You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা: ৫ই জুন, মঙ্গলবার, ২১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১

জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন

জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশন শুরু হয়েছে গতকাল। দেশের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে এই বাজেট অধিবেশনের গুরুত্ব নতুন করে আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। দুঃসহ একটা বোঝা বয়ে ধুঁকছে সাধারণ। মানুষ ইতিমধ্যেই খাদ্যদ্রব্য সহ অন্যান্য জিনিসের দাম তাদের আয়ত্বের বাইরে চলে গেছে। পাশাপাশি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে এক শ্রেণীর লোক। অবস্থার এই পার ওপার বৈপরীত্য স্বাভাবিকভাবেই একটা পরিবর্তনে প্রয়োজনীয়তাকে আগের চাইতে অনেক অনেক বেশি জরুরী করে তুলেছে। সাধারণ মানুষ এসব কিছুর পটভূমিকায় একবারে বাজেট অধিবেশনের দিকে তাকিয়ে আছে আশা আর হতাশার দোদুল্যচিত্ততায়।
শুরুতে অবশ্য কিছু আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম সমাপ্ত করা হবে। নেয়া হবে শোকপ্রস্তাব, নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা গ্রহণ করবেন শপথ। এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে সংসদে পেশ করা হবে বাজেট। আগামী বছরের সম্ভাব্য আয় ব্যয় উন্নয়ন-অগ্রগতির একটা ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে। ’৭৪-৭৫ সালে দেশ কোন দিকে আগাবে, জনসাধারণের কোন অংশকে সরকারি কোষাগারে কতটুকু অর্থ তুলে দিতে হবে, সরকারি খরচ যা জনগণের আয়ের উৎস সেই খরচই বা কতটুকু করা হবে, খরচে কত অংশ কোন শ্রেণীর লোকের হাতে জমা হবে সে সম্বন্ধে একটা পরিস্কার ধারনা আশা করা যায় বাজেটে।
এবার বাজেটের চরিত্র কি হবে? সকলেরই সংশয়াকুল প্রশ্ন। আরো কত বোঝা এসে পড়বে ধুকে ধুকে বেঁচে থাকা নির্ধারিত আয়ের সরকারি বেসরকারি কর্মচারী শ্রমজীবী মানুষ আর গ্রামীণ কৃষক সম্প্রদায়ের কাঁধে? না ফুলে-ফেঁপে ওঠা মানুষদের পকেট থেকে কিছু রোজগারের ব্যবস্থা করবেন সরকার। ইতিমধ্যে খবরের কাগজ গুলোতে যে সকল রিপোর্ট বেরিয়েছে তাতে কিন্তু সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ এর উপর কর আরোপ, চা এর উপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি এমনই নানা পরিকল্পনা কথা শোনা যাচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম নাকি আর এক দফা বাড়তে পারে। রেশনের চালের মূল্য বৃদ্ধি এমনিতেই বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। সরকার অবশ্য কিছু সংখ্যক লোকের জন্য ভর্তুকি দেবেন কিনা আর দিলেও তা কত ভাগ তা অবশ্যই বিতর্ক সাপেক্ষ কিন্তু নির্ধারিত লোকদের অবশ্যই দেখতে হবে। তাদের চলার সঙ্গিত করে দেয়ার দায়িত্ব সরকারেরই এড়িয়ে যেতে পারেন না। এরপরেও যদি পরোক্ষ নানা করের বোঝা তাদের বইতে হয় তবে তা অধিকতর দুঃসহ অবস্থা সৃষ্টি করবে এবং তার পরিণতি অবশ্য শুভ হবার নয়।
এছাড়াও রয়েছে বাজার নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন। সরকারের নির্ধারিত মূল্যে ক্রেতাসাধারণের পকেট থেকে দিতে হবে এমন ঘটনা আর বাংলাদেশে ঘটে না। সরকার যদি বলেন পাঁচ টাকা, তো তখনই দোকানি দাম হাঁকে সতেরো টাকা। এ বাস্তবতাগুলো হিসেবে আনতে হবে। বিগত সময়গুলোর অভিজ্ঞতা কিন্তু আমাদের ভিন্নতর। সরকারের মূল্য নির্ধারণের পিছনে বাজার ছোটে না বরং বাজার যে মূল্য নির্ধারণ করে তার পিছু নিয়ে সরকারের নির্ধারিত মূল্য ঊর্ধ্বগতিতে অগ্রসর হয়। আগেকার আধা পুঁজিবাদী আধা সামস্তবাদী সমাজ ব্যবস্থায় বাজারের ওপর সরকারের যতোটুকু নিয়ন্ত্রণ ছিল আজকে সমাজতন্ত্র নির্মাণের কালে ততটুকু নিয়ন্ত্রণও বাজারের ওপর সরকারের নেই।
সমস্যাগুলো সামনে এনেই আগামী দিনের পথ চলার দিক নির্দেশ দেয়া দরকার। বাজেটে এসব কিছুর প্রতিফলন হওয়া দরকার। কালো টাকার উপর প্রত্যক্ষ কর আরোপের কোন যাদু মন্ত্র জানা নেই, আর আজকের অর্থনীতিতে যেহেতু কালো টাকার আধিপত্যই সর্বাধিক সেহেতু সরকারি কোষাগারে আয়ের চ্যানেলটা যে সরাসরি সাধারণ মানুষের পকেটের সাথেই সংযুক্ত হবে-এমনটিই আশঙ্কা করা হচ্ছে। সরকারি নেতৃবৃন্দ কি বিকল্প কোন পথ খুঁজে পেয়েছেন? ’৭৪-৭৫ -এ কি দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির সাথে রেসে হাঁপিয়ে ওঠা জনসাধারণ একটু হাত ছাড়াবার সুযোগ পাবে? মানুষের হাতে পয়সা আসবার কোনো ব্যবস্থা কি নেয়া হবে এবারের বাজেটে?

কনফারেন্স লাইনের ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব

গোদের ওপর বিষফোঁড়া আর কি! বর্তমান সমস্যার জটিলতা এমনিতেই চারিদিকে স্বাভাবিক অবস্থা গ্রাস করতে উদ্যত। তারই প্রেক্ষিতে কনফারেন্স লাইনের ডেলিগেশন এসেছেন ঢাকায়। বয়ে এনেছেন শতকরা ২০ ভাগ ভাড়াবৃদ্ধির নতুন প্রস্তাব। এই প্রস্তাবের সুপারিশে কেবলমাত্র পশ্চিম দিক গামী মালবাহী জাহাজের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে। কনফারেন্স লাইনের বর্তমান ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব পর্যালোচনায় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশ তার একমাত্র প্রধান কাঁচামাল পাট বেঁচে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকে। এছাড়া পাটজাত দ্রব্য, চা, চামড়াও কিছু বহির্বিশ্বে পাঠিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে হয়। আর দেশীয় সম্পদ বহিঃবিশ্বের আন্তর্জাতিক বাজারে পাঠাবার জন্য বাংলাদেশের নিজস্ব কোনো শক্তিশালী নৌ পরিবহন ব্যবস্থা নেই। সেক্ষেত্রে তাকে কনফারেন্স লাইনের উপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হয়। ফলে কনফারেন্স লাইনের পক্ষ থেকে ভাড়া বৃদ্ধি করলে তার প্রত্যক্ষ ফলটা এসে পড়বে বাংলাদেশের উপর। এবং বিশেষজ্ঞ মহল মনে করছেন কনফারেন্স লাইনের বর্তমান ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব বাংলাদেশ-ভারত ও পাকিস্তানকে প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
পাট ও পাটজাত দ্রব্য বেচে বাংলাদেশ যে অর্থ পায় তা দিয়ে তাকে মূলত দেশের জন্য ঘাটতি খাদ্য ক্রয় ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ বাস্তবায়িত করতে হয়। সে ক্ষেত্রে ভাড়া বৃদ্ধির ফলে পাট আন্তর্জাতিক বাজারে পাঠানোর খরচ বেশি পড়বে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশি টিকতে পারবে না। ফলে আমরা বাজার হারাবো এবং সেইসঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিপুল পরিমাণে ভাটা পড়বে যা দেশি অর্থনীতিতে এবং দেশে বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতিকে ব্যাপকভাবে আঘাত হানবে। এই আঘাত হবে সুদুরপ্রসারী এবং স্থায়ী।
এই প্রসঙ্গে বলা যায়-কনফারেন্স লাইনের সঙ্গে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এর যে চুক্তি হয়েছিল-তারই ১৫ নং ধারায় উল্লেখ ছিল যে, বহিঃবিশ্বে মাল পাঠানোর ব্যাপারে তারা বাংলাদেশের জন্য তার চাহিদা অনুযায়ী পূর্ণ জায়গা দেবে এবং প্রত্যেক মাসেই মালবাহী জাহাজের মাল বিক্রয় ব্যাপারে কোনো সুযোগ দেবে। এই চুক্তি কার্যকর হয়নি বলেন বিশেষ অভিযোগ সূত্রে বলা হয়েছে। এবং তারই ফলশ্রুতি হিসেবে দেশের বন্দরগুলো সর্বদাই রপ্তানিযোগ্য মালে ঠাসা থাকে। রপ্তানিযোগ্য মালে বন্দরের এই ঠাসাঠাসি অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে বন্দর থেকে অন্যান্য দ্রব্যাদির শহর খাদ্যশস্য খালাস করার কাজে দারুন বিঘ্ন ঘটে। ঘটনাক্রমে বেশ কয়েকবার রপ্তানিযোগ্য ওই স্তুপকৃত আগুন লেগে দেশীয় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের ঘটনা নৈরাজ্যকে আমন্ত্রণ করে।
কনফারেন্স লাইনের ভাড়া বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের শুধু যে একতরফা লোকসান তাই নয়। ভাড়া বৃদ্ধির ফলে স্বভাবতই পাটের দাম বাড়বে এবং যে সমস্ত দেশ পাঠ কিনবে তাদেরকেও দেশীয় অর্থনীতি ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ, পাট কেনার জন্য তাদের অনেক বাড়তি টাকা দিতে হবে ফলে তারা পাটের বিকল্প কিছু দিয়ে কাজ সেরে ফেলার কথা চিন্তা করবে। আমাদের দেশের জন্য সেই ক্ষতির সম্ভাবনা মারাত্মক।
আমরা জানিনা, কিসের ভিত্তিতে কনফারেন্স লাইন ডেলিগেশন বাংলাদেশের বর্তমান ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন। তবে কারণ যাই হোক তা প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যকে প্রভাবিত করবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। এবং তার জন্য বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথও বিঘ্নিত হবে বহুল পরিমাণে। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, “ইউনাইটেড নেশান্স কনফারেন্স অন ট্রেড এন্ড কমার্স” এ ব্যাপারে আলোচনা চালাচ্ছেন। তারা ভাড়া বৃদ্ধির প্রসঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যালোচনা করে দেখছেন এবং উন্নয়নশীল দেশ যারা কাঁচামাল বাইরে পাঠায় তাদের জন্য বিশেষ সহানুভূতি রেখেই কোন সিদ্ধান্ত নেবেন। তারই প্রেক্ষিতে এই ভাড়া বৃদ্ধির প্রস্তাবে আমরা একটু চিন্তান্বিত। সেক্ষেত্রে আবেদন রাখছি ভাড়া বৃদ্ধি প্রসঙ্গে কনফারেন্স লাইনে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার ফলটা প্রকাশিত হবার পরই যেন এ সম্বন্ধে আলোচনা চালানো হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশসহ এমন উন্নয়নশীল দেশের স্বার্থেই ভাড়া বৃদ্ধির প্রশ্নটা সংশ্লিষ্ট কর্তাদের ভেবে দেখতে হবে এবং এই আলোচনায় কোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগেই দেশীয় পর্যায় ও সংশ্লিষ্ট কর্তাদের বিশ্লেষণ ও বিচার বিবেচনা রাখতে হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ জাতীয় অর্থনৈতিক অবস্থার পটভূমিতে লাভ-লোকসানের যেকোনো প্রসঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আজ বহুমুখী ও সুদুরপ্রসারী ভাবনা চিন্তার অবকাশ সৃষ্টি করতে না পারলে সমূহ সর্বনাশ।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!