বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩রা মার্চ, রোববার, ১৯৭৪, ১৯শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
পাট কি তার বাজার হারাবে?
সাধারণতঃ এক একটা বিশেষ অনুকূল বাতাসের মুখেই ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রচুর ডিল, বাজার বা মুনাফা লাভের সম্ভাবনা থাকে। এমন একটি অনুকূল বাতাস আমরা সেই সাবেক পাকিস্তান আমলেও পেয়েছিলাম কোরিয়ার যুদ্ধ থেকে, আর এমন একটি অনুকূল বাতাস আজো আমাদের অর্থনৈতিক প্রাঙ্গণে তার কোমল পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি তথা বিশ্বব্যাপী তেল সংকটের ফলে।
আমাদের জাতীয় অর্থনীতির প্রধান মেরুদন্ড পাট। এই পাট থেকেই আমাদের প্রতি বছর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয় শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ। গত কোরিয়ার যুদ্ধে অনুকূল বাতাসের মাহাত্ম্যে সাবেক সরকার পাট বেচে যে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেছিলেন, তা’ আজো স্মৃতির চারণায় রেকর্ড হয়ে আছে।
মাঝে দারুণ নৈরাজ্য ও সংকটের পর আমাদের পাটের রাজ্যে আবার অনুকূল বাতাস এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ, রাজনীতি ও বিশ্বব্যাপী তেল সংকটের ফলে। এতদিন বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে পাটের বিকল্প তৈরী করে বিভিন্ন উন্নত দেশগুলো আমাদের পাটের সঙ্গে সার্থক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির উপর যে চরম আঘাত হেনে আসছিল, তার একটি দারুণ মোড় ঘুরে যায় বর্তমানের তেল সংকট থেকে। কারণ, পাটের বিকল্প তৈরী করতে এখন তেলের দরুণ যে বিপুল খরচ বেড়ে গেছে, তাতে বিকল্প তৈরীর চেয়ে আমাদের পাটকে কিনলেই বেশী লাভ হয় বলে উন্নত দেশগুলোর ঔদ্ধত্যমুলক মানসিকতা এখন অনেকটা কমে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বিদেশীরা এখন আমাদের পাটে যথেষ্ট আগ্রহও দেখাতে শুরু করেছে। বলতে গেলে, আমাদের জাতীয় জীবনে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের এখন হচ্ছে এক মোক্ষম সময়।
অথচ বিভিন্ন সূত্রে যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে বর্তমান আর্থিক বছরে সরকার পাটজাত-দ্রব্যের যে রপ্তানী লক্ষ্য ধার্য করেছিলেন, তা নাকি অর্জন করা সম্ভব হবেনা।
এ-বছর রপ্তানীর লক্ষ্যমাত্রা ছিল নাকি ৫ লাখ টন। অথচ শোনা যাচ্ছে গত জুলাই থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত সময়ে রপ্তানী হয়েছে নাকি মাত্র ১ লাখ ৫১ হাজার টন।
আবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছিল ৫ লাখ ৬৮ হাজার টন। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ লাখ ৫১ হাজার টন পাটজাত দ্রব্য উৎপাদিত হয়েছে।
উৎপাদনের এ মন্থর গতির ফলেই নাকি সরকার তার লক্ষ্যমাত্রার পৌঁছুতে পারবেন না বলে অনেকেই আশংকা করছেন। অথচ রপ্তানী লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারলে প্রায় ১৬০ কোটি টাকার মতো বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা সম্ভব হতো। কিন্তু রপ্তানী যথাযথ না হওয়ায় এ উপার্জন নাকি আর সম্ভব হবেনা।
একটি স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি রিপোর্ট অনুসারে বর্তমান আর্থিক বছরে পাটজাতদ্রব্যের প্রাপ্যতার পরিমাণ হচ্ছে সর্বমোট ৬ লাখ ৬৯ হাজার টন। এর মধ্যে দেশে ব্যবহৃত হবে ৪০ হাজার টন এবং বছরের শেষে ইজারা থাকবে ১ লাখ ২৯ হাজার টন।
