You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ১১ই আগস্ট, রোববার, ২৫শে শ্রাবণ, ১৩৮১

শহরের বন্যা পরিস্থিতি

ঢাকার বন্যা পরিস্থিতি ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ইতিমধ্যেই বন্যার পানি ঢাকা শহর ঘিরে ফেলেছে। ঢাকার সঙ্গে দেশের সকল জেলার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। রাস্তা পথ বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। শহরতলী এলাকায় বন্যা প্লাবিত হয়ে বহু জীবন ও সম্পদ বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক মানুষ মারা গেছে এবং প্রায় তিন লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঢাকায় এখনো পানি বাড়ছে ফলে বিপদের সম্ভাবনা আরও প্রকট হয়ে উঠছে। সর্বশেষ খবরে জানা গেছে–বুড়িগঙ্গার পানি বর্তমানে বিপদসীমার ১ ফুট ২ ইঞ্চি উপরে রয়েছে। এর ফলে পুরান ঢাকা রক্ষাকারী অন্যতম বাকল্যান্ড বাঁধ উপচে পড়ে পুরান ঢাকায় অলিগলিতে পানি প্রবেশ করছে। ঢাকা মিরপুর সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। শহরের মধ্যখানে পানি প্রবেশ করায় চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে।
মতিঝিল এলাকার সর্বত্রই প্রায় বন্যার পানি ঢুকেছে। শহরের বিভিন্ন এলাকায় বন্যার পানি পড়ার দরুন এ পর্যন্ত ৬৩টি ত্রাণ শিবির স্থাপন করা হয়েছে। কাজী আলাউদ্দিন রোড, বংশাল, নাজিরাবাজার, নারিন্দা প্রভৃতি এলাকায় সড়কের পানি আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ঢাকা-মিরপুর সড়কের উপর দিয়ে যেভাবে নৌকা চলাচল শুরু হয়েছে, পানি এভাবে বাড়তে থাকলে ঠিক এমনিভাবে নৌকা চলাচল শুরু হবে খিলগাঁও, বাসাবো, মাদারটেক, মুগদাপাড়া, গুলশান, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সড়ক ও আরামবাগ প্রভৃতি এলাকায়ও। এরই মধ্যে ফকিরাপুল ডুবে যাওয়ায় নৌকা চলাচল শুরু হয়েছে। শহরের বিভিন্ন স্থানে বন্যাকবলিত হওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ত্রাণ শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রতিদিন নতুন নতুন শিবিরের আবশ্যকতা দেখা দিচ্ছে। ত্রাণকার্য শুরু হয়েছে তবে তা মোটেই চাহিদা উপযোগী নয়। শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে এ পর্যন্ত যে সকল সংবাদ এসেছে তাতে করে শিবিরগুলোতে অসুখ-বিসুখ শুরু হয়েছে, ত্রাণ সামগ্রীর অপ্রতুলতার দরুন শিবিরের মানুষদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
ত্রাণশিবিরে এ পর্যন্ত ৩৫ হাজার ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এই আশ্রয়প্রাপ্ত মানুষের অনেকেই আজ বিভিন্ন অসুখে আক্রান্ত হয়েছে। চিকিৎসার কোন সুব্যবস্থা এখনো করা হয়নি। ত্রাণশিবির গুলোকে অস্বাস্থ্য পরিবেশের মধ্যে রাখা হয়েছে এবং অপরিচ্ছন্নতার কারণ জড়িত কিছু রোগও ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাব প্রকট হয়ে উঠেছে বলে সংবাদ প্রকাশ। এছাড়া ক্যাম্পগুলোর জন্য প্রয়োজনে আলোর ব্যবস্থাও এখনো করা হয়নি। যদিও পৌর কর্তৃপক্ষ কিছু ল্যাট্রিন ও খাবার পানির ব্যবস্থা করেছেন তবুও চাহিদার তুলনায় তা নিতান্তই কম। ক্যাম্পগুলোর আশেপাশের পুলিশ নিয়োগ করার প্রয়োজন রয়েছে। কারণ বিভিন্ন ক্যাম্পে দুষ্কৃতিকারীদের অনুপ্রবেশ ও অন্যান্য তৎপরতা বন্ধ করার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বস্তুতঃ দেশের সকল অঞ্চলের মারাত্মক বন্যা পরিস্থিতির ন্যায়ই শেষ পর্যন্ত ঢাকার বন্যাও ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। দেশের রাজধানী শহরের বন্যা ও শেষ অবধি শহুরে মানুষের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নানা কারণে ঢাকার বন্যা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার। বিশেষ করে–দেশের গোটা বন্যা পরিস্থিতির মোকাবেলা করার প্রধান কেন্দ্রস্থল হল ঢাকা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিভিন্ন যোগ স্থাপনের জন্য এই কেন্দ্রে স্বাভাবিক জীবন ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু বন্যার করালগ্রাস ঢাকাকেও রেহাই দেয়নি। লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশকিছু মানুষ মারা গেছে, দুঃখ কষ্ট আরো বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমনই মুহূর্তে পৌর কর্তৃপক্ষ ও অন্যান্য সরকারি বেসরকারি সংস্থা ছাড়াও সাধারণ জনসেবীদেরকেও এগিয়ে আসা দরকার শহরের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিভিন্নভাবে সাহায্য করার জন্য। রোগ মহামারী যাতে করে প্রকট আকার ধারণ না করে তার ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। পর্যাপ্ত ত্রাণসামগ্রী দিয়ে এবং প্রাণকেন্দ্র গুলোকে পরিচ্ছন্ন রাখার কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করে অবিলম্বে রিলিফ কাজ জোরদার করা আবশ্যক বলে আমরা মনে করি।

মানবাধিকার বিরোধী দক্ষিণ আফ্রিকা

দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ জনতার উপর সে দেশের বর্ণবাদী সরকারের নির্যাতন ঠিক আগের মতোই সমানে চলেছে এবং বলতে হবে সে নির্যাতনের ধারা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। জীল চার্লসন নামে একজন দক্ষিণ আফ্রিকান আইনজীবিকে সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, যিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে সেখানে আইন ব্যবসা চালিয়ে এসেছেন এবং মানুষের উপর মানুষের অকথ্য ও সীমাহীন নির্যাতনের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছেন। তানজানিয়ার রাজধানীর দারুসসালামে গত ৮ই আগস্ট জাতিসংঘের মানবাধিকার সম্পর্কিত তদন্ত কমিশনের সামনে জীল চার্লসন দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের মানবতা বিরোধী কার্যকলাপের চিত্র তুলে ধরেন। এই কমিশনটি দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের মানবতা বিরোধী কার্যকলাপের তথ্য উদঘাটন করছেন, বহিস্কৃত আইনজীবী বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার বর্তমানে কৃষ্ণাঙ্গ বন্দীদেরকে শ্বেতাঙ্গ খামার মালিকদের কাছে দাস হিসেবে বিক্রি করছে। এই সমস্ত বন্দীদের মধ্যে শিশুরা রয়েছে এবং এরা স্বাস্থ্যগত কারণে চিকিৎসা লাভের অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকছে। জীল চার্লসন বলেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকার বসবাসরত কৃষ্ণাঙ্গ নারী পুরুষ ও শিশুদেরকে প্রকাশ্য জনসমক্ষে পিটানো হয়ে থাকে এবং এভাবে নির্যাতন চালাতে বর্ণবাদী সরকার কোন প্রকার দ্বিধা করে না।
বহিস্কৃত আইনজীবী জীল চার্লসন অবশেষে কমিশনের সামনে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা সবিশেষ প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারকে যদি তার মানবতা বিরোধী কার্যকলাপ থেকে নিরস্ত্র করাতে হয় তার একমাত্র পথ সমগ্র বিশ্ববাসীর তরফ থেকে এই দেশটিকে একঘরে করে রাখতে হবে এবং এক ঘরে হবার ভীতিই রয়েছে এদেশের সরকারের সমধিক। জীল চার্লসনের সাম্প্রতিক বিবৃতি ছাড়াও বহু তথ্য আমাদের হাতে রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় রাজনৈতিক বন্দীদের সংখ্যা বর্তমানে দশ হাজার অতিক্রম করে গেছে এবং বলার অপেক্ষা রাখে না যে, তাদের সবাই হলো কৃষ্ণকায়। ১৯৭৩ সালে এই বর্ণবাদী সরকার একশত পঞ্চাশ জন দক্ষিণ আফ্রিকান এর গলায় ফাঁসির রজ্জু পড়িয়েছে। ১৯৭২ সালে কারাগারে অন্তরীণ থাকা অবস্থায় ২৬৫ জন দক্ষিণ আফ্রিকান এর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। সরকারের তরফ থেকে সাধারণ মৃত্যুর কথা ঘোষণা করা হলেও দৈহিক নির্যাতন যে তাদের মৃত্যুর কারণ তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দক্ষিণ আফ্রিকার খনি শ্রমিকদের মধ্যে শ্বেতাঙ্গ শ্রমিকদেরকে কৃষ্ণাঙ্গদের অপেক্ষা দ্বিগুণ মজুরি দেওয়া হয় এবং এই রীতি চলে আসছে ১৯৪৪ সাল হতে।
এই হল দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ নির্যাতনের ইতিবৃত্ত। এই মুহূর্তে আমরা বলতে পারছিনা পৃথিবীতে ঠিক কোন সময় থেকে দাস প্রথা চালু হয়েছে। তবে দীর্ঘকাল থেকে এই মানবতাবিরোধী প্রথা চলে আসছে। এই নিন্দিত ও জঘন্য রীতি বন্ধ করার জন্য সুদীর্ঘকাল হতে জনমতও হচ্ছে এবং বিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে আমরা দেখছি এমন একটি অঞ্চলে আজও মানুষের সাথে পশুর সমতুল্য ব্যবহার করা হচ্ছে। বহিস্কৃত দক্ষিণ আফ্রিকান আইনজীবী ঠিকই বলেছেন। কিন্তু মানবাধিকারবিরোধী দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারকে সকল দিক থেকে একঘরে করে রাখার প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত সফল হয়নি এবং সফল হয়নি তাদের জন্য, যারা মানবাধিকার রক্ষার বুলি যত্রতত্র আউড়িয়ে চলেছেন। দারুস-সালামে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন বর্তমানে দক্ষিণ আফ্রিকায় মানবতা বিরোধী কার্যকলাপের যে তথ্য সংগ্রহ করছেন, আগামী মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্মেলন তা পেশ করা হবে। আফ্রিকায় বর্তমানে স্বাধীনতার হাওয়া বইছে এবং সে হাওয়ায় আজ গিনি-বিসাউ, মোজাম্বিক ও অ্যাঙ্গোলা উপনিবেশ মুক্তির পথে। শুধুমাত্র রোডেশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় ওই দেশের ঐ কালো মানুষ গুলো আজও পশুর মতো জীবনযাপন করছেন। আমরা মনে করি, আগামী মাসে জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্মেলনের মানবতাবিরোধী এই জঘন্য প্রথা রহিতকল্পে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং বিশ্ব বিবেক এই মহান কাজে উদ্বুদ্ধ হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!