You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৯শে নভেম্বর, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ৩রা অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

সংসদ সদস্যদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ

কোনো বিশেষ বিল অথবা অর্ডিন্যান্স নিয়ে নয়—আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের সভায় মূল আলোচনার বিষয় ছিল খাদ্য সমস্যা তথা খাদ্য সংগ্রহ অভিযান। এ অভিযানকে সফল করে তোলার উপর সবাই গুরুত্ব আরোপ করেছেন। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আসন্ন শীতকালীন অধিবেশন সপ্তাহ খানেক চলার পর সংসদ সদস্যরা নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় ফিরে গিয়ে খাদ্য সংগ্রহ অভিযান সফল করে তোলার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন। সীমান্তে চোরাচালান বন্ধের জন্য গণকমিটি গঠনের প্রস্তাবও এই সভায় গ্রহণ করা হয়। সংসদ অধিবেশন মুলতবী থাকবে জানুয়ারী পর্যন্ত।
আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের এই সভাকে কেন্দ্র করে নানা প্রকার জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছিল। রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একটা আমূল পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়া হতে পারে বলে অনেকেই ভবিষ্যদ্বাণী করছিলেন। বলা হচ্ছিল সংবিধান সংশোধনের কথাও। এ সব কিছুর সম্ভাবনা অবশ্য উড়িয়ে দেয়া যায়না বিশেষ করে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির চীফ হুইপ নিজেই যখন বলেছেন প্রশাসনিক পরিবর্তন সহ অন্যান্য আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে পরবর্তীকালে আলোচনা হবে। কিন্তু তা জানুয়ারীর পূর্বে নয়। মধ্যবর্তী এই দেড় মাস যাতে সংসদ সদস্যরা সরকারের খাদ্য সংগ্রহ অভিযানে সম্পূর্ণভাবে আত্মনিয়োগ করতে পারেন সে জন্যই সংসদ অধিবেশন মুলতবী রাখা হবে।
আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের এই সিদ্ধান্ত অত্যন্ত বিজ্ঞজনোচিত হয়েছে বলে আমরা মনে করি। দেশ এখন এক মারাত্মক সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত। খাদ্য সমস্যা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। দুর্ভিক্ষ এবং অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বিভিন্ন মহল থেকে যা বলা হয়েছে তা নিতান্তই উদ্বেগজনক। গত বৎসরের খাদ্য সংগ্রহ অভিযানের ব্যর্থতা এবারের খাদ্য সমস্যাকে অধিকতর প্রকট করে তুলেছে। এমতাবস্থায় এবার যদি খাদ্য সংগ্রহ অভিযানে সর্বশক্তি নিয়োগ করা না যায় তবে অনিবার্যভাবে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া পড়বে আগামী বৎসরে।
বঙ্গবন্ধু দেশের এই বাস্তব অবস্থাকে সামনে রেখেই নির্দেশ দিয়েছেন সংসদ সদস্যদের প্রতি। জাতীয় সংসদের প্রায় সবক’টি আসনেই নির্বাচিত আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিরা তাঁর নির্দেশের গুরুত্ব অবশ্যই উপলব্ধি করতে পারবেন। এটি তাদের জন্য এক অগ্নি পরীক্ষা। বঙ্গবন্ধু খুব শীঘ্রই রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে আমূল পরিবর্তন সাধন করতে যাচ্ছেন তাতে এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ সংসদ সদস্যদের নিশ্চয়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধু’র সরাসরি নির্দেশে যত সফলতার সঙ্গে কার্য সম্পাদন করতে পারেন অন্য নিয়মে তা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। সংসদীয় দলের বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশ তাদের অনুপ্রাণিত করবে বলে আমাদের বিশ্বাস। নির্বাচনী এলাকায় খাদ্য সংগ্রহ অভিযান সফল করে তোলার ব্যাপারে যে সমস্যাগুলো দেখা দেবে সে সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল। সংসদ সদস্য হিসাবে যারা নির্বাচিত হয়েছেন এবং যারা তাঁর সমর্থক তাদের সবাই ভূমিহীন কৃষক অথবা স্বল্প জমির মালিক নন। এর মধ্যে দু’একজন আছেন যাদের জমি এবং উৎপাদনের পরিমাণ বেশী। সরকারী গুদামে চাল না দিয়ে মওজুত করার প্রবণতা তাদের মধ্যে দেখা দিতে পারে। সমর্থন হারাবার আশঙ্কায় হয়তো কোনো কোনো সংসদ সদস্য এমন অবস্থাপন্ন কৃষকের দিকে হাত বাড়াতে চাইবেন না। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত আজকের খাদ্য সংগ্রহ অভিযানের ব্যর্থতা আগামী বৎসরে তার নিজের নির্বাচনী এলাকায়ই হয়তো অনেকের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। আজ অবস্থাপন্ন গুটি কতক জোতদারের ধান সরকারের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করে তারা আগামী বৎসর অনাহারে মৃত্যু থেকে বহু লোককে রক্ষা করতে পারেন। এতে করে জোতদাররা হয়তো বিক্ষুব্ধ হবে, চোরাচালানীরা বিরোধিতা করবে কিন্তু সহযোগিতা ও সম্প্রীতির হস্ত সম্প্রসারিত করবে সাধারণ মানুষ। এই সাধারণ স্বল্প জমির মালিক, ছোট ব্যবসায়ী, শিক্ষক এবং ভূমিহীন কৃষকই তার রাজনৈতিক শক্তি। এই শক্তির বিরোধিতা স্ববিরোধিতারই সামিল।
একই সঙ্গে চোরাচালানী রোধের জন্য গণকমিটি গঠনের যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে সে ব্যাপারেও আমাদের বক্তব্য : খাদ্য সমস্যা যদি কার্যকরীভাবে মোকাবেলা করতে হয় তবে খাদ্যের আভ্যন্তরীণ মওজুত বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তার পাচার রোধ করার উপরও সমান গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। যারা এ ব্যাপারে নিষ্ঠা এবং আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসবেন তাদের সম্মিলিত উদ্যোগে গঠিত গণকমিটিই একমাত্র কার্যকরীভাবে চোরাচালান রোধ করতে পারে বলে আমাদের বিশ্বাস। এ ব্যাপারে ‘মাই ম্যান’ ঢুকানো অথবা অমুককে নিয়ে কমিটি না করলে কেমন দেখায় এই সব বাজে অজুহাত বস্তুতঃ লক্ষ্য অর্জনের প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করে।
সংসদ সদস্যরা তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের গুরুত্ব উপলব্ধি করে সরকারের খাদ্য সংগ্রহ অভিযানকে সফল করে তোলার ব্যাপারে সকল শক্তি নিয়োগ করবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। আগ বাড়িয়ে ‘আমি অত লক্ষ মণ সংগ্রহ করতে পারবো’ এমনি সব বাগাড়ম্বর না করে কাজের মাধ্যমে যোগ্যতা প্রমাণের যে শেষ সুযোগ বঙ্গবন্ধু তাদের দিয়েছেন, তার সদ্ব্যবহার করেই একমাত্র দেশের ভবিষ্যত রাজনীতিতে তারা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে এগিয়ে আসতে পারেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!