (১৫) অরবিন্দ বসু (আইন ছাত্র), সহ-সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ, ডাকসু।
(গ) পনেরাে টাকা জরিমানা:
(১) শেখ মুজিবুর রহমান (আইন ছাত্র) (২) কল্যাণ দাস গুপ্ত (এম.এ. ক্লাস), সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা হল ছাত্র
সংসদ, (৩) নঈমুদ্দিন আহমদ (এম.এ. ও ল’র ছাত্র), আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান
মুসলিম ছাত্রলীগ, (৪) মিস নাদেরা বেগম (এম.এ. ক্লাস), (৫) আবদুল ওয়াদুদ (বি.এ. ক্লাস)।
৬৭
(ঘ) দশ টাকা জরিমানা:
(১) মিস লুলু বিলকিস বানু (আইন ছাত্রী), আহ্বায়ক, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের মহিলা শাখা।
বিশ্ববিদ্যালয় হইতে ৪ বৎসরের জন্য বহিষ্কৃত আমরা ছয়জন ছাত্র ব্যতীত বিভিন্ন সাজাপ্রাপ্ত বাকি একুশ জনকে ১৭ই এপ্রিলের মধ্যে লিখিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকট মুচলেকা দাখিল করিবার নির্দেশ জারি করা হয়।…ছাত্র আন্দোলন দমনের নিমিত্ত নুরুল আমিন সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ অবস্থায়ই আমরা সাতাশ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে উপরােক্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।” [৫৬]
বামপন্থি রাজনীতিবিদ ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর এ বিষয়টি তার পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি, প্রথম খণ্ড’এ উল্লেখ করেছেন এভাবে,
“বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পর কর্তৃপক্ষ ২৭ জন ছাত্র-ছাত্রীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এদের মধ্যেও ৬ জনকে ৪ বৎসরের জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার, ১৫ জনকে হল থেকে বহিষ্কার, ৫ জনকে ১৫ টাকা হিসেবে এবং ১ জনকে ১০ টাকা হিসাবে জরিমানা করা হয়। এছাড়া তারা শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্রদের বৃত্তি বন্ধ করারও সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তাই নয়, তারা আরও স্থির করেন যে, ১৭ই এপ্রিলের মধ্যে অভিভাবকদের মধ্যস্থতায় সৎচরিত্র সম্পর্কিত সার্টিফিকেট দাখিল না করলে তাদেরকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হবে। এদের মধ্যে অনেকেই এই ধরনের সার্টিফিকেট দাখিল করে এবং জরিমানা দিয়ে কর্তৃপক্ষের সাথে আপােষ করেন।” [৫৭] বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বন্ড সই দেওয়ার বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন,
“১৬ এপ্রিল খবর পেলাম, ছাত্রলীগের কনভেনর নইমউদ্দিন আহমেদ, ছাত্রলীগের আরেক নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী (এখন এডভােকেট) – ভিপি সলিমুল্লাহ হল, দেওয়ান মাহবুব আলী (এখন এডভােকেট) আরও অনেকে গােপনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেয়ে বন্ড দিয়েছেন। যারা ছাত্রলীগের সভ্যও না, আবার নিজেদের প্রগতিবাদী বলে ঘােষণা করতেন, তারাও অনেকে বন্ড দিয়েছেন। সাতাশজনের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বন্ড দিয়ে দিয়েছে। কারণ ১৭ তারিখের মধ্যে বন্ড না দিলে আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকবে না। ছাত্রলীগের কনভেনর ও সলিমুল্লাহ হলের ভিপি বন্ড দিয়েছে খবর রটে যাওয়ার সাথে সাথে ছাত্রদের মনােবল একদম ভেঙে গিয়েছিল। আমি তাড়াতাড়ি কয়েকজনকে নিয়ে নইমউদ্দিনকে ধরতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাকে পাওয়া কষ্টকর, সে পালিয়ে গিয়েছিল। সে এক বাড়িতে লজিং থাকত। সন্ধ্যার কিছু পূর্বে তাকে ধরতে পারলাম। সে স্বীকার করল আর বলল, “কি করব, উপায় নাই। আমার অনেক অসুবিধা। তার সাথে আমি
৬৮
অনেক রাগারাগি করলাম এবং ফিরে এসে নিজেই ছাত্রলীগের সভ্যদের খবর দিলাম, রাতে সভা করলাম। অনেকে উপস্থিত হল। সভা করে এদের বহিষ্কার করা হল এবং রাতের মধ্যে প্যামপ্লেট ছাপিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করলাম। কাজী গােলাম মাহাবুবকে (এখন এডভােকেট) জয়েন্ট কনভেনর করা হয়েছিল। সে নিঃস্বার্থভাবে কাজ চালিয়েছিল।” [৫৮]
সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল এই বহিষ্কারের বিষয়ে আমি বিজয় দেখেছি’ গ্রন্থে লিখেছেন,
“১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নতমকর্মচারী ধর্মঘটের জের হিসেবে নেতৃস্থানীয় জনাবারাে ছাত্রকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ স্কলারশিপ বাতিল ও জরিমানা ইত্যাদি ধরনের শাস্তি প্রদান করলে শেখ মুজিব ছাড়া বাকি এগারাে জনই ক্ষমার আবেদন করে অব্যাহতি লাভ করেন। এ সময় ছাত্র রাজনীতির কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জনাব অলি আহাদসহ ৬ জনকে ৪ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। মুজিব ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি করবাে না বলে মুচলেকা দিতে অস্বীকার করেন। ফলে শেখের ছাত্র জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রায় একুশ বছর পর বাংলাদেশ যখন স্বাধীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তখন এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে মুজিবের প্রতি প্রদত্ত শাস্তি প্রত্যাহার করে। অবশ্য তখন তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।” [৫৯]
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উক্ত শাস্তিমূলক আদেশ প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একশ’ জন ছাত্র ১৮ এপ্রিল বিকেল থেকে ভাইস চ্যান্সেলরের বাড়িতে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন। তবে ১৯ তারিখ বিকেল ৩টায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এসপিসহ বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে এসে শেখ মুজিবুর রহমানসহ ধর্মঘট করতে থাকা ছাত্রদেরকে গ্রেফতার করে ঢাকা জেলে নিয়ে যান।[ ৬০]
এ বিষয়ে ১৯৬৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর গবেষক বদরুদ্দীন উমরকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জানিয়েছিলেন,
“১৭ই এপ্রিল ছিলাে বিশ্ববিদ্যালয় খােলার তারিখ। সেই দিনের মধ্যেই ছাত্র নেতাদেরকেও মাফ চেয়ে নিতে বলা হলাে। অন্যথায় তাদেরকে বহিষ্কার করা হবে বলে জানানাে হলাে। ছাত্র নেতাদের মধ্যে আবদুর রহমান চৌধুরী, নঈমুদ্দীন আহমদ, দেওয়ান মাহবুব আলী, আবদুল মতিন চৌধুর ১৫/১৬ জন বন্ড দিয়ে দিলাে। ছাত্র লীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন বন্ড দেওয়ায় আমরা খুব মুস্কিলে পড়লাম। সাধারণ কর্মীরা অবশ্য এদিক দিয়ে অটল ছিলাে। আমরা এর পরই আবদুর রহমান চৌধুরী এবং নঈমুদ্দীনকে ছাত্র লীগ থেকে বহিষ্কার করে দিই। এই আন্দোলনের সময় জগন্নাথ কলেজ, মেডিকেল কলেজ, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ছাত্রেরা সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসেছিলাে।
৬৯
১৮ই এপ্রিল আমরা ভাইস-চ্যান্সেলারের বাড়ীতে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করলাম। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের একটা নােতুন কমিটি গঠন করা হলাে। সেই কমিটির লােকজন নিয়ে আমরা VC. এর বাড়ীতে বসে থাকলাম। পুলিশ অফিসার পরে এক সময় দলবল নিয়ে আমাদেরকে ঘেরাও করে সেই স্থান ত্যাগের নির্দেশ দিলাে কিছুক্ষণের মধ্যে। অনেকে চলে গেলেও আমরা ৮/১০ জন থাকলাম। তাজউদ্দীন সেই সময় প্রেস প্রতিনিধি সেজে অভিনয় করায় গ্রেফতার থেকে অব্যাহতি পায় কিন্তু আমরা কয়েকজন গ্রেফতার হয়ে যাই। যারা গ্রেফতার হই তাদের মধ্যে আমি ছাড়া ছিলাে বরকত, হাসনাত, খােন্দকার গােলাম মােস্তফা, আজিজ আহমদ, খালেক নওয়াজ, কাজী গােলাম মাহবুব, বাহাউদ্দীন চৌধুরী, অলি আহাদ প্রভৃতি।
এই ঘটনার ৫/৭ দিন পর আন্দোলন থেমে যায়।” [৬১]
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কিছু নেতার বিশ্বাসঘাতকতা সম্পর্কে তাজউদ্দিন আহমদ তার ডায়েরিতে ১৯৪৯-এর ১৪ মে তারিখে লিখেছেন, “(আজ) তােয়াহা সাহেব এসেছিলেন সন্ধে ৮টায় এবং তারপর আমার কামরায় এসেছিলেন নঈমুদ্দীন সাহেব। নঈমুদ্দীন সাহেবের বিশ্বাসঘাতকতার পর এই তার প্রথম আবির্ভাব। আমরা রাত্রি ১১টা পর্যন্ত আলাপ করলাম।” [৬২]
৭০
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন
এসময় (১৯৪৯ সালে) শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকতেই খবর পান বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ-এর কর্মী সম্মেলনের তােড়জোড় চলছে। এ বিষয়ে জেলখানায় শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যােগাযােগ করা হলে তিনি খবর পাঠান,
“আর মসলিম লীগের পিছনে ঘুরে লাভ নাই, এ প্রতিষ্ঠান এখন গণবিচ্ছিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এরা আমাদের মুসলিম লীগে নিতে চাইলেও যাওয়া উচিত হবে না। কারণ এরা কোটারি করে ফেলেছে। একে আর জনগণের প্রতিষ্ঠান বলা চলে না। এদের কোন কর্মপন্থাও নাই। আমাকে আরও জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, আমি ছাত্র প্রতিষ্ঠান করব, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন হলে তাতে যােগদান করব? আমি উত্তর পাঠিয়েছিলাম, ছাত্র রাজনীতি আমি আর করব না, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানই করব। কারণ বিরােধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।… যাহােক, কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রােজ গার্ডেন বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল। শুধু কর্মীরা না, অনেক রাজনৈতিক নেতাও সেই সম্মেলনে (১৯৪৯ সালের ২৩ জুন) যােগদান করেন। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আল্লামা মওলানা রাগীব আহসান, এমএলএ’দের ভিতর থেকে জনাব খয়রাত হােসেন, বেগম আনােয়ারা খাতুন, আলী আহমদ খান ও হাবিবুর রহমান চৌধুরী ওরফে ধনু মিয়া এবং বিভিন্ন জেলার অনেক প্রবীণ নেতাও যােগদান করেছিলেন। সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন; তার নাম দেওয়া হল, ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ । মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, জনাব শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক এবং আমাকে। করা হল জয়েন্ট সেক্রেটারি। খবরের কাগজে দেখলাম, আমার নামের পাশে লেখা আছে ‘নিরাপত্তা বন্দি। আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা সুষ্ঠু ম্যানিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনও আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন তারা চিন্তাভাবনা করেই করেছেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন হওয়ার
৭১
কয়েকদিন পরেই আমার ও বাহাউদ্দিনের মুক্তির আদেশ এল। বাইরে থেকে আমার সহকর্মীরা নিশ্চয়ই খবর পেয়েছিল। জেলগেটে গিয়ে দেখি বিরাট জনতা আমাদের অভ্যর্থনা করার জন্য এসেছে মওলানা ভাসানী সাহেবের নেতৃত্বে।… (শামসুল হক সাহেব আমাকে জড়িয়ে ধরলেন এবং বললেন, ‘চল, এবার শুরু করা যাক। পরে আওয়ামী মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ নামে পরিচিত হয়।” [৬৩]
৭২
‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’-এর প্রথম কাউন্সিল সভা:
সংগঠনের প্রথম সভাপতি দবিরুল ইসলাম
সংগঠনের নীতি-আদর্শের কেউ অপব্যবহার করলে, সংগঠনের নাম নিয়ে অপরাধ করলে অথবা বিশ্বাসহানীর ঘটনা ঘটালে তাদের কাউকেই ছাড় দেওয়া যৌক্তিক নয়, তা সে যত বড়াে পদেই থাকুক না কেন। নঈমউদ্দিন আহমদের বেলায়ও তাই ঘটেছিল। ১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’-এর প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন এবং প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন। এসময় সাংগঠনিক কমিটির আহ্বায়ক নঈমউদ্দিন আহমদকে বহিষ্কার করা হয় এবং সেই সঙ্গে সংগঠনের প্রথম সভাপতি ও প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয়। এ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে লিখেছেন,
(জুলাই মাসের শেষের দিকে গােপালগঞ্জ থেকে) “ঢাকায় এসে ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন যাতে তাড়াতাড়ি হয় তার ব্যবস্থা করলাম। এর পূর্বে আর কাউন্সিলসভা হয় নাই। নির্বাচন হওয়া দরকার, আর আমিও বিদায় নিতে চাই। ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে কনফারেন্স হল আমার সভাপতিত্বে। আমি আমার বক্তৃতায় বললাম, আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না। ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকার আর আমার কোনাে অধিকার নাই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি আর ছাত্র নই। তবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ যে নেতৃত্ব দিয়েছে, পূর্ববাংলার লােক কোনােদিন তা ভুলতে পারবে না । বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার আপনারা করেছেন এদেশের মানুষ চিরজীবন তা ভুলতে পারবে না। আপনারাই এদেশে বিরােধী দল সৃষ্টি করেছেন। শক্তিশালী বিরােধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না। এটাই ছিল বক্তৃতার সারাংশ। একটা লিখিত ভাষণ আমি দিয়েছিলাম, আমার কাছে তার কপি নাই। নির্বাচন হয়েছিল, দবিরুল ইসলাম তখন জেলে ছিল। তাকে সভাপতি ও খালেক নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। দবিরুল সম্বন্ধে কারও আপত্তি ছিল না, তবে খালেক নেওয়াজ খান সম্বন্ধে অনেকের আপত্তি ছিল। কারণ সে কথা
একটু বেশি বলত। শেষ পর্যন্ত আমি সকলকে বুঝিয়ে রাজি করলাম।” [৬৪]
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’র যে সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়েছিল, দেড় বছরের মাথায় তার নেতৃত্বের পরিবর্তন সম্পর্কে শিক্ষাবিদ ও
৭৩
গবেষক ড. হারুন-অর-রশিদের মূল্যায়ন হলাে
“নঈমউদ্দিনকে (পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা আহ্বায়ক) কনভেনর করা হলেও, বঙ্গবন্ধুই ছিলেন নতুন এ ছাত্র সংগঠনের প্রাণশক্তি। সমসাময়িক ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকের চেয়ে তিনি ছিলেন বয়সে জ্যেষ্ঠ । তিনি তখনই মনে মনে রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার পক্ষে মন স্থির করে ফেলেছিলেন। হয়তাে সে কারণে তিনি নিজেকে ছাত্র সংগঠনের শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত করেননি। উপরন্তু, ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্বদানের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথমে জরিমানা এবং জরিমানার টাকা দিতে অসম্মতি জানালে তাকে বহিষ্কার করা হয়। অতএব এরপর ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে আর যুক্ত থাকা তার চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না। তবে যা হােক, নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নতুন এ ছাত্র সংগঠন গড়ে তুলতে সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন। অন্যদিকে, ছাত্রনেতা নঈমউদ্দিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দেয়া শাস্তি মেনে নিয়ে জরিমানার টাকা পরিশােধ ও ভবিষ্যতের জন্য বন্ড সই দিয়ে ছাত্রত্ব বজায় রেখে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে, সংগঠনের স্বার্থ পরিপন্থী এ কাজের জন্য বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে তাকে ছাত্রলীগের আহ্বায়কের পদ থেকে বহিষ্কার করা হয়।” [৬৫]
তবে এই বিষয়ে “ভাষা সংগ্রামী নাইমউদ্দীন আহমদ” নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে,
“১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর শাবিস্তান সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনের মাধ্যমে দবিরুল ইসলামকে (তখন কারারুদ্ধ) সভাপতি ও খালেক নওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। তার আগে পর্যন্ত নাইমউদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে আহ্বায়ক কমিটিই সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করে। যদিও তিনি নিজে ততদিনে ব্যক্তিগতভাবে ছাত্রলীগের ব্যাপারে তার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন।” (৬৬)
ওদিকে বামপন্থি রাজনীতিবিদ, লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমর জানান,
“১৯৪৯ সালের এপ্রিলে নইমুদ্দীন আহমদের বহিষ্কারের পর মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় অর্গানাইজিং কমিটি পুনর্গঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির প্রথম প্রাদেশিক নির্বাচন ১৯৪৯এর সেপ্টেম্বরের পূর্বে অনুষ্ঠান সম্ভব হয়নি। কিন্তু তাহলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় কেন্দ্রীয় এবং এলাকাগত কমিটিগুলির নেতৃত্বে এই ছাত্র প্রতিষ্ঠানটির সদস্যেরা বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে।” [৬৭]
ঢাকার আরমানীটোলা ময়দানে ১৯৪৯ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর, রােজ শুক্রবার, সকাল ৮টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’-এর প্রথম
৭৪
প্রাদেশিক নির্বাচনী সম্মেলন। [৬৮] এই সম্মেলনের আগে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের আবেদনস্বরূপ ২নং সার্কুলারে বলা হয়,
“ছাত্র সমাজের অভূতপূর্ব ত্যাগ ও কর্মপ্রেরণা দ্বারাই আমরা পাকিস্তান অর্জন করিয়াছি। এই শিশু রাষ্ট্রকে গড়িয়া তুলিবার উদ্দেশ্যেই আমাদের প্রধান ও সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিতে হইবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইবার পর হইতে পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ও জনগণ সমস্ত সমস্যার সম্মুখীন হইয়াছেন তার আশু সমাধানের জন্য সুস্থ ছাত্র আন্দোলন একান্ত প্রয়ােজনীয়। দুর্ভাগ্যবশতঃ এ ব্যাপারে পূর্বতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান “মুসলিম ছাত্র লীগ” আমাদের নিরাশ করিয়াছে। বর্তমানে নির্জীব ও অকর্মণ্য এই প্রতিষ্ঠানের নিকট হইতে আমরা যাহা চাহিয়াছি তাহার কিছুই পাই নাই। তাই পাকিস্তান রাষ্ট্রকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর গড়িয়া তুলিবার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন একান্ত প্রয়ােজনীয় এবং এই ছাত্র আন্দোলন পরিচালনা করিবার জন্য “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ” নামে একটি নূতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনে সহায়তা করিবার জন্য আমরা আপনাদের সহযােগিতা কামনা করি। প্রশ্ন উঠতে পারে পূর্বতন “মুসলিম ছাত্র লীগের পরিবর্তে নূতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান কেন? আমাদের মনে হয় নিম্নোক্ত কারণ গুলি এই প্রস্তাবিত নূতন ছাত্র প্রতিষ্ঠান গঠনের পক্ষে যথেষ্ট: (১)… আমাদের নিবেদন উপরােক্ত সমস্যাগুলির ব্যাপারে দিকে দিকে ছাত্র আন্দোলন গড়িয়া তুলুন। সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক জেলা ও মহকুমায় “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের” অস্থায়ী অর্গানাইজিং কমিটি গঠন করুন। সভ্য সংগ্রহের জন্য এই কমিটিগুলির কত রশিদ দরকার শীঘ্রই জানান। এইরূপ ভাবে বিভিন্ন জেলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত “পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ কাউন্সিল” সভা আহ্বান করা হইবে এবং ঐ সভায় প্রতিষ্ঠানের খসড়া গঠনতন্ত্র চূড়ান্তভাবে গৃহীত হইবার পর এ বৎসরের জন্য কর্মকর্তা নির্বাচিত হইবে।… ঢাকা, ঠিকানায় কনভেনারের সহিত যােগাযােগ স্থাপন করুন।
নিবেদক
নাইমউদ্দিন আহমদ বি.এ. অনার্স কনভেনর (রাজশাহী), আবদুর রহমান চৌধুরী বি.এ. (বরিশাল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলনে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা), আবদুল কুদুস চৌধুরী বি.এ. অনার্স (চট্টগ্রাম), শেখ মুজিবর রহমান বি.এ. (ফরিদপুর), আজিজ আহমদ বি.এ. (নােয়াখালী) , আবদুল আজিজ এম.এ. (কুষ্টিয়া), সৈয়দ নূরুল আলম বি.এ. (মােমেনশাহী) , আবদুল মতিন বি.এ. (পাবনা) , দবিরুল ইসলাম বি.এ. (দিনাজপুর), মফিজুর রহমান (রংপুর) , অলী আহাদ (ত্রিপুরা), নওয়াব আলী (ঢাকা), আবদুল আজিজ (খুলনা), নূরুল কবীর (ঢাকা সিটি) ।* এরা শীঘ্রই নিজ নিজ জেলার ছাত্র কর্মীদের সহিত সংযােগ স্থাপন করিবেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ অস্থায়ী অর্গানাইজিং কমিটির সদস্যবৃন্দ।”
৭৫
[৬৯]।
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালে লেখক ও গবেষক বদরুদ্দীন উমরকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান,
“আমি জুন মাসের শেষের দিকে released হই। আমি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক হওয়ার পর দবিরুল ইসলামকে (তখনাে জেলে) সভাপতি এবং খালেখ নওয়াজ খানকে সম্পাদক করে ছাত্র লীগ আবার নােতুনভাবে
গঠিত হয়।” [৭০]
১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের আন্দোলনকালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটির আহ্বায়ক নঈমউদ্দিন আহমদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বন্ডসই দিয়ে আন্দোলন থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিলে, সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কার করে তার স্থলে দবিরুল ইসলামকে প্রথমে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করা হয়। [৭১] এরপর একই বছরের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অন্য ছাত্রনেতাদের সার্বিক সম্মতি ও মতামতের ভিত্তিতে জেলখানায় অন্তরীণ থাকা অবস্থায় দেশের ইতিহাসে প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি (প্রথম প্রেসিডেন্ট) নির্বাচিত হন দিনাজপুরের সূর্য সন্তান মুহম্মদ দবিরুল ইসলাম।[‘৭২] জনাব খালেক নেওয়াজ খানকে প্রথম সাধারণ সম্পাদক (প্রথম সেক্রেটারি) নির্বাচিত করা হয়। [৭৩] ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত দবিরুল ইসলাম সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।[৭৪]
“১৯৪৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। আহ্বায়ক কমিটির স্থলে এই সম্মেলনে দবিরুল ইসলামকে সভাপতি এবং খালেক নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করে প্রথম পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। ইতােমধ্যে ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতিসত্তার নতুন জাগরণ ঘটে ও দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠীর মুখােশ উন্মোচিত হতে শুরু করে। বাস্তব পরিস্থিতি, সময়ের দাবি এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার ভাবাদর্শকে বিবেচনায় নিয়ে ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ-এর নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামকরণ করা হয়।” [৭৫]
৭৬
‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ’ নাম ধারণ
“পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ছিল মূলত বৃটিশ আমলের নিখিল বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগেরই উত্তরসূরি। “নিখিল বঙ্গ’র স্থলে ‘নিখিল পূর্ব পাকিস্তান’ বসিয়ে এ সংগঠন ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পর পাকিস্তানে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে এ মুসলিম লীগ সরকারের তল্পীবাহক “নিখিল ছাত্রলীগ নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হলে বিদ্রোহী অংশ শাসসুল হুদা চৌধুরী ও শাহ আজিজুর রহমানকে বাদ দিয়ে রাজশাহীর নঈমুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করে নতুন করে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করে (শুধুমাত্র নিখিল শব্দটি বাদ দিয়ে)। সে থেকে (১৯৪৮ সাল থেকে) ছাত্রলীগ শাহ আজিজ গ্রুপ ও নঈমুদ্দিন গ্রুপ নামে প্রথম ভাঙন দেখা দেয়। ১৯৪৮ সালের ডিসেম্বরের দিকে সৈয়দ নজরুল ইসলামের (সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি) সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সাংগঠনিক কমিটির সভায় সংগঠনের অসাম্প্রদায়িক নামকরণের প্রস্তাব অস্বীকৃত হলে কয়েকজন পদত্যাগ করেন। পরে নঈমুদ্দিন আহমদও ১৯৪৯ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে বাদ পড়েন। জনাব দবিরুল ইসলাম সভাপতি ও খালেক নেওয়াজ খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ছাত্রলীগের ১৯৪৯-৫০ সালের সম্মেলনে একটি গ্রুপ, সংগঠনকে অসাম্প্রদায়িক করার উদ্দেশ্যে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়ার প্রস্তাব করে ব্যর্থ হয়ে সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। এদের অনেকে পরে ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে ভূমিকা রাখেন এবং যুবলীগ গঠন করেন। জনাব দবিরুল ইসলামের পর জনাব শামসুল হক চৌধুরী ১৯৫৩ সালে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশন পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৩ সালের কাউন্সিল অধিবেশন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগকে অসাম্প্রদায়িক করবার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম রাখে।”
[৭৬]
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ পাকিস্তানামলের বিভিন্ন সময়ের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ৭ি৭) শুধু তাই নয়, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনেও এই ছাত্র সংগঠনের অবদান ছিল গুরুত্ববহ। সংগঠনের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বিভিন্নকালে যারা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন তারা হলেন: [৭৮]
৭৭
১৯৪৮ : নঈমউদ্দিন আহমদ – আহ্বায়ক

১৯৪৯-৫৩ : দবিরুল ইসলাম – সভাপতি

খালেক নেওয়াজ খান – সাধারণ সম্পাদক

১৯৫৩-৫৪ : কামরুজ্জামান – সভাপতি
এম. আবদুল ওয়াদুদ – সাধারণ সম্পাদক।
১ ৯৫৪-৫৫ : আবদুল মমিন তালুকদার – সভাপতি
এম. আবদুল ওয়াদুদ – সাধারণ সম্পাদক
১৯৫৫-৫৬-৫৭ : আবদুল মমিন তালুকদার – সভাপতি

আবদুল আউয়াল – সাধারণ সম্পাদক
১৯৫৭-৬০ : রফিকউল্লাহ চৌধুরী – সভাপতি

১৯৫৭-৫৮ : কাজী আজহারুল ইসলাম – সাধারণ সম্পাদক

১৯৫৮-৫৯-৬০ : শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন – সাধারণ সম্পাদক।
১৯৬০-৬৩: শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন – সভাপতি

শেখ ফজলুল হক মনি – সাধারণ সম্পাদক

১৯৬৩-৬৫ : কে. এম. ওবায়দুর রহমান – সভাপতি
সিরাজুল আলম খান – সাধারণ সম্পাদক
১৯৬৫-৬৬-৬৭ : মাজহারুল হক বাকী – সভাপতি

আবদুর রাজ্জাক – সাধারণ সম্পাদক

১৯৬৮-৬৯ : আবদুল রউফ – সভাপতি

খালেদ মােহাম্মদ আলী – সাধারণ সম্পাদক
১৯৬৯-৭০ : তােফায়েল আহমেদ – সভাপতি
আ. স. ম. আবদুর রব – সাধারণ সম্পাদক
১৯৭০-৭২ : নূরে আলম সিদ্দিকী – সভাপতি
শাজাহান সিরাজ – সাধারণ সম্পাদক

৭৮
হেবিয়াস কর্পাস মামলা দায়ের
ওদিকে দিনাজপুর জেলখানার ৯নং সেলে অন্তরীণ দবিরুল ইসলামকে কারাগার থেকে ছাড়িয়ে আনার জন্য তার পিতা মৌলভী তমিজ উদ্দীন আহমদ দবিরুল ইসলামের পক্ষে হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস আবেদন করেন। করাচি থেকে এসে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী স্বেচ্ছায় ছাত্রলীগ নেতা দবিরুল ইসলামের হেবিয়াস কর্পাস মামলাটি পরিচালনা করে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করেন। [৭৯]
এ বিষয়ে বদরুদ্দীন উমর বলেছেন,
“মার্চ-এপ্রিলের ছাত্র আন্দোলনে যে সমস্ত ছাত্র গ্রেফতার হন তাদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের অস্থায়ী আহ্বায়ক দবিরুল ইসলামের পক্ষে হাই কোর্টে হেবিয়াস কর্পাসের আবেদন করা হয়। এবং শহীদ সুহরাওয়ার্দী সেই কেস পরিচালনা করেন। হেবিয়াস কর্পাস আবেদন পেশ করার সময় সুহরাওয়ার্দী হাই কোর্টকে বলেন যে দবিরুল ইসলামের উপর আটক আদেশ অযৌক্তিক। তিনি মন্ত্রিসভার বিরােধী হতে পারেন কিন্তু মন্ত্রিসভার বিরােধিতার অর্থ রাষ্ট্রবিরােধিতা নয়। কাজেই সেই অভিযােগে কোন ব্যক্তিকে নিরাপত্তা আইনে বন্দী করা চলে না। দবিরুল ইসলামকে ১৮ই জানুয়ারি ১৯৫০ বিনা শর্তে মুক্তি দান করা হয় এবং তার কয়েকদিন পূর্বে রাজশাহীর আতাউর রহমান ও খুলনার মহম্মদ একরাম মুক্তি লাভ করেন।” [৮০]
তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ১৯৪৯-১৯৫০ সালের ডায়েরিতে ২১ জানুয়ারি ১৯৫০, শনিবারের তারিখে লিপিবদ্ধ করেছেন,
“১৮. ১. ৫০ সকালে দবিরুল ইসলাম নিঃশর্ত মুক্তি লাভ করেছে। এর কিছু আগে আতাউর রহমান এবং একরামও মুক্তি পেয়েছে।” [৮১]

দিনাজপুরে মুসলিম আওয়ামী লীগের কার্যক্রম
“৫২-এর ভাষা আন্দোলনের উত্তপ্ত চেতনার উৎস থেকে পরবর্তী বছরেই তমুদুনবাদী মুসলিম লীগ রাজনীতির প্রতিপক্ষে বিরােধী দল সংগঠনের বীজ উপ্ত হয় এবং অনতিবিলম্বে রাজধানী ঢাকায় গঠিত হয় কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ দল। মুসলিম লীগের বুর্জোয়া রাজনীতির খপ্পর থেকে জাতিকে চিন্তাচেতনায় মুক্ত করতে নতুন ধারায় প্রবাহিত তরণীর হাল ধরেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল হাসিমসহ প্রগতিপন্থী অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা। ঐ সময়ের শীর্ষস্থানীয় প্রগতিবাদী নেতারা অনেকেই দিনাজপুর সফর করেন এবং মুসলিম লীগ সরকারের হুমকী ধমকীর মধ্যেও শহরে বিরােধীয় ফ্রন্টের অনেক উত্তেজনাপূর্ণ সভা সম্মেলন হয়। ফলে স্বতঃস্ফুর্ত ফলশ্রুতিতে অত্র শহরে মওলানা ভাষানীর উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে জেলা আওয়ামী শাখা গঠিত হয় ১৯৫৩ খৃষ্টাব্দে নির্ভীক জননেতা রহিম উদ্দীন আহমদের বাড়ীর প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত জনসভায়। সরকারী হুমকী ধমকী অগ্রাহ্য করে নবগঠিত জেলা আওয়ামী লীগকে প্রগতির ধারায় এগিয়ে নিয়ে একটি শক্তিশালী বিরােধী রাজনৈতিক সংগঠনের রূপদান করতে এ সময় অত্র শহরে যিনি অদম্য সাহসিকতার ও হেজস্বীতার পরিচয় দেন তিনি ছিলেন বারের লব্ধপ্রতিষ্ঠ আইনজীবী ও তুখােড় নেতা রহিম উদ্দীন আহমদ। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের জেলা শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। সম্পাদক হন মােয়াজ্জেম হােসেন। ঐ সময় থেকে প্রগতিবাদী নতুন রাজনৈতিক দলটির সংগঠন কাজে আর যারা ক্রমাগতভাবে নির্ভয়ে এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে ছিলেন খতিবউদ্দিন চৌধুরী, দূর্গামােহন রায়, ডাঃ নইমউদ্দিন আহমদ, গােলাম রহমান, মির্জা গােলাম হাফিজ, দবিরুল ইসলাম, এস.এ. বারী, এ.টি. আব্দুর রহমান চৌধুরী, আজিজুর রহমান, মােঃ ইউসুফ আলী (পরে অধ্যাপক ও মন্ত্রী হন), শাহজামাল বিশ্বাস, শাহ মােঃ ইউসুফ, এম. আবদুর রহীম, মাহতাব বেগ, শাহ মাহতাব প্রমুখ তরুণ রাজনৈতিক নবিশী নেতাগণ, সেই সঙ্গে কলেজের প্রগতিবাদী ছাত্রদের কথাও উল্লেখ্য। স্মর্তব্য যে উল্লেখিত তরুণ নেতারা আওয়ামী লীগ পূর্ব যুগে অধিকাংশই ছিলেন কলেজ ছাত্র ও মুসলিম লীগ আন্দোলনের ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান মিছিলের ভলান্টিয়ার।” [৮২]
৮২
যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য
ও আদালত পাড়ার জীবন
১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত দবিরুল ইসলাম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের কিছুদিন পর জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবারও পাকিস্তান সরকারের রােষানলে পড়েন তিনি। পুনরায় তাকে গ্রেফতার করে জেলখানায় ঢুকিয়ে দেয় সরকারের পুলিশ বাহিনী। ৮ি৩ এরইমধ্যে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর মওলানা আবদুল হামিদ খান। ভাসানী, শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং শেখ মুজিবুর রহমান একত্রে গঠন করেন যুক্তফ্রন্ট।
“১৯৫৩-এর ১৭ নভেম্বর পল্টন ময়দানে কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে একটি মাত্র জোট গঠনের আহ্বান জানানাে হয়। জনসভায় সভাপতিত্ব করেন কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্যে টিমের সদস্য মীর্জা আবদুস সামাদ। বক্তব্য রাখেন নূরুন্নবী চৌধুরী, গাজীউল হক ও মােহাম্মদ তােয়াহা। ১৯৫৩-এর নভেম্বরের দৈনিক আজাদ’-এর একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তফ্রন্ট গঠনে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও কৃষক শ্রমিক পার্টির (কেএসপি) মধ্যে আলােচনার ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটেছে। পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ-এর সভাপতি সােহরাওয়ার্দী, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা ভাসানী ও কেএসপি’র প্রধান এ. কে. ফজলুল হকের মধ্যে দু’ঘণ্টাব্যাপী আলােচনা হয়। ….
…আওয়ামী মুসলিম লীগের উদ্যোগে ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫৩-এর ১৮ নভেম্বর। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী। সর্বদলীয় গণবিরােধী মূলনীতি প্রতিরােধ কমিটি নামে আওয়ামী মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি, খিলাফতে রব্বানী পার্টি, গণতন্ত্রী পার্টি, কেএসপি, যুবলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠিত হয়। এর আহ্বায়ক নিযুক্ত হন মওলানা ভাসানী। ১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর এক সরকারি ঘােষণায় জানানাে হয়, আগামী ১৯৫৪-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ২৪ ডিসেম্বর চূড়ান্ত ভােটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। ১৯৫৪ সালের ১ জানুয়ারি থেকে মনােনয়নপত্র জমা নেয়া হবে। ১১ জানুয়ারি মনােনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ।… যুক্তফ্রন্টের কাজ
৮৩
শুরু হয়ে গিয়েছিলাে। ১৯৫৩-এর ২৩ নভেম্বর অভয় আশ্রম, সােশালিস্ট পার্টি, গণসমিতি ও কংগ্রেস প্রভৃতি সংখ্যালঘু দল মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।… সরকারের পক্ষ থেকে ১৯৫৩-এর ১২ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রতীক নির্ধারণ করা হয়। যুক্তফ্রন্ট তখনই ‘নৌকা প্রতীকটি নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।…. …কুমিল্লার জনসভায় বক্তব্য রাখেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, এ. কে. ফজলুল হক এবং মওলানা ভাসানী। যুক্তফ্রন্টের এটাই ছিলাে মূল সভা। টাউন হলের এ সভায় প্রায় ৮০ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন। মওলানা ভাসানী ও এ. কে. ফজলুল হক যুক্তফ্রন্টের প্রতীক নিয়ে যারা নির্বাচনে দাঁড়াতে চান, তাঁদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করেন। আবেদনপত্রের সাথে ১০০ টাকা জমা দেয়ার জন্যও অনুরােধ করা হয়।”[৮৪]। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে দবিরুল ইসলাম পূর্ববাংলা প্রাদেশিক নির্বাচনের জন্য যুক্তফ্রন্টের কৃষক শ্রমিক পার্টি থেকে ঠাকুরগাঁও (দিনাজপুর) আসনে মনােনয়ন পান। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত সেই নির্বাচনে বিপুল ভােটের ব্যবধানে মুসলিম লীগের তৎকালীন প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল হককে পরাজিত করে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন দবিরুল ইসলাম।[৮৫]।
“১৯৫৪ খৃষ্টাব্দে দেশে প্রাদেশিক আইনসভাসহ কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আসলে উক্ত নির্বাচন ছিল তমুদুনবাদী মুসলিম লীগ রাজনীতির প্রতিপক্ষে উদ্ভুত প্রগতিশীল রাজনীতির চ্যালেঞ্জস্বরূপ। যুক্তফ্রন্ট ও ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। নির্বাচনের প্রতিযােগিতায় প্রগতিবাদী রাজনৈতিক সংঘ যুক্তফ্রন্টের কাছে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের ভরাডুবি হয়। বিজয়ী যুক্তফ্রন্ট দল দেশের সরকার গঠন করে। ঐ নির্বাচনে দিনাজপুর থেকে যারা আইনসভার সদস্যপদ লাভ করেন তারা হলেন ফজলে হক, রহিমউদ্দীন আহমদ, দুর্গামােহন রায়, দবিরুল ইসলাম, হাজী মােঃ দানেশ, ভবেশ লহিড়ী, মির্জা গােলাম হাফিজ, আজিজুর রহমান, গজেন চৌধুরী প্রমুখ।” (৮৬)। কিন্তু ৩০ মে কেন্দ্রীয় সরকার ৯২(ক) (৮৭) ধারা জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বরখাস্ত করে।[ ৮৮] পাশাপাশি মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ববাংলার গভর্নর এবং এন. এম. খানকে চিফ সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। [৮৯] সরকার ভেঙে দেওয়ার পরের দিনই গ্রেফতার হন শেখ মুজিবুর রহমান, মির্জা গােলাম হাফিজ, সৈয়দ আবদুর রহিম। এছাড়া ১০/১৫ দিনের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রায় তিন। হাজার কর্মী ও সমর্থক, দবিরুল ইসলামসহ ৫০ জনের মতাে এমএলএ, অন্যান্য দলের কয়েকজন কর্মী এবং কয়েকশ ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। পরে প্রফেসর অজিত গুহ ও মুনীর চৌধুরীকেও গ্রেফতার করে আনা হয়। ঢাকা জেলের দেওয়ানি ওয়ার্ডে এবং
৮৪
সাত সেলে রাখা হয় কোরবান আলী, দেওয়ান মাহবুব আলী, বিজয় চ্যাটার্জী, খন্দকার আবদুল হামিদ, মির্জা গােলাম হাফিজ, ইয়ার মােহাম্মদ খান, মােহাম্মদ তােয়াহাকে। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক নিজবাড়িতে অন্তরীণ রাখা হয়। [৯০]
১৯৫৬ সালে যুক্তফ্রন্টের আবু হােসেন সরকারের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় স্থান করে নেন দবিরুল ইসলাম। তিনি প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রম) নিযুক্ত হন। এ সময় তিনি ঠাকুরগাঁওয়ে একটি সুগার মিল স্থাপনের জন্য সরকারের কাছে জোরালাে দাবি তুলে ধরেন। [৯১] দবিরুল ইসলামের প্রস্তাবের উপর ভিত্তি করে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার (বর্তমান ঠাকুরগাঁও জেলার সদর উপজেলার) প্রধান সড়কের পাশে ১৯৫৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হয় মহকুমার একমাত্র ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান ‘ঠাকুরগাঁও চিনি কল লিমিটেড’এর। যা বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান চিনি কলের গৌরব অর্জন করেছে। দিনাজপুর কারাগারে বন্দি অবস্থায় ১৯৫৩ সালে এল.এল.বি. পরীক্ষা দিয়ে কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন দবিরুল ইসলাম। দিনাজপুর আদালতে ওকালতি পেশায় তিনি অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন। তিনি ছিলেন দিনাজপুর ও অত্র এলাকার জনদরদী একজন আইনজীবী। [৯২] দবিরুল ইসলাম প্রথমবার গ্রেফতার হন ১৯৪৯ সালের ১৩ মার্চ, দিনাজপুর রেল স্টেশন থেকে। দ্বিতীয়বার তাকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময়। গ্রেফতারের আগের দিন রাতে তিনি পরিবার নিয়ে রামপুরে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন। পরদিন ভােরবেলা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। এসময় তিনি কারাবাস করেন ছয় মাস। জেলে বসে এল.এল.বি. পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন। এছাড়া সময় কাটাতেন সূচিকর্ম করে। তৃতীয়বার গ্রেফতার হন ১৯৫৫ সালে। জাতীয় ও স্থানীয় রাজনীতির পাশাপাশি দবিরুল ইসলাম পেশায় ছিলেন আইনজীবী। ১৯৫৬ সালে আবু হােসেন সরকার পদত্যাগ করার পর দবিরুল ইসলাম ঢাকা থেকে দিনাজপুর ফিরে যান। এসময় তিনি পরিবার নিয়ে শহরের বালুবাড়িতে মরহুম হাসান আলী সাহেবের বাড়ির পূর্ব দিকের একটি বাসায় ভাড়া থাকতেন। পাশাপাশি দিনাজপুর আদালতে ওকালতিও শুরু করেন। বাসাতেই তার চেম্বার ছিল। মৃত্যুর আগপর্যন্ত তিনি দিনাজপুর আদালতে ওকালতি করে গেছেন। তিনি ছিলেন দিনাজপুর বারের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। ওকালতি জীবন স্বল্প সময়ের হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনের মতাে আদালতপাড়াতেও দবিরুল ইসলাম দক্ষতার আলােক ছটা দেখিয়েছেন, ছিলেন বিচারক, সহকর্মী ও বিচার প্রার্থীদের কাছে সমানভাবে শ্রদ্ধেয় ও সমাদৃত। [৯৩]

Reference: দবিরুল ইসলাম বিস্মৃত জননেতার আলেখ্য – মনোয়ারা বেগম, রুমানা শারমীন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!