অন্যান্য পাটজাত দ্রব্য রপ্তানীকারক দেশসমূহের সঙ্গে বাংলাদেশ নাকি বিশেষ সুবিধা করতে পারছেনা। বিশেষ করে সময় মতো মাল সরবরাহ করতে না পারায় নেপাল, থাইল্যান্ড ও বার্মার মতো বেশ কয়েকটি বাজার ইতিমধ্যেই হাতছাড়া হয়ে গেছে। তা’ছাড়া জানা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসায় করতে বিদেশী ক্রেতারা নাকি দিনদিনই উৎসাহ হারিয়ে ফেলছেন। কারণ, আমাদের ব্যবসায়ীরা একে সময় মতো মাল দিতে পারেনা, তার উপর অনেক সময়ে শর্তভঙ্গ করে নিম্নমানের মালও সরবরাহ করে এবং ঠিক মতো দেনাপাওনাও শোধ করে না।
পাটের উৎপাদন ও রপ্তানী বৃদ্ধির জন্য সরকার ইতিমধ্যেই পাটকে আলাদা গুরুত্ব দিয়ে একটা পৃথক মন্ত্রণালয় খুলেছেন। তা’ছাড়া গত বছরের তুলনায় এবার পাটের সর্বনিম্ন মূল্যও ৫০ থেকে ৬০-এ উন্নত করেছেন। তবুও নাকি কোথায় একটা গলদ থেকে যাচ্ছে। অবশ্য সরকারী ভাষ্যমতে চলতি সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত বাংলাদেশ পাট রপ্তানী সংস্থা (বি-জে-ই-সি) নাকি ভারতে বিক্রিত ২ লাখ বেল পাট সহ মোট ২৪ দশমিক একুশ লাখ বেলের রপ্তানী মূল্য পেয়েছে এবং ১৭ই ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত বিদেশে রপ্তানীর জন্যে পাট জাহাজ বোঝাই করেছে ১৪ দশমিক ৪২ লাখ বেল।
শীঘ্রই আরো ২ লাখ বেল পাট ভারতের কাছে বিক্রি করা হবে। এছাড়া আরো ৮ থেকে ১০ লাখ বেল আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই বিভিন্ন দেশে রপ্তানী হবে। এতে চলতি মৌসুমে মোট ৩৪ থেকে ৩৬ লাখ বেল পাট রপ্তানী সম্ভব হবে।
যা হোক, পাটমন্ত্রী মহোদয়ের ভাষ্য অনুসারে পাটের বর্তমান যে অবস্থা জানা যায়, তাতে মোটামুটি আশার আলো পাওয়া গেলেও বাস্তবে বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা ও পরিকল্পনা ঠিক কতটুকু ফলপ্রসূ হবে সেটাই আমাদের মূল ভাবনা।
আমরা সবাই সবাই আন্তরিকভাবে চাই যে, পাট মন্ত্রণালয়ের সমস্ত ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা সর্বতোভাবে সফল হয়ে আমাদের জাতীয় জীবনে অর্থনৈতিক সুখ আনে। আবার, আমাদের এও ভাবনা যে, আমাদের দ্বারপ্রান্তে বর্তমানে যে অনুকূল বাতাস বইছে তাকেও সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে আমরা যেন ব্যর্থ না হই।
সুপরিকল্পিত চক্রান্ত প্রতিরোধের আহ্বান
ঢাকা জেলা বার সমিতি’র ৫২ জান এ্যাডভোকেট এক যৌথ বিবৃতিতে মওজুতদার, মুনাফাশিকারী এবং কালোবাজারীদের বিরুদ্ধে সরকারী কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বার সমিতির ৫২ জন এ্যাডভোকেট যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি, পাটের গুদামে আগুন, খাদ্যদ্রব্য, তেল ও অন্যান্য ব্যবহার্য জিনিসপত্রে ভেজাল মিশ্রণ এবং লবণ কেলেংকারী ‘একটা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত।’ ব্যবসাঙ্গণে এই ‘চক্রান্ত’ বর্তমানে এমন এক পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যে, জনজীবনের সর্বস্তর থেকেই এর মুলোৎপাটনের জন্যে দাবী উঠেছে। সরকারও হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যকে স্থিতিশীল করার জন্য মওজুতদার, মুনাফাখোর, কালোবাজারী ও অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান পরিচালিত হয়েছে। বিশেষ আইন বলে অসাধু ব্যবসায়ীদের শায়েস্তা করার জন্যে সরকার অবিচল রয়েছেন। কিন্তু সরকারী কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির মূল কারণগুলো বার করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কল-কারখানায় কম উৎপাদন, দ্রব্যাদির বন্টন ব্যবস্থার গলদ, চোরাচালান এবং পাট কেলেংকারীর ফলেই নাকি দ্রব্যমূল্য ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। সরকার অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করাতে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কোনো কোনো জিনিসের দাম কমলেও অশুভ এবং অসাধু তৎপরতার অবসান হয়নি। সরকারের কঠোর মনোভাব গ্রহণের ফলে পাইকারী ব্যবসায়ীরা দোকান বন্ধ করে গোপন রন্ধ্র পথ দিয়ে বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি নিরাপদ স্থানে স্থানান্তর করে চলেছে। অর্থাৎ সরকার যতোই কঠোর ব্যবস্থা নিন না কেন, অসাধু ব্যবসায়ীরাও পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার ব্যাপারে পিছপা হচ্ছে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যকে স্থিতিশীল করার জন্যে জনজীবনের সর্বস্তর থেকে দাবী সোচ্চার এবং এজন্য সরকারের সঙ্গে জনসাধারণের সহযোগিতাও একান্ত আবশ্যক। ব্যবসায়ীরা সব সময়ই নানা অজুহাত দেখিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করে। অসাধু ব্যবসায়ীদের ইন্ধন জোগানোর জন্য নাকি সমাজবিরোধী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরাও জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এই প্রভাবশালী মহলটি কারা, তা নিরুপণের জন্যও সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। কারণ, বাজারের অবস্থা স্থিতিশীল করতে হলে কে প্রকৃত ব্যবসায়ী আর কে ভুয়া ব্যবসায়ী তা নির্ধারণ করতে হবে। একশ্রেণীর হঠাৎ গজিয়ে উঠা ব্যবসায়ীরা নাকি রাতারাতি ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হওয়ার জন্য ব্যবসার সমুদয় নীতিমালাকে জলাঞ্জলি দিয়ে ব্যবসাঙ্গণে এক অরাজকতার সৃষ্টি করছে। এমনকি, ছাত্র নামধারী ব্যক্তিরাও পারমিটবাজীতে নেমে ব্যবসার ক্ষেত্রে এক নিদারুণ অচলাবস্থার সৃষ্টি করছে। আমদানী এবং বন্টন নীতিতেও ক্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা চালু রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এবং এই অব্যবস্থার জন্যেই নাকি একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজারে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। এইভাবে দেশে এখন মওজুতদার, কালোবাজারী এবং অসাধু ব্যবসায়ীদের পোয়া বারো অবস্থা বিরাজ করছে। জনসাধারণ যতোই দিন গড়িয়ে যাচ্ছে ততোই অতিষ্ঠ হয়ে উঠছেন। জীবনসংগ্রামের যাঁতাকলে জনজীবনে আজ নাভিশ্বাস দেখা দিয়েছে। জনসাধারণকে দ্রব্যমূল্যের এই গগনস্পর্শী ছোবল থেকে রক্ষার জন্যে সরকারী কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ অতি প্রয়োজনীয়। কিন্তু চোরা যেমন ধর্মের কথা শোনেনা, অসাধু ব্যবসায়ীরাও তেমনি। অসাধু ব্যবসায়ীদের এখনো টনক নড়েনি। এখনো তারা নানা টালবাহানার অবতারণা করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুদাম থেকে লাপাত্তা করে দিচ্ছে। বাজারে সৃষ্টি করছে কৃত্রিম সংকট। এই অবস্থায় সরকার যখন অসাধু ব্যবসায়ী দমনে এগিয়ে এসেছেন, তখন আমাদের সকল মহলেরই উচিত সরকারী পদক্ষেপকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলার জন্য সক্রিয় সহযোগিতা করা। মওজুতদার, মুনাফাখোর, কালোবাজারীদের শায়েস্তা করার সরকারী ব্যবস্থার ফলে ভুয়া ব্যবসায়ীরাও নিশ্চয়ই উৎখাত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। কাজেই ৫২ জন আইনজীবী যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন তাতে বঙ্গবন্ধুর সরকারকে জনগণের সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দেয়া হয়েছে। আমরাও বলি, জনগণের সহযোগিতা ছাড়া দ্রব্যমূল্যের এই সীমাহীন সমস্যা নিবারণ হতে পারে না। জনসাধারণ যাতে দ্রব্যমূল্যের বিপুল ব্যয়ভার থেকে মুক্তি পান সে জন্যে সরকারী পদক্ষেপের প্রতি জনগণের আনুগত্য ও সহযোগিতা কাম্য।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক
পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন