You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১০ই অক্টোবর, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ২৩শে আশ্বিন, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ

জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি আহ্বান

নীরব নিশ্চুপ হয়ে আর বসে থাকা সম্ভব হয়নি সমাজের বিবেকবান বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৪ জন অধ্যাপক এক যুক্ত বিবৃতিতে হতাশায় নিমজ্জিত জাতির মনে নতুন প্রেরণা এবং আস্থার ভাব ফিরিয়ে আনার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় নেতৃবৃন্দের প্রতি। দেশ আজ চরমতম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ক্ষুধা, দারিদ্র, অনাহার নিত্যদিনের ছবি। মানুষ মরছে কাতারবন্দী হয়ে। অনাহারে মৃত্যুর সংবাদ লক্ষ কোটি মানুষের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে : তার পালা কবে আসবে? এমনি দুর্দিন আর দুর্যোগ মুহূর্তে নেতৃবৃন্দ উদাসীন, জাতীয় মানস আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে নৈর্ব্যক্তিকতায়, কর্মে এসেছে অনাসক্তি।
বিবৃতিদাতাগণ বর্তমান অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, জাতির জীবনে দুর্যোগ আসবে এটা নতুন কথা নয়। বাংলাদেশেও দুর্যোগ এই প্রথমবারের মতো আসেনি। কিন্তু সর্বস্তরে দুর্যোগ মোকাবেলায় এত অনাসক্তি, অবজ্ঞা, এত অদ্ভূত রকম ঔদাসীন্য কখনো দেখা গেছে বলে বিশ্বাস হয় না। নিজের উপর আস্থাহীন জাতি যে কি পরিমাণ জড় পদার্থে পরিণত হতে পারে, বর্তমান বাংলাদেশ তার জ্বলন্ত উদাহরণ। বিবৃতিদাতাদের বক্তব্যের সঙ্গে আমরা সম্পূর্ণ একমত। দুর্ভিক্ষের করালগ্রাসে নিপতিত জাতি যেন হাল ভাঙ্গা নাবিকের মতো দিশা হারিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। আশার এক চিলতে আলো পর্যন্ত নেই। যতদূর দৃষ্টি যায় মৃত্যু, ক্ষুধা, দারিদ্র আর অনাহারের ছবি।
উল্টোটিও আছে। অমানবিক বিলাস বাসনে গা ভাসিয়ে দেবার ছবি। মানুষের দুর্ভোগ আর মৃত্যুর কারণ ঘটিয়ে দু’হাতে পয়সা লুটবার ছবি। এই দুই বিপরীত ছবির মাঝে সরকার, নেতৃবৃন্দের ফলহীন আস্ফালন জাতিকে মূক, বিস্মিত করে রেখেছে। অথচ এই ক’বছর আগেই এই জাতি প্রচন্ড একটা ইচ্ছাকে সামনে রেখে নজিরবিহীন এক সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণের বিনিময়ে অধিকার আদায় করেছিল নিজেদের মনমতো, দেশকে গড়ে তোলার একটা লক্ষ্য ছিল। এক সাগর রক্তের উপর প্রতিষ্ঠিত সরকার সেই লক্ষ্য এবং আদর্শের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন সমাজতন্ত্রকে। ধর্ম নিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এসব কিছুই স্বীকৃতি পেয়েছিল কাগজে-কলমে।
কিন্তু মাত্র তিন বছর যেতে না যেতেই গোটা জাতি সে লক্ষ্য অর্জনে নেতৃবৃন্দের আন্তরিকতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে। প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তা এবং সিদ্ধান্তহীনতায় লক্ষ্যপথে আমাদের বারবার বিচ্যুতি দেখা দিচ্ছে। আর তারই ফলে দুর্ভোগ দুর্যোগ দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে।
আমরা বারবার সরকার এবং জাতীয় নেতৃবৃন্দকে সময় থাকতে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছি। বলেছি উৎপাদন, প্রশাসন এবং নির্মাণ কাজে ব্যাপক জনগণের উপর আস্থা রাখতে। একমাত্র জনগণই তাদের সমস্যা সমাধানে কার্যকরী সহযোগিতা প্রদান করতে পারে। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে আমরা যা লক্ষ্য করেছি, তা হলো গুটিকতক কালোবাজারী, মধ্যস্বত্বভোগী, জোতদার পুরনো কায়দায় আবার জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের মালিক বনে গেছেন। বাজার থেকে প্রশাসন সর্বত্রই এদের অবাধ প্রতিপত্তি।
এ অবস্থার অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে। জাতীয় লক্ষ্য সম্পর্কে জনগণের আস্থা আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। তাদের নিয়োজিত করতে হবে দেশ পুনর্গঠনের কাজে। অবিলম্বে যদি এই লক্ষ্যহীনতা দূর করা না যায়, নেতৃবৃন্দ যদি তাদের আন্তরিকতা প্রদর্শন করতে ব্যর্থ হন, তবে দেশ আজকের চাইতেও আরো মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে।

লঙ্গরখানায় অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ

দুর্ভিক্ষ মোকাবেলা করার জন্য শহরে যে সকল লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে তার পরিবেশ সম্পূর্ণ অস্বাস্থ্যকর বলে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। লঙ্গরখানায় হাজার হাজার মানুষের মাঝে বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। এবং তাদের স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি ঘটছে। দীর্ঘদিন অপুষ্টি ও অনাহারে থেকে তারা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। লঙ্গরখানাগুলোতে যে সকল রোগ বেশী আকারে দেখা দিয়েছে তার মধ্যে রয়েছে, ম্যালেরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, চর্মরোগ, পেটের অসুখ এছাড়া ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত মানুষও রয়েছে। সংবাদে আরো বলা হয়েছে, লঙ্গরখানায় ঔষধের প্রচুর অভাব রয়েছে। শিশুদের অবস্থা শোচনীয়। শিশুরা যেমন রুটি খেতে পারেনা তেমনি লঙ্গরখানায় দেয় গুঁড়া দুধও তারা হজম করতে পারছেনা। গুঁড়া দুধ খেয়ে বহু শিশুর পেটের অসুখ হয়েছে বলে সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য একটি পত্রিকার এক সংবাদে বলা হয়েছে, মিরপুর যে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে তাতে অবস্থানরত ছিন্নমূল মানুষগুলো দিন দিন মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। মৃত্যুর প্রহর গোনা ছাড়া আর ওদের কোনো গত্যন্তর নেই। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে মল-মূত্রে মাখামাখি হয়ে মানুষ বাস করছে। মিরপুর লঙ্গরখানায় প্রায় বারোশ’ লোক বাস করছে। এর মধ্যে শিশু রয়েছে পাঁচশ’য়ের মতো। ঐ রিপোর্ট অনুযায়ী প্রায় প্রত্যেকটি শিশুই নাকি বিভিন্ন অসুখে ভুগছে। মিরপুর লঙ্গরখানার জন্য প্রতিদিন চিড়া ও গুড়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সরকারী ঘোষণায় দুর্ভিক্ষাবস্থা আজ চরমে পৌঁছেছে। প্রতিটি মানুষ আজ অসহায়ের মতো হাহাকার করছে। পরিস্থিতির উপশম হবার লক্ষণ আপাততঃ নেই। কর্তৃপক্ষ যত আশাবাদই ব্যক্ত করুন না কেন, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কিছু লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে পরিস্থিতির আপাততঃ মোকাবেলার জন্য। কিন্তু সেখানেও অব্যবস্থার সংবাদ খবরের কাগজে প্রকাশিত হয়েছে। লঙ্গরখানায় অবস্থান করে আরো বিভিন্ন প্রকার অসুখে মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। লঙ্গরখানাগুলোকে প্রথম থেকেই সুবিন্যস্তভাবে সংগঠিত করা উচিত ছিল। বিশেষ করে অসহায় মানুষকে কোনো মতে খাবার দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে। তার মধ্যে যদি তাদের বাঁচবার নিশ্চয়তা না থাকে, তাহলে তা আরো দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার। কর্তৃপক্ষ অসুখের বা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারেননি। অথচ লঙ্গরখানা খোলার পূর্বেই এ চিন্তা তাদের কথা উচিত ছিল। লঙ্গরখানার মূল উদ্দেশ্য যেহেতু দুঃস্থ মানুষকে আশ্রয়, ঔষধ ও খাবার দেওয়া সেহেতু এর গঠন প্রণালীও তেমনিভাবে বিন্যস্ত করা দরকার ছিল। লঙ্গরখানায় যেয়ে যদি মানুষের দুর্দশা আরো বেড়ে যায় তাহলে তার চাইতে আর মর্মান্তিক ব্যাপার হতে পারে না। ঔষধ এবং চিকিৎসার অভাবে শিশুদের মৃত্যুর যে খবর পাওয়া যাচ্ছে তার জন্য অবিলম্বে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা আবশ্যক। আমরা আশা করি, কর্তৃপক্ষ অবিলম্বে ছিন্নমূল অসহায় মানুষগুলোর জীবন ধারণের নিশ্চয়তা বিধানে আবশ্যকীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!