বাংলার বাণী
ঢাকা : ৪ঠা মার্চ, সোমবার, ১৯৭৪, ২০শে ফাল্গুন, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত
এটা সবার পক্ষে সত্যিই খুব আনন্দের বিষয় যে, আজ থেকে সারাদেশে যে ব্যাংক ধর্মঘট হবার কথা ছিল, তা’ আর হচ্ছে না। চাকুরী ক্ষেত্রে সরকার ব্যাংক কর্মচারীদের কয়েকটি বর্ধিত সুযোগ সুবিধা দানের যে প্রশংসনীয় আশ্বাস দিয়েছেন, তারই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংক কর্মচারী ফেডারেশন গত শুক্রবার এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তার পূর্বঘোষিত ৪ঠা মার্চের ধর্মঘটকে স্থগিত ঘোষণা করেছে।
এখন থেকে ব্যাংক কর্মচারীদের সম্পূর্ণ ক্ষোভ প্রশমিত হয়েছে এবং এজন্য তারা ধর্মঘট স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাদের এ গঠনমূলক নমনীয়তা বা মনোভাব সংশ্লিষ্ট সমস্ত মহলেই অত্যন্ত অকুন্ঠভাবে প্রশংসিত হয়েছে। শিল্প ও বাণিজ্য ফেডারেশন, ঢাকা শিল্প ও বণিক সমিতি এবং চট্টগ্রাম শিল্প ও বণিক সমিতি ইতিমধ্যেই ব্যাংক ফেডারেশনের এ সিদ্ধান্তকে বিপুলভাবে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
আমরাও জানাচ্ছি আমাদের আন্তরিক মোবারকবাদ। আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস, ব্যাংক কর্মচারী ফেডারেশনের এ সিদ্ধান্ত এবং সরকারের এ সময়োচিত আশ্বাস যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক দাবী-দাওয়া আদায়ের ক্ষেত্রে গঠনমূলক নমনীয়তার এক অপূর্ব মনোভাবের নজির স্থাপন করেছেন।
এ কথা অবিশ্যি ঠিক যে, গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থায় ধর্মঘটের মাধ্যমে দাবী আদায়ের পদ্ধতি পৃথিবীর প্রায় সব সভা দেশেই আছে। তবে, যেখানে একটু ধৈর্য ধরলে ও সময় সাপেক্ষে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও আলোচনার মাধ্যমে দাবী পূরণ হয়, সেক্ষেত্রে উগ্র বা অনমিত মনোভাব নিয়ে অধৈর্যের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে অহেতুক ধর্মঘটের প্রশ্রয় নিয়ে জনশান্তি বিঘ্নিত করার কি কোনো যৌক্তিকতা আছে?
বিশেষ করে, আমাদের মতো শত শতাব্দী শোষিত ও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের এতো প্রাথমিক গঠনমূলক পর্যায়ে কথায় কথায় ধর্মঘট করার মতো অর্থনৈতিক প্রাচুর্য কি আমাদের জাতির আছে? আমাদের সমস্যা অপার, অমিত। আমাদের খাদ্যে সমস্যা, বসনে, বাসস্থানে সমস্যা, জীবনে সমস্যা, সমস্যা কোথায় নাই? মাত্র তিনটি বছর আগে পাঞ্জাবী হার্মাদেরা আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে চরম মরণাঘাত হেনে গেছে তারই ধকল আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। দেশকে প্রকৃত আদর্শ ও প্রাণ প্রচুর দেশে গঠন করে তুলতে আমাদের সামনে এখন এক সাগর সমস্যা। একদিনে এ সমস্যা কখনোই সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। এক এক করে এবং আস্তে আস্তে আমাদের সবাইকে এগুতে হবে এক এক সমস্যার অভিশাপ থেকে দেশকে বিমুক্ত করার দৃঢ়চিত্ত পথে। আর এইভাবেই আমাদের দেশ একদিন সত্যি সত্যিই সর্ব সমস্যামুক্ত হয়ে স্বস্তির বসন্ত বাতাসে উদ্বেলিত, স্পন্দিত হবেই। তবে এজন্যে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, পারস্পরিক সহযোগিতা ও স্বার্থত্যাগ এবং পারস্পরিক ধৈর্যশীল নমনীয়তা।
এজন্য দেশের প্রতিটি মানুষকেই দেশের সরকার সম্পর্কে তার সনাতন অস্পষ্ট ধারণা বদলাতে হবে। আজীবন বিদেশী শোষণের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়ে আমাদের অধিকাংশ মানুষেরই প্রায় ধারণা হয়ে আছে যে, সরকার একটি দিল-উজাড় কোম্পানী বা গৌরী সেন বৈ আর কিছু নয়। একে যতো টিপবে এ ততো রস দেবে। এর ভান্ডার অফুরন্ত। এ ইচ্ছে করলেই কোটি কোটি টাকা ছাপিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারে এবং জনসাধারণ সুখ-বিলাস জীবন যাপন করতে পারে। কিন্তু সে এমনি কৃপণ যে, তাঁতে গুতো না মারলে বা মরণাঘাত না দিলে সে কিছুতেই পয়সা বের করতে চায়না। আর, এজন্যেই দরকার হরতাল, ধর্মঘট, লুন্ঠন ইত্যাদি।
হয়তো কোনোদিন এসবের প্রয়োজন ছিল। কারণ, সেদিন দেশের মানুষ ছিল সত্যি সত্যিই বিদেশীর পরাধীন। কিন্তু আজ যে সে তার নিজেরই মুক্ত স্বাধীন দেশের নাগরিক সে কথা অনেকেই এখনো সম্যক উপলব্ধি করতে পারছেনা বলে মনে হচ্ছে। তাই অবস্থাদৃষ্টে এ কথা অনায়াসেই বলা চলে যে, আজো অনেকেই সরকার সম্পর্কে তাদের পূর্বতন ধারণা বদলাতে সক্ষম হয়নি।
কিন্তু, এটা খুবই পরিতাপের বিষয় এবং দেশের সরকার সম্পর্কে মানুষের এ ধারণা পোষণ যে, জাতির পক্ষে কতোখানি মারাত্মক সে কথা বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন পড়ে না।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সরকারের সমালোচনা সম্পূর্ণ সমর্থিত। তবে, সে সমালোচনা বা বিরোধিতা অবশ্যই গঠনমূলক হওয়া উচিত। ব্যাংক কর্মচারী ফেডারেশনের সাম্প্রতিক ধর্মঘট স্থগিতের সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে সবার জন্যেই অনুপ্রেরণার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। আর এই পথেই প্রকৃত অর্থে দেশ গঠন সম্ভব।
এটা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, ডাক ধর্মঘটের ১৮তম দিন অতিবাহিত হয়ে গেলেও আজো পর্যন্ত এর কোনো সুরাহা হলোনা। অথচ, এর মধ্যে জাতিকে প্রায় দু’কোটি টাকার মতো বৈদেশিক মুদ্রা হারাতে হয়েছে। আর আভ্যন্তরীণ অসীম জন-ভোগান্তি তো আছেই। দাবী আদায়ের ক্ষেত্রে এতো অনমিতভাব কখনোই জাতির স্বার্থানুকূল হতে পারেনা। আমাদের ডাক ধর্মঘটী ভায়েরা ব্যাংক কর্মচারীদের মহান পন্থা অবলম্বন করে নিজেদের সমস্যা সমাধানে সরকারের সহযোগিতা নিতে এই মুহূর্তে তৎপর হবেন বলে আমরা আন্তরিকভাবে কামনা করছি। সরকারও তাদের দুঃখ মোচনে সর্বতোভাবে চেষ্টা করবেন, আমরা পরিশেষে এই আশাই রাখছি।
বৃটেনে নির্বাচন : হতাশা ও অনাস্থার প্রতিফলন
নির্বাচন বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ এবং তার রক্ষণশীল দলীয় সরকারের উপর জনসাধারণের আস্থা এনে দেয়নি বরং বলে দিয়েছে সে দেশকে রাজনৈতিক সংকটের আবর্তে। প্রতিদ্বন্দ্বী বৃহত্তম দল শ্রমিক পার্টি রক্ষণশীলদের চাইতে পাঁচটি বেশী আসন পেয়েও সরকার গঠনের মতো প্রয়োজনীয় শক্তি সঞ্চয় করতে পারেনি। শ্রমিক দলীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসন বলছেন জলদি সরকার গঠিত হওয়া দরকার আর রক্ষণশীল দলীয় নেতা এডওয়ার্ড হিথ নিজ দলের সরকার গঠনের আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। বাকিংহাম প্রাসাদে রাণীর সাথে আলোচনাও হয়েছে তার। লিবারেল পার্টির নেতা জেরেমি থর্পকে তিনি আলোচনার জন্যে ডেকে পাঠিয়েছিলেন গত পরশু। আলোচনার ফল কিছু জানা না গেলেও লিবারেল পার্টিকে শরীক করে যদি রক্ষণশীল দল সরকার গঠনের উদ্যোগ নেয় তবে তাও হবে একটি সংখ্যালঘু সরকার। কারণ লিবারেল পার্টির ১৪টি আসন যুক্ত হযে ৬৩৫ আসন বিশিষ্ট হাউস অব কমন্স-এ সে সরকারের সমর্থন থাকবে ৩১০ জন সদস্যের।
অনির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত এবারের এ নির্বাচনে লিবারেল পার্টি আগের চাইতে আসন বেশী পেয়েছে মাত্র তিনটি কিন্তু গুরুত্ব বেড়েছে তার আগের চাইতে অনেক বেশী। বৃটেনে কোনো সরকার গঠনে এই পার্টি এখন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। অন্যান্য দল ও গ্রুপের আসন সংখ্যা যদি চব্বিশ থেকে কিছু কম হতো তবে লিবারেল পার্টিই হতো বৃটেনে সরকার গঠনে ভারসাম্য রক্ষাকারী শক্তি।
কিন্তু নির্বাচনের রায় এমন হলো কেন? বৃটেনবাসী নির্বাচনী রায় প্রদানে এমন বিভ্রান্তি ও সংশায়চ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল কেন? কেনই বা কম্পুটার আর পর্যবেক্ষকদের ভবিষ্যদ্বাণীর তাবে থাকেনি নির্বাচনী রায়? আসলে সাম্রাজ্যহারা এককালের প্রচন্ড শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তি আজ সার্বিক অবক্ষয়ের পথে ন্যুব্জদেহে এগিয়ে চলেছে। ধীরে ধীরে তারই কাঁধের উপর চেপে বসছে একালের সম্রাটেরা। অর্থনৈতিক সংকট আজ বৃটেনে মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করেছে। মুদ্রাস্ফীতি, ধর্মঘট, সাধারণ বাজারে সংকট। সবার উপরে আবার আরবদের তেলের মার। এক সময় যে আরব দেশসমূহে শঠতা, চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শোষণ অব্যাহত রাখতে বৃটেন ছিল সদা সক্রিয় আজ সেই আরবদেরই তৈলাস্ত্রের আঘাত সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ‘বুড়ো সম্রাটকে’। তবে কি অর্থনৈতিক সংকট উদ্ভূত অসন্তোষ বৃটেনবাসীকে হতাশা আর অনাস্থার দিকে ঠেলে দিয়েছে?
বৃটেনের নির্বাচনী রায় দৃষ্টে তেমনি মনে হয়। হিথ জনগণের আস্থা ভোট চেয়েছিলেন। তিনি তা পাননি। উইলসন চেয়েছিলেন সরকার পরিবর্তন করে শ্রমিকদলের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে। জনগণ তাতেও সাড়া দেয়নি। জনগণের রায় যেন সর্বনাশা সেই ‘না’। নেতিবাচক ভূমিকা পালন করে জনসাধারণ বৃটেনের সনাতনী রাজনৈতিক আবরণ বদলাবার প্রক্রিয়ারই বিরোধিতা করেছেন। শ্রমিক এবং রক্ষণশীলদলের শাসন তারা বহুদিন ধরেই দেখে আসছেন। দু’টো দল ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে বক্তৃতা-বিবৃতি প্রচার করলেও যে সরকারী লেবাস পরে তারা একের পাইপে অন্যের তামাক টানেন এই সত্যটা জনসাধারণের কাছে ধরা পড়েছে। আজ তাই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের মুখে বৃটেনবাসী সেই ‘আগমন-নির্গমনের’ আনুষ্ঠানিকতার প্রতি খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি।
এই অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংকটের সাগরে কোয়ালিশনের শত ছিদ্র নৌকা কতটুকু আগাতে পারবে সেদিকেই দুনিয়া জোড়া রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সাগ্রহ দৃষ্টি। ইতিমধ্যেই কোনো কোনো মহল থেকে বলা হয়েছে নতুন সরকার সে যারাই গঠন করুক না কেন তা হবে অত্যন্ত স্বল্পস্থায়ী। বৃটেনবাসীকে এ ব্ৎসরই আবার নির্বাচনে যেতে হবে।
গত বৃহস্পতিবারের থেকে রাজনৈতিক দল সমূহ বিশেষ করে বৃহত্তম দু’টি রাজনৈতিক দল কি কোনো শিক্ষা গ্রহণ করবে। বৃটেনবাসী একটা বড় রকমের পরিবর্তন এবং অত্যন্ত শক্তিশালী এবং দৃঢ় নেতৃত্বের প্রতীক্ষায় রয়েছে। সংকট মোচনে নয়া নেতৃত্ব সেই উপলব্ধি নিয়ে এগিয়ে আসুক এটাই আমরা কামনা করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক
পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন