You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজশাহীর কলেজ জীবন
তখনও পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলায় কোনাে কলেজ স্থাপিত হয়নি। উত্তর বঙ্গে উল্লেখযােগ্য কলেজ ছিল দুইটি, এক. রাজশাহী সরকারি কলেজ এবং দুই. রংপুরের কারমাইকেল কলেজ। দবিরুল ইসলাম আই.এ. ভর্তি হন স্বনামধন্য রাজশাহী সরকারি কলেজে। কলেজের কোল ঘেঁষে বয়ে চলা প্রমত্তা পদ্মা এবং তার বুকে শতশত রংবেরঙের পালতােলা নৌকার চলাচল, নদীতে সূর্যাস্ত-সূর্যোদয়, বর্ষা অথবা পূর্ণিমার রূপ দবিরুলকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে তােলে। ম্যাট্রিকের ফল মনমতাে
হওয়ায় তার মনে এক ধরনের জেদ তৈরি হয়। পণ করেন, ম্যাট্রিকে ভালাে করতে পারি নাই, ইন্টারমিডিয়েটে ভাল কিছু করে দেখাতেই হবে। তাই এসময় লেখাপড়ায় বেশ মনযােগী হয়ে ওঠেন দবিরুল। কলেজেও মেধা, মনন ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে শিক্ষক ও সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নজর কেড়ে নেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না , রাজনীতির ঘােড়ার সহিস যে একবার হয়েছে তার পক্ষে রাজনীতি ত্যাগ করা অসম্ভব। দবিরুল ইসলামের পক্ষেও রাজনীতিবিহীন জীবন’ সম্ভব ছিল না। রাজনীতি তখন নেশায় পরিণত হয়েছে, অস্থি-মজ্জায় মিশে গেছে। বলা হয় চেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, তেমনই রাজশাহী এসে ছাত্রনেতা আতাউর রহমানসহ (ন্যাপ নেতা) অন্যান্য ছাত্রনেতাদের সঙ্গে তার সহজেই পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়ে যায়। পাশাপাশি এসব ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে পরােক্ষ যােগাযােগ স্থাপিত হয় উপমহাদেশের রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র কলকাতার প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও। এক সময় তিনি আবুল হাশেম সাহেবের রাজনীতির ক্লাসে পাঠ নিতে কলকাতায় যাওয়াআসা শুরু করেন। সেখানে গিয়ে ছাত্রনেতাদের মিটিং-এও অংশ নিতেন তিনি। এভাবেই দবিরুল ইসলামের প্রবেশ ঘটে ছাত্ররাজনীতির বৃহত্তর অঙ্গনে। তবে পড়াশুনার বাইরে অত কঠোর পরিশ্রম করলেও ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বিপর্যয়ের কথা ভুলে যাননি। তাই রাজনীতির মঞ্চে একাধারে একজন সুবক্তা, স্পষ্টভাষী ও তুমুল জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখায় আর গাফিলতি করেন নি। তার সেই অটল অধ্যাবসায় বিফলে যায়নি। ১৯৪০ সালে দবিরুল ইসলাম কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে আই.এ. (এইচএসসি) পরীক্ষায় অংশ নিয়ে প্রথম বিভাগ তাে বটেই, হিন্দু-মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সম্মিলিত মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে নিজের মেধার যথাযােগ্য মর্যাদা দেন। এবার শুধু আর স্পষ্টভাষী ছাত্রনেতা হিসেবেই নয় বরং, এমন অসাধারণ ফলাফল করায় সমগ্র উত্তরবঙ্গে মেধাবী দবিরুল ইসলামের সুনাম আরও ছড়িয়ে পড়ে। ঐসময়ে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। অনুষ্ঠিত হতাে।
৩৩
কিন্তু এসময় দবিরুল ইসলামের জীবনে ঘটে যায় এক বিপর্যয়। আই.এ. পড়ার সময়ই হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং আবুল হাশেমের সঙ্গে যােগাযােগ হওয়ায় উনাদের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করার জন্য দবিরুল ইসলাম বামুনিয়ায় ফিরে আব্দার ধরলেন, ‘এবার কলকাতা যাবাে পড়াশুনা করতে। তিনি ভেবেছিলেন এত ভাল ফল করায় এবার হয়তাে কেউ না বলবে না। কিন্তু এবারও বাড়ি থেকে অনুমতি মিলল না। বরং পারিবারিক সিদ্ধান্তে রাজশাহী সরকারি কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলে দবিরুল ইসলামের মন ভেঙে গেল। তারপরও কি আর করা! উপায় নেই! পড়াশােনা চালিয়ে যেতে হবে দেখে তিনি রাজশাহী চলে গেলেন। কিন্তু মন টিকছিল না। তাই একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে কলকাতায় চলে গেলেন। ওদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা তখন বেজে গেছে কলকাতায়ও। একদিকে ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন, অন্যদিকে বিশ্বযুদ্ধ , বিপর্যস্ত সেই শহরে পৌঁছে দবিরুল ইসলাম সােজা চলে গেলেন বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর দোরগােড়ায়। গিয়ে বলেন, স্যার, আমার লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে। আমি আর লেখাপড়া করব না। এখন থেকে কলকাতায় থাকব আর রাজনীতি করব। এখানে খেয়েপরে থাকার জন্য আমাকে একটা চাকরি দেন। এ কথা শুনে। সােহরাওয়ার্দী সাহেব মালদায় ফুড ইন্সপেক্টরের চাকরি দিলেন দবিরুল ইসলামকে। সেখানে তার জন্য একটা বাসাও ঠিক করে দেওয়া হলাে। ফুড ইন্সপেক্টর হিসেবে দবিরুল ইসলামকে যেতে হতাে মফস্বলে, বাহন ছিল ঘােড়া। একদিন মফস্বলে যাওয়ার পথে ঘােড়ার পিঠ থেকে পড়ে তিনি মাথায় মারাত্মক চোট পান। একে তাে ইচ্ছেমাফিক পড়াশুনা করতে পারছেন না, তার উপরে বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে এমন এক দুর্ঘটনায় পড়লেন। এসব দুর্যোগ তার মনকে একেবারে বিধ্বস্ত করে দিলাে। বলা যায় মানসিক ভারসাম্য প্রায় হারিয়ে ফেললেন দবিরুল ইসলাম। খবর পেয়ে বামুনিয়া থেকে লােক গিয়ে যখন তাকে বাড়িতে নিয়ে আসে তখন তিনি শারীরিক-মানসিকভাবে খুবই অসুস্থ। ওদিকে দবিরুল ইসলামের মতােন একজন মেধাবী ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মীর অমন অসুস্থতার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে বেশি সময় লাগল না। খবর চলে গেল সুদূর বিহারের ইসলামপুরে চাকুরিরত দবিরুল ইসলামের ঘনিষ্ট বন্ধু মশিরউদ্দীন আহম্মদ (মােক্তার)-এর কাছেও। মালদায় থাকতে উনার সঙ্গেই দবিরুল ইসলামের যােগাযােগ ছিল সবচেয়ে বেশি। তিনিও অবিভক্ত বাংলায় মুসলিম লীগের ছাত্রনেতা ছিলেন। যাই হােক খবর পেয়ে কালবিলম্ব না করে বাড়ি ফিরে এলেন মশিরউদ্দীন আহম্মদ। বামুনিয়ায় গিয়ে দবিরুল ইসলামের পিতা ও বড়াে ভাইয়ের কাছে আবেদন জানালেন, আপনারা যদি কিছু মনে না করেন, যদি আমাকে দায়িত্ব দেন, চিকিৎসার জন্য ওকে আমার ওখানে নিয়ে যেতে চাইছি। তখন পিতা মৌলভী তমিজউদ্দীন আহমদ অনুমতি দিলে দবিরুল ইসলামকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় নেপালে। সেখানে এক কবিরাজ তার চিকিৎসা করেন। ছয় মাস সেই অস্বাভাবিক অবস্থায় কাটে দবিরুল ইসলামের। পরে কিছুটা সুস্থ হলে নেপাল থেকে দুই বন্ধুতে মিলে যান আজমির শরিফ,
৩৪
খাজা মইনুদ্দিন চিশতী (র.)-এর দরগা জিয়ারত করতে। ওখান থেকে আসার পর দবিরুল ইসলাম শারীরিক ও মানসিকভাবে অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠলে মশিউদ্দীন। আহম্মদ বন্ধুকে বাড়ি ফিরিয়ে আনেন। বন্ধুর জন্য বন্ধুর এমন আন্তরিকতা ও আত্মত্যাগ দবিরুল ইসলামের পরিবারের সকলকে নাড়িয়ে দেয়। মৌলভী তমিজউদ্দীন আহমদ খুব সন্তুষ্ট হন মশিরউদ্দীন আহম্মদের ওপর। এজন্য পরবর্তীতে নিজের ছােটো মেয়ে সুফিয়া খাতুনকে বিয়ে দেন মশিউদ্দীন আহম্মদের সঙ্গে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসার বছরই দবিরুল ইসলাম বি.এ. ক্লাসে ভর্তি হন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অস্থায়ী ভিত্তিতে সরিয়ে আনা কলকাতার বিখ্যাত রিপন কলেজের দিনাজপুর শাখায় [৪]। সেইসঙ্গে সব বাধা কাটিয়ে উঠে তিনি রাজনীতিতেও মনােনিবেশ করেন। বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম ছাত্রলীগের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে পড়েন। সুবক্তা ছাত্রনেতা হিসেবেও তার যথেষ্ঠ খ্যাতি ছড়ায়। এই বিষয়ে এম আর আখতার মুকুল, রূপালী বাতাস বইয়ের ৫৭ নম্বর পৃষ্ঠায় এবং শতাব্দীর কান্নাহাসি’ গ্রন্থের ৮৩ নম্বর পৃষ্ঠায় স্মৃতিচারণে বলেছেন,
“দিনাজপুর কলেজে পড়ার সময়ই দবিরুল ইসলাম নামে বি.এ. ক্লাসের একজন ছাত্রের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হলাে। সত্যি কথা বলতে কি, কলেজের একটা মিটিংএ ভদ্রলােকের অনলবর্ষী বক্তৃতা শুনে আমরা মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এর হাতেই রাজনীতিতে আমাদের দু’ভাইয়ের প্রথম হাতেখড়ি হলাে। আমরাও বড় ভাইয়ের মতাে তাকে শ্রদ্ধা করতাম। তার হাত ধরেই পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়লাম।”
৩৫
তেভাগা আন্দোলনপরবর্তী দিনাজপুরের সংগঠন।
১৯৪৬ সালে পূর্ববঙ্গের দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও-এ শুরু হয় ভূমিহীন কৃষক ও বর্গাচাষীদের তেভাগা আন্দোলন ।[ ৫] তবে জমিদারদের লাঠিয়াল বাহিনী, ব্রিটিশ পুলিশের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ, ধরপাকড় এবং মামলা-মােকদ্দমার ফাদে পড়ে এই আন্দোলনের যবনিকা এক বছরের মধ্যেই নেমে যায়। আন্দোলন শেষের পরপরই দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁওয়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণির শিক্ষিত তরুণেরা স্থানীয় মুসলিম দরিদ্র কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে মাঠে নামেন।
“১৯৪৭ সালে তেভাগা আন্দোলন যখন স্তিমিত হয়ে এলাে, তখন আমরা ‘মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড সংগঠনের মনস্থ করলাম। কেননা, মুসলমান গ্রামবাসীদের এভাবে বিপদগামী হতে দেওয়া আর বরদাস্ত করা যায় না। … মরহুম দবিরুল ইসলামের উৎসাহে আমরা দিনাজপুরে মুসলমান জোতদারদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করে ন্যাশনাল গার্ড সংগঠনের জন্য দিনাজপুরের গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়লাম।” [৬]
এই কাজের পাশাপাশি পাকিস্তান আন্দোলন এবং মুসলিম লীগ সংগঠনের কাজও চলতে থাকে।
“মরহুম দবিরুল ইসলাম আর জনাব রহিমউদ্দীন উকিল সাহেবের উৎসাহে আমরা সবাই মুসলিম লীগ সংগঠনে মেতে উঠলাম। দিনাজপুরের রুহিয়া থেকে শুরু করে হিলি পর্যন্ত সর্বত্রই আমরা মুসলিম লীগ আর পাকিস্তানের বাণী বয়ে বেড়ালাম। শেষ পর্যন্ত সাধারণ নির্বাচনে দিনাজপুর জেলার
প্রতিটি মুসলমান আসনেই লীগ প্রার্থী জয়লাভ করলাে।” [৭]
তবে দুঃখজনক হলাে, ব্রিটিশরাজের কবল থেকে স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য পূর্ববাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলমান তরুণেরা আন্দোলন করেছিলেন যে স্বপ্ন নিয়ে তা ‘পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মলাভের পর একে একে ভেঙে যেতে থাকে। এজন্য দেখা যায়। পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য ন্যাশনাল গার্ডের নেতাকর্মীরা যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন তার অবমূল্যায়ন করে পাকিস্তানের গর্ভনর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দীন এই সংগঠন ভেঙে দেওয়ার নির্দেশ জারি করেন।
“খাজা নাজিমুদ্দীন সাহেব মুসলিম লীগ ন্যাশনাল গার্ড ভেঙে দিতে হুকুম দিলেন। জহিরুদ্দিন, মির্জা গােলাম হাফিজ এবং আরও কয়েকজন আপত্তি করল। কারণ, পাকিস্তানের জন্য এবং পাকিস্তান হওয়ার পরে এই
৩৬
প্রতিষ্ঠান রীতিমত কাজ করে গিয়েছে। রেলগাড়িতে কর্মচারীর অভাব, আইনশৃঙ্খলা ও সকল বিষয়েই এই প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে। হাজার হাজার ন্যাশনাল গার্ড ছিল। এদের দেশের কাজে না লাগিয়ে ভেঙে দেওয়ার হুকুমে কর্মীদের মধ্যে একটা ভীষণ বিদ্বেষ ভাব দেখা গেল। ন্যাশনাল গার্ডের নেতারা সম্মেলন করে ঠিক করলেন তারা প্রতিষ্ঠান চালাবেন। জহিরুদ্দিনকে সালারে-সুবা করা হল। জহিরুদ্দিন ঢাকায় আসার কিছুদিন
পরেই তাকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হল মােগলটুলী অফিস থেকে । মােগলটুলীতেই ন্যাশনাল গার্ডের অফিস করা হয়েছিল। তিনতলা বাড়ি,
অনেক জায়গা ছিল। দেড় মাস কি দুই মাস পরে জহিরুদ্দিন মুক্তি পেল।
অনেক নেতা ভয় পেয়ে গেল। মিস্টার মােহাজের, যিনি বাংলার ন্যাশনাল | গার্ডের সালারে-সুবা ছিলেন তাকে নাজিমুদ্দীন সাহেব কি বললেন, জানি না । তিনি খবরের কাগজে ঘােষণা করলেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে, ন্যাশনাল গার্ডের আর দরকার নাই। এই রকম একটা সুপ্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় সরকার দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার না করে দেশেরই ক্ষতি করলেন। এই সংগঠনের কর্মীরা যথেস্ট ত্যাগ স্বীকার করেছেন, অনেক নেতার চেয়েও বেশি। অনেকে আমাদের বললেন, এদের দিয়ে যে কাজ করাব, টাকা পাব কোথায়? এরা টাকা চায় নাই। সামান্য খরচ পেয়েই বৎসরের পর বৎসর কাজ করতে পারত। আস্তে আস্তে এদের আনসার বাহিনীতে নিয়ােগও করতে পারতেন। এদের অনেক দিন পর্যন্ত ট্রেনিংও দেওয়া হয়েছিল। আমাদের এই সমস্ত নেতাদের লীলাখেলা বুঝতে কষ্ট হয়েছিল। ন্যাশনাল গার্ডদের বেতনও দেওয়া হত না। ন্যাশনাল গার্ড ও মুসলিম লীগ কর্মীদের মধ্যে যে প্রেরণা ছিল পাকিস্তানকে গড়বার জন্য তা ব্যবহার করতে নেতারা পারলেন না। জনগণ ও সরকারি কর্মচারীরা রাতদিন পরিশ্রম করত। অনেক জায়গায় দেখেছি একজন কর্মচারী একটা অফিস চালাচ্ছে। একজন জমাদার ও একজন সিপাহি সমস্ত থানায় লীগ কর্মীদের সাহায্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করছে। জনসাধারণ রেলগাড়িতে যাবে টিকিট নাই, টাকা জমা দিয়ে গাড়িতে উঠেছে। ম্যাজিকের মত দুর্নীতি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। আস্তে আস্তে সকল কিছুতেই ভাটি লাগল, শুধু সরকারের নীতির জন্য।” ৮ি)
যাই হােক, ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে জয়ী করে আনার জন্য অন্যান্য মুসলিম ছাত্রনেতা-কর্মীদেরকে সঙ্গে নিয়ে দবিরুল ইসলাম, লেখাপড়া এক প্রকার বাদ দিয়েই, উত্তরবঙ্গের গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েন। এ সময় হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী দিনাজপুর সফরে এলে বিরলে মুসলিম লীগের নির্বাচনী জনসভার আয়ােজন করা হয়। সেখানে ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলামের অনলবর্ষী। বক্তৃতা উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এতে হিতে বিপরীত ঘটনাও ঘটে, পিতা মৌলভী তমিজউদ্দীন আহমদ লােকমুখে জেনে যান দবিরুল পড়ালেখা বাদ দিয়ে
৩৭
দিনরাত রাজনীতির পেছনে ছুটছে। সে আর এবার বি.এ. পাশ করতে পারবে না! আর যায় কোথায়! পিতা রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে তৎক্ষণাৎ গাড়ােয়ান ডেকে হুকুম দেন। গাড়ি সাজানাের; তিনি দিনাজপুর যাবেন, দবিরুলের ওসব রাজনৈতিক কাজকারবার বন্ধ করে তবেই বাড়ি ফিরবেন! অবশ্য পিতার এমন দুশ্চিন্তা যে অহেতুক নয়, তা ঠাকুরগাঁওয়ের ইতিহাস সংক্রান্ত গ্রন্থ ‘ঠাকুরগাঁও পরিক্রমা: ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ থেকেই স্পষ্ট হয়,
“পাকিস্তান আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাবিরােধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় লেখাপড়ায় বিঘ্ন ঘটে মুহম্মদ দবিরুল ইসলামের। পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানামলেও বিভিন্ন আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় সরকারের রােষানলে পড়েন তিনি।” [৯]
সেই সময়ে কাচা, এবড়াে-খেবড়াে রাস্তাঘাট পার হয়ে বামুনিয়া থেকে দিনাজপুর শহরে পৌছাতে একদিন-একরাত অর্থাৎ ২৪ ঘণ্টা লেগে যেত। পিতা মৌলভী তমিজউদ্দীন আহমদ ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় দিনাজপুর শহরের বালুয়াডাঙ্গায় পুত্রের আস্তানায় পৌঁছে দেখেন এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! শহরের অদুরের বিরল থানাবাসী কয়েকজন বয়স্ক লােক ছাত্রনেতা দবিরুল ইসলামের জন্য অপেক্ষা করছেন এক বিশেষ কাজে তাকে নিজেদের এলাকায় নিয়ে যাবেন বলে। পুত্রের পড়ালেখার বিহিত করার জন্য এতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসে এসব দেখে তিনি আরও থমথমে হয়ে যান। ওদিকে ছেলেও পিতার এমন হঠাৎ উপস্থিতি যে স্বাভাবিক নয়, কিছু একটা ঘটেছে, তা বুঝে যান। তবে খুব শান্ত অথচ তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে পিতাকে তখনকার মতাে নিরস্ত করে মুখে শুধু বললেন, ‘বাজান, উনারা অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছেন। আপনি হাতমুখ ধুয়ে বিশ্রাম নিন। আমি আসছি। পরে আপনার সঙ্গে কথা হবে। এই বলে তক্ষুণি পিতার খাওয়াদাওয়া-বিশ্রামের বন্দোবস্ত করে দবিরুল ইসলাম বিরলের পথে রওনা হন। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামল। একে তাে মৌলভী তমিজউদ্দীন আহমদের শরীর ছিল পথ যাত্রায় ক্লান্ত, তার উপরে পুত্রের জন্য একাকী অপেক্ষায় থাকতে থাকতে খাওয়াদাওয়া সারার পর কখন যে বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন, টেরও পেলেন না। দবিরুল ইসলাম ফিরলেন রাত তখন প্রায় ২টা। পরদিন সকালে মুখােমুখি হলেন পিতাপুত্র। যে পিতা এসেছিলেন পুত্রের সঙ্গে বিহিত করবেন ভেবে, কার্যত হলাে উল্টো! অত্যন্ত তীক্ষ্ম বুদ্ধির দবিরুল রাগান্বিতভাবে পিতার হঠাৎ আগমনের কারণ বুঝতে পেরে নিজেই পাগলা হাতির মাহুত সেজে পিতাকে বশ করে ফেললেন। তার হাত ধরে বললেন, বাজান, আপনি চিন্তা করবেন না। ইন শা আল্লাহ, আমি ভালভাবেই পাশ করব। কারণ দবিরুল ইসলাম ততদিনে জেনে গেছেন, নেতা হতে গেলে পড়াশুনার বিকল্প নেই। একটি রাজনৈতিক সংগঠনের কর্মীকে নিজের দেশ এবং বিশ্বের ইতিহাস, সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি যেমন জানতে ও বুঝতে হয় তেমনিভাবে বাজার ব্যবস্থা ও বিজ্ঞানের নানাদিক সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখতে হয়। তাহলেই সেই কর্মী নিজসংগঠনের পাশাপাশি ভবিষ্যতের সমাজ তথা দেশকে
৩৮
নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যথাযথভাবে প্রস্তুত হয়ে ওঠেন। পুত্রের থেকে সন্তোষজনক ফলাফলের প্রতিশ্রুতি পেয়ে পিতা তখনকার মতাে বাড়ি ফিরলেন। পিতাকে দেওয়া কথা রাখতেই পরীক্ষার মাত্র এক মাস আগে দবিরুল ইসলাম ঘরের দরজা বন্ধ করে পড়ালেখা শুরু করেন। সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে বি.এ. পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৬-১৯৪৭ শিক্ষাবর্ষের অধীনে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তার রােল নম্বর ছিল ১৮৫। তিনি সাবেক ইকবাল হল [১০] (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল)-এর আবাসিক ছাত্র [১১]ছিলেন। একই শিক্ষাবর্ষের অধীনে এই বিভাগে এবং হলে তিনি সহপাঠী হিসেবে পান ১৬৬ নম্বর রােলের অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। সেই থেকে এই দু’জনের বন্ধুত্ব এবং রাজনৈতিক মাঠে পথচলার শুরু। দবিরুল ইসলামের মৃত্যুর পরও তাদের এই বন্ধুত্ব বঙ্গবন্ধু অটুট রেখেছিলেন আজীবন।
৩৯

Reference: দবিরুল ইসলাম বিস্মৃত জননেতার আলেখ্য – মনোয়ারা বেগম, রুমানা শারমীন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!