You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ২১শে ডিসেম্বর, শনিবার, ৫ই পৌষ, ১৩৮১

বৈশিষ্ট্যপূর্ণ অধিবেশন শেষ হয়েছে

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশন শেষ হয়েছে। সমাপ্তি অধিবেশনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের নেতারা অধিবেশনের ফলাফলের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে ভাষণ দেন। বস্তুতঃপক্ষে জাতিসংঘের এই অধিবেশনটি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে চিহ্নিতকরণের দাবিদার। এই অধিবেশনে আন্তর্জাতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা, শান্তি ও নিরাপত্তা সংহতি, নিরস্ত্রীকরণ সমস্যার সমাধান, বিভিন্ন দেশের মধ্যে উত্তেজনা হ্রাস করে সহযোগিতা উন্নয়নের ব্যাপারে বেশ কিছু সংখ্যক প্রস্তাবের ভিত্তিতে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
এবারের জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনের বহু বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সর্বপ্রথম আমরা জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যভুক্তির কথাটা শ্রদ্ধা ও গর্বের সঙ্গে স্মরণ করছি। স্বাধীনতা লাভের পর এত অল্প সময়ের ব্যবধানে বিপুল ভোটে জাতিসংঘের সদস্য ভুক্তির গৌরব আমরা পেয়েছি ২৯তম অধিবেশনের প্রায় সূচনাতেই। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে ও তাই এবারের ২৯তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বিশেষভাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
অন্যান্য ক্ষেত্রে বিশ্ব নিরাপত্তার প্রশ্নে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যে ব্যাপকভিত্তিক প্রস্তাব নেয়া হয় তাতে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা জোরদার করার ঘোষণা বাস্তবায়িত করতে বলা হয়। এই প্রস্তাবের বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠা শান্তি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে তোলা এবং প্রতিটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে তাদের সমস্যাবলীর সমাধান করতে সর্বোচ্চ সুযোগ দানের কথা উল্লেখ করা হয়। এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রশ্নে উত্থাপিত প্রস্তাবে সামরিক উদ্দেশ্যে নির্মম অস্ত্র প্রতিযোগিতার অবসান তথা নিরস্ত্রীকরণ ও শান্তির স্বপক্ষে ১১৯টি দেশ ভোটদান করে। এতে করে একথাই সুস্পষ্ট হলে যে বিশ্বে আজ শান্তিকামী দেশই জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হয়েছে।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক যেন শান্তিপূর্ণ হয় সেদিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি দেশকে স্ব স্ব সার্বভৌম অধিকারের ভিত্তিতে নিজস্ব সম্পদ এর পূর্ণ ব্যবহারের সুযোগ দানের প্রস্তাবটিও মাত্র একটি বৃহৎ শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে ভোট এবং একটিমাত্র দেশের মৌনব্রতের প্রেক্ষিতে হয়ে যায়। এই প্রস্তাবটি উন্নয়নশীল দেশ ও জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত জাতিগুলোর জন্য অশেষ আশ্বাসদানকারী। কারণ বিশ্বের সকল উপনিবেশিক দেশের ক্ষেত্রে তার নিজস্ব সম্পদ ব্যবহারে চূড়ান্ত বাধার সৃষ্টি করে শোষণ নীতি চলত। ওইসব শোষণ ক্লিষ্ট দেশের অধিকাংশ দেশে আজও রক্তপিপাসু ভাইপার রুপি সাম্রাজ্যবাদ চক্রের গোপন অথচ শক্তিশালী লীলাক্রমের ষড়যন্ত্র চলে। ছলে বলে কৌশলে বা বন্ধুত্বের আবরণে মুখ ঢেকে আজও তাদের সহায়-সম্পদ ধরনের প্রচণ্ড ও প্রকাশ্য অপচেষ্টাও চলে। তাই প্রতিটি দেশের নিজস্ব সম্পদ ব্যবহারের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ও সহানুভূতির প্রত্যয়ে জাতিসংঘ অধিবেশনে ষোলআনা সমর্থন বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বের জন্য ভবিষ্যতে ব্যাপক আশীর্বাদস্বরূপ হলো। এবং রক্ষিত হল উপনিবেশবিরোধী দেশগুলোর মৌল স্বার্থ।
বেশিদিন নয় -মাত্র বছর দশেক পেছনের স্মৃতিতে আমরা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকে বৃহৎ শক্তিবর্গের একচেটিয়া মুরুব্বিয়ানায় যেভাবে নিয়ন্ত্রিত হতে দেখেছি-এবারের অধিবেশনে তার আমূল পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। এবারের অধিবেশনে বহু প্রস্তাবই শক্তিশালী দেশে এমনকি ভোট প্রদানকারী দেশের বিরোধিতা সত্ত্বেও বিপুল সংখ্যক অন্যান্য দেশের ভোটে পাস হয়ে যায়। যা দশ বছর আগে ছিল প্রায় অকল্পনীয়। জোট নিরপেক্ষ দেশ সহ ছোট ছোট দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট চাপে বলতে গেলে সাম্রাজ্যবাদী চক্রের কুলোপনা চক্কর এবার অনেকটাই নেমে গেছে। তারই প্রমাণ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ইয়াসির আরাফাতের উপস্থিতি। অস্বীকৃত রাষ্ট্রের মুক্তিসংগ্রামের লৌহ কঠিন নেতার বলিষ্ঠ ঐতিহাসিক ভাষণ সৃষ্টি করলো ইতিহাস। সেইসঙ্গে তারা জাতিসংঘের স্থায়ী পর্যবেক্ষকের ভূমিকা ও আদায় করল।
আরো বলা যায়, স্বার্থ সচেতন এশিয়া, আফ্রিকা ও আরব বিশ্বের বলিষ্ঠ বক্তব্য ও নির্ভীক আচরণকে আর চোখ রাঙিয়ে থানা করা যায়নি ২৯তম জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনটিতে। তাই সাইপ্রাসকে ভাগাভাগি করে ভোগ করার পরিকল্পনা ধাকা খেলো, সেখানে গেল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের বিশেষ শান্তি ফৌজ। দিয়াগো গার্সিয়া মত একটি দ্বীপ নিয়েও কেউ বড় একটা সুবিধা করতে পারছে না। নিন্দীত হচ্ছে পর্তুগাল সরকার। এবং এমনিভাবে শান্তিকামী মানবতাবাদি ও স্বাধীনতাকামী জাতিদের চিত্র যা আগে জাতিসংঘের আওতায় আসার ছাড়পত্রই পেত না-তা ন্যায্য দাবির শপথ নিয়ে আজ চিত্রে আসছে একের পর এক।
মধ্যপ্রাচ্য পরিস্থিতির ক্ষেত্রেও মার্কিন সরকারপুষ্ট ইসরাইলকে তার আগ্ৰাসন নীতি পরিবর্তন করতে চাপ দেয়া হচ্ছে। ইউনেস্কো থেকে ইসরাইলকে বহিষ্কারের প্রস্তাবও সেই সূত্রে এসেছে। এমনকি ১৩৮ সদস্যবিশিষ্ট পরিষদ একমত হয় যে, মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতির জন্য প্রয়োজন হলে কোনো দেরি না করে পরিবেশন পুনরায় ডাকা হবে। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকাকে তার বর্ণবৈষম্যবাদ নীতির হীনমন্যতার জন্য জাতিসংঘের সংস্থা থেকে বহিষ্কারের ব্যাপক সুপারিশ উত্থাপিত হয়। এবং সেই প্রস্তাবে অবিলম্বে বর্ণবাদী সরকার কর্তৃক আটক সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি করা সহ দক্ষিণ আফ্রিকা কর্তৃক নামিবিয়াকে জোর করে দখলে রাখার তীব্র নিন্দা করা হয়।
সর্বোপরি এবারের জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলোর বিরোধিতা উপেক্ষা করেই পরিষদে জাতিসংঘ সনদ পর্যালোচনার জন্য কমিটি নিয়োগের পক্ষে রায় গৃহীত হয়েছে। এসব দেখে আশা হয় জাতিসংঘ তার ভূমিকা পাল্টাতে বাধ্য হচ্ছে। যা ভবিষ্যতে বিশ্ব শান্তির সর্বোচ্চ সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারবে। আমাদের সেইটাই পরম লাভ। কারণ বিশ্বের অন্যান্য শান্তিকামী দেশের সঙ্গে আমরাও চাই শান্তি-যুদ্ধ নয়। সে ক্ষেত্রে জাতিসংঘের ভূমিকা ক্রমশঃ বলিষ্ঠ থেকে বলিষ্ঠতর হোক-এই প্রার্থনা!

মানব কল্যাণে বিজ্ঞান

রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনার সঠিক বিকাশ, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধনে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। বিংশ শতাব্দীতে মানব সম্পদ উন্নয়ন এর শীর্ষদেশে উপনীত হবার সহায়ক হয়েছে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের বদৌলতে আজকের দিনে মানুষ চাঁদের বুকে পদার্পণ করেছে। গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে যাচ্ছে অবলীলাক্রমে। আকাশ পাতাল এর অচেনা অদেখা বস্তু আবিষ্কারের নেশায় মেতেছে মানুষ বিজ্ঞানকে জয় করেই। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির দ্বাবিংশ বার্ষিক অধিবেশনে উদ্বোধনী ভাষণ দান প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ বিজ্ঞান সাধনায় প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে বলেছেন, এশিয়ার অগণিত মানুষের উচ্চতম জীবনের চাহিদা মেটাতে এবং উন্নত দেশগুলোর পর্যায়ে পৌঁছাতে আধুনিক বিজ্ঞান বস্তুতন্ত্রের নবতম জ্ঞান ও কৌশল আমাদের আয়ত্ত করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের ঐতিহ্যিক মূল্যবোধের পরিপুষ্টির পাশাপাশি আজ প্রয়োজন ক্ষুধা, রোগ ও বেকারত্বের অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভের জন্য আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানকে কাজে লাগানো।
একই অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি দেশের চিন্তাবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, আজ বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান লাভ করেছে এবং আমরা জানি, এর জন্মলাভে আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারা বিশেষ ভাবে প্রবাহিত হয়েছে। যে সকল সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের মাধ্যমে এই মহান ঐতিহাসিক পরিবর্তন সংঘটিত হয়েছে, আশা করা যায় বিভিন্ন শাখার সমাজবিজ্ঞানীরা এর স্বরূপ উদঘাটনে মনোনিবেশ করবেন।
বিজ্ঞান ও সামাজিক বিবর্তনের ধারা দুটিই অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আর এ কারণে আজকের দিনে সবচেয়ে প্রয়োজন কোন পটভূমিতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তা জানা। সোয়া দু’শো বছরের ব্রিটিশ ও পাকিস্তানি শাসন, শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতনের ফলে বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে সম্ভব হয়নি সমাজ-সংস্কৃতি, সভ্যতা ঐতিহ্যকে জানা। সম্ভব হয়নি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করা। যেটুকু হয়েছে তা পুঁথিগতভাবেই। কেতাবি বিদ্যা আর যাই হোক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নের কাজে লাগেনি। আমরা পিছিয়ে পড়েছি দিনের পর দিন। দারিদ্র্য রোগ, বেকারত্ব ও অজ্ঞানতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আজকের দিনে তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন একদিকে যেমন নিজস্ব ঐতিহ্যকে জানা তেমনি অপরদিকে বিজ্ঞানকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো। শস্য-শ্যামলা স্বর্ণ প্রসবিনী বাংলাদেশে আজ খাদ্য সংকট। নানাবিধ সমস্যায় বাংলার মানুষ জর্জরিত। অথচ প্রাকৃতিক সম্পদ আমাদের কম নয়। অফুরন্ত সম্পদ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। রাস্ট্রপতির ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, প্রকৃতপক্ষে ভাববাদ সার্থকভাবে বাঁচার প্রেরণা যোগায় আর বস্তুবাদ সুন্দরভাবে জীবন-যাপন আশীর্বাদে বয়ে আনে। আর এ দুয়ের সমন্বয় এর মধ্যে মানব জীবনের সার্থকতা নিহিত।
স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে বিজ্ঞান সাধনা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সঠিক মূল্যায়ন ঐতিহ্যকে পরিপূর্ণতার আলোকে উপস্থাপিত করার দায়িত্ব বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি পালন করতে পারেন। কেমন যোগ্যতার সোসাইটির আছে। আমরা আশা করব সোসাইটি এ বিষয়ে এগিয়ে আসবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!