You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৪ই নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ২৭শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশ-কুয়েত সহযোগিতা

কুয়েতের বিচার বিভাগীয় ও পররাষ্ট্র দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী জনাব মোহাম্মদ আহমেদ আবদুল লতিফ আল হামিদীর সঙ্গে এক ঘন্টারও বেশী সময় আলোচনা শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন যে, বাংলাদেশে সিমেন্ট, সার ও জাহাজ নির্মাণ কারখানা স্থাপনে এবং তেল শোধনাগারের সম্প্রসারণে কুয়েত আর্থিক সাহায্য দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এছাড়া বাংলাদেশের শিল্প কারখানাগুলোতে পূর্ণ পর্যায়ে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল আমদানীর জন্য ঋণ দিতে এবং দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য আরো সম্প্রসারিত করতেও কুয়েত রাজি হয়েছে। কুয়েত ও বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করতে এবং সর্বক্ষেত্রে সম্পর্ক সম্প্রসারিত করতে ঐক্যমতে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের উল্লিখিত নির্দিষ্ট প্রকল্পগুলোতে আর্থিক সাহায্য দিতে এবং সর্বক্ষেত্রে সম্পর্ক সম্প্রসারিত করার বিষয়ে কর্মরত ৬টি গ্রুপে তাদের প্রস্তাবসমূহ প্রায় প্রস্তুত করে ফেলেছেন। তারা তাদের এই প্রস্তাবগুলো অনুমোদনের জন্য মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটির কাছে পেশ করবেন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও কুয়েতের আমীর শেখ সাবাহ আল সালেম আল সাবাহর মধ্যে অনুষ্ঠিত শীর্ষ বৈঠকের পর উক্ত কমিটিগুলো গঠন করা হয়েছে দু’দেশের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক সহযোগিতার উদ্দেশে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব ও সুপারিশ প্রণয়নের জন্য।
কুয়েতের মাটিতে পদার্পণ করার পর কুয়েত সরকার ও জনসাধারণ যে অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিবুর রহমানকে জানান তাতে দু’দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক সুদৃঢ় হওয়ার ছবিই প্রতিফলিত হয়ে উঠে। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণঢালা ভালোবাসা ও শুভেচ্ছার বাণী নিয়ে বঙ্গবন্ধু কুয়েত সফরে গেছেন। সেখানে তিনি যে সম্বর্ধনা পেয়েছেন তা যে অত্যন্ত আন্তরিক সে কথা বিস্তারিত বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ ও কুয়েত উভয়েই জোটনিরপেক্ষ এবং সহ-অবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী। এটাও আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ ও আরব বিশ্ব সহ সকল উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে নিজেদের উন্নয়ন কর্মধারা বাস্তবায়ন তথা সার্বিকভাবে স্বাবলম্বীতা অর্জনের ব্যাপারে প্রয়োজন পারস্পরিক সহযোগিতাভিত্তিক সংহতি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মিশর ও কুয়েত সফর পারস্পরিক সাহায্য, সহযোগিতা ও সংহতির পথই প্রশস্ত করবে। কুয়েত এ ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করাতে আমরা আনন্দিত। কুয়েত তার শুভেচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ ইতিপূর্বে বাংলাদেশ ব্যাংকে ৬০ লক্ষ কুয়েতী দিনার অর্থাৎ ২ কোটি মার্কিন ডলার জমা রেখেছে এবং এ মর্মে গত মঙ্গলবার উভয় দেশের ব্যাংকের কর্মকর্তারা একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন।
কুয়েতের উচ্চ পর্যায়ের একটি অর্থনৈতিক প্রতিনিধিদল এ মাসেই বাংলাদেশ সফর করবেন বলে জানা গেছে। প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে অবস্থানকালে বিভিন্ন বড় শিল্প প্রকল্পে কুয়েতের অংশ গ্রহণ সম্পর্কে বিস্তারিত আলাপ আলোচনা করবেন।
সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশকে বর্তমানে নানান সমস্যা ও সংকটের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হচ্ছে। খাদ্য সংকট, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, বন্যা ইত্যাদি সমস্যায় বাংলাদেশ জর্জরিত। এমতাবস্থায় আজকের দিনে বন্ধু দেশগুলোর সাহায্য ও সহযোগিতা যে প্রয়োজন এ কথা উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। কুয়েতের হিলটন হোটেলে আয়োজিত এক সম্বর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, এ কথা সত্যি যে, বাংলাদেশ আজ এক সংকটময় ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ভবিষ্যত উজ্জ্বল ও সম্ভাবনাময়। দুর্ভোগের এ কাল রাত্রির অবসান ঘটবেই এবং আবার আমরা ফিরে পাবো উজ্জ্বল সোনালী দিন। এ কথা শুধু বঙ্গবন্ধুর নয়—এ কথা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর। বাংলার মানুষ বিশ্বাস করে দুর্যোগ ও দুর্ভোগের অবসান একদিন হবেই। দুর্ভোগের ক্রান্তিলগ্নে যারা সাহায্য ও সহযোগিতার হস্ত সম্প্রসারিত করে এগিয়ে এসেছেন তাদের আমরা জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, প্রীতি ও শুভেচ্ছা।

শিল্পে উৎপাদন সংকট

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো আজ গুরুতর সংকটের সম্মুখীন। যতদিন যাচ্ছে উৎপাদনের হার বৃদ্ধি পাবে কি-ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। অথচ এমনটা আমরা কেউ আশা করিনি। দেশের বেশীর ভাগ শিল্প কারখানা রাষ্ট্রায়ত্ত করার সময় দেশবাসী খুব সঙ্গতভাবেই প্রত্যাশা করেছিল, উপনিবেশবাদের এজেন্ট মুৎসুদ্দি পুঁজির কবল থেকে কলকারখানাকে মুক্ত করে জাতীয় মালিকানা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে পারলে উৎপাদন বিপুল হারে বৃদ্ধি পাবে, দেশের সমৃদ্ধি আসবে এবং বহু দিনের শোষিত, নিপীড়িত জনগণের যুগ সঞ্চিত দুঃখ আর গ্লানির ঘটবে অবসান।
বলাবাহুল্য, সে প্রত্যাশা মোটেই অমূলক ছিল না। কারণ, পরাধীনতার নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভের পর উৎপাদন ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে পশ্চাৎপদ অর্থনীতির বহু দেশ শিল্পে, বাণিজ্যে আর কৃষি ব্যবস্থায় বিপুল সমৃদ্ধি সৃষ্টি করেছে—এমন দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে রয়েছে অসংখ্য। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের কথা, আমাদের প্রত্যাশা সফল হয়নি। রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের উৎপাদনে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি দেখতে আমরা বেশ খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
সম্প্রতি কোনো একটি বার্তা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিবেশিত একটি খবর থেকে জানা গেছে, পর্যাপ্ত পরিমাণ কাঁচামাল আমদানী করা না হলে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো বর্তমান অর্থবছরের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হবে। ইতিমধ্যেই উৎপাদন সাংঘাতিকভাবে হ্রাস পেয়েছে। জানা গেছে, গত বছরের আমদানীকৃত কাঁচামাল দিয়ে খুব ধীরগতিতে কোনো রকমে কলের চাকা চালু রাখা হচ্ছে বটে তবে এই ব্যবস্থায় উৎপাদন যে লক্ষ্যমাত্রার অনেক নীচে থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
বিভিন্ন শিল্প সংস্থার সেক্টর কর্পোরেশনসমূহের ঘনিষ্ঠ মহলের বরাত দিয়ে উক্ত বার্তা প্রতিষ্ঠান বলেছেন, দশটির মধ্যে ন’টিতেই জুলাই-ডিসেম্বর মৌসুমে কাঁচামালের স্বল্পতা, বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও অন্যান্য কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এমনকি এই সময়ের মধ্যে বেশীর ভাগ সেক্টর কর্পোরেশনেই উৎপাদন হয়েছে মাত্র নয় ভাগ।
দেশের সচেতন বা অসচেতন প্রতিটি নাগরিকের পক্ষেই খবরটা খুবই মর্মান্তিক। উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে কেন? না, কাঁচামালের অভাব। কাঁচামালের অভাব কেন?—উত্তর নেই। জানা গেছে, জানুয়ারী-জুন শিপিং মৌসুমে (এল.সি.) খোলার জন্য যে ৩৫ কোটি ৩২ লাখ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল তন্মধ্যে ১৫ কোটি টাকার এল.সি. খোলাই সম্ভব হয়নি। কিন্তু কেন? খুব সঙ্গতভাবেই এ প্রশ্ন তোলা যায়, তবে ঐতিহ্য অনুসারে এসব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। কিংবা জানা যাবে না, কাঁচামাল আমদানীর জন্য জুলাই-ডিসেম্বর শিপিং মৌসুমের জন্য পূর্ব বরাদ্দকৃত ১৬ কোটি ২১ লাখ টাকা থেকে কমিয়ে ৬৪ কোটি ৯৩ লাখ করা হলো কেন।
পরাধীন আমলে আমলাতান্ত্রিক দপ্তরবাজি বলে একটা কথা শোনা যেতো। দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশের কলকারখানা, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদির মালিকানা মুষ্টিমেয় সংখ্যক পুঁজিপতির হাত থেকে এখন এসেছে জনগণের হাতে কিন্তু আমাদের উৎপাদনের সংগঠকদের কাঁধ থেকে পরাধীন আমলের সেই আমলাতান্ত্রিক দপ্তরবাজির ভূত আজো নামেনি। না হলে দীর্ঘ তিনটি বছরের মধ্যে তাঁরা উৎপাদন ক্ষেত্রে অনুকূল পরিস্থিতি রচনা করতে এমন নিদারুণভাবে ব্যর্থ হলেন কেন?
আজ কথায় কথায় বিদ্যুৎ বিভ্রাট, কারখানা বন্ধ, যানবাহন সংকট, কাঁচামাল নেই অতএব কারখানা বন্ধ, সময় মতো এল.সি. খোলা হয় না, কাঁচামাল আমদানীর বরাদ্দকৃত অর্থ কোনো অদৃশ্য হাতের কারসাজিতে কমে যায়। কারখানার কাজ চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সামগ্রিক চিত্র হলো এই।
আমরা জানি, উৎপাদনে বৈপ্লবিক গতি সঞ্চার করতে না পারার এ সবই হলো খোঁড়া অজুহাত অথচ এইগুলোই আবার বাস্তব কারণও। প্রতি মাসেই সেক্টর কর্পোরেশনের কর্মকর্তাগণ এইসব খোঁড়া অজুহাতই দেখিয়ে আসছেন। দিন যায়, মাস যায়, বছরও ঘুরে যায় কিন্তু কর্পোরেশনের বড় কর্তাদের অজুহাত শিল্পের কোনো রদবদল হয়না। সেই একই বিদ্যুৎ বিভ্রাট, একই কাঁচামালের অভাব এবং সেই একই যানবাহন সংকট সংক্রান্ত অজুহাত ঘুরে ঘুরে আসে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন?

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!