বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৮শে নভেম্বর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ১২ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
পরলোকে উথান্ট
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব মিঃ উথান্ট গত সোমবার নিউইয়র্কের এক হাসপাতালে পরলোক গমন করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব মিঃ উথান্টের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ডহেইমের নিকট প্রেরিত শোকবাণীতে বঙ্গবন্ধু মিঃ উথান্টকে শান্তির অগ্রদূত রূপে অভিহিত করে বলেন যে, আন্তর্জাতিক শান্তির অগ্রগতির ব্যাপারে তাঁর মহান অবদানের কথা বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ স্মরণ রাখবে।
১৯৭১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর মিঃ উথান্ট জাতিসংঘ মহাসচিবের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। জাতিসংঘের ইতিহাসে এক দশক পর্যন্ত মহাসচিবের পদে তাঁর আগে কেউ অধিষ্ঠিত ছিলেন না। মিঃ দাগ হেমার শোল্ড আকস্মিক এক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হবার পর মিঃ উথান্ট মহাসচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ষাট দশক ছিল অগ্নিপরীক্ষার দশক। এ দশকে একজন এশীয়বাসী হিসাবে আন্তর্জাতিক সমস্যা, সংকট ও বিশ্ব উত্তেজনা হ্রাসের ব্যাপারে কতটুকু দায়িত্ব তিনি পালন করতে পেরেছেন—এ প্রশ্ন অনেকের মনে দোলা দিয়েছিল। কোনো কোনো বৃহৎশক্তির চোখ রাঙানীকে উপেক্ষা করে স্বকীয় সত্তাকে জাগ্রত রেখে সকল বাধা বিপত্তিকে উপেক্ষা করে কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হবেন কিনা এ প্রশ্নও ছিল সেদিন অনেকের মনে। কিন্তু মিঃ থান্ট মহাসচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল তিনি জাতিসংঘের মহান আদর্শকে সবার উপরে তুলে ধরার বিষয়ে দৃঢ়চিত্ত। এ ব্যাপারে তিনি আপোষহীন।
জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালে তিনি ইন্দোচীন, কঙ্গো ও পশ্চিম এশিয়া সমস্যা সহ বিভিন্ন বিশ্ব সংকটের সম্মুখীন হন। ১৯৬২ সালে সোভিয়েত-মার্কিন মিসাইল সংকট নিরসনে তাঁর সফল প্রচেষ্টা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। মিঃ উথান্টের আমলে চীন জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। মিঃ থান্ট পরিণত বয়সে পরলোকগমন করেছেন এমন কথা বলা যাবে না। দুরারোগ্য ব্যাধিক ক্যান্সার তাঁকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর পর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মার্কিন প্রতিনিধি মিঃ জন কেলী বলেছেন, আমরা আমাদের যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানুষকে হারিয়েছি। মিঃ থান্টের মৃত্যুতে তাঁর আত্মার অনন্ত শান্তি কামনা করে ও তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানিয়ে আমরাও বলবো, এ যুগের একজন মানব পুজারী ও শান্তির সৈনিককে বিশ্ববাসী হারালো।
তানাকার বিদায়
‘ওয়াটারগেট’ তুল্য একটি কেলেংকারীর বোঝা মাথায় নিয়ে জাপানের ৬৫তম প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেছেন। একটি জনপ্রিয় মাসিক পত্রিকা নভেম্বর সংখ্যার তাঁর দুর্নীতি সম্পর্কে একটি নিবন্ধ ছাপলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক রাজনৈতিক অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। নিবন্ধে একজন দরিদ্র কৃষকের হয়ে তানাকা ছেলে কিভাবে সম্পদশালী হয়ে উঠেছেন তার বিস্তারিত তথ্য পরিবেশন করা হয়। তানাকা ১৯৭২ সালের ৬ই জুলাই তাঁর দীর্ঘকালীন প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক অর্থমন্ত্রী তাকেও ফুকুদাকে পরাজিত করে ক্ষমতা লাভ করেন। প্রধানমন্ত্রী তানাকা ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রধান হিসেবেও পদত্যাগ করেছেন। এরূপ একটি কেলেংকারীর সাথে খোদ প্রধানমন্ত্রী জড়িত হয়ে ক্ষমতা ত্যাগ করার নজির জাপানী পার্লামেন্টের ইতিহাসে এই প্রথম।
তানাকার পদত্যাগের ব্যাপারটি আপাততঃ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত মনে হলেও আসলে তা নয়। ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে বিপুল পরিমাণ অর্থসম্পদের অধিকারী হওয়ার বিষয়টিকে কেন্দ্র করে জাপানের রাজনৈতিক আকাশে যে নিন্দা ও সমালোচনার ঝড় উঠে তাতে তানাকা একা নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হননি, বরং ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্র্যাটিক পার্টিও বিরাট ভাঙনের সম্মুখীন। বস্তুতঃ জাপান আজ দু’মুখী সংকটের সম্মুখীন। একটি হলো রাজনৈতিক, অপরটি অর্থনৈতিক। ক্ষমতার উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত থেকে সম্পদ আত্মসাৎ করার প্রশ্নটি ক্ষমতাসীন ব্যক্তির নৈতিক অধঃপতনের সুস্পষ্ট ইঙ্গিতবাহী।
ওয়ারটারগেট কেলেংকারীতে নিক্সনের পতনের পর একটি বিষয় সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে এই ধরনের নৈতিক অধঃপতনের কলুষতা থেকে কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতাও মুক্ত নন। সাম্প্রতিককালে প্রেসিডেন্ট ফোর্ডের জাপান সফরের সময় যে বিরাট বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয় তা তানাকা-বিরোধী মনোভাবেরও বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ধরে নেয়া যেতে পারে। আন্তর্জাতিক তেল সংকট ও মুদ্রাস্ফীতির ফলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যে অবনতি ঘটেছে তা তানাকা বিরোধী মনোভাবকে আরো তীব্র করে তুলেছে। তেল ও মুদ্রাস্ফীতির জন্য হয়তো তানাকাকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করা যায় না, কিন্তু যে নৈতিক অধঃপতনের জন্য তানাকাকে বিদায় নিতে হয়েছে সে ধরনের পরিস্থিতি তানাকা কেন কাউকে রেহাই দেয় না।
এশীয় খাদ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আহ্বান
বিশ্বব্যাপী আজ এক ভয়াবহ খাদ্য সমস্যা বিরাজমান। অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। অপুষ্টির কবলে পড়েও মানুষ হারাচ্ছে প্রাণ। এছাড়া, দুর্ভিক্ষ কবলিত হয়েও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী জানা যাচ্ছে, মানবজাতির এক-তৃতীয়াংশ ক্ষুধা এবং দীর্ঘ অপুষ্টির কবলে পড়ে মৃত্যুর সঙ্গে ধুঁকছে।
খাদ্য সমস্যা দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখার ব্যাপার নয়। খাদ্য সমস্যা মোকাবেলার জন্য অবশ্যই বিশ্বের খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো দরকার। বিশ্বের খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য রোমে অনুষ্ঠিত বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে কতিপয় সুপারিশ করা হয়েছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তুন আবদুর রাজ্জাক এই সুপারিশমালার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি এশীয় খাদ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছেন। তুন রাজ্জাক কুয়ালালামপুরে এশীয় প্রশাসনিক কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত খাদ্যনীতি ব্যাখ্যা এবং উন্নয়ন সংক্রান্ত এক আলোচনা চক্রের উদ্বোধন করতে গিয়ে এশীয় খাদ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রতি জোর দিয়েছেন। বাংলাদেশ সহ ২৫টি এশীয় দেশের পদস্থ প্রশাসনিকরা এ বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। তুন রাজ্জাক বলেছেন, বিশ্বখাধ্য মওজুত ব্যবস্থা বাস্তবায়নের জন্য তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষা করে বসে থাকলে চলবেনা। খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য আঞ্চলিক কিংবা এলাকাভিত্তিক কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। তুন রাজ্জাক বলেছেন জ্বালানী সংকট তো রয়েছেই, তার চেয়েও বড়ো সমস্যা হিসেবে বিরাজ করছে খাদ্য সংকট। খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলার জন্য এশীয় দেশগুলোকে জনসংখ্যা নীতি পর্যালোচনা করে দেখতে হবে। এবং কীভাবে জনসংখ্যা স্ফীতি রোধ করা যায় সে ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করার প্রতিও তুন রাজ্জাক আহ্বান জানিয়েছেন। খাদ্য সমস্যার সঙ্গে জনসংখ্যাস্ফীতির একটি অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে। জনসংখ্যা নীতি নির্ধারিত না হলে খাদ্য সংকট কিছুতেই প্রতিরোধ করা যাবেনা। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী তুন রাজ্জাক এশীয় খাদ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়ে একটি সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রতিই অঙ্গুলী সংকেত করেছেন। এ কথা খুবই সত্য যে, খাদ্য ঘাটতি যেখানে প্রকট, সেখানে খাদ্য মওজুত করার প্রস্তাব নিতান্তই অন্তঃসারশূন্য হতে বাধ্য। তবুও বিশ্ব খাদ্য ব্যাংক গঠনের কথা যেমন উড়িয়ে দেয়া যায় না, তেমনি এশীয় খাদ্য ব্যাংক গঠনের প্রস্তাবটিকেও যায়না হেলা ফেলা করা। বিশ্ব খাদ্য সম্মেলনে বিভিন্ন নেতারা বিশ্বখাদ্য পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, বিশ্ব সমাজ খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য বদ্ধপরিকর। খাদ্য সংকট অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে একটি মারাত্মক হুমকি স্বরূপ, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তুন রাজ্জাক অঞ্চলভিত্তিক খাদ্য ব্যাংক গঠনের যে আহ্বান জানিয়েছেন, তাও আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। খাদ্য সমস্যার মতো একটি ভয়াবহ সমস্যার সমাধান করতে হলে অঞ্চলভিত্তিক যদি এশীয় খাদ্য ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা যায়, তাহলে এশীয় দেশগুলো উন্নতি ছাড়া অবনতি হবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক