বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩০শে মে, বৃহস্পতিবার, ১৬ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
চা–শিল্পের ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পদ হিসেবে চা–এর স্থান তৃতীয়। শুধু চা রপ্তানি করেই আমরা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে থাকি। সে ক্ষেত্রে জাতীয় অর্থনীতির সঙ্গে চা-শিল্পের একটা ঘনিষ্ঠ যোগ আছে। এই দিকে ইঙ্গিত রেখেই বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য মন্ত্রী গত ২৮শে মে বাংলাদেশ চা সংসদের বার্ষিক সাধারণ সভায় কিছু বক্তব্য রাখেন। এই বক্তব্যে তিনি জাতীয় অর্থনীতিতে চা উৎপাদকরা যেন ন্যায় আসন করে দিতে পারে তার জন্য চা বোর্ড ও সরকারের প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতার আশ্বাস দেন।
চা শিল্পকে চাঙ্গা করে তোলার ব্যাপারে মাননীয় মন্ত্রী অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক কথা বলেছেন সন্দেহ নেই। কিন্তু তার এই পাশাপাশি বিভিন্ন পত্রিকাস্তরের প্রতিবেদন মারফত আমরা যে সমস্ত বিভিন্ন খবর পেয়েছি এবং পাচ্ছি-তাকে ঠিক সঙ্গতিপূর্ণ বলতে পারছিনা। কারণ চা শিল্প আমাদের লাভজনক বাণিজ্য সম্পদ। এখানকার সকল সমস্যা দূরীভূত হয়ে কারখানার উৎপাদন বাড়ুক এবং শ্রমিক সমস্যা নিরসন হোক-এ আমরাও চাই। তদুপরি চা-শিল্প বাংলাদেশের জন্য প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করুক তাও চাই। কিন্তু চা-বাগানগুলো সংক্রান্ত খবর আমাদের সে দিক থেকে হতাশ করে। কারণ চা শিল্পের উৎস কেন্দ্রই তো হল চা-বাগান গুলি।
প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই বলতে হচ্ছে আজ পর্যন্ত চা-বাগানের মালিকানা নির্ধারিত হয়নি। কিছু ব্যক্তি মালিকানায়, কিছু সরকারি নিয়ন্ত্রণে আছে। কিছু সংখ্যক পরিত্যক্ত চা-বাগান ছিল সেগুলোর সুষ্ঠু সুরাহা করা হয়নি এখনো। সেগুলো নিয়ে মালিকানার গোলমাল জনিত মামলাও চলছে। ’৭২ ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেইসব বাগানের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
১৯৭২ সালে সরকার পরিত্যক্ত চা বাগানগুলো পরিচালনার জন্য চা বোর্ডের চেয়ারম্যানকে চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মচারী ছাড়াও ৩ জন সংসদ সদস্যকে সদস্য নির্বাচিত করে ৮ সদস্য বিশিষ্ট চা শিল্প ম্যানেজমেন্ট কমিটি গঠন করা হয় । এই কমিটিকে অতঃপর ৪০টি চা-বাগান নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পরিত্যক্ত চল্লিশটি বাগানের দায়িত্ব ওই কমিটি কখনোই নিতে পারেননি। কারণ পরিত্যক্ত ঘোষিত হবার সাথে সাথেই সাতটি বাগানের স্বত্বাধিকারীরা মালিকানা নিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেন। সেই মামলা আজও ঝুলছে। চা-উৎপাদনের জন্য এসব কি বিরাট অন্তরায় নয়?
চা-শিল্প সমৃদ্ধি প্রশ্ন আরো বহু সমস্যার কথাও এ প্রসঙ্গে বলা যায়। প্রথমত চা উৎপাদনের পরেই আসে তা সংরক্ষণের প্রশ্ন। সংশ্লিষ্ট মহল সূত্রেই জানা যায় যে, দেশে উৎপাদিত চারা সংরক্ষণের জন্য আমাদের প্রায় সাত লক্ষ চা বাক্সের প্রয়োজন। স্বাধীনতার পূর্বে দেশি চারটি কারখানাই এই চাহিদা পূরণ করত। এখন সে চা বাক্সও আমদানি করতে হয়। শুধু তাই নয়-চা বাক্স আমদানির মধ্যেও ঘাপলা। সময়মতো আমদানিকৃত চা বাক্স এসে পৌঁছে না। ফলে একমাত্র সংরক্ষণের অভাবে প্রচুর চা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এক্ষেত্রে পরিকল্পকের সহযোগিতায় জানাবার অবকাশ কতটুকু?
দ্বিতীয়তঃ চা-বাগানগুলো সংস্কার সাধনের প্রশ্ন আছে। সীমান্ত এলাকার চা বাগানগুলো বিগত স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। সেগুলোর পুনর্বিন্যাস বা উন্নতির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জানা যায় না। চা শিল্পের উন্নতির ব্যাপারে বাগান সম্প্রসারিত করার কোন পরিকল্পনা বা ফ্যাক্টরির উন্নয়ন পরিকল্পনাও নেয়া হয়নি। এরই প্রেক্ষিতে শুধু মুখের কথায় চা-শিল্পের সমৃদ্ধির উল্লেখ একটি অসঙ্গতিপূর্ণ মনে হয় বৈকি!
তৃতীয়তঃ দেশের সমগ্র বাগান মিলে প্রায় ২ লাখ ৭৯ হাজার ১ শত ৮৭ একর এলাকা চা বাগান বলে চিহ্নিত হলেও চা গাছ রয়েছে মাত্র ১লাখ ৬ হাজার একর জমিতে। পত্রিকান্তরের এই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়-বাকি জমি অনাবাদি পড়ে আছে। তদুপরি চা বাগান এলাকায় চা গাছ ছাড়াও মাঝে মাঝে আনারস, লেবু, গোল মরিচ ইত্যাদি চাষের অবকাশও রাখা যায়। কারণ ওইগুলো মূলতঃ পাহাড়ি এলাকারই ফসল। কিন্তু সেদিকে কোন পরিকল্পনার ইঙ্গিত আমরা পাইনা। চা-বোর্ড বা চা-ম্যানেজমেন্ট কমিটি তাহলে কেন গঠন করা হয়েছে? এসব সংশ্লিষ্ট ছোটখাটো পরিকল্পনা ও উন্নয়ন মূলক চিন্তা কি ম্যানেজমেন্টের নয়? যদি তা নাই হয় তাহলে তেমন ম্যানেজমেন্ট এর আওতায় রেখে চা-শিল্প সমৃদ্ধি বা চা-শিল্প কেন্দ্র ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার কথার গুরুত্বই বা কতটুকু?
চতুর্থতঃ শ্রমিক সমস্যা। আমরা জানি চা-উৎপাদনের খরচ বেড়েছে। সেই অনুপাতে জীবনযাত্রার মান সবারই বেড়েছে। অল্প এবং সীমিত আয়ের ২০ লক্ষ শ্রমিকদের জীবনেও দেখা দিয়েছে তীব্র খাদ্য সংকট ও বস্ত্র সংকট। মজুরিসহ তাদের ঐ সকল সমস্যার জটিলতাকে বাড়তে দিলে চা-উৎপাদন বৃদ্ধি তথা বাণিজ্য সম্পদ সমৃদ্ধি কি অনেকটা পিছিয়ে যাবে না?
আমরা মন্ত্রী মহোদয়ের কথায় আশ্বাস পেয়েছি এ কথা আবারও বলছি। কিন্তু সেই সঙ্গে এও বলতে চাই যে, সমস্যাকে ঢেকে রাখলে সমাধান কোনদিনও আসবেনা। অপর পক্ষের সমস্যা যতটাই থাক, তাকে অকপটে মেনে নিয়েই যদি গোড়া থেকে একটা কাজে হাত দেওয়া যায়-তাহলে ধীরে হলেও তার পরিণতি হয় শুভ। তাই চা শিল্প ও সংশ্লিষ্ট যত গলদ আছে, সেগুলো মিটিয়ে ফেলে তবে চা-সম্পদের সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে হবে। স্বর্ণ প্রসু এ দেশ। আমরা বিশ্বাস করি অখন্ড নিষ্ঠা নিয়ে কাজ করলে বাংলাদেশ চা-শিল্পে বিশ্বে উল্লেখযোগ্য স্থান নিতে পারবে।
রেলের ভাড়া বৃদ্ধি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
আগামী নতুন বাজেটে রেলের ভাড়া শতকরা পঁচিশ ভাগ বৃদ্ধি পেতে পারে এমন আশঙ্কা করে একটি জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। খবরটির সূত্র ওয়াকিফহাল মহল। কিন্তু সূত্রটির আশঙ্কা সম্পূর্ণ উড়িয়ে দেবার মত নয়। স্বাধীনতার পর একবার রেল ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল শতকরা দশ ভাগ। অনেকদিন ধরেই আমরা আশঙ্কা করছিলাম রেলভাড়া আরো বাড়ানো হবে বলে। উল্লেখিত সংঘটিত যে তথ্য পরিবেশন করা হয়েছে তাতে বলা হয়েছে যে এ বছরের রেলওয়ে রাজস্ব আয়ে বিপুল পরিমাণ ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অনুমান করা হচ্ছে এই ঘাটতির পরিমাণ হবে পঞ্চাশ ভাগ অর্থাৎ প্রায় সতেরো কোটি টাকা। ১৯৭৪-৭৫ সালে রেলওয়ের রাজস্ব বাজেটের আয়ের লক্ষ্য ছিল তেত্রিশ কোটি তেষট্টি লাখ টাকা। সংবাদটিতে বাজেটের ঘাটতির কারণে করতে গিয়ে বলা হয়েছে যে, বরাবর রেলযাত্রীদের অসম্ভব ভিড় থাকলেও বিনা টিকিটে চলাচলের রেওয়াজের দরুন যথাযথ কর্তৃপক্ষ পায়নি। এ ব্যাপারে প্রশাসনিক ব্যর্থতা রয়েছে। এছাড়া অন্যান্য দিকেও যেমন-বুকিংয়ের মালের ভাড়া আদায়ে, বিভিন্ন ধরনের চুরির দরুন, অন্যান্য অনিয়ম, কারচুপি প্রভৃতিতেও প্রশাসনিক কারসাজি রয়েছে। রাজস্বে যে ঘাটতি হয়েছে তার পেছনে অন্যতম কারণ এসকল কারসাজিই। শতকরা পঁচিশ ভাগ রেলভাড়া বাড়ালে সবকিছু মিলিয়ে অতিরিক্ত আয় হবে প্রায় চার কোটি টাকা। স্বাধীনতার পর থেকে রেলওয়ে বিভাগে যে সকল দুর্নীতি এবং অবস্থা অব্যাহতভাবে চলছে তা এই বিভাগটি আর্থিক ক্ষতির অন্যতম কারণ। অব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে-বিনা টিকেটের যাত্রীদের অত্যধিক ভিড়, দৌরাত্ম্য উপর্যুপরি বহু দুর্ঘটনা, গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর অনিশ্চয়তা, বিভিন্ন স্টেশনে অহেতুক বিলম্ব, কোচগুলোর করুন অবস্থা, আলো-পানির অপ্রতুলতা, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানির কারণে জানমালের নিরাপত্তার অভাব প্রভৃতি। চলতি অর্থবছরে রেল বাজেটে পৃথকভাবে সতেরো কোটি ষাট লাখ টাকার উন্নয়ন কর্মসূচি আট কোটি সত্তর লাখ টাকার পুনর্বাসন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় বৈদেশিক সাহায্য ও আভ্যন্তরীণ অর্থের প্রভাবে এ সকল কর্মসূচি দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। সংবাদে আরো বলা হয়েছে-কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নির্মীয়মান প্রকল্প ছাড়া রেলের অনেক নতুন পরিকল্পনায় এ বছরে হাত দেওয়া সম্ভব হয়নি। দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে প্রতিটি জিনিসের নতুন করে কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করছেন। প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারণ করা হচ্ছে বাড়তি মূল্যের উপর নির্ভর করে। রেলওয়ে ভাড়া বৃদ্ধি পাবে-এতে করে আশ্চর্য হবার কোন কারণ নেই। কেননা কতৃপক্ষকে প্রতিটি সেক্টরে নতুন বিন্যাস সাধন করতে হচ্ছে। রেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রসঙ্গে যে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তার পেছনে হয়তো যুক্তিও রয়েছে। কিন্তু রেলওয়েতে যে সকল অবস্থায় রয়েছে তার দূরীকরণও আজ অপরিহার্য। রেল বিভাগের নানা অব্যবস্থাপনার ছাপা হয়েছে খবরের কাগজে। বিভিন্ন সময়ে এর আশু সংস্কারের দাবি করেছি আমরা। ওয়াগণের অভাব ও যাত্রীবগীর দুরবস্থা, বিনা টিকিটে ভ্রমণ, ডাকাতি, রাহাজানি প্রভৃতি যে সকল দুর্নীতি ও অবস্থান রয়েছে তার সংস্কার সাধন করা একান্ত প্রয়োজন। ভাড়া যদি সত্যি বৃদ্ধি করা হয় তাহলে সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অব্যবস্থাও দূর করতে হবে। রেল বিভাগে যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে তা পূরণ করাই একমাত্র উদ্দেশ্য না হয়ে রেলের সকল অসুবিধার দূরীকরণও লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা হোক।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক