You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৩ই নভেম্বর, বুধবার, ১৯৭৪, ২৬শে কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

মর্মান্তিক লঞ্চ দুর্ঘটনা

গত পরশুদিন ধলেশ্বরী নদীর শাখা কুমারভাঙা নদীতে একটি মর্মান্তিক লঞ্চডুবি হয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় পত্র-পত্রিকা খবরটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রাণহানির হিসাব দিতে গিয়ে বিভিন্ন প্রকার মত দিয়েছেন। কেউ বলেছেন—লঞ্চডুবিতে দু’শ’ যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন, আবার কেউ তিন শ’ থেকে চার শ’ যাত্রীর প্রাণহানির আশংকা করেছেন। দুর্ঘটনাটি ঘটেছে মুন্সীগঞ্জ ঘাট থেকে তিন মাইল দূরে ডিগ্রীচরের কাছাকাছি রাজাপুর গ্রামের পূর্বদিকে। লঞ্চটির নাম ‘এম এল তিতাস’। লঞ্চটি তালতলা লঞ্চঘাট থেকে ছেড়ে ঢাকার দিকে আসছিল। সংবাদে প্রকাশ—লঞ্চটিতে নাকি অতিরিক্ত যাত্রী ছিল এবং ঢাকার দিকে আসছিল বহু কাঁচামাল। সংবাদসমূহের সার্বিক বিশ্লেষণে নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায় অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বহনের দরুণই লঞ্চটি ডুবেছে। মুন্সীগঞ্জের মহকুমা প্রশাসকের মতে লঞ্চটিতে নাকি আনুমানিক চারশ’য়ের মতো যাত্রী ছিল। যাত্রীর মধ্যে প্রায় চল্লিশ জন মহিলা ও বহু শিশু ছিল। কোনো পত্রিকার মতে, ষাট জনের মতো বেঁচেছে আবার কেউ বলেছেন শতাধিক যাত্রী বেঁচে গেছে। মুন্সীগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক খবর পাওয়ার পর ঘটনাস্থলে যান এবং পুলিশ ও দমকল বাহিনীর লোকদেরকে পাহারার কাজে নিয়োগ করেন। আভ্যন্তরীণ নৌ-চলাচল বিভাগের একটি উদ্ধারকারী ইউনিট লঞ্চটি যেখানে ডুবেছে তার কাছেই ছিল—সেটি বড় আকারের এই লঞ্চটি উদ্ধার করতে সক্ষম নয় বলে জানিয়েছে। জানা গেছে, কর্তৃপক্ষ গতকাল সকাল থেকে লঞ্চটির উদ্ধার কাজ শুরু করেছেন। গত ১৯৭২ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে বহু লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে। বোধকরি তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে বড় ঘটনা—এবং নিদারুণ মর্মান্তিক। দু’শ’ থেকে তিন শ’ যাত্রীর প্রাণহানির এই ঘটনা গোটা জাতিকে শঙ্কিত করেছে। লঞ্চযাত্রার উপর মানুষের যে আতঙ্ক ছিল তা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। বস্তুতঃ লঞ্চ মালিকদেরকে অধিক আয়ের ঘৃণ্য মনোভাবে দরুণই দেশের সবগুলো লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটেছে। সবগুলো ঘটনাই অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহনের দরুণ ঘটেছে। এ ব্যাপারে দেশের প্রত্যেকটি সংবাদপত্র যাত্রীদের পক্ষ থেকে সরকারকে প্রয়োজনীয় দাবী জানিয়েছে। আমরাও বার বার আমাদের মতামত ব্যক্ত করেছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নেননি। নদীপথে চলাফেরা করা আজ যেমন নিরাপদ নয় তেমনি লঞ্চ দুর্ঘটনাও একটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। লঞ্চের মালিকরা তাদের মুনাফা অর্জনের লেলিলহান স্পৃহায় উন্মত্ত হয়ে লঞ্চের ক্ষমতার চাইতে সবক্ষেত্রেই বেশী যাত্রী ও মালামাল বহন করে থাকে। ফলে লঞ্চ তার শক্তি বা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে যদি সুষ্ঠু নিয়মের প্রবর্তন না করেন তাহলে অনিবার্যভাবে পরবর্তী সময়েও লঞ্চ দুর্ঘটনা অব্যাহত থাকবে। উল্লেখিত এম.এল. তিতাসের এই দুর্ঘটনায় কত অসহায় মানুষ নির্মম নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, সন্তান-সন্ততি নিয়ে কতজন প্রাণ হারিয়েছে। এই দুঃসহ মৃত্যু ঘটনা বর্ণনাতীত। কর্তৃপক্ষের যদি বোধোদয় হয় তাহলে অবিলম্বে এম.এল. তিতাসের মালিককে খুঁজে বের করে এবং লঞ্চডুবির কারণ অনুসন্ধান করে একটি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। লঞ্চে যাত্রী ও মাল বহনের ব্যাপারে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়মের প্রবর্তন করবেন। মানুষের চলাফেরার দুরবস্থার সুযোগ নিয়ে যারা আজ এহেন মুনাফা অর্জনে ব্যস্ত এবং এদের উপরে যে কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই তাদের উভয়কেই আমরা জনগণের বন্ধু বলে মনে করি না। এবং আমাদের বিশ্বাস দেশবাসীও তাদেরকে বন্ধু বলে বিবেচনা করেনা। লঞ্চডুবির কারণে যারা মারা গেছেন আমরা সেই সকল হতভাগ্য মানুষের আত্মার মঙ্গল কামনা করি, তাদের আত্মীয়-স্বজনের দুঃখের সঙ্গে একাত্মতা স্থাপন করি।

দুর্বোধ্য রপ্তানী নীতি

পাট আমাদের প্রধান সম্পদ। পাট আমাদের জাতীয় অর্থনীতির মেরুদন্ড। অথচ এ যাবত এমন একটা পাটনীতি নির্ধারণ করা হলো না যার মাধ্যমে দেশের অন্যান্য রপ্তানীজাত দ্রব্য সহ সময়মতো কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্যদামে পাট সংগ্রহ করা, পাট বা পাটজাতদ্রব্য রপ্তানী করে নির্দিষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার উদ্যোগ নেয়া, দেশের পাটকলগুলোকে চালু রাখার চিন্তা বা পাটচাষীদেরকে পাটচাষে উদ্বুদ্ধ করার বাস্তব পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়। এমনকি দেশে কতটা পাট চাষ হয়—তারও সঠিক পরিসংখ্যান সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল মহল সন্দিহান।
বলা হচ্ছে, এবার দেশে ৪০ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হয়েছে। এর পুরোটাই সরকারীভাবে সংগ্রহ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল আশা পোষণ করে সুষ্ঠু বক্তব্যও রেখেছেন। পাটমন্ত্রী আরো বলেছেন, সংগৃহীতব্য এই ৪০ লাখ বেল পাট সহ গত বছরের ক্যারিওভার ১৩ লাখ বেল মিলিয়ে সরকারের হাতে থাকবে ৫৩ লাখ বেল পাট। এ বছরে দেশের মিলগুলোর জন্য প্রয়োজন ৩০ লাখ বেল পাট, রপ্তানী বাবদ ধার্য করা আছে ২০ লাখ বেল। উদ্বৃত্ত থাকছে ৩ লাখ বেল। এসবই হলো কাগুজী হিসেব।
এরই প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট মহলের হিসেব অনুযায়ী মাত্র ২২ লাখ বেল পাট কেনা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যে চটকল সংস্থার মিলগুলো ৬ লাখ বেল, চারটি পাটক্রয়কারী সংস্থা ১২ লাখ বেল ও বেসরকারী পার্টির কাছ থেকে কেনা হয়েছে ৪ লাখ বেল। বাকী পাট সংগ্রহ করতে না পারার অজুহাত স্বরূপ বলা হয়েছে যে—এখনো যে সমস্ত পাট বাইরে রয়ে গেছে তা সীমান্ত এলাকার এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে ফড়িয়া, অসৎ ব্যবসায়ী ও জোতদাররা আটকে রেখেছেন। পাট প্রতিমন্ত্রী আরো উল্লেখ করেছেন যে, সীমান্তবর্তী এলাকায় ৬ থেকে ৭ লাখ বেল পাট উৎপাদিত হয়ে থাকে। তার মধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে আড়াই হাজার বেল। অবশিষ্ট পাট পাচারের অভিযোগকে তিনি এই সঙ্গে স্বীকার করেন।
প্রশ্ন দাঁড়ায়—কাগুজী হিসেবের সঙ্গে বাস্তব হিসেবের মিল কেন থাকে না? ঘাপলাটা কোথায়? স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে এবং অবৈধ পাট মওজুতদারীদের কাছ থেকে প্রত্যাশানুযায়ী পাট কেনা যায়নি। এতদসত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে জোর দিয়ে বলা হচ্ছে ১৫ই ডিসেম্বরের মধ্যে ওদের কাছ থেকে প্রায় ১০ লাখ বেল পাট সংগ্রহ করা হবে। কেমন করে বা কোন্ পদ্ধতিতে তার অবশ্য কিছু উল্লেখ নেই। অপরপক্ষে পাট কেনার মৌসুম প্রায় শেষ। এরপর মাথায় বাড়ি মারলেও পাটের পাত্তা পাওয়া সম্ভব যে হবে না—এ কথা একটি শিশুও বোঝে।
বলতে গেলে দেশের উৎপাদন কত, সংগ্রহ লক্ষ্য কত এবং কিভাবে সেই লক্ষ্য যে কোন্ প্রক্রিয়ায় হাসিল করা সম্ভব হবে—এসবেরই কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। রপ্তানী নীতি তো বহু দূরের কথা। হিসেবের বেলায় কাগুজী হিসেব দাখিল করা হয়তো সহজ। ওতে মন্ত্রণালয়ের গায়ে আঁচড় না লাগলেও জাতীয় অর্থনীতির কুপোকাৎ অবস্থা। একটা সুষ্ঠু পাটনীতি নির্ধারণ করতে না পারার জন্য দেশে পাট চাষ ও পাটচাষীদের অবস্থা হয়েছে শোচনীয়। পাট ও পাটজাতদ্রব্য রপ্তানীর ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে মারাত্মক ক্ষতিকর অবস্থা। পাটকলগুলোকে উৎপাদনে চালু রাখার কোনো বাস্তব পন্থাও নেয়া সম্ভব হচ্ছে না সুষ্ঠু পাটনীতি গ্রহণ করতে না পারার জন্য। ফলে পাট সংগ্রহের লক্ষ্য তো অর্জিত হতেই পারবে না, উপরন্তু আমাদের পাট অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত হয়ে পড়বে।
এ কথা সত্য যে, পাট বেচেই আমরা মূলতঃ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করি। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের প্রচুর নানাবিধ দ্রব্যাদি আমদানী করতে হয়। এর দায় প্রতিশোধ করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায়—যার সিংহভাগ আসে পাট বেচেই। তাই পাট রপ্তানী করতে হলে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার পাট সংগ্রহ করে তা যথাবিহীত ব্যবস্থায় রপ্তানী করার একটা সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেয়া যেখানে বাঞ্ছনীয়, সেক্ষেত্রে আমরা দেখি রপ্তানীযোগ্য পাট বন্দরে স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে, অথবা রপ্তানীযোগ্য স্তুপীকৃত পাটে আগুন লাগে বা পাট সংগ্রহকালে পর্যাপ্ত পাটবাহী নৌকা যায় ডুবে এবং এরকমই সব ঘট্না। এবং এ বছরও নির্ধারিত লক্ষ্যের পাট সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি বলে পাট রপ্তানীর পরিমাণ ২৮ লাখ বেল করা হয়েছে এবং তার মধ্যে মাত্র ১০ লাখ বেল পাট এ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। এসবই মর্মান্তিক খবর।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, রপ্তানীখাতে ক্রমশঃ ঘাটতি পড়ায় আমাদের আমদানী খাতের দায় পরিশোধ ভার ক্রমশঃ দুর্বহ হয়ে ‍উঠছে। এবং বৈদেশিক মুদ্রায় আমদানী-রপ্তানীর মধ্যে এই যে বিরাট ফাঁক সৃষ্টি হচ্ছে শুধুমাত্র তারই মোকাবেলায় আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন। অন্যথায় বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে বলে অভিজ্ঞ মহলের স্থির আশংকা। দুঃখের বিষয় এই যে, এসব প্রধান প্রধান বিষয়ের প্রতি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো উদাসীন থাকেন। মৃতের পাঁজরার পাহাড় সামনে দেখেও জাতীয় আয় বাড়ানোর পরিকল্পনা তথা বাস্তব পন্থা তাঁরা যেন এখনো নিতে আগ্রহী নন। ওসব চলবে না। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধনের রপ্তানীনীতিকে এখন অধিকতর সুষ্ঠু ও কার্যকরী করতেই হবে। বিকল্পে জাতীয় সম্পদের অপচয় এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে অচলাবস্থা তথা সমস্যার আবর্তে তলিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!