You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৪শে এপ্রিল, বৃহস্পতিবার, ১১ই বৈশাখ, ১৩৮১

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বিতরণ ব্যবস্থা

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহল থেকে দারুন অভিযোগ আসছে যে, স্থানীয় ভাবে প্রস্তুত অথবা টিসিবি কর্তৃপক্ষ বিদেশ থেকে আমদানিকৃত বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বর্তমান বিতরণ ব্যবস্থা ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্নীতির জর্জরিত যে, একমাত্র এর কারণেই প্রধানভাবে বাজারের বিভিন্ন জিনিসপত্র মূল্য দিন হু হু করে বেড়ে চলেছে। তাদের মতে, বাংলাদেশে ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থা, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা ও টিসিবি সহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও একমাত্র পরিবেশকদের দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি মানুষের বর্তমান দুর্গতির কারণ।
এজন্য, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আহুত বিভিন্ন শিল্প ও বণিক সমিতি এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থার প্রতিনিধিদের এক সাম্প্রতিক সমাবেশে বেসরকারি পর্যায়ে বাণিজ্য বিভিন্ন বক্তারা সরকারের বর্তমান বিতরণ তীব্র সমালোচনা করেন এবং এর আমূল সংস্কারের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
বর্তমান নীতি অনুসারে বিভিন্ন দ্রব্যাদি বিতরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থা এক বিরাট গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। সংস্থা হিসেবে এটা নতুন হলেও এর ওপর টিসিবি আমদানিকৃত অধিকাংশ প্রায় শতকরা নব্বই ভাগ ক্ষমতা রয়েছে। এসবের মধ্যে আছে টেক্সটাইল, ড্রাইসেল ব্যাটারি, দুগ্ধজাত খাবার, টুথপেস্ট, দাঁতের ব্রাশ ও পরিশোধিত নারিকেল তেল। এ সংস্থাকে ওয়াশিং সোডা, বাইসাইকেল এবং টায়ার ও টিউব এর শতকরা একশো ভাগ এবং টিসিবি আমদানিকৃত ৬০ কাউণ্ট পর্যন্ত প্রায় শতকরা ৩৩ ভাগ সুতাও বরাদ্দ করা হয়েছে। বাকি ৬৭ ভাগের দায়িত্ব ক্ষুদ্র শিল্প সংস্থা ও তার বিভিন্ন অংগ দপ্তরগুলির। আবার টিসিবি আমদানিকৃত বিভিন্ন ভোগ্যপণ্য ও অন্যান্য পণ্যের শতকরা ১০ ভাগ বিতরণ ভার বাংলাদেশ সমবায় মার্কেটিং সোসাইটি ওপর ন্যস্ত রয়েছে।
সাধারণতঃ বিভাগীয় পর্যায়ে নিয়োজিত বিভিন্ন ডিস্ট্রিবিউটরের মাধ্যমেই দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প কারখানা গুলি তাদের বিভিন্ন উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রি করে।
প্রায়ই অভিযোগ শোনা যায় যে, এসব পণ্য সরাসরি খুচরা বিক্রেতাদের হাতে পৌঁছায় না বলেই এবং জনসাধারণের প্রকৃত ব্যবহার পর্যন্ত তিন-চার হাত ঘুরে আসে বলেই জিনিসপত্রের এত দাম বাড়ে।
অবশ্য বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত মিলে প্রস্তুত টেক্সটাইল দ্রব্যাদির ক্ষেত্রে একটু আলাদা। এগুলি সরকারি ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থার কাছে দেয়া হয় এবং সংস্থার নিয়োজিত বিভিন্ন ন্যায্যমূল্যের দোকান এর মাধ্যমে বিতরণ করেন।
সিলেট অথবা রংপুরের ব্যবসায়ীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে, তারা নাকি সরাসরি বিভিন্ন রাষ্ট্রের মালপত্র পান না এবং ঢাকা অথবা চট্টগ্রামের পাইকারি বাজার থেকেই নাকি তাদের মাল খরিদ করতে হয়। অথচ এগুলো যে কিভাবে এত উচুঁ দামে পাইকারি বাজারে গিয়ে বিক্রি হয়, সে কথা আর কেউ বলতে পারে না।
