You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৮শে মার্চ, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ১৪ই চৈত্র, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধুর বাণী

দুঃসহ অতীত স্মৃতির রোমন্থনে একধারা শোকাশ্রু ফেলে আর দৃপ্ত রক্ত শপথের বেদীমূলে এক ডালি নতুন রজনীগন্ধা ঢেলে, গতকাল সমগ্র জাতি যুগবৎ হর্ষ ও বিষাদে তার চতুর্থ স্বাধীনতা দিবস পালন করেছে।
রক্তস্নাত ২৬শে মার্চ। সংগ্রামী বাংলা ও বাঙালীর রক্তে লেখা ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় দিন। মিশ্রিত হাসি ও কান্নার এক অমোঘ দিন।
এদিন এজন্যেই আনন্দের যে, এ দিনেই প্রথম ইথারে ইথারে ছড়িয়ে পড়েছিলো গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতার ডাক। জন্ম নিয়েছিল স্বাধীনতাকামী সাড়ে সাতকোটি মানুষের এক প্রাণ শপথ মুক্তির সংগ্রাম। এ ডাক দিয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
আবার, এদিন এজন্যই কান্নার দিন যে আজ থেকে চার বছর আগে ঠিক এই দিনই বাঙালীর জাতীয় জীবনে নেমে এসেছিল এক মহা অভিশাপের শ্রাবণ ধারা। বিশ্বের স্মরণকালের সমস্ত হিংস্রতা ও বর্বরতাকে ম্লান করে ঔপনিবেশিক পাঞ্জাবী পশুদের হিংস্র হায়েনারা ১৯৭১-এর ২৫শের কালোরাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাংলার নিরস্ত্র, নিরন্ন ও নির্যাতিত দুঃখী মানুষের উপর এক বিরাট বহর মারণাস্ত্র নিয়ে। কতো মানুষ বুক ফাঁটা আর্তচিৎকার করে প্রাণ হারিয়েছিল, কতো গৃহে আগুন লেগেছিল, কতো মা তার সন্তান হারিয়েছিল কিম্বা কতো বোন তার মূল্যবান ইজ্জত হারিয়েছিল, তার সম্পূর্ণ কথা হয়তো প্রকৃতিরও জানা নেই।
বর্ষ পরিক্রমার শাশ্বত নিয়মানুবর্তিতা পালন করে বাঙালীর জাতীয় জীবনের এমন আনন্দ বিষাদঘন দিন চতুর্থবারের মতো আবার গতকাল জাতিকে নতুন করে জানিয়ে গেলো তার হর্ষ-বিষাদ আর প্রাণ শপথের নতুন গুঞ্জরণ নতুন বাণী। এজন্যে সারাদেশেই সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে নানা রকমের আচার অনুষ্ঠান আলোকীকরণ ও গুরু গম্ভীর প্রার্থনা ইত্যাদিরও আয়োজন করা হয়েছিল।
জাতির এমন একটি মিশ্রিত আনন্দ ও দুঃখের দিনে যেদিন আমরা সবাই আবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে অতীত স্মৃতি, বর্তমান সমস্যা ও ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্নে বিভোর হয়ে শত শহীদের শ্রদ্ধাস্মৃতিচারণায় বাঙময় হয়ে উঠেছি, ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের মাঝে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর অভাব আমরা তিলে তিলেই অনুভব করছি।
বঙ্গবন্ধু আজ রোগ শয্যায়। তিনি মস্কো ক্লিনিকে ব্রঙ্কাইটিস রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসারত রয়েছেন। কিন্তু তাঁর প্রাণ-মন ধ্যান-ধারণা প্রীতি-ভালোবাসা সবই বাংলার জীর্ণ-পর্ণ কুটিরের দিকেই নিবদ্ধ। তিনি আমাদের কাছে তাঁর আশু রোগ মুক্তির জন্যে দোয়া চেয়েছেন। বাংলা ও বাঙালীকে তিনি কতো প্রাণ-মন দিয়ে ভালোবাসেন তার আর এক নিদর্শন পাওয়া যায় ২৬শে মার্চ উপলক্ষে তিনি রোগ শয্যা থেকে যে বাণী পাঠিয়েছেন, তা থেকে।
জাতির উদ্দেশে কয়েকটি উপদেশ রেখে তিনি তার বাণীতে বলেছেন যে, যে ব্যক্তি নিঃস্বার্থভাবে কাজ করবে, আল্লাহ তাকে সাহায্য করবেনই। তাঁর মতে, বাংলায় সোনার মানুষ আছে, সোনার মাটিও আছে। সুতরাং, বাংলাদেশকে সোনার দেশ হিসেবে গড়ে তোলা মোটেই কোনো দুঃসাধ্য কাজ নয়। তবে, এজন্য প্রয়োজন সম্মিলিত সহযোগিতা ও প্রচেষ্টা।
২৬শের পচা অতীতের কথা স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু আজ রোগশয্যায়ও শোকাতুর মুহ্যমান। তাঁর ডাকের মর্যাদা রাখতে গিয়ে বাংলার যে সব মুক্তিকামী সংগ্রামী মানুষেরা অকাতরে প্রাণ বাজী রেখেছিল, তাদের স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু আজ ভীষণ মনঃক্ষুন্ন।
তিনি গভীর দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন যে, বাংলার মানুষ আজ যে দুঃখকষ্টে দিন গুজরান করছে তা’ প্রতি মুহূর্তেই তাঁর হৃদয়ে দারুণ ব্যথার সঞ্চার করে। বিদেশী চক্রান্তের পুতুল হিসেবে বাংলার যে সব নির্বোধ সন্তানেরা পাটের গুদাম পোড়াচ্ছে, রেল লাইন ধ্বংস করছে, সম্পত্তি নষ্ট করছে এবং দেশে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টায় মেতে আছে, তাদের তিনি সংশোধিত হতে উপদেশ দিয়ে জাতীয় স্বার্থ সজাগ হতে আহ্বান জানিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধু দৃঢ় বিশ্বাস প্রকাশ করে বলেছেন যে, আমরা সবাই যদি সততা ন্যায়নিষ্ঠা ও গঠনমূলক মনোভাব নিয়ে দেশ গঠনে উদ্দীপ্ত হই নিশ্চয়ই একদিন বাংলার সুদিন আসবেই। তিনি গুপ্তহত্যা, স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি থেকে দূরে থেকে বাংলাদেশ গঠনের জন্য সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন।
সত্যিই, আমরাও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সুর মিলিয়ে আমাদের সংগ্রামী ভাই-বোনদের ও দেশবাসীকে জানাতে চাই যে, সত্যিকারের আগ্রহী, ন্যায়নিষ্ঠতা, সহযোগিতা ও পারস্পরিক স্বার্থত্যাগ ও প্রচেষ্টা না থাকলে আমাদের এদেশকে সোনার দেশ হিসেবে গড়ে তোলা কখনই সম্ভব নয়। বাংলার আকাশে বাতাসে দিগ-দিগন্তে অশুভ শক্তির দৌরাত্ম্যে আজ যে দুর্যোগের ঘনঘটা, তা’ সবাইকে সম্মিলিতভাবেই প্রতিরোধ ও প্রতিহত করতে হবে। তা’ না হলে আগামী দিনের কাছে আমাদের সবাইকেই সমানভাবে অপরাধের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে জবাবদিহি করতে হবে। কারণ, ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করবেনা।

কয়লা নেই ইটও নেই : উন্নয়ন কার্য বন্ধ

জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনা শেষটায় হয়তো বা শিকেয় উঠবে। এর কারণ বহুবিধ। এর কারণ ইটের অভাব। কয়লার অভাবে ইটের অভাব এবং ইটের অভাবে উন্নয়ন কাজ শিকেয় ওঠার সমূহ আশঙ্কা। দেশের উন্নয়ন ও পুনর্গঠনমূলক কাজের জন্য ইট একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমাগত কয়লার অভাবে ইট পোড়ানোর কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে এবং বিকল্প ব্যবস্থা নিয়ে যে ইট পোড়ানো হচ্ছে তার মূল্যও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইটের অভাব ও মূল্য বৃদ্ধি উন্নয়ন ও পুনর্গঠনমূলক কাজের উপর ব্যাপক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে যে, ইট কাটার জন্য এবারকার মৌসুমে প্রায় তিন লাখ টন কয়লার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেখানে ইট পোড়াবার জন্যে মাত্র ২৩ হাজার টন কয়লা সরবরাহ করা হয়। আর এতে ইট পোড়ানোর পরিকল্পনাও ব্যাপকভাবে সংকুচিত করতে হয়। দেশের সর্বত্রই এই একই অবস্থা বিরাজিত। অপরদিকে কয়লার অভাবে কেউ কেউ ফার্ণেস তেল ও পীচ দিয়ে ‘ইট’ পোড়ানোর ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ফার্ণেস তেল ও পীচও এখন দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে। আর ফার্ণেস তেল ও পীচ দিয়ে যারা ইট পুড়িয়েছেন, তাদের উৎপাদন ব্যয় কয়লা পোড়ানোর তুলনায় দ্বিগুণ লেগেছে। ফলে তাদের ইটের দর-পড়তাও দ্বিগুণ হতে বাধ্য।
স্বাধীনতার পর পরই যেখানে ইটের দাম ছিল হাজার প্রতি ‘সোয়াশ’ টাকা। এখন সেই দাম এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ‘তিনশ’ টাকায়। অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন, এবার চাহিদা মতো ইট পোড়ানো না হওয়ায় এ মূল্য যদি পাঁচশ’ টাকাতেও পৌঁছায় তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। তা ছাড়াও অনেকে কয়লা পাবেন আশায় ইট কেটে রেখেছেন, এখনো পোড়াতে পারেননি। গত দু’দিনের বৃষ্টিপাতে তাদের সেই ইটের কি দশা ঘটেছে তা সহজেই অনুমেয়।
বস্তুতঃ কয়লার এহেন অভাব তথা কয়লা নিয়ে যে সব কেলেংকারীগুলো ঘটেছে বা ঘটছে-কয়লা আমদানীর ক্ষেত্রে যে সব অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, কয়লার পারমিট দানের ক্ষেত্রে যেসব কারচুপি হচ্ছে, এগুলো নতুন তো কিছু নয়। এসব ব্যাপারে বহুবার জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর পক্ষ থেকে কর্তৃপক্ষ সমীপে বহুকিছু তুলে ধরা হয়েছে, তার সঠিক কোনো সুরাহা হয়েছে কি না বা সে ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে কি না আজ পর্যন্ত তার কিছুই জানা যায়নি। কেননা, চলতি অর্থ বছরে যে ৫ লাখ ৪০ হাজার টন কয়লা আসার কথা ছিল, তা আমদানীর কর্মসূচী ইতিমধ্যেই পিছিয়ে পড়েছে। চলতি বছরের জন্যে নির্ধারিত কয়লা আনার কথা ছিলো গত সেপ্টেম্বর মাসে কিন্তু তা আসতে শুরু করেছে গত জানুয়ারী মাসে, তাও এ যাবত এসেছে মাত্র ২৯ হাজার টন। অন্যদিকে অগ্রাধিকারের প্রশ্নে কয়লা বন্টনের ক্ষেত্রে ইট খোলার স্থান পাঁচ নম্বরে। কাজেই ইট পোড়ানোর জন্যে কয়লা পেতে অনেক তেল খুড় পোড়াতে হয়।
এমতাবস্থায়, জাতীয় উন্নয়নের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হতে তো বাধ্যই, তদুপরি বন্ধ হয়ে যাওয়াটাও স্বাভাবিক কিছু নয়। উন্নয়ন কর্মসূচীর গতিবেগ রাখতে হলে এদিকটায় আরো মনোযোগী হবার অবশ্যই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!