You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৮ই সেপ্টেম্বর, রোববার, ২২শে ভাদ্র, ১৩৮১

টেস্ট রিলিফ ব্যবস্থা

সাম্প্রতিক সর্বনাশা বন্যায় প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের জন্য পর্যাপ্ত সাহায্য প্রয়োজন দেশের দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা জলমগ্ন হওয়ায় গড়বাড়ী গবাদি পশু এবং ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে এ দেশের প্রায় ৩ কোটি মানুষের। এই ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের পুনর্বাসন এবং তাদের বেঁচে থাকার জন্য সাহায্যের প্রয়োজন বর্তমানে সর্বাধিক। খাদ্য ও ত্রাণ মন্ত্রী জনাব আব্দুল মমিন গত বৃহস্পতিবার বলেছেন, আগামী মৌসুমের ফসল উঠা পর্যন্ত সরকারের তরফ থেকে বন্যাদুর্গত অঞ্চলগুলোতে টেস্ট রিলিফ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। ত্রাণমন্ত্রী গত সতেরই আগস্ট ঢাকাতে এক সাংবাদিক সম্মেলনেও অনুরূপ কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, দুর্গত এলাকা গুলোতে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত লোকের সংখ্যা হল দেশের মোট জনসংখ্যা দশ থেকে বারো ভাগ। এরা সর্বস্ব হারিয়েছে এবং আগামী ফসলের মৌসুম পর্যন্ত এদেরকে অন্নের সংস্থান করতে হবে সরকারকে।
সতেরই আগস্ট ত্রাণ মন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী একটা কথা পরিষ্কারভাবে বুঝা গেছে যে, সর্বস্বহারা বন্যাদুর্গত লোকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি এবং তাদেরকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে রিলিফ দরকার। বৃহস্পতিবার তিনি ঐ একই কথা বলেছেন এবং আগামী ফসলের মৌসুম পর্যন্ত সরকারিভাবে টেস্ট রিলিফ প্রধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বন্যায় হৃতসর্বোচ্চ ঐ এক কোটি লোককে, না ক্ষতিগ্রস্ত মোট ৩ কোটি লোককে টেস্ট রিলিফ প্রদান করা হবে সেটা সরকারের বিবেচ্য, তবে অভাবী জনগণকে কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক অর্থাৎ টেস্ট রিলিফ প্রদানের কর্মসূচিতে অভিনন্দনযোগ্য তাতে কোন সন্দেহ নেই। কারণ বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা গুলোতে একই সাথে দুটি উদ্দেশ্য সফল হবে এই টেস্ট রিলিফ প্রধান কর্মসূচিতে। প্রথম কথা হলোঃ আগামী ফসলের মৌসুম পর্যন্ত অন্ততপক্ষে দুর্গত অভাবী জনগণের অন্নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সরকার। অপরদিকে শুধু বসিয়ে না খেতে দিয়ে বন্যার আক্রান্ত এলাকাগুলোর রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, সেতু এবং হাসপাতাল ইত্যাদি পুননির্মাণ ও মেরামতের কাজ সমাধা হবে এই প্রাণ তৎপরতার মাধ্যমে। সুতরাং সামগ্রিক বিচারে টেস্ট রিলিফ ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম।
টেস্ট রিলিফ ব্যবস্থার প্রবর্তন এই প্রথমবার নয় আমাদের দেশে, অতীতেও বন্যা এবং ঘূর্ণি উপদ্রব এলাকায় টেস্ট রিলিফ কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে। তবে টেস্ট রিলিফ প্রদানকারী ও তাদের বন্টন পদ্ধতি নিয়ে অতীতে বিভিন্ন সময় নানা কথা উঠেছে এবং স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতির অভিযোগ পত্রিকা অফিস গুলোতে এসেছে বারবার। সরকার বর্তমানে যে টেস্ট রিলিফ কর্মসূচি গ্রহণ করতে চলেছেন তা কলুষিত হবে সে কথা আমরা বলতে চাইছি না, তবে যে বন্যা দুর্গত এলাকার জন্য টেস্ট রিলিফ এর ব্যবস্থা সেই অঞ্চলের অভুক্ত মানুষের জন্য বরাদ্দকৃত সাহায্য সামগ্রী নিয়ে কারচুপির অভিযোগ আসছে প্রতিনিয়ত। তাই সম্পূর্ণ মানবিক কারণে গৃহীত এই কর্মসূচিকে বানচাল না হয়ে যায় সেজন্য কর্তৃপক্ষ এবং রিলিফ বন্টনের নিয়োজিত স্থানীয় কর্মকর্তাদের প্রতি আমরা সজাগ দৃষ্টি রাখার অনুরোধ জানাচ্ছি। সরকারের একার পক্ষে এই দুরূহ কাজ সমাধা করা যেমন কঠিন, তেমনি স্থানীয় প্রশাসন ও কর্মীদের ওপর ছেড়ে দিলেও চলবে না। সুষ্ঠু ও যৌথ কার্যক্রমের উপর এই মানবিক ত্রাণ তৎপরতা সাফল্য সর্বাংশে নির্ভরশীল।

পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ

সর্বনাশা পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতার মধ্যে শান্তির আশা করাটা দুরাশা মাত্র। আণবিক ও পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ নিষিদ্ধকরণ নিয়ে অতীতে আলোচনা হয়েছে। এখনো হচ্ছে। জাতিসংঘে নিরস্ত্রীকরণ সম্পর্কিত প্রস্তাব উঠেছে। প্রস্তাব পাশও হয়েছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সাম্প্রতিক মস্কো সফরকালে ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ নিষিদ্ধ করেন সম্পর্কিত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এককথায় বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে প্রায় সকলেরই অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করার স্বপক্ষে রায় দিয়েছেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো পক্ষ থেকে এমন কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি যার ভিত্তিতে বলা চলে যে, বিশ্বের অগণিত শান্তিকামী মানুষকে আর পারমাণবিক বা আণবিক বা কোনরকম ক্ষেপনাস্ত্রের ভয়ে ভীত হতে হবে না।
ইরান ও মিশর মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র মুক্ত এলাকা হিসেবে গড়ে তোলার প্রস্তাব দিয়েছেন। সম্প্রতি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রস্তাবটি আলোচিত হতে পারে। জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়ার্ল্ড হেইম প্রস্তাবটিকে স্বাগত জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের কার্যক্রম সম্পর্কিত মহাসচিব এর বাৎসরিক রিপোর্টের ভূমিকায় তিনি বলেছেন, সব ধরনের পারমাণবিক পরীক্ষা বন্ধ করার ব্যাপারে একটি সাধারন চুক্তিতে উপনীত হওয়ার সময় এসেছে। নিরস্ত্রীকরণ কমিটির সম্মেলন এবং এ ব্যাপারে জাতিসংঘের সক্রিয় অংশগ্রহণে প্রশ্নে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।
প্রসঙ্গতঃ বলা যেতে পারে যে, জাতিসংঘের মহাসচিব রিপোর্টের ১৯ পৃষ্ঠাব্যাপী ভূমিকায় বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মধ্যে স্বাক্ষরিত বিভিন্ন চুক্তি কথা উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন যে এবছর শুধুমাত্র দক্ষিণ এশীয় উপমহাদেশেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেছে।
এটা তো দিবালোকের মতোই আজকের দিনে স্পষ্ট যে, যে-যাই বলুন না কেন সারা বিশ্বকে যুদ্ধের আতঙ্ক থেকে মুক্ত করতে অনেকে রাজি নন। বিশেষ করে সাম্রাজ্যবাদী চক্র তো ব্যাপারে আদৌ আগ্রহী নন। মুখে যা বলা হয় তার বাস্তবায়ন ঘটে না। তারই ফলশ্রুতিতে দেখা যাচ্ছে বিশ্বের কোথাও না কোথাও উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছেই। প্যারিস শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে ঠিকই তবু ভিয়েতনামে এখনো অস্ত্রের ঝংকারে বন্ধ হয়নি। কম্বোডিয়ায় রণদা মামা। মধ্যপ্রাচ্যেও একই অবস্থা। সাইপ্রাস অশান্তি। কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে নতুন করে পাকিস্তান সরকারের তৎপরতা।
ইসরাইল দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে আরম্ভ করে এশিয়ার আরো কয়েকটি দেশ তো কোন সময় নিজের হাতে তামাক খায়নি। অদৃশ্য হস্তের লীলাখেলায় পুতুলের মত নর্তন-কুর্দন করেছেন। এরা কেউ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও নিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী নয়। অথচ এটা তো ঠিক যে, যুদ্ধের উত্তেজনাকে সামনে রেখে শান্তি প্রচেষ্টা চালানো তো অবাস্তব।
পারমাণবিক অস্ত্র মুক্ত এলাকা গঠনের সিদ্ধান্ত খুবই সময়োপযোগী এতে কোন সন্দেহ নেই। এ ব্যাপারে শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য দক্ষিণ এশিয়া কেন সারা বিশ্বকে পারমাণবিক অস্ত্র মুক্ত এলাকা রূপে চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা ও প্রয়াস চালাতে হবে আর এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন জাতিসংঘ এবং বৃহৎ শক্তিবর্গ। তবে এটাও ঠিক যে শুধুমাত্র তা বুঝে সিদ্ধান্ত নিলেই চলবে না। সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করার জন্য চাই পরিপূর্ণ মানসিক প্রস্তুতি। ইচ্ছা থাকলে উপায় হয় তারই প্রমাণ হলো বাংলাদেশ। বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও জোট নিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী। বিশ্বাসী বলেই এ উপমহাদেশের সামগ্রিক স্বার্থে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দী ও ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিনাবিচারে ছেড়ে দিয়েছেন। পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসেছেন। কাজেই নিরস্ত্রীকরণ বা পারমাণবিক অস্ত্র মুক্ত এলাকা গঠন ইত্যাদি বক্তব্যকে সামনে রাখলে চলবে না-সেজন্য চাই পরিপূর্ণ সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও ঐকান্তিক আগ্রহ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!