খবর নিয়ে জানা গেছে যে, ভোগ্য পণ্য সরবরাহ সংস্থার অধীনে সারা দেশে প্রায় চার হাজার ৪০০০ নায্য মূল্যের দোকান আছে এবং প্রায় ৪২০০০ কর্মচারী এতে নিয়োজিত আছে। এসব দোকানের প্রায় ৩৪টি ঢাকায় অবস্থিত। আরো জানা গেছে যে মূলধন নয় কোটি টাকাকে ভরসা করে সংস্থা গঠন করা হয়েছিল, তার প্রায় ৬ কোটি টাকা নাকি ইতিমধ্যে হজম হয়ে গেছে। ফলে বলতে গেলে লুলা ল্যাংড়ার মতোই নাকি সংস্থা অর্থাভাবে দিন গুজরান করছে। জনহিতকর কাজে হাত দেয়া তো দূরের কথা নিজস্ব স্থাপন খরচ নাকি তার পক্ষে দুরূহ হয়ে উঠেছে। তাই নিজের গা বাঁচাতে প্রায়ই সংস্থা বলে থাকেন যে, অর্থ নেই, দূর-দূরান্তে মাল পাঠানোর মতো উপযুক্ত পরিবহন নেই, আরো কত কি।
এদিকে রাজধানীর মানুষের অভিযোগ, ঢাকায় যে ৩৪টি ন্যায্যমূল্যের দোকান আছে তা প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম। আরও দোকানের প্রয়োজন, তা না হলে এই দুরবস্থা মোচন করা বড়ই মুশকিল।
তার ওপর, বিভিন্ন ন্যায্যমূল্যের দোকান এর দুর্নীতি ও হাংকি-পাংকি তো আছেই। ন্যায্য মূল্যের দোকান মানে অনেকেই ভাবেন “চার আনার সাবান দু টাকায় পাওয়া যায়”। এই ক’দিন আগে ঢাকার একটি ন্যায্য মূল্যের দোকান এ কোন এক ভদ্রলোক একটা শাড়ি কিনতে গিয়ে কি হিমশিম খেয়েছেন তা খবরের কাগজে সবাই দেখেছেন। তিনি পর্যাপ্ত তথ্য ও রশিদ নং দেখিয়ে প্রমাণ করেছেন যে, প্রশ্নাধীন ন্যায্যমূল্যের দোকানটি সরকার থেকে মাল সরবরাহ নিয়েছে ঠিকই কিন্তু কে যে সে মাল পেল, তার কোন হদিস নেই। এর প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে, কে কিভাবে মাল নিয়ে কোথায় যাচ্ছে, কিভাবে বিক্রি করছে কিংবা কি করছে তার নির্দিষ্ট ও নির্দোষ সিস্টেম নেই।
অনেকের মতে, দুধ, টুথপেস্ট, ড্রাইসেল ব্যাটারি ইত্যাদি রেশন কার্ডের মাধ্যমে দেওয়ার পদ্ধতিটা আদর্শ ভাবে উপযুক্ত নয়। তাই কেউ কেউ একে ন্যায্যমূল্যের ড্রাগ ষ্টোরের মাধ্যমে বিক্রি করার সুপারিশ করেছেন।
অনেকের আবার অভিযোগ যে, ভোগ্যপণ্য সংস্থা বা কুটির শিল্প সংস্থা এত ঢিলা ঢালা কাজ করেন যে হঠাৎ প্রয়োজনে বিশেষ জরুরী মাল তুলতে তারা রীতিমতো কুম্ভক-গতি পেয়ে বসেন।
যাহোক, এসব নানান গ্যাঞ্জামে আর কারো কিছু হোক না হোক জনসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে মধ্যবিত্ত শ্রেণী বা সীমিত আয়-গ্রুপের মানুষের দুর্গতিই সবচেয়ে বেশি।
সুতরাং এসব সমস্যার চতুর্দিক বিচার করে সরকারের উচিত বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মতামতের একটা সামঞ্জস্য বিধান করে এর সম্পর্কে বাস্তবভিত্তিক ব্যবস্থা নেয়া।
বিশেষ করে, বিভিন্ন প্রয়োজনীয় দ্রব্য যাতে নিয়মিত ভাবে সরকার নিয়োজিত বা অন্যান্য দোকানে সবসময় মজুত থাকে এবং জনসাধারণ ও যাতে নিয়মিত সে মাল পেতে পারে, সে ব্যাপারে যথেষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে। তাহলে, জনসাধারণও অহেতুক মাল স্টক রেখে দ্রব্য সংকট ঘটিয়ে অন্যের অসুবিধা করতে উৎসাহী হবে না। সময়মত মাল পাওয়া যায় কিনা, যায় প্রধানতঃ এই ভয়েই মানুষ প্রয়োজনের বাইরে স্টক করে রাখে।
সুতরাং এসব সমস্যা দূর করতে প্রয়োজন এক সুচিন্তিত, সময় উপযুক্ত ও বাস্তবভিত্তিক উৎপাদন, সরবরাহ ও বন্টন ব্যবস্থা।

কৃষি ঋণ প্রসঙ্গে

কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির দেশ আমাদের। দেশের গোটা জাতীয় আয়ের সিংহভাগই কৃষি তথা কৃষি উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের দেশের শতকরা ৮৫ জন বাসিন্দাই কৃষিজীবী। কাজেই এক কথায় বলতে গেলে কৃষি এ দেশের প্রাণ-কৃষি উৎপাদনই দেশের জীবন। কিন্তু আমাদের কৃষিব্যবস্থা কোনদিনই একটি সুষ্ঠু ও স্বাভাবিক এবং বিজ্ঞানসম্মত সিস্টেমের উপর ভিত্তি করে এযাবত এগুতে পারেনি। পাকিস্তানি আমলে দেশ স্বাধীন হবার পরেও এ ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া হয়নি, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হবার আগ পর্যন্ত। প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনা কৃষিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে-বিশেষ-গুরুত্বারোপ করা হয়েছে কৃষি উৎপাদনের ওপর সম্ভবতঃ তার ওপর ভিত্তি করে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ জাতীয় সমবায় ব্যাংক, প্রাথমিক সমবায় সমিতি ও সমবায় ব্যাংক যথাক্রমে ৫০ লাখ টাকা স্বল্পমেয়াদী, ৭৫ লাখ টাকা মাঝারি মেয়াদী এবং ৫০ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদী ঋণ মঞ্জুর করেছেন। জানা গেছে যে ১৯৭৪ সালের আউশ, আমন ও পাট উৎপাদনের জন্য সমবায় সমিতির সদস্যদের পৃথক পৃথকভাবে অর্থ জোগানোর জন্য স্বল্পমেয়াদী ৫০ লক্ষ টাকা ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। এটা ১৯৭৫ সালের ৩০শে জুনের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। ৭৫ লাখ টাকা মাঝারি ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে প্রাথমিক সমবায় সমিতির সদস্যকে লাঙ্গল ও গবাদি পশু কেনার উদ্দেশ্যের অর্থ যোগানের জন্য। ১৯৭৫ সালের ৩০শে জুন থেকে তিনটি মেয়াদে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। জমি বন্ধকী ব্যাংকের সদস্য কৃষককে পুরানো ঋণ থেকে বরাদ্দ করা আবাদি জমির উন্নয়ন, কৃষি যন্ত্রপাতির জন্য ৫০ লাখ টাকা দীর্ঘমেয়াদী ঋণ মঞ্জুর করা হয়েছে। এসব ঋণের সর্বনিম্ন বার্ষিক সুদের হার হবে শতকরা তিন টাকা। বস্তুতঃ কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং যথাযথভাবে কৃষিকার্য পরিচালনার জন্য সরকার এই কৃষি ঋণ বরাদ্দ করেছেন। মৌসুমে যাতে করে কৃষকরা হালের গরু, লাঙ্গল, বীজ, পানি সেচের উপকরণ, পাওয়ার পাম্প বা খাল খনন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাধা বিঘ্নের সম্মুখীন না হন বা না হতে পারেন, সেজন্যই তথা সেই মহৎ উদ্দেশ্যেই কৃষি ঋণ দানের ব্যবস্থা বলেই আমরা জানি। কিন্তু বাস্তবে সেই মহৎ উদ্দেশ্য টি কতখানি সফল হয় না হতে পারে? এর একমাত্র কারণ সেই বহুল কথিত বহুল আলোচিত লাল ফিতার দৌরাত্ম্য। কারণ কৃষি ঋণ দানের ক্ষেত্রে যেসব শর্তারোপ করা হয়, তথা ফ্রম কেনা, আবার সরাসরি নয় বিভিন্নভাবে চেষ্টা তদ্বির চালানো এবং তারপর স্থানীয় কৃষি ব্যাংক কৃষি অফিসার অথবা সমবায় ব্যাংক কর্তাদের মনোরঞ্জন করে তবে ঋণ পেতে হয়। অন্যদিকে এসব জনহিতকর প্রতিষ্ঠানগুলোর দফতর গাঁয়ে গ্রামে না হয়ে গঞ্জে শহরে হওয়ায় দূরাঞ্চলের কৃষকদের পক্ষে সময়মতো ঋণ পাওয়ার জন্য যোগাযোগ ও দৌড়োদৌড়ি করাটাও হয়ে ওঠে না। তাই তাদের হা-পিত্যেশ করেই মরতে হয়। এমতাবস্থায় আমরা বিশ্বাস করি, কর্তৃপক্ষ এদিকটার প্রতি একটু দৃষ্টি দিলে যে উদ্দেশ্যে ঋণ দেয়া সে উদ্দেশ্য সফল হতে পারে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!