You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.08.04 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | এ দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার জন্য— | বাণিজ্য মন্ত্রীর মধ্যপ্রাচ্য সফর | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ৪ঠা আগস্ট, রোববার, ১৮ই শ্রাবণ, ১৩৮১

এ দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠার জন্য—

এবারের বন্যা ভয়াবহ প্রলয়ংকারী; বিগত বছরগুলির ক্ষয়ক্ষতির সকল রেকর্ড এবার ছাড়িয়ে গেছে। চুয়ান্নতেও বন্যা হয়েছিল, বন্যা হয়েছিল পঞ্চান্ন, ছাপ্পান্ন, ষাট, একষট্টি, তেষট্টি, চৌষট্টি, এবং অন্যান্য সালে। কোন বার তা প্রাথমিক একটা আঘাত এনেই থেমে গেছে; কোন কোন বার তা সয়লাব করে দিয়েছে পথঘাট, নগর-বন্দর সবকিছু। চুয়ান্নর বন্যা সবার স্মরণে আছে এর ভয়াবহতা আর সে বছরের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এর জন্য। সেবার বন্যা প্লাবিত হয়েছিল এক কোটি ২৩ লাখ একর জমি আর ক্ষতি হয়েছিল ১২০ কোটি টাকার সম্পদ। মানুষের আহাজারি ছড়িয়ে পড়েছিল সারাদেশে, সে শোকধ্বনি-প্রতিধ্বনিত হয়েছিল বিদেশেও।
এবার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরো বেশি। টাকার অঙ্কে অনুমান করা হচ্ছে ৪০০ কোটি টাকার সম্পদ ইতিমধ্যে বিনষ্ট হয়েছে। মোট ১৯টি জেলার মধ্যে ষোলটিই বন্যাক্রান্ত। প্রাণহানির খবর যতটুকু পাওয়া গেছে তাতে এক চট্টগ্রাম জেলায় বন্যার মারা গেছেন ১৯২ জন। কলেরায় মৃত্যুর সংখ্যা বাদ দিয়ে সরকারিভাবেই প্রাণহানি ধরা হয়েছে ১৩৮ জন। ৫৪ সালের বন্যার ভয়াবহতা তাই চুয়াত্তরের বন্যার কাছে ম্লান হতে বসেছে।
৫৪ অথবা অন্যান্য সালের বন্যার ধকল যেভাবে এদেশের মানুষ সামলাতে পেরেছিল, ’৭৪-এর তার অবকাশ আছে বলে আমাদের মনে হয় না। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এমনিতেই ভীষণ নাজুক। আভ্যন্তরীণ সম্পদের যেমন ঘাটতি তেমনি অভাব রয়েছে বৈদেশিক সূত্র থেকে পাওয়া অর্থের। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি অতীতের সকল দৃষ্টান্তকে ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের জীবন ধারণের ক্ষমতা বন্যা পূর্বকালীন সময়ই অস্বাভাবিক রকম হ্রাস পেয়েছিল। এমতাবস্থায় বন্যার নিদারুন আঘাত আমাদের অর্থনীতিকে যে কোনো নৈরাজ্য আর শূন্যতার দিকে নিয়ে যাবে তা ভবিষ্যতেই বলতে পারে।
এ বাস্তব অবস্থাকে সামনে রেখে জাতিসংঘের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে সাহায্যের জন্য আবেদন জানিয়েছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বাংলাদেশের বন্যা পীড়িত মানুষকে বাঁচাতে জাতিসংঘের ত্রাণ এজেন্সিকেও চিঠি লেখা হয়েছে। ঢাকায় যে সকল দেশের কূটনীতিকরা অবস্থান করছেন তারা নিজেরা সরেজমিনে বন্যা পরিস্থিতি দেখে এসেছেন। আন্তর্জাতিক রেডক্রসের বাংলাদেশস্থ প্রতিনিধি মিঃ পল এডামস বন্যা দুর্গত এলাকায় ঘুরে এসে বলেছেন, ‘দুর্গত মানবতার সেবায় সাহায্য নিয়ে উন্নত দেশগুলির এগিয়ে আসা উচিত।’ তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়া এ জাতীয় দুর্যোগ মোকাবিলা করা একটা জাতীয় সরকারের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বন্যা দুর্গত মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করে বিভিন্ন দেশ সাহায্যের সম্প্রসারনের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন রাষ্ট্রসমূহ এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন বলে আমাদের বিশ্বাস। বন্যা একদিন হ্রাস পাবে, পানি নেমে যাবে, কিন্তু যে ক্ষত এই সর্বনাশা বন্যা আমাদের অর্থনীতিতে রেখে যাবে তা নিবারণের উপায় কি? এটা সত্যি কথা যে, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পেলে আমরা প্রাথমিকভাবে বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারব। কিন্তু যে, ক্ষত তারপরও রয়ে যাবে তা নিবারণের জন্য অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো শৈথিল্য প্রদর্শন করলে তার গোটা জাতিকেই একটা মারাত্মক পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আশঙ্কিত পরিণতির কথা ভেবে বন্যার এই দিনগুলোতে বর্তমান এবং ভবিষ্যতের দিকে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি রাখে অগ্রসর হওয়া উচিত।

বাণিজ্য মন্ত্রীর মধ্যপ্রাচ্য সফর

বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ তিন সপ্তাহব্যাপী মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষে গত শুক্রবার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেছেন। ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সাথে আলাপ-আলোচনা কালে তিনি তার এই সফরকে ফলপ্রসূ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি সফর করেছেন মিশর, ইরাক এবং সৌদি আরব। ইরাকের জাতীয় দিবসে তিনি বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দান করেন। এবং ইরাকের প্রেসিডেন্ট হাসান আল বকরসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেছেন। বাণিজ্যমন্ত্রী বিমানবন্দরে বলেছেন যে, ইরাক বাংলাদেশকে প্রচুর পরিমাণে অপরিশোধিত তেল দেবে ইরাকি নেতৃবৃন্দ তাকে আশ্বাস দিয়েছেন। মিসর সফরকালে তিনি মিশরের সাথে তিন বছর মেয়াদী একটি সাধারণ বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তিনি আলাপ আলোচনা করেছেন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদতের সাথে। সাদত বাংলাদেশের বর্তমান ভয়াবহ বন্যায় গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্য সফরের শেষ পর্যায়ে বাণিজ্যমন্ত্রী সৌদি আরবে যান এবং সৌদি নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনা করেছেন।
আমরা বাণিজ্যমন্ত্রীর সাম্প্রতিক মধ্যপ্রাচ্য সফর এবং তার সফলতা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে চাই। সমগ্র আরব জাহান এখন বাংলাদেশের বন্ধু। সে বন্ধুত্বের পরিমাপ আমরা করতে পেরেছি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিগত ইসলামিক শীর্ষ সম্মেলনে। সৌদি আরব ও লিবিয়া বাস্তবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান না করলেও প্রকৃতপক্ষে লাহোর সরম্মেলনে এ দুটি দেশ বাংলাদেশের উপস্থিতি কামনা করেছিল মনেপ্রাণে। এবং বিগত অক্টোবর মাসের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের বাংলাদেশের ভূমিকা আরব জনগণের মনে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে শ্রদ্ধার আসন প্রতিষ্ঠিত করেছিল তারই ফলশ্রুতিতে লাহোর সম্মেলনে বাংলাদেশের উপযুক্ত মর্যাদা লাভ। তাই স্বীকৃতি সময় ও সুযোগের ব্যাপার মাত্র। সৌদি আরব ও লিবিয়া বাংলাদেশের অন্যতম বন্ধুদেশ।
বাণিজ্যমন্ত্রী সেই সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দেশ সফর করে এলেন। আমরা জানি গত একটি বছর ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে আরব দেশগুলোর ভূমিকার কথা। তৈল অস্ত্র প্রয়োগের বৃহৎ শক্তিগুলো সহ অন্যান্য ক্ষুদ্র দেশ চরম মার খাচ্ছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং সেই তৈলাস্ত্র যাদের হাতে তারা বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার প্রতিশ্রুতিতে উভয়ের বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হবে বলে আমরা আশা করি। আরব দেশগুলোর একমাত্র উৎপাদন দ্রব্য তেল। সে তেলের বিনিময়ে তারা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি আমদানি করবে নিজেদের চাহিদা পূরণের জন্য এবং যার কাছ থেকে সহজ শর্তে এগুলো তারা লাভ করবে তার সাথেই তাদের বাণিজ্যিক লেনদেন এবং সম্প্রীতি গড়ে উঠবে। জ্বালানি তেলের প্রয়োজন আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে। আরব তৈলাস্ত্রের মার বৃহৎ শক্তিগুলোর উদ্দেশ্যে হলেও সে ঢেউ আমাদের মত ক্ষুদ্র অথচ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদনকারী দেশের উপরও এসে পড়ছে। তাই চা, পাট,পাটজাত দ্রব্য ও চামড়ার সেখানে প্রচুর সম্ভাবনাপূর্ণ বাজার রয়েছে। সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবে কিভাবে রূপ দান করা যায় বাণিজ্যমন্ত্রী আশা করি সে ব্যাপারে বিস্তারিত সম্যক ধারণা নিয়ে এসেছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময় আমরা দেখেছি মধ্যপ্রাচ্য সফর শেষে স্বদেশ প্রত্যাগত বিভিন্ন প্রতিনিধিদল বিভিন্ন সময় আমাদেরকে আশ্বস্ত করেছেন উভয় দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেনের উজ্জ্বল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে, কিন্তু যতখানি বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে আরব দেশগুলোর সাথে, বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি সেই অনুপাতে। এ বাণিজ্য সম্পর্ক উন্নয়নে আরো তৎপর হওয়া উচিত ছিল। বাণিজ্যমন্ত্রীর বর্তমান সফর আরব জাহান ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেন এর কাজ ত্বরান্বিত করবে বলেই আমাদের ধারণা। তবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে আমরা কতটুকু তৎপর হব তারই উপর।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন