বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৭শে অক্টোবর, রোববার, ১৯৭৪, ৯ই কার্ত্তিক, ১৩৮১ বঙ্গাব্দ
আরব শীর্ষ বৈঠক
সারা দুনিয়ার দৃষ্টি আবার মধ্যপ্রাচ্যে। জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনী প্রতিনিধির উপস্থিতির স্বপক্ষে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হবার পর রাবাতে আজ শুরু হয়েছে আরব শীর্ষ সম্মেলন। প্যালেস্টাইনী প্রতিনিধি দলে যারা থাকবেন তাদের নাম ইতিমধ্যেই ঘোষণা করা হয়েছে। ইসরাইল এবং তার মুরুব্বীদের জন্য এটা খুব একটা সুখকর ব্যাপার নয়।
বস্তুতঃ জাতিসংঘে প্যালেস্টাইনী প্রতিনিধিদলের ভাষণ দেবার সুযোগ লাভ আর একবার বিশ্বসংস্থা কর্তৃক প্যালেস্টাইনবাসীদের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি সমর্থনেরই নামান্তর।
আরব শীর্ষ বৈঠকের প্রধান আলোচ্যসূচী হিসেবে বলা হয়েছে, অধিকৃত আরব এলাকা উদ্ধার এবং প্যালেস্টাইনী জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার প্রতিষ্ঠা প্রশ্নে আরব দেশগুলোর যৌথ কর্মসূচী গ্রহণ। এই আলোচ্যসূচী নির্ধারণের জন্য আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের গত ২২শে অক্টোবর থেকে কয়েক দফা বৈঠক করতে হয়েছে। বলাবাহুল্য শীর্ষ বৈঠকের আলোচ্যসূচী জর্ডানের অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হয়।
জর্ডানের এই ভূমিকা কিছু নতুন নয়। স্বাধীন প্যালেস্টাইনী রাষ্ট্রগঠন এমনকি প্যালেস্টাইনীদের অধিকৃত এলাকা মুক্তির সংগ্রামে জর্ডান বরাবরই ষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকা পালন করে আসছিল। নিজ দেশে প্যালেস্টাইনী মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা এবং আরব ঐক্যে বিভেদ সৃষ্টির ব্যাপারে বাদশা হোসেনের চক্র অমূলক তৎপরতায় অতিষ্ঠ হয়ে এক সময় মিসরের প্রেসিডেন্ট জামাল আবদুল নাসের মধ্যপ্রাচ্যের এই ‘বেঁটে শয়তান’ থেকে সবার দূরে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন।
আরব রাষ্ট্রসমূহের এবারকার এই শীর্ষ বৈঠকের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অনেক বেশী। প্যালেস্টাইনীরা এই প্রথম প্রবাসী একটা সরকার প্রতিষ্ঠার কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। খুব শীঘ্রই তারা সরকার গঠন করবে বলে অনেকের ধারণা। আরব রাষ্ট্রসমূহও আগেরই চাইতে অনেক বেশী ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী। আরবদের তেল সম্পদ এবং বিরোধীপক্ষের উপর তা অস্ত্র হিসেবে প্রয়োগের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে শিল্পোন্নত রাষ্ট্রসমূহ এখন বেশ সজাগ। এমনকি ইসরাইলী মনোভাবেরও যে কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে তা সেখানকার প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে ধরা পড়ে। এমতাবস্থায় আরব শীর্ষ বৈঠকে প্যালেস্টাইনী সরকার গঠন অথবা মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার স্থায়ী সমাধানের ব্যাপারে যদি চূড়ান্ত কোনো কর্মসূচী গ্রহণ করা হয় তবে বিস্মিত হবার কিছু থাকবে না।
আমরা প্যালেস্টাইনীদের ন্যায্য সংগ্রামে বরাবর সমর্থন জানিয়ে এসেছি। স্বাধীন প্যালেস্টাইনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং অধিকৃত এলাকা থেকে ইসরাইলীদের উৎখাতের সংগ্রামে প্যালেস্টাইনী মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রয়েছে আমাদের অব্যাহত সমর্থন। বঙ্গবন্ধু আরব শীর্ষ বৈঠক উপলক্ষে রাবাতে বাদশাহ হাসানের কাছে প্রেরিত এক বাণীতে প্যালেস্টাইনী মুক্তি সংগ্রামীদের ন্যায্য সংগ্রামের সাফল্য কামনা করেছেন। আমাদের বিশ্বাস, এবারকার শীর্ষ বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার স্থায়ী সমাধানের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ বাস্তব এবং চূড়ান্ত কোনো কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।
শান্তির দায়িত্ব ভুট্টোর স্কন্ধে
পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর সম্মানে ক্রেমলিনে প্রদত্ত এক ভোজসভায় সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি উপমহাদেশের পারস্পরিক সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, দক্ষিণ এশীয় পরিস্থিতি স্বাভাবিকীকরণে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের প্রচেষ্টার প্রতি সোভিয়েত ইউনিয়ন অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করে থাকে। এই উপমহাদেশে পারস্পরিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ইতিপূর্বে যে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের গত পরশুর এ আহ্বান সোভিয়েত ইউনিয়নের সেই অনুসৃত নীতিরই আরেক দফা বহিঃপ্রকাশ। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন যে, কিছুদিন আগেও পরস্পরের মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল বর্তমানে সেই অবস্থার অবসান ঘটেছে এবং নিজেদের আভ্যন্তরীণ সমস্যাদি এই তিনটি দেশকেই স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে মিটিয়ে ফেলতে হবে। বাংলাদেশ এবং ভারত এ দু’টি দেশ পরস্পরের বন্ধুত্বের সুকঠিন নিগড়ে আবদ্ধ। সমস্যা শুধু এককভাবে বাংলাদেশ ও ভারতের সাথে পাকিস্তানের।
ক্রেমলিনে কোসিগিনের বক্তৃতার জবাবে প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো ভারত ও আফগানিস্তানের সাথে তার দেশের মতবিরোধের কথা উল্লেখ করে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি ক্রেমলিনে কোনো বক্তব্য রাখেননি। জনাব ভুট্টো ইচ্ছাকৃতভাবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ হয়তো এড়িয়ে গেছেন। কারণ তিনি ভালোভাবেই জানেন উপমহাদেশে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার জটগুলো খুলে ফেলবার দায়িত্ব বর্তমানে তার নিজের স্কন্ধে অর্পিত হয়েছে। যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দান ও অপরাপর সমস্যাদি সমাধানে স্বাক্ষরিত দিল্লী চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ যে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছে পাকিস্তান তার প্রতি তার বিন্দুমাত্র সাড়া প্রদান করেনি। প্রতিশ্রুত ৩ লক্ষ অবাঙালীকে পাকিস্তানে ফিরিয়ে নেয়া এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত অবিভক্ত পাকিস্তানের দায়-দায়িত্ব ও সম্পদের ভাগ বাটোয়ারার প্রশ্নে পাকিস্তানকে নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করে বাংলাদেশের সাথে আলাপ-আলোচনায় বসে সমস্যার একটা শান্তিপূর্ণ পথ খুঁজে বের করতে হবে। কারণ উপমহাদেশের ৩টি দেশের পারস্পরিক সমস্যাগুলো ধীরে ধীরে সমাধান না করা পর্যন্ত সামগ্রিক স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব নয়, সে কথা জনাব ভুট্টোকে আন্তরিকভাবেই উপলব্ধি করতে হবে।
নামের বাহার দিয়ে নয়—
ঢাকার রাস্তাঘাট যেমনই হোক তার নামের বাহার রয়েছে। নামের গোলক ধাঁধায় পথচারীরা মোটামুটি আহ্লাদিতই বটে। একটি সংবাদে জানা গেছে, ঢাকা শহরে নাকি পাঁচ-পাঁচটা রোড রয়েছে যেগুলোর নাম হলো টয়েনবি সার্কুলার রোড। এই পাঁচটি সার্কুলার রোড হলো প্রথমটি জি.পি.ও’র মোড় থেকে রমনা ভবন হয়ে গুলিস্তান সিনেমার পেছন পর্যন্ত। দ্বিতীয়টি গুলিস্তান বি.আর.টি.সি বাস স্টেশন থেকে বঙ্গভবনের পাশ ঘেঁষে টিকাটুলী মোড় পর্যন্ত। তৃতীয়টি গোপীবাগের প্রবেশ মুখ থেকে মধুমিতা সিনেমার পেছন দিক হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত। চতুর্থঃ কমলাপুর মোড় থেকে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার ঝিলের তীর ঘেঁষে বিসিকের সামনে দিয়ে ফকিরাপুলের প্রবেশ পথ পর্যন্ত। এবং পঞ্চমটি হলো ডি.আই.টি এক্সটেনশন রোডের মোড় থেকে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার প্রবেশ পথের প্রথমাংশ পর্যন্ত। উল্লেখিত এই পাঁচটির নামই হলো টয়েনবি সার্কুলার রোড। এছাড়াও আরো কয়েকটি টয়েনবি সার্কুলার রোড রয়েছে। এ সকল রাস্তার বর্তমান অবস্থা ঢাকাবাসীর নিশ্চয়ই জানা রয়েছে। অর্ধ শতাব্দী কাল ধরে এ সকল রাস্তা ঢাকাবাসীকে আর কিছু না হলেও নামের দিক দিয়ে উচ্চকিত করে এসেছে। রাস্তাগুলোর মোড়ে কিছু কিছু টিনশেড ছিল আজো তার অবশেষ চোখে মেলে। কিন্তু তার সর্বশেষ অবস্থা নিশ্চয়ই যাত্রীদের আছে আজ আর আবেদন জাগায় না। রাস্তার নামের বাহার আমাদের পৌরসভার সৌজন্যই হয়েছে। আউটার সার্কুলার রোড, সার্কুলার রোড, টয়েনবি সার্কুলার রোড ইত্যাদি হরেক রকম সার্কুলার রোডের গোলক ধাঁধায় ঢাকার মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। রাস্তাঘাটের বর্তমান দুঃসহ অবস্থা দেখে তাদের গাড়ীতে চড়তেও আজকাল চিন্তা করতে হয়। পৌর কর্তৃপক্ষ দেশে আছেন এমন মনে হয়না এ সকল সার্কুলার রোডের উপর দিয়ে গাড়ীতে চড়ে যাওয়ার সময়। ঢাকার রাস্তা সম্পর্কে ইতিপূর্বে আমরা বহু কথা লিখেছি। পৌরসভার কর্তৃপক্ষ তাতে কান দেবার প্রয়োজন মনে করেননি। যানবাহনে যারা চলাফেরা করেন তাদের দুর্ভোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে অথচ কর্তৃপক্ষের তাতে যেন এসে যাচ্ছে না। রাস্তার দুরবস্থার জন্য যানবাহনগুলোর নিদারুণ ক্ষতি হচ্ছে। যে সকল খুচরা যন্ত্রাংশ এক বছর সক্রিয় থাকতে পারতো তা তিন মাসেই রাস্তার দুর্গতির দরুণ নষ্ট বা অকেজো হয়ে যাচ্ছে। তাতে করে কর্তৃপক্ষকে প্রচুর ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে। অতএব নামের বাহার নয় রাস্তাঘাটগুলোর শ্রীবৃদ্ধি হলেই জনগণ খুশী হবে—সরকারেরও অপচয কমবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক