You dont have javascript enabled! Please enable it! 1950 | পঞ্চাশ সালের দাঙ্গা | পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু দর্শন – যতীন সরকার - সংগ্রামের নোটবুক

পঞ্চাশ সালের দাঙ্গা

মাত্র এক বছর পড়েছিলাম নেত্রকোনার চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে। কিন্তু সে-বছরের (অর্থাৎ উনিশ শো আটচল্লিশ সালের) প্রায় প্রত্যেকটি দিন ছিল আমার কাছে ‘সােনা ঝরা দিন। প্রত্যেকটি দিন ছিল রােমাঞ্চের, নতুন নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের, নতুন নতুন আনন্দের, এবং বেদনারও। বেদনার মধ্যেও জড়িত মিশ্রিত হয়ে থাকতাে আনন্দ। নিত্য নতুন আনন্দ আহরণ করতাম চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে আমার মাস্টার মশাইদের চমৎকার পাঠদান থেকে। জ্ঞানই শক্তি’ এমন কথা বহুকাল ধরেই জ্ঞানীগুণীরা বলে আসছেন। কিন্তু জ্ঞান যে আনন্দ—কেউ না বললেও তা সেবয়সেই বুঝে ফেলেছিলাম। আমার কাছে সেদিন মাস্টার মশাইদের দেয়া জ্ঞান হয়ে উঠেছিল অফুরান আনন্দের উৎস।
এ ছাড়া আমাকে এ-আনন্দের অন্যতর উৎসের সন্ধান দিয়েছিলেন হরেন্দ্র দা। পুখুরিয়া গ্রামের হরেন্দ্রচন্দ্র দাস। একজন সুদর্শন যুবক। পেশায় কালেক্টরেটের কেরানি। নেশা বই পড়ার। সঙ্গী ছাড়া নেশা জমে না, নেশাখােররা তাই সঙ্গী খুঁজে নেয়। সমবয়সী না পেলে অসমবয়সী সঙ্গী গ্রহণেও নেশাখােরদের বােধ হয় আপত্তি থাকে না। এভাবেই আমিও, তেরাে বছর বয়সী এক কিশাের, তিরিশ বছর বয়সী যুবকের বই পড়ার সঙ্গী হয়ে গিয়েছিলাম। সঙ্গী হওয়া মানে একসঙ্গে বসে বই পড়া নয়। পড়তেন তিনিই। আমি কেবল তার পাশে বসে থাকতাম। যেসব মােটা মােটা বই তিনি পড়তেন, সে-সবই আমার পক্ষে ছিল একান্ত দুম্পাঠ্য ও দুম্পাচ্য। যেমন—রজনী পাম দত্তের ‘ইন্ডিয়া টুডে’। এই বিরাট আকৃতির বইটির অনেকগুলাে অধ্যায় তিনি আমার সামনে বসেই পড়েছিলেন। ইংরেজিতে একেক পৃষ্ঠা পড়েন, আর আমার কাছে তার ব্যাখ্যা দেন। ভারতীয় রাজনীতির মার্কসীয় ভাষ্যের সঙ্গে এভাবেই হরেন্দ্র দা আমাকে পরিচিত করে তুলতে চেষ্টা করেন। সে-সব কঠিন কঠিন কথা হজম করা
১১৫
আমার পক্ষে শক্ত ছিল অবশ্যই; তবু হরেন্দ্র দার পরিবেশনার গুণে সেগুলাে একান্তই উপাদেয় হয়ে উঠতাে। হরেন্দ্র দা নিজে যে মার্কসবাদী ছিলেন, তা নয়। ভারতীয় মার্কসবাদীদের অনেক কঠোর সমালােচনাও তাঁর মুখে শুনেছি। পরবর্তী সময়ে হরেন্দ্র দা-কে তাে বৈষ্ণবধর্মের অনুরাগী হতেও দেখেছি। তবে জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা বিষয়ে প্রচণ্ড কৌতূহলই বােধ হয় এক সময় তাঁকে মার্কসবাদ ও মার্কসবাদীদের সম্পর্কেও কৌতূহলী করে তুলেছিল। সেই কৌতুহলটিই তিনি আমার মধ্যে সঞ্চার করে দিতে চেয়েছিলেন যখন আমি মাত্র ক্লাস সিক্সের ছাত্র। রুশ দেশের অনেক কথা তিনি গল্পের মতাে করে আমার কাছে বলতেন। তাঁর মুখেই প্রথম মাক্সিম গাের্কির নাম শুনি। একদিন পুখুরিয়া থেকে নেত্রকোনার পথে হাঁটতে হাঁটতে গাের্কির ‘মা’ উপন্যাসের কাহিনীটি অত্যন্ত চমৎকার ভঙ্গিতে তিনি বলে যাচ্ছিলেন। ‘মা’ উপন্যাসটির সঙ্গে আমার প্রত্যক্ষ পরিচয় অনেক পরে, কিন্তু তেরাে বছর বয়সে হরেন্দ্রদার মুখে শােনা ‘মা’-এর গল্পটি এখনাে আমার মনে গেঁথে আছে।
এখন নেত্রকোনা ছেড়ে চলে গেলে চন্দ্রনাথ হাইস্কুলের মাস্টার মশাইদের দেয়া শিক্ষা থেকে তাে বঞ্চিত হবােই, বঞ্চিত হবাে হরেন্দ্রদার প্রীতিকর সান্নিধ্য থেকেও।
এ-রকম বঞ্চনার ব্যথা নিয়ে শেষ পর্যন্ত নেত্রকোনা ছাড়তেই হলাে। ভর্তি হলাম বেখৈরহাটি হাইস্কুলে। আমাদের গ্রাম থেকে তিন মাইল পশ্চিমে। শহরের ঐতিহ্যবাহী ইস্কুল থেকে একেবারে অজ পাড়াগাঁয়ের নতুন স্কুলে। যে স্কুল, বলতে গেলে, ভালােভাবে গড়েই ওঠেনি এখনাে। স্কুলের ঘরগুলাের চেহারা তাে কুঁড়েঘরের মতােই। লাইব্রেরি বলতে একটা ভাঙা আলমারি। আগে এটি ছিল ‘মাইনর স্কুল’—অর্থাৎ ক্লাস সিক্স পর্যন্ত এখানে পড়ানাে হতাে। এখন রাতারাতি একে হাইস্কুল বানিয়ে ফেলা হলেও হাইস্কুল হওয়ার মতাে কোনাে উপাদান-উপকরণই এর নেই। স্কুলের জন্য গ্রাজুয়েট শিক্ষক পাওয়া দুরূহ। আজ একজন মাস্টার আসেন তাে এক সপ্তাহ বা এক মাস পরই বিদায় নেন। ব্যাপক সংখ্যায় শিক্ষিত হিন্দুরা দেশ ছেড়ে চলে গেছেন ও যাচ্ছেন। মাস্টারির চেয়ে ভালাে চাকুরি শিক্ষিত মুসলমানের জন্য তখন দুর্লভ নয়। কাজেই তারা কেন গাঁয়ের ইস্কুলে মাস্টারি করতে আসবেন?
পাকিস্তানের জন্মের পরপরই এখানে-ওখানে নতুন নতুন ইস্কুল-কলেজ খােলার ধুম পড়ে যায়। নতুন রাষ্ট্রে অনেক শিক্ষিত কর্মচারীর প্রয়ােজন। হিন্দু কর্মচারীদের প্রায় সবাই ‘অপশন’ দিয়ে ভারতে চলে গেছেন, তার বদলে ভারত-থেকে-আসা মুসলমান কর্মচারীর সংখ্যা খুবই নগণ্য। রাষ্ট্রের চাহিদার তুলনায় শিক্ষিত জনশক্তির সরবরাহ পর্যাপ্ত নয়। তাই চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ভারসাম্য আনার প্রয়ােজন পড়ে যায়, নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার তাগিদ দেখা দেয়। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য অপরিহার্য যে শিক্ষক, তারই তাে একান্ত অভাব। এ-কারণেই সাতচল্লিশ সালের পর অন্তত এক দশক কাল গ্রামাঞ্চলের স্কুলগুলাের ছিল অত্যন্ত করুণ অবস্থা।
তিন মাইল পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে যাওয়া-আসা করি বটে, কিন্তু সাত পিরিয়ডের মধ্যে অনেক দিনই তিন পিরিয়ডের বেশি ক্লাস হয় না। ডিসিপ্লিন’ বলতে প্রায় কিছুই নেই। চন্দ্রনাথ হাইস্কুলে পড়ার সময় ভালাে ছাত্র হওয়ার যে-উৎসাহ আমার ভেতর সঞ্চারিত হয়েছিল, সেউৎসাহ একেবারেই উবে গেলাে। রহমান সাহেবের বিজ্ঞান ও বারি সাহেবের ইংরেজির ক্লাস দুটো ভালােই লাগতাে। এই দু’জন কৃতী শিক্ষকই ছিলেন আন্ডার গ্রাজুয়েট। খুবই অল্প দিনের জন্য এসেছিলেন আবদুল হামিদ নামক একজন গ্রাজুয়েট শিক্ষক। তাঁর পাঠদান-রীতিও বেশ আকর্ষণীয়ই ছিল। তবু চন্দ্রনাথ স্কুলের সঙ্গে তুলনা করে বেখৈরহাটি স্কুলটিকে ভালােবাসা খুব
১১৬
কঠিন হয়ে উঠেছিল আমার পক্ষে। এক বছর আগে পাঠ্য বইয়ের প্রতি যে-অনুরাগটি জন্মাতে শুরু করেছিল, সেটি বেড়ে ওঠার কোনাে অনুকূল পরিবেশ না পেয়ে আস্তে আস্তে মরে গেলাে। আবার আমি পাঠ্যবই-বিরূপ হয়ে গেলাম। (সে-বিরূপতা আর ইহজন্মে ঘুচলাে না।) অক্ষরজ্ঞান-দানের সঙ্গে সঙ্গে বাপ-ঠাকুর্দা আমাকে যে নেশাটি ধরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই নেশাটিই বরং এখন আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরলাে। অর্থাৎ পাঠ্য বইয়ের বদলে ‘অপাঠ্য বই-ই বেশি করে আমার মনােযােগ কেড়ে নিতে লাগলাে। বসুমতী সাহিত্য-মন্দির’-প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্র, সঞ্জীবচন্দ্র, মধুসূদন, গিরিশচন্দ্র, দীনবন্ধু, ক্ষিরােদ প্রসাদ প্রমুখ ঔপন্যাসিক কবিনাট্যকারদের গ্রন্থাবলি থেকে শুরু করে প্রবাসী, ভারতবর্ষ, বসুমতী ইত্যাদি মাসিক পত্রের পুরনাে সংখ্যা—এ-সবই হয়ে উঠলাে আমার দিনরাতের সাথী। পরিপার্শ্বের বিরূপতার হাত থেকে এগুলােই আমাকে সেদিন রক্ষা করেছিল। তবে, স্কুলের একটি পাঠ্যবিষয় অবিশ্যি সেসময় আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল। সেটি সংস্কৃত ভাষা। বেখৈরহাটি হাইস্কুলের শিক্ষক ধীরেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্যের চমক্কার পাঠদান-কুশলতাই সংস্কৃত ভাষা শিক্ষায় আমাকে বিশেষ উৎসাহী করে তােলে। যদিও এরপর খুব ভালােভাবে সংস্কৃতচর্চার সুযােগ আর কোনাে দিনই পাইনি, তবু মাত্র একবছর ধীরেন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয়ের কাছে যেটুকু সংস্কৃত পড়েছিলাম সেটুকুই আমার অকিঞ্চিত্বর সারস্বতচর্চাকে নানাভাবে সহায়তা করে আসছে।
যা হােক, এক নিরানন্দ পরিবেশে টিমে তেতলা লয়ে উনিশ শাে উনপঞ্চাশ সালটা তাে কেটে গেলাে কোনাে রকমে। ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠলাম। এইটে উঠেই, উনিশ শাে পঞ্চাশের প্রায় শুরুতেই, আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলাে। হেতু: পঞ্চাশের সেই ভয়াবহ দাঙ্গা।
না, আমার এলাকায় উনিশ শাে পঞ্চাশেও দাঙ্গা হয়নি। তবু ছেচল্লিশে যেমন দাঙ্গা না হলেও একটা দাঙ্গা দাঙ্গা ভাব বিরাজ করছিল সারাদেশ জুড়ে; এবারও তেমনটিই দেখা দিল। ছেচল্লিশের চেয়ে বরং এবারের পরিস্থিতি ভিন্নতর ও গুরুতর। ছেচল্লিশে তাে কেবল দাঙ্গা হয়েছিল নােয়াখালিতে, আর এবার সারা দেশেরই এখানে-ওখানে। তা ছাড়া ছেচল্লিশে নােয়াখালির দাঙ্গার পর সারা দেশেই সংখ্যালঘুরাও দাঙ্গা মােকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আর এবার? মােকাবেলার কোনাে প্রস্তুতি নয়, প্রতিকার বা প্রতিরােধের কোনাে চিন্তাও নয়। প্রস্তুতি কেবল এক বিষয়ের। দেশত্যাগের। চিন্তা কেবল দেশত্যাগ-জনিত অনিশ্চয়তার।
বিভিন্ন এলাকা থেকে রক্ত হিম করা সব খবর আসছিল। সবচেয়ে বেশি আলােচিত ছিল ভৈরবের দাঙ্গা। মেঘনা নদীর ভৈরব সেতুর ওপর ট্রেন থামিয়ে গুণ্ডারা নাকি যাত্রীদের বলেছিল, সব হিন্দুরা দাঁড়াও একদিকে, মুসলমানরা অন্যদিকে। তারপর একেকটি হিন্দুকে ছুরি মেরে ট্রেন থেকে নদীতে ছুঁড়ে ফেলছিল। মুসলমানের সারিতে দাঁড়িয়েছিল যারা তারা মুসলমান কিনা তার পরীক্ষা নেয়া হচ্ছিল কলেমা জিজ্ঞেস করে। কলেমার পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের মধ্যেও যাদের মুসলমান সম্পর্কে ওরা সন্দেহমুক্ত হতে পারছিল না, লুঙ্গি খুলে তাদের মুসলমানত্বের ‘ফাইনাল পরীক্ষা দিতে হয়েছিল। এতাে সব পরীক্ষার পরও কিন্তু অনেক মুসলমান তাদের মুসলমান প্রমাণ করতে পারেনি, তাই প্রাণেও বাঁচেনি। আবার অনেক হিন্দুও দিব্যি মুসলমানত্বের ছাড়পত্র পেয়ে সশরীরে বেঁচে গিয়েছে।
এ-সব অম্লমধুর খবরের সত্যাসত্য যাচাই করার কোনাে সুযােগ ছিল না। তবু সত্য আর অসত্য যা-ই হােক, এগুলােই সেই উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগের দিনগুলােতে আমাদের জন্য ছিল হাস্যরসের উপাদান।
১১৭
সে-সময় আমাদের পােস্ট অফিসে ‘অর্ধসাপ্তাহিক আনন্দবাজার ও দৈনিক আজাদ এই দুটো পত্রিকাই আসতাে। দুটো পত্রিকাতেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও নির্যাতনের খবর ছাপা হতাে। কিন্তু আনন্দবাজারে যা লেখা হতাে আজাদে থাকতাে তার বিপরীত কথা। আনন্দবাজার খুললেই চোখে পড়ে পাকিস্তানে হিন্দু নির্যাতনের লােমহর্ষক খবর, আর আজাদ পড়লে মনে হবে ভারতের মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে আর মােটেই দেরি নেই। আনন্দবাজার বলতাে: সেকুলার ভারতে মুসলমানরা পূর্ণ নিরাপত্তার সঙ্গে বাস করে, আর মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের হিন্দুদের জীবন দুর্বিষহ। আজাদ বলতাে: মুসলিম রাষ্ট্রে সংখ্যালঘুরা পবিত্র আমানত, হিন্দুস্থানে মুসলমানদের ওপর চরম নির্যাতন সত্ত্বেও পাকিস্তানের মুসলমানরা এখানকার হিন্দুদের জানমালের হেফাজত করে যাচ্ছে।
রামপুর পােস্ট অফিসে, অর্থাৎ গয়ানাথ সরকারের বাড়িতে, পঞ্চাশ সালেও আগের মতােই পত্রিকা পাঠের আসর বসতাে। এ-আসরের পাঠকদের এখন দু’টি দল। আনন্দবাজারপন্থীরা হিন্দু, আজাদপন্থীরা মুসলমান। আনন্দবাজারে যা লেখা হয় হিন্দুদের কাছে তার প্রতিটি শব্দই অকাট্য সত্য। মুসলমান পাঠকদের দৃষ্টিতে সব সত্যের একমাত্র ধারক হচ্ছে আজাদ। আনন্দবাজার আর আজাদ দুয়েরই খবরের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলতাে, দুয়েরই খবর পরিবেশনায় ও সম্পাদকীয় মন্তব্যে বাড়াবাড়ি আছে বলে মনে করতাে—এমন পাঠকও অবিশ্যি ছিল দু’একজন। তবে জাতে তারা হিন্দু বা মুসলমান যা-ই হােক, সকলের কাছেই তারা ধিকৃত। তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল পাকিস্তানের সব চেয়ে সেরা ও মােক্ষম গালিটিক্যুনিস্ট।

‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’ ও বহিঃরাষ্ট্রীয় আনুগত্য
উনিশ শো পঞ্চাশ সালের দাঙ্গায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে ভারতবর্ষ বিভক্ত হলেই এ-উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে যারা বাগ্‌বিস্তার করতাে তারা ছিল কতাে ভ্রান্ত। না, ভ্রান্ত বলা বােধ হয় ঠিক হবে না। কেউ কেউ ভ্রান্তিতে আক্রান্ত হলেও দেশবিভাগের মূল হােতারা ভ্রান্ত ছিল না, ছিল মতলববাজ। একটি ক্ষুদ্র গােষ্ঠীর মতলব সাধনের জন্যই ধর্মের নামে একটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করা হয়েছিল। ভারত রাষ্ট্রের স্থপতিরা অবিশ্যি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থারই প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন, রাষ্ট্রীয় সংবিধানেও তাঁদের সেই আকাক্ষারই প্রতিফলন ঘটেছিল। কিন্তু বাস্তবে সেই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতিষ্ঠা পদে পদেই বাধা পেয়েছে। প্রতিবেশী পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকশ্রেণী প্রতিনিয়ত যে ধর্মীয় জিগির উচ্চারণ করেছে তাতে ভারতের সাম্প্রদায়িক শক্তিরই সুবিধা হয়েছে। ওরা বলতে পেরেছে: ‘ভারতমাতার অঙ্গচ্ছেদ করে মুসলমানরা ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান বানিয়েছে, তাই এখন ভারতকেও অবশ্যই হিন্দুরাষ্ট্র হতে হবে। মুসলমানরা ভারতে থাকতে চাইলে তাদের থাকতে হবে ভারতীয় হয়ে। ভারতীয়’ বলতে ওরা যা বুঝিয়েছে তা আসলে হিন্দু ছাড়া আর কিছুই না। ভারতীয় হিন্দু-সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের এ-ধরনের প্রচার প্রােপাগাণ্ডায় ভারত রাষ্ট্রের সাংবিধানিক চরিত্রের পরিবর্তন না হলেও সেখানকার সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্য মানসিক যন্ত্রণার কারণ হয়েছে নিশ্চয়ই। অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের হিন্দুদের যন্ত্রণায় তাে কেবলই নতুন নতুন মাত্রার সংযােগ ঘটেছে। ভারতে মুসলিম-নিগ্রহের নানা বাস্তব ও কল্পিত
১১৮
কাহিনীর অবিরাম প্রচারের মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল শাসকরা দেশের মুসলমানদের উত্তেজিত ও হিন্দুদের ভীত করে রাখতে চেয়েছে।
এ-সব থেকে বােঝা যায় : সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা অপর সম্প্রদায়ের মানুষদের তাে নির্যাতন করেই, তারা আপন সম্প্রদায়েরও কোনাে কল্যাণে আসে না। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে তাে বরং ওদের ভূমিকা স্ব-সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষদের জন্যই সমূহ বিপদ ডেকে নিয়ে আসে। বিশেষ করে ভারতবর্ষ যখন ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্রে বিভক্ত হলাে তখন ভারতীয় হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের আচরণ পাকিস্তানি হিন্দুদেরই জীবন বিপন্ন করেছে, পাকিস্তানি মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা ভারতীয় মুসলিমদেরই দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। ভিন দেশের স্বসম্প্রদায়ের মানুষদের জন্য তাদের অশ্রুপাত তাে কুম্ভীরাশ্রু ছাড়া আর কিছু নয়। যদি তা না হতাে তবে ভারত ও পাকিস্তানের হিন্দু ও মুসলমান সাম্প্রদায়িকতাবাদীরা নিজ নিজ দেশের ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্যাতন করার বদলে তাদের প্রতি সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দিতাে। এতে দুদেশেই তাদের আপন আপন সম্প্রদায়ের মানুষরা শান্তিতে থাকতে পারতাে, কাউকেই কোনাে দেশেই সাম্প্রদায়িক নির্যাতন সইতে হতাে না।
কিন্তু বাস্তবে তাে তেমনটি হয়নি। কারণ, কোনাে দেশের সাম্প্রদায়িকতাবাদীরাই অপর দেশে তাদের স্ব-সম্প্রদায়ের মানুষের ভালােমন্দের কথা ভাবে না। সাম্প্রদায়িক স্বার্থের কথা ওরা মুখে বলে বটে, কিন্তু আসলে স্ব-সম্প্রদায়ের প্রতিও ওদের কোনাে প্রীতি নেই। সাম্প্রদায়িকতার মানে হতে পারে অপর সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ, আপন সম্প্রদায়ের প্রতি প্রীতি মােটেই নয়। তাই, সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধানের বদলে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশবিভাগ বরং দু’রাষ্ট্রেরই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ‘নিজ বাসভূমে পরবাসী’ বানিয়ে ফেললাে চিরকালের জন্য। দু’রাষ্ট্রেই তারা হলাে বলির পাঠা । দু’রাষ্ট্রেই তারা দেশপ্রেমহীনতা ও বহিঃরাষ্ট্রীয় আনুগত্যের দায়ে অভিযুক্ত। ভারতে যদি দাঙ্গা লাগে তাে সেখানকার শাসকশ্রেণীর লােকেরা এটিকে বলে পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্বাভাবিক ও অপরিহার্য প্রতিক্রিয়া। আর পাকিস্তানে কোনাে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা সহজে তাে এখানকার শাসকরা স্বীকারই করে না, যদি-বা করে তবে ভারতীয় শাসকদের পদাঙ্ক অনুসরণেই তারাও এটিকে ভারতে মুসলিম-বিরােধী দাঙ্গার ‘স্বাভাবিক ও অপরিহার্য প্রতিক্রিয়া’ বলে আখ্যায়িত করে। অবিশ্যি কে যে কার পদাঙ্ক অনুসরণকারী বলা শক্ত, দুদেশের শাসকরাই বােধ হয় এ ব্যাপারে পরস্পরের গুরু ও শিষ্য একের ভেতর দুই। আসলে উভয় রাষ্ট্রের কর্তৃত্বশীল গােষ্ঠী নিজেদের নানা অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে নাগরিকদের দৃষ্টি ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে দেয়ার জন্য নানা ধরনের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সৃষ্টি করে। এ-অবস্থাটা লক্ষ করেই ভারতের বিশিষ্ট অভিনেতা ও বামপন্থী বুদ্ধিজীবী প্রয়াত উৎপল দত্ত একবার বলেছিলেন : ভারতে মুসলিম নিধন ও পাকিস্তানে হিন্দু নিধন। দু’দেশের বুর্জোয়াদের অলিখিত চুক্তির বলেই সংঘটিত হয়। কথাটাকে যে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না, তার প্রমাণ আমরা বহুবারই পেয়েছি। যখনই পাকিস্তানের রেডিও কিংবা পত্রপত্রিকায় খবর এসেছে যে ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগেছে—অর্থাৎ হিন্দুরা মুসলমানদের ধরে ধরে মারছে—তখনই আমাদের—মানে পাকিস্তানি হিন্দুদের জিভের জল শুকিয়ে গেছে। ভেবে নিয়েছি, এই তাে স্বাভাবিক ও অপরিহার্য প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেলাে বলে। হিন্দুস্থানে যারা মুসলমানদের মেরেছে তারা হিন্দু, আমরাও হিন্দু। কাজেই হিন্দুর অপরাধের শাস্তি
১১৯
আমাদের পেতেই হবে। এবং পেতে হয়েছেও। পঞ্চাশের পর এখানে-ওখানে ছােট খাটো দাঙ্গা তাে হয়েছেই, বড়াে ধরনের দাঙ্গা হয়েছে বাষট্টি আর চৌষট্টিতে।
এখানে বলে নেয়া দরকার : বাংলাভাষায় দাঙ্গা হাঙ্গামা’ বলতে যা বােঝায়, পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাগুলাের চরিত্র কখনাে সেরকম ছিল না। দাঙ্গা হাঙ্গামায় দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গােষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত হয়, সব পক্ষের লােকই কম বেশি আহত ও নিহত হয়, কোনাে এক পক্ষই পড়ে পড়ে মার খায় না। পাকিস্তানে এ-রকম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা কোনাে দিনই হয়নি। এখানে এক সম্প্রদায়ের মানুষ কেবলই মার খেয়েছে, উল্টো মার দেয়ার চিন্তাও করেনি, এমন কি আত্মরক্ষার চেষ্টাও খুব কমই করেছে।
অবিশ্যি এক ধরনের ব্যতিক্রম দেখা দিয়েছে উনিশ শো চৌষট্টি সালের দাঙ্গায়। পূর্ব বাংলার সচেতন মানুষ সে-দাঙ্গা প্রতিরােধে এগিয়ে এসেছে, দাঙ্গাকারীদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে আমীর হােসেন চৌধুরীর মতাে মহাপ্রাণ ব্যক্তি অকুতােভয়ে আত্মাহুতি দিয়েছেন। সার্থকভাবে সে-দাঙ্গাকে মােকাবেলা করে নবজাগ্রত বাঙালিরা পাক শাসকদের মতলববাজিকে ব্যর্থ করে দিয়েছে, এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের নতুন শক্তির উন্মােচন ঘটিয়েছে। কিন্তু সেপ্রসঙ্গ পরে আসবে। আমি আপাতত উনিশ শো পঞ্চাশের কথাই স্মরণ করছি।
পঞ্চাশের দাঙ্গার সময় থেকেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে, হিন্দুস্থানের সাম্প্রদায়িকতাবাদী কিংবা দাঙ্গাবাজ হিন্দুদের সকল অপকর্মের দায় পাকিস্তানি হিন্দুদের বহন করতে হবে। সব সময় তাদের সামনে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে উচ্চারিত বা অনুচ্চারিত এ-রকম প্রশ্নের খড়গ: হিন্দুস্থানে হিন্দুরা মুসলমানের মসজিদ ভেঙেছে, তাই পাকিস্তানের হিন্দুদের মন্দির অক্ষত থাকবে কেন? পাকিস্তানে হিন্দুদের বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে : হিন্দুস্থানে মুসলমান নারী নির্যাতিতা হচ্ছে, মুসলমানদের সম্পত্তি লুণ্ঠিত হচ্ছে, তারা চাকরি পায় না, নিরাপদে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারে না। এ-সব কথা স্মরণ করিয়ে দেয়ার পরই পাকিস্তানি হিন্দুদের প্রতি নিক্ষিপ্ত হয় প্রশ্নবাণ : তা হলে পাকিস্তানের হিন্দু নারীর ওপর কেন নির্যাতন হবে না, হিন্দুদের সম্পত্তি কেন লুণ্ঠিত হবে না, তাদের জীবন কেন নিরাপদ থাকবে, তারা কেন এদেশের চাকরিতে দখল নেবে ও নিরাপদে ব্যবসা বাণিজ্য করবে? প্রশ্নগুলাে যারা উত্থাপন করেন তারাই আবার বরাভয়ও প্রদান করেন। না, না, এ-রকম কিছুই এদেশে হবে না, হিন্দুস্থানে মুসলমানদের ওপর যতাে অত্যাচারই হােক, পাকিস্তানের সংখ্যালঘুরা এখানে নিরাপদই থাকবে, তারা যে পবিত্র আমানত। কিন্তু পাকিস্তানের হিন্দুদের তাে দেশপ্রেমিক হতে হবে, মনে প্রাণে তাদের পাকিস্তানি হতে হবে। অথচ আফসােস, হিন্দুরা পাকিস্তানকে নিজেদের দেশ বলেই মনে করে না, হিন্দুস্থানে বৃষ্টি হলে ওরা এখানে ছাতা ধরে, এখানে ভাত খেয়ে হিন্দুস্থানে গিয়ে কুলকুচা করে, এখানকার টাকা হিন্দুস্থানে পাচার করে, ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়ে হিন্দুস্থানে পাঠিয়ে দেয়। ওরা যেহেতু এ-রকম দেশপ্রেমবর্জিত, সেহেতু…।
অর্থাৎ ভারতের হিন্দুমহাসভা কিংবা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ-পন্থীরা ও-দেশের মুসলমানদের সম্পর্কে যে-ভাষা প্রয়ােগ করে, এদেশের হিন্দুদের সম্পর্কে পাকিস্তানের শাসকদল মুসলিম লীগ আর তাদের চেলাচামুণ্ডাদের ভাষাও অবিকল সে-রকমই। উভয় দেশের সাম্প্রদায়িকতাবাদী মতলববাজরা নিজ নিজ দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সব সময়ই দেশপ্রেমহীনতার অপবাদ দেয়। অথচ, একবারও ভাবতে চায় না যে : পাকিস্তানের মুসলমানদের হিন্দু নির্যাতনের জন্য যদি দণ্ড ভােগ করতে হয় ভারতের মুসলমানদের, এবং তারপর তাদের উপদেশ দেয়া হয় মনে প্রাণে ভারতীয় হয়ে যাওয়ার এবং সে-ভারতীয়ত্ব
১২০
স্বরূপত হয় হিন্দুত্বের সঙ্গে অভিন্ন—তা হলে কোনাে মুসলমানই ভারতীয় হয়ে থাকতে পারে না। ঠিক একই রকম অবস্থায় একজন হিন্দু কী করে হয় দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি?
তবু, ভারতে হিন্দু মহাসভাপন্থীরা যা-ই বলুক, আর যে-রকম উগ্র সাম্প্রদায়িক আচরণই করুক, সে-দেশের রাষ্ট্রীয় সংবিধান তাে ধর্মনিরপেক্ষ। এই ধর্মনিরপেক্ষতা নিতান্ত কাগুজেও যদি হয়ে থাকে তাহলেও সে-দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য তা একটি বড়াে ধরনের রক্ষাকবচ ও মানসিক শক্তির উৎস। ধর্মীয় রাষ্ট্র-বলে-ঘঘাষিত পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের জন্য তাে সে-রকম একটি কাগুজে রক্ষাকবচও নেই। দেশকে ভালােবাসার শক্তিটা তারা পাবে কোথায়?
তবু, আমরা তাে জানি: ধর্মনিরপেক্ষতার মতাে একটি সাংবিধানিক রক্ষাকবচ ও শক্তির উৎস থাকা সত্ত্বেও ভারতের অনেক মুসলমানকে সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের শিকার হয়ে বাস্তুহারা হতে হয়, পাকিস্তানে এসে আশ্রয় নিতে হয়। এদের মধ্যে উত্তর প্রদেশ আর বিহারের মুসলমানদেরই সংখ্যাধিক্য। পাকিস্তানে এসে এদের সবারই পরিচিতি হয় ‘বিহারি’ নামে। শুধু যে হিন্দুসাম্প্রদায়িকতার নির্যাতনের শিকার হয়েই এই বিহারিদের দেশত্যাগী হতে হয়, তা নয়। পাকিস্তানের অপদর্শনের দ্বারাও তারা প্রতারিত হয়েছে। জিন্নাহ সাহেবের মুসলিম লীগ যে-পাকিস্তান কায়েমের জন্য আন্দোলন করেছে, বিহারি মুসলমানদের তাতে কোনাে স্বার্থই ছিল না। কারণ, সঙ্গত কারণেই বিহার কিংবা উত্তরপ্রদেশ যে কখনাে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হবে না—সে-কথা তাে সবাই জানতাে। তারপরও ওই বিহারিদের ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর জোশে প্ররােচিত করা হয়েছে, তাদের হাত দিয়ে অনেক সাম্প্রদায়িক অপকর্ম করানাে হয়েছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ভারতরাষ্ট্রে তাই, স্বাভাবিকভাবেই, এরা অনেকেই বাধ্য হয়েছে স্বদেশ ছেড়ে পাকিস্তানে পাড়ি জমাতে। পাকিস্তানে, বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব বাংলায়, এসে তারা অন্য ধরনের প্ররােচনা ও প্রতারণার শিকার হয়েছে। এখানকার বাঙালিদের থেকে তারা স্বতন্ত্র ও উৎকৃষ্ট, তারাই আসল রাজার জাত,—নানাভাবে তাদের মাথায় ঢােকানাে হয়েছে এ-রকম নানা বিভ্রম। সে-বিভ্রমে আক্রান্ত হওয়ার ফলেই, ওই বিহারিদের একটি গােষ্ঠীই, পঞ্চাশ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী বছরগুলােতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিয়েছে প্রধান ভূমিকা। এক পর্যায়ে যে হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ছাড়িয়ে পূর্ববাংলায় বাঙালি-বিহারি দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠেছিল, তা-ও ওই পাকিস্তানি প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের ষড়যন্ত্রেরই পরিণতি। সেই ষড়যন্ত্রই তাদের জন্য করুণতর পরিণতি নিয়ে এলাে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর। পাকিস্তানি সামরিক চক্র বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে বাঁচলাে, বিহারিদের দিকে ফিরেও তাকালাে না, তাদেরকে নিক্ষিপ্ত করে গেলাে মানবেতর জীবনের আঁস্তাকুড়ে। অথচ বিহারিদের অধিকাংশই হলাে নিরপরাধ ও সৎ শ্রমজীবী মানুষ, পাকিস্তানি অপদর্শন সৃষ্ট পরিস্থিতির শিকার হয়েই তারা আজ শিকড়হীন ও ভবিষ্যৎহীন।
আমাদের এলাকায় কোনাে বিহারি ছিল না। তবু দাঙ্গার খবর পেলেই সবাইকে বিহারিআতঙ্কে পেয়ে বসতাে। কে একজন হয়তাে বললাে, অমুক বাজারে সে সেদিন দু’জন বিহারিকে ঘােরাফেরা করতে দেখে এসেছে। অমনি সারা গায়ে রায়টের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যে যেভাবে পারে পলায়নের পথ বা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে লেগে যায়।
রায়ট হােক বা না হােক, রায়টের ভয়ে যাদের সারাক্ষণ এ-রকম তটস্থ হয়ে থাকতে হয়, মানসিক ভারসাম্য তাদের বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। হিন্দুস্থানের হিন্দুদের দ্বারা সে-দেশের মুসলমান-নির্যাতনের স্বাভাবিক ও অপরিহার্য প্রতিক্রিয়া’র শিকার হয় যখন পাকিস্তানের
১২১
হিন্দুরা, তখন তারা হিন্দুস্থানমুখী না হয়ে কী করে? পাকিস্তানের হিন্দুরা, তাই, পরিণামে হিন্দুস্থানমুখীই হয়ে যায়। হিন্দুস্থানের হিন্দুর অপকর্মের দায় যদি প্রতিনিয়ত পাকিস্তানের হিন্দুদের ওপরই বর্তে, অন্তত সবসময় ওই খোটাই তাদের শুনতে হয়, তবে পাকিস্তানের বদলে হিন্দুস্থানের ভালোেমন্দের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে ফেলা ছাড়া আর কীই-বা তারা করতে পারে? এ-রকম অবস্থায় বহিঃরাষ্ট্রীয় আনুগত্যের অভিযােগ নীরবে হজম করা ছাড়া কোনাে বিকল্প থাকে কি তাদের?
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এ-রকম বহিঃরাষ্ট্রীয় আনুগত্য আরাে অনিবার্য করে তােলে পঞ্চাশ সালেরই একটি বিশেষ ঘটনা। সেটি নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তি। দাঙ্গার ফলে সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি যখন দুদেশের শাসকদেরই অতিমাত্রায় ব্ৰিত ও বিপর্যস্ত করে ফেলে, তখন তারা শান্তির খোজে বৈঠকে বসে। সেই বৈঠকের ফল নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকৎ আলী খান স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে আসলে কী ছিল তা কেউই খুটিয়ে দেখতে চায়নি। তবে সে-চুক্তির একটি ভুতুড়ে ভাষ্য’ সর্বত্র মুখে মুখে প্রচারিত ও গৃহীত হয়ে গিয়েছিল, এবং সত্যমিথ্যা যাচাই না করে তা বেশ জনপ্রিয়ও হয়ে গিয়েছিল। সে ভাষ্যটি অনেকটা এরকম: এ-চুক্তি স্বাক্ষরের পর যদি পাকিস্তানের কোনাে হিন্দুর ওপর নির্যাতন চলে, তবে ভারত সরকার পাকিস্তান সরকারের ওপর তার জন্য কৈফিয়ৎ তলব করবে। পাকিস্তান সরকার তার কৈফিয়ৎ দিতে বাধ্য থাকবে। ভারতে কোনাে মুসলিমবিরােধী ঘটনা ঘটলে পাকিস্তানেরও অধিকার থাকবে ভারত সরকারকে চুক্তিভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত করার।
ভারতের কথা জানি না, তবে পাকিস্তানের অনেক হিন্দুকে তাে নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তির এ-রকম ভাষ্যের মধ্যেই বাঁচার অবলম্বন খুঁজতে দেখেছি। যে-কোনাে রকম সাম্প্রদায়িক ঘটনা ঘটলেই গ্রামগঞ্জের অনেক হিন্দুকে বলতে শুনেছি: ঠিক আছে, খবর দিয়ে দাও ইন্ডিয়ান হাই কমিশনারকে, তাহলে বুঝবে ব্যাটারা কতাে ধানে কত চাল!
নিজ বাসভূমে পরবাসীদের পক্ষে নানা রকম বিভ্রমে পড়ে এ-রকম বহিঃরাষ্ট্রীয় আনুগত্যের আশ্রয় নিয়ে বাঁচতে চাওয়াকে অস্বাভাবিকই-বা বলি কী করে?

পঞ্চাশের দাঙ্গার পরে
উনিশ শাে পঞ্চাশ সালের দাঙ্গা এবং তারপরই নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তি, এদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার একটি স্থায়ী চরিত্র নির্ধারণ করে দিল। পশ্চিম পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাব ও ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান লােক বিনিময় করা হয়েছিল। এতে সমস্যার এক ধরনের সমাধান হয়তাে হয়েছিল। যদি পাঞ্জাবের মতাে সারা পাকিস্তানের হিন্দুদের ভারতে এবং ভারতের মুসলমানদের পাকিস্তানে হিজরত করার ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয়ভাবে করা হতাে, তা হলেই কি উপমহাদেশের সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হয়ে যেতাে? যেতাে না নিশ্চয়ই, তবে সেব্যবস্থাটি যে অন্তত ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হতাে,—এ-কথা মানতেই হবে। জিন্নাহ সাহেবরা অবিভক্ত ভারতের মুসলমানদের ‘তাহজিব-তমদ্দুন’ রক্ষার জন্য পাকিস্তানের জন্ম দিলেন। খুবই ভালাে কথা! কিন্তু খণ্ডিত ভারত রাষ্ট্রে যে-মুসলমানদের তারা রেখে এলেন, তাদের কথা কী ভাবলেন? ওই বিপুল সংখ্যক মুসলমানের কি তাহজিব-তমদ্দুন
১২২
রক্ষার কোনাে প্রয়ােজন নেই? তাহজিব-তমদ্দুন তাে পরের কথা, মুসলমানদের জন্য আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হওয়ার পর ভারতে অবস্থানরত মুসলমানদের জীবন-জীবিকাই যে হুমকির মুখে পড়তে পারে, সে-চিন্তাই কি তারা করেছিলেন?
ভারতের শাসকরা যদিও নিজেদের দেশকে ভারতই বলতাে, পাকিস্তানের প্রচারমাধ্যমে কিন্তু সবসময়ই ওই দেশটিকে বলা হতাে হিন্দুস্থান। এর উদ্দেশ্যটা স্পষ্ট। অর্থাৎ পাকিস্তানের প্রবক্তারা তাদের দ্বিজাতিতত্ত্বের দর্শনের সত্যতা প্রমাণ করার জন্যই চাইতাে যে, পাকিস্তান যেমন মুসলিম রাষ্ট্র তেমনি ভারতও হােক হিন্দুস্থান বা হিন্দুরাষ্ট্র।
ভারতের অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদীরা এ-রকমটি যে চাইতেন না, তা ঠিক। তাঁরা হয়তাে মনে প্রাণেই একটি সেকুলার ভারত প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যে-বিধর্মী হিন্দুরা রয়ে গেলাে মুসলিম ধর্মীয় রাষ্ট্র পাকিস্তানে, তারা যে সেখানে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার নির্যাতনের শিকার হবে স্বাভাবিকভাবেই—সে-বিষয়ে কি ধর্মনিরপেক্ষ ভারতরাষ্ট্রের প্রবক্তারা আদৌ সচেতন ছিলেন? পাকিস্তানে বসবাসরত হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক নির্যাতনের ছুতাে ধরেই যে হিন্দু মৌলবাদীরা ভারতে ধর্মনিরপেক্ষতার অনুশীলনকে ব্যর্থ করে দেবে,—এ-কথাও কি তারা জানতেন না?
এ-প্রশ্ন উঠতাে না। ওঠে এ-কারণে যে, পাকিস্তান সৃষ্টির দায় বা কৃতিত্ব তাে কেবল জিন্নাহ সাহেবদের ওপরই বর্তায় না। কারণ শেষ পর্যন্ত নেহেরু মহাশয়দের স্বীকৃতির ভিত্তিতেই তাে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়েছে। জিন্নাহ-নেহেরুদের আপােসরফার ফলই পাকিস্তানের অভ্যুদয় বা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার প্রতিক্রিয়াশীল ভাবাদর জয়লাভ। এ-রকম একটি নীতিবর্জিত আপােস যখন তারা করলেনই, তখন তারা দু’রাষ্ট্রের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু মুসলমান অধিবাসীদের বিনিময় করে সে-আপােসরফাকে সম্পূর্ণতা দিলেন না কেন? তবে কি দু’রাষ্ট্রের নেতারাই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পণবন্দি করে রাখতে চেয়েছিলেন? চেয়েছিলেন কি এক রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের রক্ষার জন্য আরেক রাষ্ট্রের সংখ্যালঘুদের ঢাল হিসেবে খাড়া করে রাখতে? আর লােক-বিনিময়ের নীতি যদি তাঁদের নাই থাকবে তাে পূর্ব পাঞ্জাব-পশ্চিম পাঞ্জাবের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে লােকবিনিময়কে অনুমােদন করলেন কেন?
এ-সব প্রশ্নের জবাব পাকিস্তান বা ভারতের রাষ্ট্রবিধায়করা সেদিনও দেননি, আজো দেন । দেয়া প্রয়ােজন মনে করেন না। কিন্তু দু’দেশেরই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মনে এ প্রশ্নগুলাে সব সময় কাটার মতাে বেঁধে।
সিন্ধু এলাকায় কিছু সংখ্যক হিন্দু থেকে গেলেও পাঞ্জাবের লােক বিনিময়ের ফলে পশ্চিম পাকিস্তান প্রায় হিন্দুশূন্যই হয়ে যায়। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে থেকে-যাওয়া হিন্দুরা সংখ্যায় লঘু হলেও তাদের গুরুত্বকে খাটো করে দেখতে পারে না কেউই। সেই গুরুত্বই সমস্যাকে গুরুতর করে তােলে। আর সে-কারণেই পাকিস্তানের দুই অংশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি দু’রকম হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানের বিষয়টি আমার প্রত্যক্ষ দর্শনের মধ্যে পড়ে না, তাই সে নিয়ে কিছু বলছি না। বলছি কেবল পাকিস্তানের পূর্ব অংশের কথাই।
এখানে হিন্দুরা সংখ্যালঘু, কিন্তু এই সংখ্যালঘুদের সংখ্যাটা একেবারে লঘু নয়। পঞ্চাশ সালে হয়তাে দেড় কোটি বা তার কাছাকাছি হিন্দু এদেশে ছিল। পূর্ব পাকিস্তানের চেয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত আয়তনের এমন বহু দেশ আছে যে-দেশের সমগ্র জনসংখ্যাই এখানকার সংখ্যালঘুদের চেয়ে অনেক অনেক কম।
১২৩
এই বিপুল সংখ্যক মানুষ যে কেবল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক কারণেই স্বাভাবিক মানবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল, জ্ঞানপাপী ছাড়া কে সে কথা অস্বীকার করবে?
যে-এলাকা নিয়ে পাকিস্তানের পূর্ব অংশ গঠিত হয়েছিল সে-এলাকায় হিন্দুরা আগে থেকেই সংখ্যায় লঘু, কিন্তু প্রতিপত্তিতে ছিল গুরু। আমার গাঁয়ের দশ-বিশ মাইলের মধ্যেই তাে আমি দেখেছি বর্ধিষ্ণু গ্রামগুলাের প্রায় সবই হিন্দু-অধ্যুষিত। আশুজিয়া, নওপাড়া, কাটিহালি, বাড়রি—সবগুলাে গ্রামই ব্রাহ্মণ-প্রধান। ওই ব্রাহ্মণদের প্রায় সবাই তালুকদার কেউ ছােট, কেউ বড়াে। কিন্তু মর্যাদায় তাঁরা কেউই খাটো নন। হিন্দুর বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ বলে হিন্দুদের কাছেই শুধু তাঁরা মান্য নন, আশপাশের গ্রামের অধিকাংশ মুসলমানেরই তাঁরা মনিব । সেই মুসলমানদের প্রায় সবাই মেহনতি কৃষক, কৃষকরূপে ওই ব্রাহ্মণ জোতদার তালুকদারের অনুগ্রহের প্রত্যাশী। জোতদার-তালুকদারদের ওপরের স্তরে যাদের অবস্থান, তখনকার পূর্ব ময়মনসিংহে সেই জমিদারদের বাড়ি ছিল মূলত গৌরীপুর, কালীপুর, কৃষ্ণপুর, গােলকপুর ও রামগােপালপুরে। এই গ্রামগুলাের অবস্থান প্রায় পাশাপাশি, রামগােপালপুর কিছুটা দূরে। গৌরীপুরকে অবিশ্যি গ্রাম বলা যাবে না, রেলস্টেশনের পাশে এটি একটি ছােট্ট শহর। অনেক আগে থেকেই এখানে পৌরসভা (মিউনিসিপ্যালিটি) আছে।
গৌরীপুর থেকে মাইল বিশেক দূরে আঠারােবাড়ির জমিদাররা ছিলেন জাতে কায়স্থ। এছাড়া পূর্ব ময়মনসিংহের প্রধান প্রধান জমিদারদের প্রায় সবাই ব্রাহ্মণ। ময়মনসিংহের অন্য অঞ্চলে কেবল শেরপুরের জমিদাররা ছিলেন বৈদ্য। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য হিন্দুসমাজের এই তথাকথিত উঁচু জাতের লােক ছাড়া অন্য জাতের মধ্যে জমিদার-তালুকদারের সংখ্যা ছিল খুবই কম।
কিশােরগঞ্জের হয়বত্নগর, বৌলাই বা জঙ্গলবাড়ির মুসলমান জমিদাররা ঐতিহ্যবাহী হলেও আয়ের বিচারে তাঁরা ছিলেন হিন্দু জমিদারদের অনেক পেছনে। সেকালের ময়মনসিংহে কেবল টাঙ্গাইলেই বেশি আয়ের মুসলমান জমিদার ছিলেন।
কোনাে কোনাে জমিদার-সন্তান হাইকোর্টের ব্যারিস্টারি কিংবা কোনাে উচ্চ রাজকর্মে নিযুক্ত থাকলেও, সাধারণভাবে জমিদাররা ছিলেন জমির খাজনাভােগী মাত্র—অন্য কোনাে উপজীবিকা তাদের ছিল না। তবে খুব ছােট জমিদার কিংবা তালুকদারদের অনেকেরই ছিল সুদে টাকা খাটানাের মহাজনী কারবার। অর্থাৎ একই সঙ্গে তারা সামন্ততান্ত্রিক ও ধনতান্ত্রিক শােষণের প্রতিভূ। এই শােষণই এঁদের সচ্ছলতার উৎস। এই সচ্ছলতাই আবার এঁদের সন্তানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলেছে, বাঙালি এলিট গােষ্ঠীটি গড়ে উঠেছে মূলত ওই তালুকদার-জোতদার কাম মহাজনদের ভেতর থেকেই। এঁরাই উকিল-মােক্তার-ডাক্তারমাস্টার হয়েছেন, কেরানি-পেস্কার-তহসিলদার হয়েছেন, জজ-ম্যাজিস্ট্রেটের মতাে উচ্চপদস্থ সরকারি চাকুরেও হয়েছেন এঁরাই। এবং বলা হয়তাে নিষ্প্রয়ােজনই, তবু আগেও বলেছি এবং এখনাে বলছি, এঁদের সংখ্যাগুরু অংশই এসেছেন দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অর্থাৎ হিন্দু সমাজ থেকে। সংখ্যালঘুদের প্রতিপত্তির গুরুত্বটা এ থেকেই বােঝা যায়।
শুধু জমিদার-তালুকদার-জোতদার-মহাজনের মতাে শােষক কিংবা উকিল থেকে ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত এলিট হওয়ার মধ্যেই সংখ্যালঘু হিন্দুদের গুরুত্ব সীমাবদ্ধ ছিল না। বিভিন্ন বৃত্তিজীবী গােষ্ঠীরও উদ্ভব ঘটেছে মূলত হিন্দু সম্প্রদায় থেকেই। গ্রামীণ কুটির শিল্পের সিংহভাগ তাে ছিল এদেরই হাতে। কামার, কুমার, কাঁসারি, কাঠমিস্ত্রি, স্বর্ণকার, গােয়ালা, মাদক, তেলী,
১২৪
তাঁতী—এ-রকম বৃত্তিজীবীরা তাে হিন্দুসম্প্রদায়ের একেকটা জাতই তৈরি করে নিয়েছিল। পানচাষ ছিল হিন্দু বারুইদের জীবিকা। ধােপা, নাপিত, জেলে, পাটনি, মালী—এগুলােও হিন্দুদেরই বৃত্তিজীবী জাত। সাহা, কুণ্ডু, বণিক, বসাকরা দখল করে রেখেছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের এলাকা।
ইসলামে কোনাে জাতপাতের বিধান না থাকলেও মাছধরা বা ঘানি ঘুরিয়ে সরষের তেল বের করা কিংবা তাঁতে কাপড় বােনা এবং এ-রকম আরাে কিছু কিছু পেশা অবলম্বন করে এখানকার মুসরমানদের মধ্যেও কয়েকটি বৃত্তিজীবী জাত গড়ে উঠেছিল বটে। তবু মানতেই হবে : সংখ্যালঘু হিন্দুরাই বৃত্তিজীবীদের মধ্যে পূর্ববাংলায় ছিল সংখ্যাগুরু, এদের ছাড়া দেশের পুরাে অর্থনীতিটাই অচল। বিষয়টি সম্পর্কে পূর্বপাকিস্তানের কর্তৃত্বশীল মুসলমানরাও বেশ সচেতন ছিলেন। তাই উপরের স্তরের সকল হিন্দুরের দেশত্যাগটা তাদের পছন্দসই হলেও, তারা চাইতেন না যে বৃত্তিজীবী হিন্দুরা বিপুলসংখ্যায় দেশ ছেড়ে চলে যাক। পঞ্চাশ সালের দাঙ্গা ও নেহেরু-লিয়াকৎ চুক্তির পর কিছুদিন পাকিস্তানের কর্তাব্যক্তিরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা ভড়ং দেখাতাে। নানা জায়গায় সভাটভা করে খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলতাে। একান্ন সালের ফেব্রুয়ারি কি মার্চ মাসে এ-রকমই একটি সভা হয়েছিল আমাদের গ্রামের দু’মাইল দক্ষিণে বসুর বাজারে। সে-সভায় একজন মৌলবি সাহেবের বক্তৃতা শুনছিলাম। সুরেলা কণ্ঠে একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে তিনি বলছিলেন, ভাইসব, এদেশ থেকে সব হিন্দুরা চলে গেলে আমরা সুখে থাকতে পারবাে না। যদি কামাররা চলে যায় তবে আমরা দা-কুড়াল কোথায় পাবাে, যদি কুমাররা চলে যায় তবে আমরা হাঁড়ি-পাতিল কোথায় পাবাে, যদি কাঠমিস্ত্রিরা চলে যায় তবে আমরা লাঙ্গল-জোয়াল কোথায় পাবাে, যদি…।’
মুসলমানদের সংখ্যাগুরুত্ব ছিল কৃষিতে। যদিও আমার হাতে কোনাে নির্ভরযােগ্য সংখ্যাতত্ত্ব নেই, তবু সঙ্গতভাবেই অনুমান করতে পারি যে, এদেশের কৃষিজীবীদের শতকরা আশি জনেরও বেশি মুসলমান। এবং এদের মধ্যেও প্রধান অংশটি অতি সামান্য পরিমাণ জমির মালিকের কিংবা একেবারে ভূমিহীন কৃষকের। এরাই ভাগচাষী, ক্ষেতমজুর, দিনমজুর বা কামলা। এ-ধরনের জীবিকার জন্য এরা, স্বাভাবিক ভাবেই, হিন্দু জোতদার-তালুকদারমহাজনদের ওপর নির্ভরশীল।
কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর গ্রামের নবসৃষ্ট মুসলিম এলিটদের একটা গােষ্ঠী মুসলিম স্বাতন্ত্র ও শ্রেষ্ঠত্ববােধের এমন প্রকাশ ঘটাতে চাইলাে যাকে স্বাভাবিক বলে মেনে নেয়া শক্ত। হিন্দুদের খাওয়া-দাওয়ায় ছোঁয়াছুয়ির বিধি নিষেধের কথা সবাই জানে। সাম্যবাদী ইসলাম ধর্মে তাে এসব থাকার কথা নয়। কিন্তু এখন বলা হলাে : হিন্দু বাড়িতে কোনাে মুসলমান যদি ভাত খায়। তবে সে অবশ্যই গুনাহগার হবে। একদিন রামপুর বাজারে, দেখলাম একজন মৌলবি সাহেব ওয়াজ করছেন : হিন্দু মেয়েরা হাতে শাঁখা পরে; ওরা যখন নদী বা পুকুর থেকে কলসীতে পানি ভরে নেয় তখন ওই পানিতে ওদের হাতের শাখা ডুবে যায়। শাখা-ধােয়া পানি খাওয়া হারাম। ভাই মুসলমান, এ-কথা সব সময় মনে রাখবেন।
মুসলমান জোতদার বা বড়াে কৃষক বা এলিটরা এ কথা অবশ্যই মনে রাখতে পারেন। কিন্তু মুসলমান কামলা বা ক্ষেতমজুরের পক্ষে তা মনে রাখা তাে রীতিমত আত্মঘাতী ব্যাপার। বাবুর বাড়িতে যে কামলা দেয় সে তাে তার খাবারটা ওখানেই খেয়ে আসে। তাতে যে সাশ্রয়টা হতাে, নয়া ফতােয়া তা থেকে তাকে বঞ্চিত করলাে। তাই আমাদের গ্রামের দস্তর
১২৫
আলী, যে সারা বছর কামিনী চক্রবর্তীর বাড়িতে কাজ করে তিন বেলা খাবার পেতে এবং মাইনেও পেতাে, তার অবস্থা হলাে কাহিল। চক্রবর্তী বাড়িতে ভাত খায় বলে সে সবসময় তার জাত ভাইদের ধমক খায়। কামিনী বাবুর ছেলে গােপাল সে-সময় ময়মনসিংহ শহরের মৃত্যুঞ্জয় হাইস্কুলে পড়তাে। রমজানের ছুটির পর সে বাড়ি থেকে ময়মনসিহে ফিরে যাচ্ছিল। দস্তর আলী তার পেছনে পেছনে চলছিল বইখাতা আর বিছানাপত্রের মােট বয়ে নিয়ে। মদনপুরে যেতেই কয়েকজন লােক তাকে আটকালাে।
এই ব্যাটা, আজও হিন্দুদের মােট বয়ে নিয়ে যাস, লজ্জা করে না তাের?…মােট নামা মাথা থেকে।
ধমক খেয়ে দস্তর আলী মাথার মােট ফেলে দিয়ে রাস্তায় ধপ্ করে বসে পড়লাে। অনেক লােক জমে গেলাে। আরাে অনেকক্ষণ ধরে ধমক ধামক চললাে। ধমকটা শুধু দস্তর আলীকে নয়, গােপালকেও।
সেদিন সকলকে অনেক বলে কয়ে জনতার হাত থেকে গােপাল রক্ষা পেয়েছিল এবং দস্তর আলীও আবার মােট তুলে নিয়ে নেত্রকোনা রেলস্টেশন পর্যন্ত পৌছিয়ে দিয়ে এসেছিল বটে। কিন্তু এরপর আর গােপাল কোনােদিন দস্তর আলীকে দিয়ে মােট বইয়ে নিতে সাহস পায়নি।
দস্তর আলীদের তাতে কী লাভ হয়েছিল?
না, একেবারে যারা নিঃস্ব তাদের কারাে তেমন কোনাে লাভ হয়নি, তবে একটু যাদের ভালাে অবস্থা আগে থেকেই ছিল তাদের অনেকেরই লাভ হয়েছিল বৈকি। তারা বাস্তুত্যাগী হিন্দুদের জমি-জিরাতে জলের দামে কিংবা বিনা দামে দখল নিতে পেরেছিল। পঞ্চাশের দাঙ্গার পর গ্রামের এ-রকম অনেকেরই অবস্থা ফিরে গিয়েছিল। ছনের ঘর থেকে টিনের ঘরে, টিনের ঘর থেকে দালানে অনেকেরই স্থানান্তর ঘটেছিল। এবং কামিনী বাবুদের বদলে এ-রকম নতুন সচ্ছল কোনে মিঞা বাড়িতে দস্তর আলীদের চাকরির ব্যবস্থা হয়েছিল। তারা গুনাহর ভাত খাওয়া থেকে রেহাই পেয়েছিল।
কাজেই, উনিশ শাে আটচল্লিশ সালে উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মদাতা নিজেই এ রাষ্ট্রটির যে মৃত্যুবীজ রােপণ করেছিলেন, সে-বীজটির চারা সে-সময়ই খুব বেশি বেড়ে উঠতে পারেনি। তার জন্য আরাে কিছু সময় লেগেছিল।

‘মানুষ থুইয়া খােদা ভজ, এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে?”
ক্লাস এইটে ওঠার পর মাত্র কয়েকদিনই বেখৈরহাটি হাইস্কুলে যাতায়াত করেছিলাম। তারপর ফেব্রুয়ারিতেই সেই পঞ্চাশ সালের দাঙ্গা। আমাদেরও স্কুলে যাওয়া বন্ধ । আমাদের মানে সংস্কৃত নামওয়ালা অর্থাৎ হিন্দু ছাত্রদের । আমি ছাড়া এদের প্রায় সবাই স্কুলও ছাড়লাে, দেশও ছাড়লাে। সুরেন্দ্র-দেবেন্দ্র দুই যমজ ভাই আমার সঙ্গে পড়তাে। তারা বােধ হয় মার্চ মাসেই ভারতের কুচবিহারে পাড়ি জমালাে। সুরেন্দ্র আর কোনাে দিন দেশে ফিরে আসেনি। বহুদিন পর দেবেন্দ্রর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। দাড়িগোঁফওয়ালা গেরুয়াপরা এক সন্ন্যাসী হঠাৎ একদিন আমার ময়মনসিংহের আস্তানায় এসে জিজ্ঞেস করে, “কি হে যতীন, কেমন আছ?…চিনতে পারছে না তাে?…তােমার বন্ধু দেবেন্দ্রর কথা মনে আছে?
১২৬
কোন্ দেবেন্দ্র, কোন্ দেবেন্দ্র? স্মৃতির পাতা হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ সন্ধান পেয়ে গেলাম। সেই নিরীহ ছেলেটি তাে! যমজ ভাই হলেও দেবেন্দ্র সুরেন্দ্রর একেবারে বিপরীত। সুরেন্দ্র স্মার্ট, দেবেন্দ্র গােবেচারা। সুরেন্দ্র সবার সঙ্গে হৈ চৈ করে, মুখচোরা দেবেন্দ্র ক্লাসে এক কোণে একা একা বসে থাকে। সেই দেবেন্দ্র আমার সামনে। সে এখন সন্ন্যাসী বেশে ফিরে দেশে দেশে হইয়া সাধুর শিষ্য। নামও আর তার দেবেন্দ্র নেই। প্রথমে স্বামী’, তারপর কী একটা গালভরা শব্দ এবং সে-শব্দটির শেষে ‘আনন্দ। এবং সবশেষে ব্রহ্মচারী। উনিশ শো উনপঞ্চাশ সালের বেখৈরহাটি হাইস্কুলের ক্লাস সেভেনের সেই মুখচোরা ছাত্রটি তার পিতৃদত্ত নাম পরিত্যাগ করে আজ-স্বামী ‘অমুক’ আনন্দ ব্রহ্মচারী। জীবনে কোনাে নারীর স্বামী হয়নি, কিন্তু নামের আগে স্বামী’ টা খুব শক্ত করে বসিয়ে নিয়েছে, এবং নামটি শুনেই বােঝা যায় সে সে খুব আনন্দেই আছে। আমাদের মতাে ক্ষুদ্র ও নিরানন্দ সংসারে তার বিচরণ নয়, সে এখন ব্রহ্মচারী ব্রহ্মে বিচরণকারী।
তার মুখেই সুরেন্দ্রর কথা শুনলাম। পুত্র-কন্যা নিয়ে সুরেন্দ্র কুচবিহারেই থাকে। ব্যবসাবাণিজ্য করে সে মােটামুটি অর্থবান। দেবেন্দ্রর মতাে অর্থকে অনর্থ জ্ঞান করে সুরেন্দ্র পরমার্থের সন্ধানে সংসার ছেড়ে বেরিয়ে পড়েনি।
স্কুল ছাড়ার প্রায় চল্লিশ বছর পরে, স্বাধীন বাংলাদেশে, সুরেন্দ্র-দেবেন্দ্রর খবর এভাবে পেয়ে গিয়েছিলাম। এরা ছাড়া বেখৈরহাটি হাইস্কুলে ক্লাস সেভেনে আর যে-সব হিন্দু ছাত্র আমার সহপাঠী ছিল তারা যে কে কোথায় ছিটকে পড়েছে তার কিছুই জানি না। বাংলাদেশে বােধ হয় এখন আর একজনও নেই। কোথায় আছে বীরেন্দ্র কুমুদ? সুশীল? মােহন? কানু?
মনে পড়ে বিধান কৃষ্ণ দাসের কথা। বাংলা থেকে সংস্কৃত অনুবাদের কায়দা শেখাতে গিয়ে আমাদের ক্লাসে একদিন পণ্ডিত মশাই বলছিলেন, ‘সংস্কৃত শব্দের জন্য বালিকে কখনাে হাতড়ে ফিরতে হয় না। কারণ বাংলা ভাষাতেই প্রয়ােজনীয় সংস্কৃত শব্দটি পাওয়া যায়। আমরা বলিহাতী, সাপ, বাঘ, কাজ, বাজ, চামড়া। কিন্তু শুদ্ধ বাংলায় হস্তী, সর্প, ব্যাঘ্র, কার্য, বজ্র, চর্ম। এগুলােই সংস্কৃত। অর্থাৎ শুদ্ধ বাংলা শব্দটাই সংস্কৃত।
পণ্ডিত মশাই খাটি বাংলা শব্দকে অশুদ্ধ বিবেচনা করতেন কিনা জানি না। তবে সেদিন তিনি সংস্কৃতের কথা বলতে গিয়ে বারবার ‘শুদ্ধ’ কথাটা ব্যবহার করেছিলেন।
হঠাৎ বিধানকৃষ্ণ একেবারে লাফ দিয়ে উঠলাে। “ইউরেকা’র ভঙ্গিতে হাত তালি দিয়ে বলে ফেললাে, বাঃ কী মজা! সংস্কৃত শিখে ফেলেছি। শুদ্ধ বাংলা শব্দটাই সংস্কৃত। সব শুদ্ধ বাংলা শব্দই তাে জানি। কাজেই সংস্কৃত ভাষা তাে খুবই সােজা।
তার কথা শুনে আমরা সবাই হেসে ফেলেছিলাম। পণ্ডিত মশাইও। কিন্তু এরপর তিনি যখন সংস্কৃত শব্দরূপ, ধাতুরূপ ও লিঙ্গনির্ণয়ের জটিলতার কথা বেশ গম্ভীরভাবে বলতে লাগলেন তখন বিধানের মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেলাে। আমাদের মুখও শুকিয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়ই। তবু বিধানের ‘সংস্কৃত শিখে ফেলেছি’ কথার সূত্র ধরে ওকে আমরা বেশ ক’দিন খুব ক্ষেপালাম। ও যতাে ক্ষেপতাে, আমরা ততাে মজা পেতাম।
সেই বিধানের কথা ভেবে আমি প্রায়ই স্মৃতিতাড়িত হয়ে যাই। তার স্মৃতির অনুষঙ্গেই সেদিনের অনেক কথা মনে এসে ভীড় করে।
বেখৈরহাটি হাইস্কুলে আমার একজন ‘পাতানাে বন্ধু ছিল। বন্ধু পাতানাের ব্যাপারটা বােধ হয় এ-যুগের শহুরে ছেলেদের আমি বােঝাতে পারবাে না। গ্রামের ছেলেরাও বুঝবে কিনা জানি
১২৭
না। আজকাল পাতানাে খেলা’ বলে একটা কথা শুনি। এই পাতানাে খেলা যে মােটেই প্রকৃত খেলা নয়, খেলার ভড়ং মাত্র—এতাে সবাই জানে। তাই পাতানাে বন্ধুত্বও যে এ-রকম একটা কপট ব্যাপারই হবে—এ-ধারণা হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
কিন্তু, না। বন্ধু পাতানাের ব্যাপারটা মােটেই ভড়ং বা কপট কিছু ছিল না। বন্ধুত্বকে একটা অনুষ্ঠানের ভেতর দিয়ে জীবন্ত ও পাকাপােক্ত করে তােলার নামই ছিল বন্ধুপাতানাে। ছেলেদের মতাে মেয়েরাও এ-ভাবেই সই পাততাে। এই বন্ধু বা সই পাতানােতে কোনাে সাম্প্রদায়িক বিবেচনা ঠাই পেতাে না। অনেক রক্ষণশীল হিন্দু আর মুসলমান পরিবারের ছেলেমেয়েরাও অনায়াসেই পরস্পরের বন্ধু বা সই হয়ে যেতাে। পরস্পরের বন্ধুত্ব বা সখিত্বকে চিরকাল অটুট রাখার শপথ গ্রহণ, পরিজনদের নিয়ে খাওয়া-দাওয়া ও নানা আমােদ-আহ্লাদ— এ-সবই ছিল বন্ধু পাতানাে বা সই পাতানাের অনুষ্ঠানের অঙ্গ। এটি লােকায়ত বাংলার একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান।
এ-ধরনের অনুষ্ঠান করেই আমি আর আমার সহপাঠী নীরেন্দ্র কিশাের কর পরস্পরের বন্ধু হয়েছিলাম। আমার সেই বন্ধুও দেশত্যাগী হলাে। বেশ কিছুদিন পশ্চিমবঙ্গের আলিপুর দুয়ার থেকে তার চিঠি আসতাে। আমিও লিখতাম। তারপর আস্তে আস্তে পত্র যােগাযােগ বন্ধ হয়ে যায়।
শুধু বন্ধু-বান্ধবদের কথাই-বা বলি কেন, রক্তের সম্পর্কে বাধা যে-সব আত্মীয়-স্বজন দেশ ছেড়ে চলে যায় তাদের সঙ্গেও যােগাযােগ ক্রমে শিথিল হয়ে আসে। আমার দুই মামাই মারা গেছেন, মাসিমাদেরও কেউ বেঁচে নেই। তাঁদের ছেলেমেয়েদের কেউ আসামে, কেউ কুচবিহারে, কেউ পূর্ণিয়ায়, কেউ বেনারসে। কিন্তু কে কেমন আছে, কী করছে, তার কোন খোঁজই রাখি না। আমার যে জ্ঞাতিভাইরা পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই কুচবিহারে চলে গিয়েছিল, দেশে তাে আমরা তাদের সঙ্গে একই বাড়িতে প্রায় একান্নভুক্ত হয়েই ছিলাম। তাদেরও কোনাে খবর জানি না বহুদিন ধরে। আমার ছেলেমেয়েদের তাে তাদের সম্পর্কে কোনাে ধারণা পর্যন্ত নেই।
এ-সবই পাকিস্তানের অবদান। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়েও সে-অবদানের অপচ্ছায়া দূর হয়নি, বিস্তৃততর হয়েছে বরং।
পঞ্চাশ সালে দাঙ্গা যখন চলছিল এখানে-ওখানে, সে-সময়ই একদিন বেখৈরহাটি বাজারে নােয়াখালিবাসী এক গ্রাম্য কবি কবিতার বই বিক্রি করছিলেন। ক্রেতা আকর্ষণ করছিলেন টিনের চোঙে মুখ লাগিয়ে সুর সহযােগে তাঁর বইয়ের কবিতা আবৃত্তি করে। আট পৃষ্ঠার কবিতার বইটির দাম মাত্র দু’আনা। মানুষ হামলে পড়ে বইটি কিনছিল। সে-বইয়ের কবিতার প্রতিটি পংক্তি হিন্দুস্থানের মুসলিম-বিরােধী দাঙ্গার কাল্পনিক ও উত্তেজক বিবরণে ঠাসা। সারা কবিতা জুড়ে সাম্প্ৰয়িক বিদ্বেষের আগুন। কবি সে-আগুন ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন তার কবিতার শ্রোতা ও ক্রেতাদের চোখেমুখেও। না, সব শ্রোতা ও ক্রেতার চোখেমুখে নয়। কেবল আরবি নামধারীদের। তারা অনেকেই কবির ভাবে ভাবিত হয়ে উত্তেজনায় ফেটে পড়েছিল ঠিকই, কিন্তু সংস্কৃতনামধারী মানুষগুলাের চোখ মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল ভীতি আর আতঙ্কে।
আমাদের গায়ের গয়ানাথ চক্রবর্তী ও শচীন্দ্র দে হাটে হাটে ঘুরে ক্রিমির ওষুধ, দাদের মলম ও হজমি দাওয়াই বিক্রি করতেন। তারাও সেদিন বেখৈরহাটি বাজার থেকে ওই কবিতার
১২৮
বইটি কিনে এনেছিলেন। গ্রামে তাঁদের প্রতিবেশীরা (অবশ্যই হিন্দু প্রতিবেশীরা) যখন বইয়ের কবিতা পড়লাে বা শুনলাে তখন তাদের চোখে মুখেও আতঙ্কের ছাপ পড়ে গিয়েছিল।
পাকিস্তানের জন্মলগ্নে, সাতচল্লিশ সালে, মুক্তাগাছার গাবতলি বাজারে পল্লীকবি ইউনুস আলীর ‘পাকিস্তানের কবিতা শুনে আমার কিশাের মন আনন্দের আবেশে টইটুম্বুর হয়ে পড়েছিল। অথচ তারই বিপরীত অনুভূতির সঞ্চার করলাে মাত্র তিন বছর পরে, পঞ্চাশ সালে, নােয়াখালির গ্রাম্য কবির কবিতা। ইউনুস আলী আবহমান বাঙালির সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চিত্র কী মনােরম ভঙ্গিতেই-না তুলে ধরেছিলেন। ইউনুস আলী চেয়েছিলেন: পাকিস্তানে ‘হিন্দুমুসলিম মিলে মিশে থাকতে যেন পাই’। আর নােয়াখালির কবি নেত্রকোনার বেখৈরহাটি বাজারে এসে যে-কবিতা পরিবেশন করলেন তার ধ্রুবপদ ছিল—চিলুমচি আর দস্তরখানা সকল জাতে চিনে না। কলাপাতার দুই পিঠেতে দুই জাতির খানা।
ইউনুস আলী আনন্দে আপ্লুত হয়েছিলেন ফজর আলী আর ঠাকুরদাসের (অর্থাৎ মুসলমান আর হিন্দুর ) ‘এক উঠাইন্যা বাড়ি’ দেখে। এবং কামনা করেছিলেন: দেশের সকল ফজর আলী আর ঠাকুরদাসরাই যেন এ-রকম এক উঠাইন্যা বাড়িতে (অর্থাৎ অভিন্ন উঠানে বা প্রাঙ্গণে বাড়ি তুলে) পরম সম্প্রীতির সঙ্গে বসবাস করে। আর নােয়াখালির ওই গ্রাম্য কবির প্রত্যয়: হিন্দু আর মুসলমানে কখনাে ঐক্য ছিল না, কখনাে ঐক্য হতে পারে না। চিলুমচি আর দস্তরখানা যে-জাতের লােকেরা চেনে না, সেই হিন্দুদের থেকে আলাদা হয়ে থাকার মধ্যেই আছে মুসলমানের মঙ্গল। সে-রকম আলাদা থাকার জন্যই তাে মুসলমানরা পাকিস্তানের সৃষ্টি করেছে।
এক কবির কবিতা দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষকে প্রীতি প্রেমের পুণ্য বাঁধনে মেলাতে চায়, আরেক কবির কবিতার প্রতিটি ছত্র দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা-বিদ্বেষের দেয়াল তুলে দেয়। অথচ, দুজনই তারা লােকায়ত পল্লী বাংলার কবি। তবু কেন দুয়ের মধ্যে এমন বৈপরীত্য?
এ-প্রশ্নের জবাব লােকসাহিত্য-সংস্কৃতির অ্যাকাডেমিক গবেষকরা দিলেও দিতে পারেন। তবে অ্যাকাডেমিক যান্ত্রিকতার মধ্যে প্রশ্নটির সঠিক জবাব পাওয়া সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।
সারা জীবন ধরে আমি প্রশ্নটিকে নিয়ে নাড়াচাড়া করেছি। এবং তার ফলে সঠিক, সন্তোষজনক, সর্বজনগ্রাহ্য ও নিঃসংশয় জবাব পেয়ে গেছি—এমন কথা অবশ্যই বলবাে না। সবিনয়ে শুধু বলবাে: বহুমাত্রিক লােকসাহিত্য-সংস্কৃতির এমন অনেক মাত্রা আমার অনুভবে ধরা পড়েছে, অ্যাকাডেমিক ফোকলােরচর্চাকারীরা যেগুলােকে খুব একটা বিবেচনার মধ্যে আনেন নি। বাংলার লােকসমাজে সাম্প্রদায়িকতার ঘাতপ্রতিঘাত সে-সমাজের কবিশিল্পীদের কাকে কীভাবে নাড়া দিয়েছে, সে-সবের মর্মগ্ৰাহী বিচার-বিশ্লেষণ প্রায় হয়ই নি বলতে গেলে। যদি হতাে তাহলে আমাদের সমাজ-মানসের পরিচয়টি যেমন আরাে স্বচ্ছ হয়ে উঠতাে, তেমনি পাকিস্তানের জন্মমৃত্যুর প্রচলিত ব্যাখ্যাগুলাের সীমাবদ্ধতাও অনেক পরিমাণে দূর হয়ে যেতাে। শুধু তাই নয়। পাকিস্তান মরে গিয়ে কীভাবে বাঙালির ঘাড়ে ভূত হয়ে চেপে বসতে পারে তারও নিদান সন্ধান হতাে।
পল্লী বাংলার যে-সব কবিকে ভদ্রভাষায় ‘লােককবি’ বলা হয়ে থাকে তাদের অনেকের মধ্যেই আমি সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক ভাবনার দোলাচল লক্ষ করেছি। এ-ও লক্ষ করেছি
১২৯
যে, ধূর্ত মােড়ল মাতব্বর বা প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকদের খপ্পরে পড়ে পল্লীর অনেক সরল প্রাণ কবিশিল্পী প্রায়শই নিজেরা বিভ্রান্ত হন ও অন্যকে বিভ্রান্ত করেন। তাঁরা তাঁদের গানকবিতা পালা বা লােকনাট্যের মধ্য দিয়ে লােকসমাজে সেই বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেন। বিভিন্ন সামাজিক আলােড়ন-আন্দোলনে লােককবি বা শিল্পীরাও আন্দোলিত হন। জাতীয়তাবাদী স্বদেশী আন্দোলন তাঁদের উদ্দীপ্ত করেছে, কমুনিস্টদের জমিদার-মহাজন বিরােধী কৃষক আন্দোলনকেও তারা তাদের সৃষ্টি দিয়ে বেগবান করে তুলেছেন। আবার অন্যদিকে পাকিস্তানআন্দোলনের নেতারাও সাম্প্রদায়িক ভাবনা বিস্তারে তাদেরকে কাজে লাগিয়েছেন।
লােককবিদের ভেতর বস্তুবাদ ও ভাববাদের দ্বন্দ্বও দেখেছি। স্বার্থপরতা ও পরার্থপরতার দ্বন্দ্ব কম দেখিনি। তবে প্রকৃত প্রতিভাবান লােককবি যে এ-সবের দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হতে হতেও সব দুর্বলতা ও সংকীর্ণতাকে জয় করে মানুষের প্রতি বিশ্বাসকেই শক্ত করে আঁকড়ে ধরতে পারেন তার পরিচয় আমি নেত্রকোনা-কিশােরগঞ্জের লােককবিদের মধ্যে পেয়েছি। বিপ্লবী কৃষক কবি নিবারণ পণ্ডিতকে আমি দেখিনি, তবে তাঁর কবিতা তথা গান অনেক পড়েছি ও শুনেছি। প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক ভাবনা তাঁর সৃষ্টিকে কখনাে স্পর্শ করতে পারেনি। পাকিস্তান আমলেও অখিল ঠাকুরের গান শুনেছি। তাঁর গান হিন্দু মুসলমানকে এক সঙ্গে মিলিয়েছে, কোরআন-পুরাণের ঝগড়া ভুলিয়ে দিয়েছে। সব চেয়ে কাছে থেকে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে আমি পেয়েছি পূর্ব ময়মনসিংহের প্রখ্যাত কবি জালাল উদ্দীন খাকে। জালাল খার বাড়ি আমাদের পাশের পল্লী সিংহের গাঁও-এ। উনিশ শাে পঞ্চাশ সাল থেকেই আমি তার স্নেহসান্নিধ্যে ধন্য হয়েছি। তার কাছ থেকে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক ও প্রথাবিরােধী বিদ্রোহী সংস্কৃতির যে-রকম অন্তরঙ্গ পরিচয় পেয়েছি, সে-রকমটি কোনাে সংস্কৃতি-তাত্ত্বিকের বই পড়ে পাইনি। পঞ্চাশ সালে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে অ্যাকাডেমিক শিক্ষা থেকে আমি বঞ্চিত হয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু জালাল খাঁর কাছে পাওয়া লােকায়ত সংস্কৃতির জীবন্ত শিক্ষা আমার মনের দারিদ্র্য দূর করে দিয়েছে। পঞ্চাশ সাল থেকেই আমার অগ্রজপ্রতিম বন্ধু ও গুরু হয়ে যান জালাল খাঁর পুত্র খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম। হাকিম নামের মানুষগুলাে আমাদের নেত্রকোনার প্রাকৃত উচ্চারণে হয়ে যায় হেকিম। এভাবেই জালাল-এর পুত্র হাকিম হয়েছিলেন আমার হেকিম ভাই। হেকম ভাইও কবি ছিলেন। বাউল পিতা জালাল খাঁর উত্তরাধিকার নিয়েই পুত্র খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম হয়েছিলেন আধুনিক কবি। পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শনে তিনিই ছিলেন আমার সবচেয়ে বড়াে সহযােগী। তাই, জালাল খাঁর মতােই হেকিম ভাইয়ের কথাও আমাকে বারবার স্মরণ করতে হবে।
এখন শুধু বলে রাখি: নােয়াখালির গ্রাম্য কবির সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষান্ধ কবিতা আমাকে বিচলিত ও সন্ত্রস্ত করতে পারেনি। পঞ্চাশ সালেই জালাল খাঁর গানের সুর আর কলি আমার পরানের গহন গভীরে জায়গা করে নিয়েছে—বিচার করলে নাই রে বিভেদ কে হিন্দু কে মুসলমান। রক্তমাংস একই বটে, সবার ঘটে একই প্রাণ।
আমি গান গাইতে জানি না, তাই জালাল খাঁর গানের পংক্তি আমি মন্ত্রের মতাে আবৃত্তি করি—মানুষ থুইয়া খােদা ভজ, এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে? মানুষ ভজ কোরআন খোজ, পাতায় পাতায় সাক্ষী আছে।
১৩০
‘বৃথায় তিলক ফোঁটা, পাঁচ ওয়াক্ত মাথা কোটা।
‘আশুজিয়া স্কুল সাদা, ছাত্রগুলি গাধা, বেঞ্চিগুলি সরু, মাস্টারগুলি গােরু। রামপুর প্রাইমারি স্কুলে যখন পড়ি তখন আশুজিয়া হাইস্কুলের ছাত্রদের দেখলেই আমরা সমবেত কণ্ঠে এ রকম ছড়া কাটতাম। রামপুর থেকে আড়াই মাইল পূর্বে আশুজিয়া গ্রাম। সে-গ্রামেরই স্কুলটির নাম ‘জয়নাথ চক্রবর্তী ইনস্টিটিউশন’ সাধারণ্যে তারই পরিচিতি ‘আশুজিয়া স্কুল’ নামে। আশপাশের গ্রামের কিছু ছাত্র রামপুর ইস্কুলের সামনের রাস্তা দিয়েই আশুজিয়া যেতাে। এরাই হতাে আমাদের ছড়ার আক্রমণের শিকার। হাইস্কুলের ছাত্ররা আমাদের চেয়ে বয়সে বড়াে বলেই। হয়তাে বুদ্ধিতেও আমাদের চাইতে পাকা ছিল। তাই তারা আমাদের পাল্টা আক্রমণ করতে না। স্মিত হাসি দিয়ে কিছুটা বরং প্রশ্রয়ই দিতাে। হাসতে হাসতেই কখনাে কখনাে তাদের কেউ আমাদের তাড়া করলে আমরা ভোঁ দৌড় মারতাম, দৌড়ে আমাদের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। দৌড়াতে দৌড়াতেই তাদের স্কুলের নিন্দার পাশাপাশি আমাদের স্কুলের গৌরব ঘােষণা করতাম-রামপুর ইস্কুল কালাে, ছাত্রগুলি ভালাে, বেঞ্চিগুলি তিন ফুট, মাস্টারগুলি ভেরি গুড।
যে আশুজিয়া হাইস্কুলের প্রতি প্রবল নিন্দা বর্ষণ করতাম, আমাকে কিনা সেই স্কুলেরই ছাত্র হতে হলাে উনিশ শো একান্ন সালে। সে-সময়ে স্কুলের পাঠ্যসূচীতে, এবং ম্যাট্রিক পরীক্ষায়, কোনাে একটি ক্লাসিকাল ভাষা (যেমন-আরবি, ফার্সি, সংস্কৃত বা পালি) ছিল অবশ্য পাঠ্য। ধীরেন্দ্র ভট্টাচার্য মহাশয় দেশত্যাগ করার পর বেখৈরহাটি হাইস্কুলে আর কোনাে সংস্কৃত শিক্ষক না থাকায় সে-ইস্কুলে পড়া আর আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। পঞ্চাশ সালে সারা বছর ক্লাস কামাই করে, একান্ন সালের গােড়ায় বেখৈরহাটি হাইস্কুল ছেড়ে আশুজিয়া হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। ক্লাস এইটের পড়া না-পড়েই নাইনের ছাত্র। নেত্রকোনা শহরের চন্দ্রনাথ হাইস্কুল ছাড়ার পর থেকেই ভালাে ছাত্র হওয়ার ইচ্ছা ও চেষ্টা চিরতরে পরিত্যাগ করেছিলাম। পরিত্যাগ না-করলেই-বা কী হতাে! ভালাে ছাত্র হওয়ার কোনাে সুযােগই আর আমার জন্য আসে নি। কেবল ভালাে স্কুলই যে পাইনি, তা নয়। স্কুলের বই-খাতার জোগানও পাইনি ঠিকমতাে। আমাদের পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা কোনাে দিনই ছিল না, দারিদ্র ছিল নিত্য সাথী। বাবার হােমিওপ্যাথি চিকিৎসার আয় দিয়েই সংসারের যাবতীয় খরচ নির্বাহ করতে হতাে। নন্দীগ্রাম ও দলপা এই দুটি গ্রাম ছিল বাবার চিকিৎসা ব্যবসার মূল এলাকা। হিন্দু-অধ্যুষিত গ্রাম দুটো থেকে ব্যাপক বাস্তুত্যাগের ফলে সে-ব্যবসায়ে দারুণ মন্দা দেখা দেয়, আমাদের সংসারের সচ্ছলতায় আরাে বেশি করে টান পড়ে, এবং স্কুল-জীবনেই আমাকে রােজগারের ধান্ধায় জড়িয়ে পড়তে হয়। তবে, সে-সব কথা এখন থাক। শুধু বলি: পাকিস্তানি যন্ত্রণাই আমার স্কুলজীবনের স্বস্তি কেড়ে নিয়েছিল, পাঠ্যবইয়ে মনােযােগ দেয়ার আবহ ও আগ্রহ থেকেও বঞ্চিত করেছিল। তবু প্রচুর ‘অপাঠ্য বই পড়ার বদৌলতে ভাষার ওপর মােটামুটি দখল এসে যাওয়াতই বােধ হয়, স্কুলের প্রথাগত শিক্ষায় মনােযােগী না হয়েও, পরীক্ষা-বৈতরণী পার হয়ে যেতে কোনাে অসুবিধা হয়নি।
আশুজিয়া হাইস্কুলের আমার তিন বছরের ছাত্রজীবন। একান্ন সালে ক্লাস নাইনে, বায়ান্ন সালে টেনে। সে-হিসেবে তেপ্পান্ন সালের মার্চেই আমার ম্যাট্রিক দেয়ার কথা। কিন্তু বায়ান্ন সালের মার্চ থেকেই এমন দুরারােগ্য পেটের পীড়ায় আক্রান্ত হই, যার দরুন আবার এক বছরের জন্য ঘটে আমার স্কুল-জীবনের বিরতি এরপর তেপ্পান্ন সালে আবার ক্লাস টেনের ছাত্র হয়ে চুয়ান্ন সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিই।
১৩১
আশুজিয়ায় এই তিন বছরের স্কুল-জীবনে আমি অনেক কিছুই পেয়েছি। না, বৈষয়িক কোনাে পাওয়া নয়। তবে যা পেয়েছি তাতে আমার চেতনার পরিপুষ্টি যে ঘটেছে, সে-কথা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারবাে না। পাকিস্তানের জন্মব্যাখ্যার যে তিন তত্ত্ব কংগ্রেসী, মুসলিম লীগার ও বামপন্থীদের মুখে শুনেছি, সেগুলাের অসম্পূর্ণতা আমার কাছে ধরা পড়ে ওই সময়েই।
বাড়ি থেকে আড়াই মাইল হেঁটে স্কুলে গিয়েছি। যেতে হতাে সিংহের গাঁওয়ের জালাল উদ্দীন খাঁর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে। তাতে এই বাউল কবি জালাল খা আর তাঁর পুত্র আধুনিক কবি খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমের (হেকিম ভাই) স্নেহ সান্নিধ্য পাওয়া আমার জন্য খুব সহজ হয়েছে। স্কুল থেকে ফেরার পথে একেক দিন বিকেলে তাঁদের ‘গােলঘর’-এর আড্ডায় বসে গেছি। গােলাকৃতির এই ঘরটিই ছিল সংস্কৃতি ও রাজনীতিরও কর্মকেন্দ্র। এটিই ছিল হেকিম ভাই-প্রতিষ্ঠিত আবেহায়াৎ সাহিত্য মজলিস’-এর অফিস। এখানেই জালাল খাঁ ও তার শাগরেদদের জমজমাট আসর বসতাে। গােলঘরটিতে মঞ্চ তৈরি করেই বছরে অন্তত একবার হতাে নাট্যাভিনয়। শাহজাহান, সিরাজউদ্দৌলা, পলাশীর পরে, টিপু সুলতান, দেবলা দেবী, পথের শেষে, মায়ের দাবি—এ-সব নাটকের মহড়া ও অভিনয় হতাে এই গােলঘরেই। হেকিম ভাই-ই ছিলেন নাটকের পরিচালক ও প্রধান অভিনেতা। আমাকেও তিনি অভিনেতা বানিয়ে ছেড়েছিলেন।
গােলঘরের আড্ডায় সিংহের গাঁও ও তার আশপাশের গায়ের অনেককেই পাওয়া যেতাে। এ-আড্ডায় আলােচনা হতাে না এমন কোনাে বিষয় বােধ হয় জগৎ সংসারে নেই। শরিয়তমারফতের ভেদ নিয়ে শুরু হওয়া কতাবার্তা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক পর্যন্ত গড়াতাে। হিন্দু-মুসলমানের বিবাদ-বিরােধ, আধুনিক সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি, পাটের দর ও গ্রামীণ অর্থনীতি, বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কার, মামলা-মােকাদ্দমা ও গ্রাম্য টাউট, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, ইউনিয়ন বাের্ডের ইলেকশান ও ভিলেজ পলিটিক্স—এ-রকম বিচিত্রবিধ বিষয় সে-আড্ডায় অনায়াসে উঠে আসতাে। শুধু বিষয়ে নয়, বিষয়ের পরিবেশনা ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও থাকতাে বহুমুখী বৈচিত্র্য। অজপাড়া গাঁয়ে স্বল্পশিক্ষিত কতকগুলাে মানুষের সেই আড্ডায় যে-রকম মুক্তবুদ্ধি ও পারস্পরিক সহিষ্ণুতার প্রকাশ দেখেছি, সে-রকমটি শহরে উচ্চশিক্ষিত মানুষদের আসরে কখনাে দেখিনি।
তবে, সিংহের গাঁওয়ে খাঁ বাড়ির গােলঘরের আড়াটি ছিল মূলত মুসলমানদের। মুসলমানের আড্ডা বলেই তাতে পাকিস্তানের শাসক ও শাসন-রীতির সমালােচনা থাকলেও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি সম্পর্কে আড়ার সকলের ছিল একটা আবেগঘন মনােভঙ্গি। সেমনােভঙ্গি থেকেই তাদের কণ্ঠ থেকে ক্ষোভ ঝরে পড়তাে সিংহের গাঁওয়ের একমাইল পূর্বদিককার ব্রাক্ষণ-অধ্যুষিত আশুজিয়া গ্রামটির হিন্দু সমাজপতি ও ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে। কারণ এদের প্রতিপত্তির পেষণেই তাে তারা এতােদিন পিষ্ট হয়েছে, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এ এরাই তাে ছিল তাদের প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী।
অন্যদিকে আশুজিয়া গ্রামটিতে এখানে-ওখানে হিন্দুদের যে-সব ছােটখাটো আড্ডা বসতাে সেগুলাের চরিত্র ছিল খাঁ বাড়ির আড্ডার সম্পূর্ণ বিপরীত। হিন্দুদের কাছে, স্বভাবতই, পাকিস্তান হচ্ছে যন্ত্রণার উৎস। তাই আশুজিয়ার মতাে গ্রামের প্রতাপ-প্রতিপত্তিহারা হিন্দুরা যে তাদের ভীরু আড্ডাগুলােতে ফিসফিস করে পাকিস্তানের মুণ্ডুপাত করবে—তেমনটিই তাে স্বাভাবিক।
১৩২
তাই বলে আশুজিয়া গ্রামের সকল ব্রাহ্মণই অত্যাচারী তালুকদার-ভূস্বামী বা শােষক মহাজন ছিলেন না। গরিব, হৃদয়বান ও শিক্ষিত ব্রাহ্মণও ছিলেন অনেক। এ-রকমই একজন। আশুজিয়া হাইস্কুলে আমার শিক্ষক জয়চন্দ্র রায়। তিনি আমার বাবারও শিক্ষক ছিলেন। আমাকে তাই আদর করে নাতিছাত্র’ বলে ডাকতেন। আশুজিয়া হাইস্কুলের প্রায় গােড়া পত্তনের সময় থেকেই তিনি এখানে মাস্টারী করে এসেছেন। স্কুলটিকে কী ভালােই-না বাসতেন তিনি। বলতে গেলে একেবারে সন্তানের মতাে। গ্রামের স্কুল ঘর। নড়বড়ে খুঁটি, ভাঙ্গা বেড়া। একটু জোরে ঝড়াে বাতাস বয়ে গেলেই ঘরের চাল উড়িয়ে নিয়ে যায়। জয়চন্দ্র বাবুর নিজের ঘরও এ-রকম পলকাই ছিল। তবু নিজের ঘরের নিরাপত্তার কথা যত না ভাবতেন, তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন থাকতেন স্কুল ঘরটির জন্য। ঝড়ের শেষে রাতেই তিনি হারিকেন নিয়ে স্কুল ঘরে চলে যেতেন। ঘরের বেড়া আলগা হয়ে গেলে কিংবা চাল উড়ে গেলে আশপাশের লােক ডেকে রাতেই তা যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিয়ে নিতেন।
সন্ধ্যা-পূজাসহ সব রকম শাস্ত্রীর নিয়ম নিষ্ঠায় জয়চন্দ্র রায় ছিলেন একেবারে খাটি ব্রাহ্মণ। কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রতি দরদে তার অবস্থান ছিল সংকীর্ণ ব্রাহ্মণ্যবাদের অনেক অনেক ঊর্ধ্বে। বিশেষ করে কোনাে শিক্ষক যে ছাত্রকে সত্যিসত্যিই পুত্রতুল্য বিবেচনা করতে পারেন, তার প্রমাণ জয়চন্দ্রবাবুকে দেখেই প্রথম পেয়েছিলাম। আশুজিয়ার ব্রাক্ষণদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার যে-অভিযােগ ছিল, জয়চন্দ্র বাবু ছিলেন তা থেকে সর্বাংশে মুক্ত। সুবিধাবঞ্চিত ও দরিদ্র অব্রাহ্মণ এবং মুসলমান ছাত্রের প্রতি তাঁর স্নেহ ছিল অতিরিক্ত পরিমাণে সক্রিয়। তাঁর সে-সক্রিয়তার প্রমাণ দেয়ার মতাে বহুছাত্র এই শতাব্দী শেষেও জীবিত আছে।
আশুজিয়া ইস্কুলে তখন, পাকিস্তানােত্তর প্রথম দশকে—অন্যান্য গ্রাম্য ইস্কুলের মতােই শিক্ষক সংকট খুবই প্রকট। আজ একজন শিক্ষক আসেন তাে দু’দিন পরই চলে যান। একা জয়চন্দ্র বাবুকেই সব সামাল দিতে হয়। পারেনও তিনি। ইংরেজি, বাংলা, গণিত, ইতিহাস, ভূগােল, সংস্কৃত—সব বিষয়েই তাঁর ছিল সমান দখল … তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বিষয় ছিল ইতিহাস। গল্প বলে বলে ইতিহাসকে তিনি আমাদের সামনে একেবারে জীবন্ত করে তুলতেন। এ-ব্যাপারে সিলেবাসের গণ্ডি তিনি বড়াে একটা মেনে চলতেন না। শুষ্ক আচারসর্বস্ব ধর্মধ্বজীদের বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য ছিল রীতিমত র্যাডিকেল। সম্রাট আকবরের দীন-ই-ইলাহি থেকে নানক-কবির শ্রীচৈতন্যের প্রথাবিরােধী ধর্মচিন্তা পর্যন্ত সবই আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে ছাত্রদের কাছে তুলে ধরতেন। মীরাবাঈয়ের একটি হিন্দি ভজন তিনি প্রায়ই ক্লাসে আবৃত্তি করতেন। যেটির ভাবার্থ হলাে, মীরা বলছেন, দুধ পানে জীবনধারণ করলেই যদি ঈশ্বরকে পাওয়া যেতাে, তা হলে তাে বাছুর গুলিরই ঈশ্বরপ্রাপ্তি ঘটতাে। পাথরের মূর্তি পূজা করলে যদি ঈশ্বর প্রাপ্তি ঘটে তাে আমি পাহাড়কে পূজা করতে রাজি আছি। ছােট্ট একটা তুলসীগাছকে পূজা করলে যদি ঈশ্বর পাওয়া যায় তাে আমি একটা আস্ত জঙ্গলকে পূজা করতে পারি।’ এ-সব নানা দৃষ্টান্তের উল্লেখ করে মীরা বাঈয়ের সব শেষে বক্তব্য : প্রেম ছাড়া কখনাে ঈশ্বর লাভ ঘটে না। (বিনা প্রেম সে নাহি মিলে নন্দলালা)।
প্রেমের কথা বলেই জয়চন্দ্র বাবু বলতেন: এই প্রেম হচ্ছে মানবপ্রেম। মুখে যারা হরদম ঈশ্বরের নাম নেয়, অথচ মানুষকে ভালােবাসে না, তারাই হচ্ছে আসল পাপী। ঈশ্বরের নাম করেই ওরা মানুষকে ঠকায়।
১৩৩
এই ধর্ম-ধ্বজী ঠকদের সম্পর্কে খুব মজার একটা গল্প বলতেন তিনি। ঠিক গল্প নয়, তার নিজের দেখা একটি সত্য ঘটনার বর্ণনা।
আশুজিয়া গ্রামেরই পাশে বসুর বাজারে ছিল এক মহাজন। মালাতিলকধারী মহা সাধু। তিলকের ছাপ দিয়েই কপালে লিখে রাখতে রাধাকৃষ্ণের নাম। মুখে সব সময় কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে। এ-রকম সাধু পুরুষকে কে না ভক্তি করে? তাকে চোরবাটপাড় বলে সন্দেহ করা তাে অসম্ভব। কিন্তু আশুজিয়ারই একজন লােকের একদিন সন্দেহ হলাে যে, ওই সাধু মহাজন ওজনে কম দেয়। ওই মহাজনের নিজের হাতে-মেপে-দেয়া ডাল অন্য দোকানে নিয়ে ওজন করে তার সন্দেহই সত্য প্রমাণিত হলাে। এ-লােকটি ছিল আবার খুবই রসিক। সাধু মহাজনের কাছে গিয়ে খুবই আস্তে বিনয় নম্র মধুর স্বরে সে ডাক দেয়, কাকা, কাকা গাে।
সস্নেহে তার দিকে মুখ ফিরিয়ে মহাজন বলে, “কী রে বাবা, কী বলছিস?”
-বলছিলাম কি, চটপট আপনার কপালের ওই ছাপটা মুছে ফেলুন তাে।
-কপালের ছাপ মুছে ফেলবাে? কী বলছিস তুই?’
-হ্যা, ঠিকই বলছি। আপনার কপালে একটা লাথি দেবাে।
-“এ্যা…’।
-এ্যা করলে চলবে না। কপালের ছাপটা তােমাকে মুছতেই হবে। এবার আর বিনয় বা সম্মান নয়। চিৎকার করে সে বলতে থাকে, হারামজাদা, ভণ্ড, শয়তান। ধার্মিকের ভড়ং দেখা আর ওজনে কম দিয়ে ক্রেতাদের ঠকাস। আবার কপালে লিখে রেখেছিস ভগবানের নাম। মুছে ফেল শিগগির। ভগবানের নামের ওপর লাথিটা দিই কী করে? মুছে ফেল শিগগির ওই নাম।…’
গল্পটা শেষ করেই জয়চন্দ্র বাবু কবিতার একটি লাইন আবৃত্তি করতেন—বৃথায় তিলক ফোটা, পাঁচ ওয়াক্ত মাথা কোটা, ভণ্ডামি ধূর্তামি ওটা নিশ্চয় নিশ্চয়।
এটি কার কবিতা, এর আগের বা পরের লাইনগুলি কী—এ-সব কিছুই জয়চন্দ্র বাবু আমাদের বলেননি।
তবে, আমার মনে হতাে, ‘মানুষ থুইয়া খােদা ভজ, এই মন্ত্রণা কে দিয়াছে?’—জালাল খার এ-ধরনের বিদ্রোহী পংক্তিমালার সঙ্গে জয়চন্দ্র বাবু কথিত কবিতা ও গল্পের একটা সাযুজ্য আছে। ধর্ম নিয়ে পাকিস্তানি ভণ্ডামির সঙ্গে জালাল খাঁ কিংবা জয়চন্দ্র রায়দের কেউই তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না। সামন্ততন্ত্রের অচলায়তন ও তার পাঁচিলের ফাঁকফোকর আমি যখন আশুজিয়া হাই স্কুলের ছাত্র, সেই পঞ্চাশের দশকের শুরুতে, আশুজিয়া গ্রামের তখন পড়তি দশা। সে-গ্রামের ব্রাহ্মণ তালুকদার-জোতদাররা তখন বিষহীন তেঁাড়া। তবে টোড়া সাপও নাকি নিজেকে জাতসাপের বংশধর বলে ভাবে, আর সে-কারণেই জাতসাপের চেয়েও সে ফোঁস করে বেশি, বিষ না থাকলেও তার আছে কুলােপানা চক্কর।
আমি সেই কুলােপানা চক্কর দেখেছি, ফোঁসফোসানিও শুনেছি। এবং এ-সব দেখে শুনে ওদের আগের অবস্থা ও অবস্থানটি আঁচ করতে চেষ্টা করেছি। এ থেকে পাকিস্তানের জন্মব্যাখ্যার একটি সূত্রও পেয়ে গেছি।
১৩৪
আশুজিয়া হাইস্কুলের শিক্ষরাই শুধু নন, সে-গ্রামের অন্য সব বয়ােজ্যেষ্ঠ মানুষেরাও আমাকে খুব স্নেহ করতেন। সে-স্নেহের অন্যতম কারণ আমার প্রয়াত পিতামহের পরিচয়। আমার প্রয়াত পিতামহের (ঠাকুর্দা) কথা নানা সূত্রে প্রায়ই তারা উল্লেখ করতেন। রামদয়াল সরকারের নাতি বলেই আমাকে বিশেষ খাতির যত্নও করতেন।
তবে আমার ঠাকুরদার যে-পরিচয়টির সুবাদে আমাকে তাঁরা খাতির যত্ন করতেন, সেপরিচয়টির জন্যে আমি মােটেই গৌরববােধ করতে পারি না।
আমার ঠাকুর্দা মাতৃগর্ভে থাকতেই তাঁর পিতৃবিয়ােগ ঘটে, তিনি ছিলেন তাঁর পিতার মৃত্যু উত্তর জাতক। তার বড়াে আরাে দু’ভাই ছিলেন। তাঁদের একজন, রামচরণ, শৈশবেই মারা যান। জ্যেষ্ঠ রামসুন্দরের মধ্য যৌবনে অকাল মৃত্যু ঘটলে তাঁর স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের দায়িত্ব এসে পড়ে কনিষ্ঠ রামদয়াল অর্থাৎ আমার ঠাকুর্দা বা পিতামহের ওপর। অনেক কষ্টে, নানা জীবিকার আশ্রয় নিয়ে, একটি বৃহৎ সংসার তাঁকে চালাতে হয়। এর মধ্যে এক সময় যে তিনি গ্রামে পাঠশালা বানিয়ে তাঁর গুরু মহাশয় হয়ে বসেছিলেন, বাবার কাছে সে-তথ্যটি জানতে পেরে আমার খুব ভালাে লেগেছিলাে। কিন্তু কিছুকাল পরে আমার ঠাকুর্দা সেই গুরু মহাশয়ের কাজ ছেড়ে দিয়ে আশুজিয়া গ্রামে এক তালুকদারের সেরেস্তার কর্মচারী হয়েছিলেন, এ-তথ্যটি আমাকে মােটেই পুলকিত করেনি। কারণ ইতিমধ্যেই গ্রামীণ তালুকদার-মহাজনদের সম্পর্কে আমার মনে ভীষণ বিরূপতা জন্মে গিয়েছিল।
পাকিস্তান সৃষ্টির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যদিও ওরা তালুকদারী-মহাজনীর স্বর্গ থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছিল, তবু সে-সময়েও, ওদের আচার-আচরণের লক্ষ করেছি: ওরা তাদের আশপাশের মানুষকে মানুষ মনে করে না, সব সময় একটা উচ্চম্মন্যতার বােধে আক্রান্ত হয়ে থাকে। পাশের গায়ের যে-ছেলেটি লেখাপড়া শিখে মােক্তার বা ডাক্তার বা মাস্টার হয়েছে, তারই বাপ হয়তাে ছিল আশুজিয়া গ্রামের কোনাে-না-কোনাে তালুকদার বাড়ির পেয়াদা কিংবা বর্গাচাষী। তা না হলেও অন্তত তাদের রায়ত তাে বটেই। আশপাশের গ্রামে দু’এক ঘর শরিফ মুসলমান কিংবা কায়স্থ দ্রলােকের বাস ছিল অবশ্যই। তবে এ-সব গাঁয়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিবাসীই ছিল চাষী, এবং চাষীদের অনেকেই আশুজিয়ার তালুকদারদের রায়ত। রায়তচাষীর ছেলেরা দু’পাতা ইংরেজি-বাংলা পড়ে বিদ্বান হয়ে যাবে, আর তালুকদার বাড়িতে এসে ফরাসে কিংবা চেয়ারে বসবে,—যে-কোনাে তালুকদার-নন্দনের কাছে এ-অবস্থাটি ছিল অসহনীয়। সেই অসহনীয় অবস্থাটিকে কিছুটা সহনীয় করার চেষ্টাতেই হয়তাে প্রতিনিয়ত ওরা সদ্যবিগত দিনগুলাের সুখস্মৃতির জাবর কাটতাে।
উনিশ শো ছেচল্লিশ সালেও কোনাে চাষী প্রজা বা রায়ত জুতাে পায়ে কিংবা ছাতা মাথায় তালুকদার বাড়ির আশপাশ দিয়ে হেঁটে যেতে পারতাে না। কেউ গেলে তাকে জুতােপেটা বা ছাতাপেটা করা হতাে। তালুকদাররা ভদ্রলােক। জুতাে পায়ে ছাতা মাথায় বাবু’ হয়ে থাকার অধিকার একমাত্র তাদেরই। তাদের সেই নিরঙ্কুশ অধিকারের ক্ষেত্রটিতে ‘ছােটলােক’ রা অনধিকার প্রবেশ করবে, সেটি দ্রলােকেরা সহ্য করবে কেন?
দ্রলােকদের বৈঠকখানার আসনবিন্যাসে সেই অধিকার-অনধিকারের সীমানাচিহ্ন আরাে স্পষ্ট হয়ে উঠতাে। ফরাসে বসতেন বাড়ির কর্তা তাঁর সমগােত্রীয় ইয়ার-বক্সীদের নিয়ে। বাইরে থেকে অন্য কোনাে ভদ্রলােক এলে বসতেন চেয়ারে। টুল, জলচৌকি, আলিসা’ (এক
১৩৫
ধরনের লম্বা কাষ্ঠাসন) ইত্যাদি আসন নির্দিষ্ট থাকতাে নিম্ন থেকে নিম্নতর বিভিন্ন স্তরের মানুষের জন্যে। আপন আপন স্তরের জন্যে নির্দিষ্ট আসনের সীমা লঙ্ঘন করে উচ্চতর আসনে কেউ বসতে চাইলে তার শাস্তি ছিল অবধারিত।।
আসনের পর তামাক খাওয়ার হুঁকো। ফরাসে থাকতাে লম্বা নল লাগনাে ফরসি হুঁকো। ফরাসে বসার অধিকারী যারা, না বললেও চলে, ফরসি হুঁকোতেও তাদেরই অধিকার। অন্য অন্য আসনের মানুষদের জন্যে থাকতাে আলাদা হুঁকো। এ-সব আলাদা হুঁকোর মধ্যে চিহ্নিত থাকতাে হিন্দুর জাতপাতের বিধিবিধান। ব্রাহ্মণের হুঁকোতে শূদ্রের মুখ লাগানাে তাে অসম্ভবই ছিল, শূদ্রদেরও জাতভেদে কোভেদ হতাে। কায়স্থের হুঁকো তাে একেবারেই পৃথক।
তামাক নিশ্চয়ই দেশজ বস্তু নয়, আর্য ঋষিরা তামাকের সঙ্গে অবশ্যই পরিচিত ছিলেন। । নতুন আবিষ্কৃত মহাদেশ আমেরিকা থেকে এটি স্যার ওয়াল্টার র্যালে ইউরােপে নিয়ে আসেন এবং ইউরােপীয়দের কাছ থেকে আসে ভারতবর্ষে। মােগল সম্রাটদের মাধ্যমেই এদেশে হুঁকোয় তামাক খাওয়ার প্রচল ঘটে বলে ঐতিহাসিক সূত্রে আভাস পাওয়া যায়। রাজদরবার থেকে হুঁকো ও তামাক ক্রমে গায়ের চণ্ডীমণ্ডপে ও গেরস্তের দাওয়ায় নেমে আসে, চাষার সঙ্গে মাঠেও চলে যায়। দামি ফরসি হুঁকো বা আলবােলা সুলভ নারকেলী হুঁকোয় পরিণত হয়ে এদেশে এক ধরনের সর্বজনীনতা পেয়ে যায়।
এহেন তামাক ও হুঁকো ব্যবহারের নানা নিয়মকানুন ও এ-সম্পর্কীয় জাতপাতের বিধিবিধান হিন্দুর প্রাচীন স্মৃতিশাস্ত্রে লিখিত থাকার কথা নয়। তামাক ও হুঁকো কোনােটাই ‘দেবভাষা সংস্কৃতের শব্দ নয়। প্রথমটি স্পেনীয় ও দ্বিতীয়টি আরবি ভাষা থেকে উপজাত। হুঁকোর প্রতিশব্দ ‘আলবােলা’ও এসেছে ফার্সি থেকে। অর্থাৎ তামাক ও হুঁকো দুই-ই জাতে স্লেচ্ছ। ম্লেচ্ছস্পর্শ বর্জন করাই তাে ব্রাহ্মণের পক্ষে স্বাভাবিক হতাে! অথচ এই স্লেচ্ছ তামাক কী করে ব্রাহ্মণের নিকট পরম আদরণীয় হয়ে উঠলাে এবং তামাক সেবন তথা হুঁকো ব্যবহারের ব্যাপারটি জাতপাতের বিধানের অন্তর্গত হয়ে গেলাে, সে-রহস্য ভেদ করা কঠিন। উনিশ শতকের কলকাতার সিমুলিয়া পল্লীতে এটর্নি বিশ্বনাথ দত্তের বালক পুত্র নরেন্দ্রনাথ দত্ত (যিনি পরে স্বামী বিবেকানন্দ নামে বিশ্বখ্যাত হন) তাঁর বাবার বৈঠক খানায় নানা জাতের মানুষদের বিশেষ করে মুসলমানদের হুঁকোয় জোরে টান দিয়ে দেখতে চেয়েছিলেন জাত না মানলে কী হয়। হিন্দুর ধর্ম যে বেদ-বেদান্তের পুঁথি-পুস্তক ছেড়ে ভাতের হাঁড়ি আর হুঁকোর জলে এসে আশ্রয় নিয়েছে, সে-কথাতাে তীব্র বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বহুবার তিনি বলেছেন। কিন্তু রামমােহন-বিদ্যাসাগর থেকে স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত সকল সংস্কারক, চিন্তক ও মনীষীর প্রয়াস নাগরিক হিন্দুসমাজের চিন্তায় ও আচরণে অনেক র্যাডিকেল পরিবর্তন নিয়ে এলেও গ্রাম বাংলার সমাজ-কাঠামােটি প্রায় অনড়ই থেকে গেছে। বাংলার সামাজিক ইতিহাসের যে-কোনাে একজন সাধারণ ছাত্রও জানে : ধনতন্ত্রী-উপনিবেশবাদী ব্রিটিশরা এদেশে ধনতন্ত্রের সুস্থ বিকাশ ঘটানাের বদলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’র মাধ্যমে নতুন ধরনের এক সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থাই প্রবর্তন করেছে এবং সে-ব্যবস্থাই গ্রামসমাজের কাঠামােটিতে বাঞ্ছিত পরিবর্তন আনতে দেয়নি, অনভিজাত সাধারণ মানুষকে নানাভাবে দাবিয়ে রেখেছে। আশুজিয়ার মতাে গ্রামগুলাে ছিল আসলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-জাত নতুন সামন্ততন্ত্রেরই কেন্দ্র। সামন্ততন্ত্র সব সময়ই ধর্মকে তার নিজের মতাে করে কাজে লাগায়। ধর্মের পুরনাে বিধি-বিধানগুলােকে নতুন সামন্ততন্ত্রও, তাই, মানুষকে নিপীড়িত করার উপযােগী করে গড়েপিটে নেয়। পুরনাে সামন্ততন্ত্র রাজাকে ঈশ্বরের
১৩৬
প্রতিভূ রূপে মান্য করার জন্যে ধর্মীয় অনুজ্ঞা তৈরি করে রেখেছিল। ব্রিটিশ আমলের নয়া সামন্ততন্ত্র সেই অনুজ্ঞারই আরাে বিস্তার ঘটায়, একেক জন গ্রামীণ ভূস্বামীকেও দেবতা বানিয়ে তােলে। আর সে-ভূস্বামী যদি ব্রাক্ষণ হন তবে তাে আর কথাই নেই। ব্রাহ্মণরা তাে এমনিতেই শূদ্রের দেবতা, তার ওপর ভূস্বামী হলে তাঁর দেবত্ব দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ওই দেবত্বের জোরেই ব্রাক্ষণ ভূস্বামী প্রজা-শাসনের জন্যে জারি করেন এমন সব অনুশাসন, যেগুলাে ধর্মীয় বিধানের মর্যাদায় ভূষিত হয়ে ওঠে। অন্তত শুদ্র প্রজাদের কাছে তাে বটেই। ফরাস থেকে টুল-জলচৌকি পর্যন্ত নানা স্তরের আসনবিন্যাস, কিংবা তামাক ও হুঁকোর জাতভেদ, এ-রকম সব কিছুই শূদ্র প্রজার কাছে শাস্ত্রবিধানের মতােই মান্যতা পেয়ে যায়। ভূস্বামীর নাবালক সন্তানটিও অতিবৃদ্ধ প্রজার নিকট একান্ত সম্মানীয়, তাই তার সঙ্গে সেই প্রজাকে আপনি আজ্ঞে’ করে কথা বলতে হবে। আর সেই নাবালক তার বাপের বয়সী প্রজাকেও যে তুই তােকারি’ করবে, তাই হবে একান্ত স্বাভাবিক ও ন্যায্য।
ব্রিটিশ-সৃষ্ট নয়া সামন্ততন্ত্র আশুজিয়ার মতাে এ-রকম অনেক গ্রামকে কেন্দ্র করেই একেকটি অচলায়তন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কোনাে অচলায়তনই চিরকালের জন্যে নিচ্ছিদ্র অচলায়তন হয়ে থাকে না, এর শক্ত পাঁচিলের এখানে-ওখানে অনেক ছােট বড়াে ফাঁক-ফোকর সৃষ্টি হয়ে যায় এবং সেগুলাে সৃষ্টি করে অচলায়তনের ভেতরের মানুষেরাই। কেউ কেউ তা সজ্ঞানেই করে, আর কেউ করে ফেলে নিজের অজান্তে। আশুজিয়া, নওপাড়া, বাড়রি, কাটিহালি–বর্তমান নেত্রকোনা জেলার এ-রকম অনেক গ্রাম যেমন ছিল সামন্ততন্ত্রের অচলায়তন, তেমনি এগুলাের ভেতর দিয়েই বয়ে গেছে আধুনিকতার মুক্তধারার সচল প্রবাহ। গাঁয়ে যারা সারা বছর থাকতেন তাঁরা যতােই তালুকদারী মেজাজ দেখান না কেন, ওই তালুকদারদেরই ছেলে ভাই-পােরা বাইরে গিয়ে লেখাপড়া শিখে অন্যরকম মেজাজের অধিকারী হয়ে গেছেন। এঁদের অনেকে উকিল, ডাক্তার, অধ্যাপক বা সরকারি-বেসরকারি চাকুরে হয়ে গ্রাম ছেড়ে শহরবাসী হয়েছেন। কিন্তু এঁরা কেউই একান্ত অনিকেত হয়ে পড়নেনি, গ্রামের মাটিতে তাদের শিকড় রয়েই গেছে। ছুটিছাটায় গাঁয়ে ফিরে এসে এঁদের অনেকেই সাধারণ রায়ত প্রজাদের সঙ্গে এ-রকম ভদ্র ও সহৃদয় আচরণ করেছেন যা ছিল তাদের বাপ-ঠাকুর্দাদের সম্পূর্ণ বিপরীত, যা দেখে রায়ত-প্রজারা বিস্মিত ও অভিভূত হয়ে পড়েছে। তা ছাড়া রায়তপ্রজার ছেলেপুলেদের শিক্ষিত ও আত্মসচেতন হয়ে ওঠার ব্যবস্থাও ওই উন্নাসিক তালুকদারদের ছেলে ভাই-পােদের হাত দিয়েই সম্পন্ন হয়েছে। তাঁরাই গাঁয়ে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন, পাবলিক লাইব্রেরি গড়েছেন। তাঁদেরই কেউ কেউ শহর ছেড়ে গায়ে ফিরে এসে স্কুলের মাস্টার হয়েছেন। এবং জয়চন্দ্র রায়ের মতাে আদর্শবাদী ও হৃদয়বান মানুষরা শুধু মাস্টার হননি, মাস্টারিকে জীবনের ব্রত করে নিয়েছেন। আশুজিয়া গ্রাম থেকে প্রথম গ্রাজুয়েট হয়েছিলেন। প্রসন্ন চক্রবর্তী। শুনেছি, গ্রামের প্রথম গ্রাজুয়েট বলে—বিশ শতকের প্রায় শুরুর দিকে সদ্যপ্রতিষ্ঠিত আশুজিয়া হাইস্কুল প্রাঙ্গণে প্রসন্ন বাবুকে ঘটা করে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। তিনি ওকালতিও পাস করেছিলেন। কিন্তু ওকালতি না করে আশুজিয়া হাইস্কুলের মাস্টারিতেই জীবন কাটিয়ে দেন। জয়চন্দ্র বাবু, প্রসন্ন বাবু এবং আরাে কয়েকজন দরদী শিক্ষকের হাতে শিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশই তাে আশুজিয়ার আশপাশের গায়ের রায়তকৃষকদের ছেলেপুলে।
শুধু ইস্কুল বা পাবলিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা নয়, স্বদেশী আন্দোলনের বীজও গ্রাম এলাকায় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন আশুজিয়া-নওপাড়া-বাড়রির মতাে তালুকদার-অধ্যুষিত বিভিন্ন গ্রামের
১৩৭
শিক্ষিত উদ্যমী তরুণরাই। উনিশ শাে বিশ-একুশ সালের ব্রিটিশ-বিরােধী অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের সময় স্কুল থেকে ছাত্রদের বের করে নিয়ে এসেছিলেন এঁরাই। আবার এঁদেরই কেউ কেউ বােমা-বন্দুক মেরে ইংরেজ-তাড়ানাের বিপ্লবী আন্দোলনেও শরিক হয়েছিলেন। আরাে পরে তাে দু’একজন কম্যুনিস্টও বেরিয়ে এসেছিলেন এঁদের ভেতর থেকেই। অর্থাৎ সামন্ততন্ত্রের দুর্গের ভেতরেই সামন্তবিরােধী চেতনা আস্তে আস্তে পাখা মেলেছিল।
তালুকদারদের শহর-প্রবাসী শিক্ষিত সন্তানদের হাত ধরেই নগর-সংস্কৃতির কিছু কিছু উপাদনও গায়ে চলে এসেছিল। আশ্বিন মাসে পূজোর ছুটিতে সব প্রবাসীরা ঘরে ফিরতাে, সারা গাঁ গমগম করতাে। খােলা মঞ্চে যাত্রা দেখে অভ্যস্ত গাঁয়ের মানুষরা পর্দাঘেরা ‘থিয়েটারে অন্য রকম স্বাদ পেতাে। জারি-সারি-বাউল-ভাটিয়ালির সুরের ধারায় সাঁতার কাটে যারা, তালুকদার বাড়ির ছেলেদের গলায় তারা শুনতে পায় স্বদেশী গান ও আধুনিক গান। এ-সব গানের কথা ও সুর তাদের এক ভিন্ন জগতে নিয়ে যায়।
মােট কথা, সামন্ততান্ত্রিক অচলায়তনের ভাঙা পাঁচিলের ফাঁকফোকর গলিয়ে আধুনিকতার যে আলাে এসে পড়ে, সে আলােতেই পাড়া গাঁয়ের সাধারণ মানুষ নিজের অবস্থা ও অবস্থানটিকে দেখে নেয়ার সুযােগ কিছুটা হলেও পেয়ে যায়।

পাকিস্তানের আসমানে তুই হেলাল যদি সে হবি
প্রসন্ন চক্রবর্তী-জয়চন্দ্র রায়দেরই ছাত্র ছিলেন সিংহের গাঁওয়ের বাউল কবি জালাল খাঁর পুত্র খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম। আশুজিয়া হাইস্কুল থেকেই উনিশ শাে চল্লিশে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন। মুসলিম স্বাতন্ত্র আর পাকিস্তান-আন্দোলনের আবহের মধ্যে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। কবির পুত্র কবি। বাপের সঙ্গে এটুকুই তাঁর প্রধান মিল। কবি বলেই অত্যন্ত সংবেদনশীল। অতিসংবেদনশীলতার জন্যেই বিরূপ পরিপার্শ্বের মধ্যে সারা জীবন স্বস্তি খুঁজে পাননি। শেষ পর্যন্ত তাকে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী হতে হয়েছিল।
উনিশ শাে পঞ্চাশ সালে তাঁর সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয়, তখন তিনি অত্যন্ত কর্মিষ্ঠ এক যুবক। মুসলমানের রাষ্ট্র পাকিস্তানকে একটি আদর্শ রাষ্ট্র রূপে গড়ে তুলতে হবে—এই প্রত্যয় তাঁর চিন্তায় বাক্যে ও কর্মে। মুসলমানের ‘তামদুনিক স্বাতন্ত্র সম্পর্কে অতিমাত্রায় সচেতন। প্রচুর কবিতা লেখেন। ফররুখ আহমদ, তালিম হােসেন, মােফাখখারুল ইসলামদের কাব্যাদর্শই তখন তাঁর অন্বিষ্ট। যেখানে একটি প্রচলিত বাংলা শব্দই লাগসই হতে পারে, সেখানেও অপ্রচলিত আরবি-ফার্সি শব্দ ব্যবহারে তার আগ্রহ। একটি মাসিক পত্রে—সম্ভবত ‘মাহেনও-এ–পড়েছিলাম তার কবিতা ‘হামদ’। হা’ কথাটার অর্থই তখন আমি জানতাম না। তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। পত্রপত্রিকায় তাঁর অজস্র কবিতা ছাপা হলেও কোনাে কাব্যসংকলন তিনি প্রকাশ করে যেতে পারেননি। তাঁর একমাত্র প্রকাশিত বই– নীল কপােত’। এটি গানের বই। এ-বইয়ের গানগুলাে রচনার পটভূমি তিনি অনেক পরে আমার কাছে ব্যাখ্যা করেছিলেন। কোনাে এক পল্লীবালার প্রতি প্রেম থেকেই তাঁর এই গানগুলাে জন্ম নিয়েছিল। নীল কপােত’-এ ছাপা হয়েছিল বায়ান্নটি গান। বায়ান্নের মধ্যে সাতচিল্লশটিই প্রেমগীতি হলেও এই প্রেমসংগীতের বইয়ের শুরু হয়েছে কিন্তু পাঁচটি পাকিস্তানি গান দিয়ে। এবং সে-গানগুলাে দুর্বোধ্য আরবি-ফার্সি শব্দে আকীর্ণ। ব্যাপারটি আমার কাছে খুবই অদ্ভুত মনে হয়েছিল।
১৩৮
নীল কপােতের প্রথম গানটিই হলাে :
পাকিস্তানের গুলবাগে আজি বুলবুলি দিল ডাক
জমানে-সিয়ার বােরকা-নেকাব আজ খুলে দূরে রাখা
ঐ দেখ তাের কাফেলা চলেছে, তুই শুধু পড়ে পিছে
গালাতি-ভরা নও জোয়ানীর দান তাের সব মিছে,
হেলাল খচিত নিশান রাঙাতে তাের সব লহু যাক
পাকিস্তানের সম্ভ্রমে আজ জাহান নােয়ায় শির
নও রৌশনে খসে পড়ে ঐ আঁধারের জিঞ্জির
ফিরে চল্, ফিরে চল,
ওরে বেদিশা পথের যাত্রী রাহী দল
সেরাতুল-মুস্তাকিমে ফিলে চল্…
দূর মঞ্জিলে দোলিয়ে উঠুক জীবনের ফলাফল
পাক কোরআনে অমলিন শিখা বুকে তাের
জ্বালা থা৷
নীল কপােতের কবি-গীতিকার খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমকে একদিন কথায় কথায় আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আচ্ছা, হেকিম ভাই, প্রেমগীতির সংকলনে ওই পাকিস্তানি গানগুলাে জুড়ে দিলেন কেন? এতে কি সংকলনটির চরিত্র ভ্রষ্ট হয়ে যায়নি?’
আমার প্রশ্ন শুনে হেকিম ভাই হাে-হাে করে হেসে উঠেছিলেন। হাসি থামলে বইয়ের টাইটেল পেজটি আমার সামনে মেলে ধরলেন।
বইয়ের প্রকাশকালটি লক্ষ করাে। ১৩৫৪ সাল। অর্থাৎ খ্রিস্টীয় ১৯৪৭ সাল। অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্মের বছর। গানগুলাে তাে এর আগে কয়েক বছর ধরে লেখা। সে-সময়ে আমরা যে কী পরিমাণে পাকিস্তানি জোশে আক্রান্ত ছিলাম তা তুমি ধারণা করতে পারবে না। তখন আমাদের সকল প্রেমই পাকিস্তান-প্রেমের সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছিল। আমাদের নারীপ্রেমও সার্থক হয়ে উঠতে পারে কেবল মাত্র পাকিস্তান কায়েম হলেই—এই ছিল আমাদের ঈমান। কবি বা গীতিকার হিসেবেও আমি তাে তখন এই ঈমানের ওপরই ভর করে ছিলাম। নীলকপােতের দুই নম্বর গানটিতেই দেখে নিজের কবিসত্তার প্রতি আমার আহবান-
পাকিস্তানের আসমানে তুই
হেলাল যদি সে হবি।
খুলে দে রে তাের রুদ্ধ দুয়ার
হে চির উদাসী কবি।
পাকিস্তানের আসমানে হেলাল হওয়ার চেয়ে বড়াে কোনাে বাসনা আমাদের তখন ছিল না।
হ্যা, হেকিম ভাই ঠিকই বলেছিলেন। চল্লিশের দশকে যে-সব বাঙালি মুসলিম সন্তান তারুণ্যপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এবং স্কুল-কলেজে শিক্ষা নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় সকলে পাকিস্তানের
১৩৯
আকাশে হেলাল হয়েই উঠতে চেয়েছিলেন। সে-সময়কার মুসলিম তরুণদের কেউই যে জাতীয়তাবাদী কিংবা কম্যুনিস্ট হননি, তা নয়। তবে তাঁদের সংখ্যা ছিল একেবারেই নগণ্য। সিংহের গাঁওয়েরই পবিত্র দাস ছিলেন হেকিম ভাইয়ের সহপাঠী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কিন্তু পবিত্র দাস কম্যুনিস্ট হলেও হেকিম ভাইয়ের চিত্তে তখন ক্যুনিজমের আদর্শ মােটেই সাড়া জাগাতে পারেনি। বালি গ্রামের লড়াকু ক্যুনিস্ট কর্মী হান্নান মৌলবির সঙ্গেও তাঁর আলাপ-পরিচয় ছিল। হান্নান মৌলবিও তাঁকে কম্যুনিজমের অনুরাগী করে তুলতে পারেননি। মুসলমানের জন্যে পৃথক আবাস ভূমি চাই, সকল মুসলমানের খাটি মুসলমান হয়ে ওঠা চাই, মুসলমানী তাহজিবতমদুনের প্রতিষ্ঠা চাই—এ-রকম চিন্তাই হয়ে উঠেছিল তাঁর তখনকার সকল কর্মের চালিকা শক্তি। পবিত্র দাস কিংবা হান্নান মৌলবি যখন তাঁকে শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলতেন, তাঁর সামনে ভবিষ্যতের শ্রমিকরাজ-কৃষকরাজের লােভনীয় চিত্র তুলে ধরতেন, সােভিয়েতের আকাশে পপত্ করে উড়ছে যে লাল পতাকা তার তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতেন, তখন খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম নির্যাতিত মুসলমান সমাজের দুরবস্থার দিকে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করতেন, খােলাফায়ে রাশেদিনের সাম্যতন্ত্রের কথা স্মরণ করতেন, পাকিস্তান কায়েম হলেই যে সকল জুলুমের অবসান হবে—দৃঢ়ভাবে তেমন প্রত্যয় ব্যক্ত করতেন।
সেই প্রত্যয় থেকেই তিনি পাকিস্তান-আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হয়ে উঠেছিলেন। স্বরচিত গান আর কবিতায় সেই প্রত্যয়েরই ভাষারূপ দিয়ে চলছিলেন। সিংহের গাঁও ও তার আশপাশের গ্রামের মুসলিম তরুণদের নিয়ে তিনি সাহিত্যচর্চার একটি ক্লাব গড়ে তুলেছিলেন। তার নাম দিয়েছিলেন—‘আবেহায়াৎ সাহিত্য মঞ্জিল। নীল কপােত’-এ তার পরবর্তী বইয়ের বিজ্ঞাপন ছেপেছিলেন—“এই লেখকের ‘শোদ’ অপূর্ব কাব্যগ্রন্থ—শীঘ্রই বের হবে।” (অবিশ্যি শোদ’ বা তাঁর অন্য কোনাে গ্রন্থই আর বের হয়নি)। ময়মনসিংহ’কে তিনি সেকালের আজাদ, মােহাম্মদী ও অন্যান্য পাকিস্তানবাদী পত্রিকার অনুসরণে লিখতেন— “মােমেনশাহী’। আবেহায়াৎ, মঞ্জিল, শোদ, মােমেনশাহী—এ-সব শব্দ প্রয়ােগের মধ্যে ছিল মুসলিম স্বাতন্ত্র্য-চেতনারই স্পষ্ট প্রকাশ।
হেকিম ভাইয়ের এই স্বাতন্ত্র-চেতনাটি জন্ম নিয়েছিল মূলত আশুজিয়ার ব্রাহ্মণ ভূস্বামীদের সঙ্গে তাঁর বাবা জালাল উদ্দিন খাঁর প্রেস্টিজের লড়াই থেকে। সে-লড়াইয়ে, স্বাভাবিকভাবেই, তিনি জড়িয়ে পড়েছিলেন একেবারে কিশাের বয়সে।
জালাল খাঁর পৈতৃক বাড়ি সিংহের গাঁওয়ে ছিল না। তিনি এখানে এসেছিলেন ঘরজামাই হয়ে নেত্রকোনারই অন্য একটি গ্রাম আসদহাটি থেকে। সিংহের গাঁওয়ের হাসমত আলী তালুকদার ছিলেন তাঁর শ্বশুর। হাসমত আলীর প্রচুর ভূসম্পত্তি এবং নামের শেষে তালুকদার পদবী থাকলেও আশুজিয়ার ব্রাহ্মণ ভূস্বামীরা তাঁকে নিজেদের সমান স্ট্যাটাস দিতে রাজি ছিলেন না। তারা বলাই শিমুল গ্রামের সৈয়দ পরিবার ছাড়া এলাকার আর কোনাে মুসলমান পরিবারের আভিজাত্য স্বীকার করতেন না। ব্রাহ্মণ হিন্দুদের মধ্যেও নগুয়া, রামপুর, চন্দনকান্দি ও মঙ্গলসিদ্ধি গ্রামের কয়েকটি কায়স্থ তালুকদার পরিবারকে মাত্র তাদের সঙ্গে ফরাসে বসার অধিকার মঞ্জুর করতেন। এঁদের বাইরে আর কাউকে নয়।
হাসমত আলী তালুকদারের জামাই এবং পৈতৃকসূত্রে ও শ্বশুরসূত্রে প্রচুর ভূসম্পত্তির মালিক—জালাল খাঁ এ-অবস্থাটা কিছুতেই মেনে নিতে পারলেন না। আশুজিয়ার ব্রাহ্মণ ভূস্বামীদের মতাে তাঁরও ছিল নীল রক্তের গর্ব। তিনিও তাে ব্রাহ্মণের বংশধর। তাঁর সপ্তম পূর্ব পুরুষ ছিলেন শচীন্দ্র শর্মা। আশুজিয়ার পাঁচ মাইল উত্তরের মনাগ্রামের অধিবাসী এই বিশিষ্ট
১৪০
ব্রাহ্মণ সৈয়দ খােয়াজ নামে একজন সুফি সাধকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করায় ব্রাহ্মণ্য বিধানে জাতিচ্যুত হয়ে পড়েছিলেন। এবং বাধ্য হয়েছিলেন মুসলমান হতে। ব্রাহ্মণ শচীন্দ্র শর্মারই মুসলমানি নাম হয়েছিল সুলতান উদ্দিন খাঁ। সেই সুলতান উদ্দিন খাঁর বংশধর কিন্তু নীলরক্তের গর্বটাকেই জীবনের সর্বসাধ্যসার করে তােলেননি। জালাল খাঁ বরং সব রকম জাত ধর্মের ঊর্ধ্বে মানুষকে মানুষ বলেই গণ্য করেছেন, বলেছেন, ‘ধর্ম হতে এই জগতে দলাদলিই কেবল সার’। ধর্মের দলাদলি আর জাতের গৌরব-দুয়ের প্রতিই ছিল তার সীমাহীন বিরূপতা। সেবিরূপতা থেকেই তিনি বাউল হয়েছেন, বাউল হয়ে গান রচনা করেছেন—
জাতিধর্ম বলে কারে—
জাতে জাতে যার তার মতে, গেছে ধর্ম বিভাগ করে।
যে বলুক যেমন আমায়, ধর্ম হবে কার্যতায়
নিরাকার চৈতন্য প্রভু, ভেদ নাহি জাত
বিচারে৷
সৃষ্টিকর্তা সবার একজন, সমান দৃষ্টি করে—
একভিন্ন দ্বিতীয় নাহি, নহেরে গণ্ডীর ভিতরে৷
তাছাড়া কেবল ব্রাহ্মণ শচীন্দ্র শর্মার বংশধর বলেই গর্ব করার কোনাে প্রয়ােজন জালাল খার ছিল না। কারণ তাঁর নিজস্ব অর্জনও তাে ছিল যথেষ্ট।
আঠারাে শো চুরানব্বইয়ে তার জন্ম। ছেলেবেলায় কিছুদিন মাদ্রাসায় পড়েছেন, স্কুলেও পড়েছেন ম্যাট্রিক ক্লাস পর্যন্ত। ফকির-সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে পরিচিত হয়েছেন মরমী ধর্মতত্ত্ব আর হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনার সঙ্গে। নিজের রচিত গানে গানে ছড়িয়ে দিয়েছেন উদার মানবপ্রেমের বাণী। অসংখ্য তাঁর শিষ্য ও গুণগ্রাহী। দেশ-বিদেশের লােকসাহিত্যগবেষক ও ফোকলাের-বিশেষজ্ঞরা তাঁর সঙ্গে এসে দেখা করেছেন, তাঁর রচনার বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। শুধু বাউল গান রচনাতেই নয়, সামাজিক কর্মকাণ্ডেও জালাল খাঁ পিছিয়ে ছিলেন না। উনিশ শো বিশ/একুশ সালে গান্ধীজীর অসহযােগ আন্দোলনে যােগ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী রাজনীতিরও অংশ হয়েছিলেন তিনি।
এহেন স্বনামধন্য গুণী, সম্পদশালী ও ব্রাহ্মণ্য গৌরবের অংশীদার জালাল খাঁ যে নিজেকে আশুজিয়ার ব্রাহ্মণ ভূস্বামীদের সঙ্গে ফরাসে বসার অযােগ্য বিবেচনা করবেন না, তেমনটিই তাে স্বাভাবিক। কিন্তু আশুজিয়ার লেদুবাবুর বাড়িতে যেদিন তার সেই স্বাভাবিক অধিকারটিই অস্বীকৃত হলাে, ফরাস থেকে উঠে আসতে বাধ্য হলেন, সেদিন সে-অপমানের ব্যথা জালাল খার চেয়ে তাঁর পুত্র খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমের বুকেই বেশি করে লেগেছিল। পঞ্চাশ সাল থেকে শুরু করে কয়েক বছরের মধ্যেই আমি হেকিম ভাইয়ের একান্ত অন্তরঙ্গ হয়ে উঠি। তাঁর জন্ম উনিশ শাে উনিশে, আর আমার উনিশ শো ছত্রিশে। অর্থাৎ খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম আমার সতেরাে বছরের অগ্রজ। তাঁর কাছে যে আমি অনুজের স্নেহ পেয়েছিলাম, সেটি অবশ্যই অস্বাভাবিক ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই হয়েছিলাম তাঁর শিষ্যও। কিন্তু যেটি একান্ত চমকপ্রদ সেটি হচ্ছে আমার পক্ষে তার বন্ধু হয়ে যাওয়া। অথচ, আমাদের মধ্যে সেই চমকপ্রদ ব্যাপারটিই ঘটেছিল। প্রথম পরিচয়ের অল্পদিন পরেই আমি তাঁর বন্ধু হয়ে গিয়েছিলাম। অন্তত উনিশ শাে চুয়ান্ন সাল থেকে যে আমার মতাে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাঁর একজনও ছিল না, সে-কথা
১৪১
আমি হলফ করে বলতে পারি। একই সঙ্গে আমি ছিলাম তার স্নেহাস্পদ অনুজ, জিজ্ঞাসু শিষ্য ও অন্তরঙ্গ বন্ধু।
আমার এই শ্রদ্ধেয় অগ্রজ, ধীমান শুরু ও দরদী বন্ধুর ভাবনাচিন্তা এবং কর্মপ্রয়াসের ভেতর পাকিস্তানের জন্মকে আমি অনেক গভীরভাবে প্রত্যক্ষ করেছি। আবার এক সময় পাকিস্তানের মৃত্যু ঘটানাের কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তাঁকে যুক্ত হতে দেখেছি। মৃত পাকিস্তান যখন স্বাধীন বাংলাদেশের ঘাড়ে ভূত হয়ে চেপে বসে তখন তিনি হয়ে পড়েছিলেন শারীরিক ও মানসিক ভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত।
তবে সে-সব কথা আপাতত উহ্য রেখে হেকিম ভাইয়ের উনিশ শাে পঞ্চাশ/একান্ন সালের ভূমিকাটিকেই শুধু স্মরণ করছি। সাতচল্লিশের অনেক আগেই যিনি পাকিস্তানের বন্দনা গান রচনা করেছিলেন, একান্ত স্বাভাবিক ভাবেই তিনি পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি বাস্তবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একে অর্থবহ করে তােলবার জন্যে মনপ্রাণ সমর্পণ করলেন। সে-সময়ে তার চোখে গভীর আশাবাদের ঝিলিক দেখেছি। সেই আশাবাদ নিয়েই অজপাড়া গাঁয়েও তিনি সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। যে আশুজিয়া হাইস্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেছিলেন, সেই স্কুলটিকে পুনর্গঠনের জন্যে তিনি উঠে পড়ে লেগেছিলেন। সে-সময়ে তাঁর পিতা জালাল উদ্দিন খাঁ আশুজিয়া হাইস্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বাস্তবে কিন্তু অত্যন্ত সৃজনশীলভাবে সেক্রেটারির কাজ করে যাচ্ছিলেন পুত্র খান মােহম্মদ আবদুল হাকিমই।
পাকিস্তান রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রচণ্ড আশাবাদী হলেও হেকিম ভাই কিন্তু পঞ্চাশ সালেই (হয়তাে-বা তারও আগে থেকেই) পাকিস্তানের রাষ্ট্র-নেতাদের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন। পাকিস্তান যে-রকম আদর্শ রাষ্ট্র হবে বলে তাঁরা স্বপ্ন দেখতেন, সে-স্বপ্ন যে এসব নেতাদের হাতে কিছুতেই বাস্তব হয়ে উঠবে না, এ-রকম সিদ্ধান্তে সে-সময়েই তিনি পৌছে গিয়েছিলেন। তবু আশা করতেন যে নিবেদিত প্রাণ তরুণদের নিয়ে পাকিস্তানে খােলাফায়ে রাশেদিনের যুগকে ফিরিয়ে আনা যাবে। সে-আশাতেই যােগ দিয়েছিলেন তমদ্দুন মজলিসে, এবং সিংহের গাঁওয়েও মজলিসের শাখা গড়ে তুলেছিলেন।
তমদ্দুন মজলিস সম্পর্কে তাঁর মােহমুক্তি ঘটতে অবিশ্যি আরাে কিছুটা সময় লেগেছিল।

আপনি, তুমি, তুই ও ভাববাচ্য
তিরিশ ও চল্লিশের দশকে যখন শূদ্র ও মুসলমান রায়ত-প্রজার ছেলেপুলেদের অনেকেই লেখাপড়া শিখে ফেললাে, কেউ কেউ নানা দ্র’ জীবিকাও জোগাড় করে নিলাে, তখন ওদের সঙ্গে আভিজাত্যগর্বী তালুকদাররা কেমন ব্যবহার করতাে? তখনাে কি তালুকদার বাড়ির পুঁচকে ছেলেটিও রায়ত-প্রজার বাড়ির শিক্ষিত যুবকটিকে তুই তােকারি’ করে কথা বলতাে?
এ-প্রশ্নের সহজ উত্তর দেয়া খুবই কঠিন। তালুকদারদের জন্যেও প্রশ্নটি ছিলাে ভীষণ নাজুক। একজন ডাক্তার বা মাস্টার বা ছােট চাকুরেকেও—এমন কি যে-ছাত্র স্কুলের উচু ক্লাসে বা কলেজে পড়ছে তাকেও—নিশ্চয়ই তুই’ বলে সম্বােধন করা যায় না। যে ছেলে শিক্ষিত হয়ে গাঁয়ের বাইরে মানমর্যাদা পাচ্ছে তার বাপকেই-বা তুই তােকারি’ করা যায় কী করে? এবং সেবাপ একেবারে গােমূর্খ ও তালুকদারের বর্গাচাষী হলেও? অথচ, গাঁয়ের মানুষের কাছে যে
১৪২
ভূস্বামীটি রাজারই প্রতিভূ, তার বা তার পরিবারের যে-কারাে পক্ষে একজন প্রজা বা প্রজার ছেলেকে ‘আপনি’ বলা তাে অসম্ভবই, তুমি’ বলাটাও রীতিমত আত্ম-অবমাননাকর! বাংলা সর্বনাম ‘আপনি, তুমি, তুই’ নিয়ে গ্রামীণ ভূস্বামীরা একসময়ে বড়াে বিব্রতকর অবস্থার মধ্যেই পড়ে গিয়েছিলাে। পুরনাে ভাবনা ও অভ্যাস ছাড়া যেমন কঠিন, নতুন বাস্তবকে মেনে নিয়ে ভাবনায় ও অভ্যাসে পরিবর্তন আনাও তাদের জন্যে হয়ে পড়েছিলাে তেমনি মর্মান্তিক।
পুরনাে অভ্যাসের অনুবর্তন করতে গিয়ে কখনাে কখনাে তাদের বেশ রামধাক্কা খেতে হয়েছে, এবং সে-ধাক্কার টাল সামলাতে গিয়ে এখানে-ওখানে আরাে অনেক কিছুর সঙ্গে ঠোকাঠুকি লেগে অনেক বাড়তি যন্ত্রণাও সইতে হয়েছে। রায়ত-প্রজা কিংবা অনভিজাত কোনাে মানুষের শিক্ষিত বা শিক্ষাভিমানী পুত্রকে অভ্যাস মতাে তুই’ সম্বােধন করে কোনাে কোনাে তালুকদারের যে ল্যাজে গােবরে অবস্থা হয়েছে, এ-রকম গল্প অনেক শুনেছি। আমার হেকিম ভাইকে (অর্থাৎ বাউল কবি জালাল খাঁর পুত্র খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম) নিয়েও এমন একটি ঘটনার কথা শুনেছি। সেটি আমাকে বলেছে হেকিম ভাইয়ের ছেলে গােলাম ফারুক। সে শুনেছে তার বাবার মুখেই।
হেকিম ভাই একদিন বিকেলে তাঁদের বাড়ির পিছনে ‘ভুইগ্যা’র পুলের ওপর তাঁর কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে বসে গল্পগুজব করছিলেন। এ-সময়েই আশুজিয়ার পরাক্রান্ত তালুকদার জগদীশ চক্রবর্তী সাইকেলে চড়ে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলেন। সাইকেল থেকে নেমে জিজ্ঞেস করলেন ‘কিরে হেকিম, তাের বাবা বাড়িতে আছে?’ হেকিম ভাই সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, ‘তাের দরকার থাকলে বাড়িতে গিয়ে খোঁজ নিয়ে দেখ।
জগদীশ চক্রবর্তীর মুখের ওপর কেউ এ-রকম উদ্ধত বাক্য উচ্চারণ করতে পারে, তা ছিলাে সকলের কল্পনারও বাইরে। অথচ এ-রকম অকল্পনীয় ঘটনাটিই ঘটলাে। বিষয়টি জালাল খার কানে গেলে তিনি অবশ্যই তাঁর দুর্বিনীত পুত্রকে যথারীতি তিরস্কার করেছিলেন, পুত্রের আচরণের জন্যে দুঃখ প্রকাশও করেছিলেন। তবে যুবক আবদুল হাকিম নিশ্চয়ই সেদিন মুসলমান রায়ত-প্রজাদের কাছে ‘বাপের বেটা’ বলে অভিনন্দিত হয়েছিলেন। আর তালুকদার গােত্রের লােকেরা ক্ষোভে অপমানে আক্রোশে কেবলই ফুঁসেছে। বুঝে নিয়েছে : যুগ বদলে যাচ্ছে।
সত্যি সত্যিই যুগ বদলে যাচ্ছিল সেই উনিশ শো তেতাল্লিশ সালেই। সেটি মহা মন্বন্তরের বছর। হিন্দু পুরাণের মতে মন্বন্তরই তাে আনে যুগান্তর।
খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম তখন তেইশ/চব্বিশ বছরের পূর্ণ যুবক। তিন বছর আগে ম্যাট্রিক পাস করে কলেজের ছাত্র হয়েছেন, এবং সে-বছরই লাহােরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব পাস হয়ে গেছে। সেই পাকিস্তান প্রস্তাব নিয়ে তখন তার প্রচণ্ড উৎসাহ। সে-উৎসাহই সঞ্চার করে দেয়ার চেষ্টা করছেন আশপাশের সকলের মধ্যে। আশুজিয়ার তালুকদারদের শিক্ষিত ছেলেদের অধিকাংশই কংগ্রেসী। কংগ্রেসীরা ইংরেজ তাড়িয়ে স্বাধীন ভারত প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে মশগুল। হিন্দু তালুকদারদের ছেলেদের পক্ষে কংগ্রেসী হয়ে ইংরেজ-তাড়ানাের স্বপ্ন দেখাটা ছিলাে একন্তই স্বাভাবিক। কারণ, তারা জানতাে ; ইংরেজ তাড়ালেই তাদের সামনে আর কোনাে মনিব থাকবে না, তারা নিজেরাই হবে সার্বভৌম মনিব। কিন্তু জালাল খাঁর ছেলে আবদুল হাকিমের বিবেচনা তাে ছিলাে অন্য রকম। ইংরেজ চলে গেলেও মনিব হয়ে থাকবে লেদু বাবু আর জগদীশ বাবুর ছেলেরা। তখন বরং তাদের সেই মনিবত্ব আবদুল হাকিমদের ওপর নিরঙ্কুশ হয়ে চেপে বসবে। ওই মনিবদেরই হুকুমবরদারি
১৪৩
করতে হবে জিন্দেগিভর। কাজেই, আশুজিয়ার তালুকদারদের ছেলেরা ইংরেজ শাসনমুক্ত অখণ্ড ভারতবর্ষে যে নবযুগের স্বপ্ন দেখে, সেটি সিংহের গাঁওয়ের জালাল খাঁর ছেলের জন্যে মােটেই সুখ স্বপ্ন নয়। ইংরেজরা এদেশের মানুষকে শাসন, শােষণ ও উৎপীড়ন করছে—শিক্ষিত তরুণ এবং সংবেদনশীল কবি খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম এ-ব্যাপারে অসচেতন ছিলেন না নিশ্চয়ই। তবু ইংরেজের শাসন-শােষণ-উৎপীড়ন তাঁর কাছে ছিলাে পরােক্ষ, স্পষ্ট প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি আশুজিয়ার তালুকদারদের শাসন-শােষণ উৎপীড়নমূলক আচরণ। তবে ওদের সে-আচরণ হেকিম ভাইদের ওপর যে পুরােপুরি প্রত্যক্ষ ছিলাে না, সে-কথাও ঠিক। হেকিম ভাই তাে আর রায়ত-পরিবারের ছেলে ছিলেন না, কিংবা তার বাবা ছিলেন না তালুকদারদের বর্গাচাষী। তাই তাঁদের ওপর প্রত্যক্ষ উৎপীড়নের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু মানসিক উৎপীড়নের হাত থেকে রেহাই পায়নি হেকিম ভাইদের খা-পরিবারও। তালুকদারদের অহেতুক অবজ্ঞা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য হেকিম ভাইকে মানসিকভাবে ভীষণ বিপর্যস্ত করেছে। তা ছাড়া হেকিম ভাই তাে ছিলেন এমন কবিপ্রাণের অধিকারী একজন মানুষ, অনেক পরােক্ষ উৎপীড়নও যার প্রাণে প্রত্যক্ষ আঘাত হেনেছে। তার প্রতিবেশী রায়তপ্রজাদের প্রতি ভূস্বামীদের যে-সব অমানবিক আচরণ তিনি দেখেছেন, সে-সবও তাঁকে উত্তেজিত করে তুলেছে। ওই সব প্রতিবেশী রায়তপ্রজাদের মুসলমান পরিচয়টি তাদের সঙ্গে তাঁকে একাত্মবােধে সংযুক্ত করেছে, মুসলমানী স্বাতন্ত্র্য-চেতনা তাকে আশুজিয়ার হিন্দু তালুকদারদের থেকে পৃথক করে নিয়েছে, তালুকদারদের ছেলেদের স্বাধীন ভারতের বিপরীতে তাঁকে ‘আজাদ’ পাকিস্তান সৃষ্টির আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়তে উৎসাহিত করেছে, পাকিস্তান কায়েমের মধ্যেই তিনি সকল সমস্যার সমাধানের সূত্র খুঁজে পেয়েছেন। এই মনােভঙ্গি থেকেই তিনি এ-সময় গান লিখেছেন-
চাই আজাদী মেরে পাকিস্তান
দ্বীনের লাগি মুসলিম তুমি
জান দেওরে কোরবান৷
জাগিলাে তুফান, এলােরে দুর্দিন
জুলুমবাজির উদ্যত সঙ্গীন
এক হওরে আজি জোলা মুছলমান।
রক্ষিতে জানু-মাল ইজ্জত হুরমত
অধরে তুলে নাও জ্বেহাদী সরবত,
হবে গাজী নয় তাে পাবে।
শহিদী ফরমান।
নিজে অবশ্যই জ্বেহাদের ময়দানে গিয়ে গাজী অথবা শহিদ হওয়ার মতাে মানুষ ছিলেন , তবে জুলুমবাজির উদ্যত সঙ্গীন’ তিনি জগদীশ চক্রবর্তীর মতাে তালুকদারদের হাতেই দেখতে পেয়েছিলেন। ওদের ‘তুই তােকারি’র জবাব তুই তােকারি করে দিতে পারাটা তার কাছে, তাই জ্বেহাদের মতােই ছিলাে। সে-জ্বেহাদে যে তিনি গাজী হয়েছিলেন, এ-কথা মানতেই হবে। আর সেই জ্বেহাদী জোশে যে তার আশপাশের মুসলামন রায়ত-প্রজারাও গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছিলাে, সে-কথাও না-মানার উপায় নেই।
এ-রকম জ্বেহাদী জোশের সামনে প্রতিপক্ষ তালুকদাররাও রণকৌশল পাল্টাতে বাধ্য হয়েছিলাে। তাদের প্রত্যক্ষ রায়ত-প্রজা কিংবা অনভিজাত মুসলমান ও শূদ্রের শিক্ষাভিমানী
১৪৪
ছেলেদের তারা তুই’ বলা নিরাপদ মনে করছিলাে না ঠিকই, কিন্তু তাই বলে তাদের আপনি বা তুমি’ বলতেও রাজি ছিলাে না। তাই, নিরাপত্তার জন্যে আপনি, তুমি বা তুই—মধ্যম পুরুষের এই তিন সর্বনামের একটিরও ধারে কাছে না গিয়ে তারা আশ্রয় নিলাে ভাববাচ্যের দুর্গে। জানি না, ব্যাকরণ বই খুলে ভাববাচ্যের অধ্যায়টা তারা খুব ভালাে করে পড়ে নিয়েছিলাে কিনা! তবে এটুকু জানি যে, ব্যাকরণ পড়ুক আর নাই পড়ুক, ভাববাচ্যের প্রয়ােগে তারা একান্ত নিপুণ হয়ে উঠেছিলাে। আজকাল কী করা হয়?’ ‘কোথা থেকে আসা হচ্ছে? কোথায় যাওয়া হবে?’ এখানে থেকে গেলে হয় না?’—এ-রকম বাক্য প্রয়ােগ করে আপনি তুমি তুই’-এর জটিলতা তারা কৌশলে এড়িয়ে গেলাে।
কিন্তু তাতে কী হবে? যাদের এড়িয়ে যাবার জন্যে এ-কৌশল, তাদের দৃষ্টি কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া গেলাে না। তারা বরং এই কৌশল পরিবর্তনের মধ্যে অভিজাত্যগর্বী ভূস্বামীদের পরাজয় ও নিজেদের বিজয়ই প্রত্যক্ষ করলাে, এক ধরনের কৌতুক ও হাস্যরসের উপাদান পেলাে এবং বিজয়ীর আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে উঠলাে।
তবু এ-কথাও সত্য : তালুকদাররা আপন মান বাঁচাবার প্রয়ােজনে যাদের প্রতি ভাববাচ্য প্রয়ােগ করতে বাধ্য হয়েছিলাে, তাদের অধিকাংশই কিন্তু বিত্তহীন পরিবারের সন্তান নয়। এদের প্রায় সবাই এসেছে সচ্ছল কৃষক পরিবার থেকে। আর এদের ভেতর শূদ্রদের চেয়ে মুসলমানরাই সংখ্যায় বেশি। কৃষি জমির মালিকানাই তাদের সচ্ছলতার উৎস। এক সময় পাটের দাম খুব বেড়ে যাওয়ায় তাদের সচ্ছলতায় নতুন মাত্রার যােগ হয়। সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যায় আত্মচেতনা ও আত্মসম্মান বােধ। এবং সেই সঙ্গে মুসলামানত্বের বােধও। মুসলমানত্বের বােধ থেকেই পাকিস্তানের স্বপ্ন। গাঁয়ের এই সচ্ছল মুসলমানদের চোখে পাকিস্তানের স্বপ্ন সঞ্চার করে দিয়েছিলেন খান মােহম্মদ আবদুল হাকিমের মতাে স্বাপ্নিকরাই। প্রত্যেক গাঁয়েই দু-একজন করে এ-রকম স্বাপ্লিকের দেখা মিলতে লাগলাে।
শুধু সচ্ছল মুসলমানরাই নয়, পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাে গায়ের ভিটেমাটিহীন মুসলমান চাষী ও ক্ষেতমজুররাও। সিংহের গাঁয়ের খাঁ-বাড়ির আশেপাশে তাে এমন বিস্তর মুসলমানের বাস। আশুজিয়ার তালুকদারদেরই তারা মনিব বলে জেনে ও মেনে এসেছে এতােকাল। চিরকাল তারা থেকেছে মনিবের ডাকের আগে খাড়া। মনিব-বাড়ি থেকে যখনই কোনাে কাজের ফরমাস এসেছে, তখনই তারা নিজের কাজ ঠেলে রেখে মনিবের হুকুম তামিল করেছে। এর অন্যথা করা যেতে পারে এমনটি তারা ভাবেও নি কোনােদিন। অথচ এখন তারা শুধু তা ভাবলাে না, কাজেও করলাে। জালাল খাঁর ছেলে আবদুল হাকিমই তাদের তেমন ভাবনা ভাবালেন ও তেমন কাজ করালেন। অবাক হয়ে তারা দেখলাে : আবদুল হাকিমের পরামর্শে মনিবের হুকুম তামিল না-করলে মনিবরা তাদের কিছুই করে না বা করতে পারে না। এ-রকম দেখে শুনে আস্তে আস্তে তারা আশুজিয়ার তালুকদার বাড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে এনে আনুগত্যের দৃষ্টি দিলাে সিংহের গাঁয়ের খা বাড়ির দিকে। নিজেদের মুসলমান পরিচয় সম্পর্কে যেন হঠাৎ করে তারা সচেতন হয়ে উঠলাে। স্বপ্নের ঘােরেই যেন চিল্কার করে বলতে লাগলাে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’—কথাটার অর্থ বুঝুক আর না-ই বুঝুক।
১৪৫
গ্রামবাংলায় শূদ্র প্রজার জীবনমান ও মান-অপমান
আশুজিয়ার মতাে নওপাড়াও ছিল প্রতাপান্বিত ব্রাহ্মণ ভূস্বামীদের একটি গ্রাম। আশুজিয়ার চেয়ে নওপাড়া আয়তনে অনেক বড়াে। আসলে পৃথক পৃথক নামের নয়টি পাড়ার সমষ্টিই এই নওপাড়া গ্রামটি।
এই নওপাড়াতেও আমি ছেলেবেলায় অনেকবার গিয়েছি। আশুজিয়ার মতাে একই দৃশ্য দেখেছি ও একই রকম কথা শুনেছি। বুঝেছি, বাংলাদেশের স্থানে স্থানে সামন্ততন্ত্রের যে অচলায়তনগুলাে তৈরি হয়েছিল সেগুলাের প্রকৃতি একই রকম। আবার এ-ও জেনেছি: সব অচলায়তনের পাঁচিলেই থাকে ছিদ্র, সেই ছিদ্রগুলাে আস্তে আস্তে বড়াে হতে থাকে, অচলায়তনের বাসিন্দাদেরই কেউ কেউ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে এগুলােকে বড়াে করে তােলে এবং বাইরেরও অনেকে এসে হাত লাগিয়ে এক সময় গােটা পাঁচিলটাকেই ভেঙে ফেলে।
দৈত্যপুরীর প্রহলাদের মতােই নওপাড়া থেকে বেরিয়ে আসেন মহাদেব সান্যাল। সিংহের গাঁওয়ের খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমের মতােই নওপাড়ার মহাদেব সান্যালও আমার সতেরাে বছরের অগ্রজ এবং অগ্রজ হয়েও বন্ধু । আমার এই অগ্রজপ্রতিম বন্ধু একান্ত শুভানুধ্যায়ী মানুষটির কাছ থেকেও গ্রামীণ সামন্ততন্ত্রের ভেতর মহলের অনেক খবর শুনতে পেয়েছি।
কৃষ্ণসুন্দর সান্যালের পুত্র মহাদেব সান্যাল নওপাড়া হাই স্কুলে যখন ক্লাস সিক্সের ছাত্র তখনই যুক্ত হয়ে পড়েন ব্রিটিশ-বিরােধী বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির কাজকর্মের সঙ্গে। নওপাড়ারই সুধাংশু রায় স্থানীয় অনুশীলন সমিতির নেতা। তারই তত্ত্বাবধানে গাঁয়ে গড়ে ওঠে যুবসংগঠন এবং যুবসংগঠনের পরিচালনায় ব্যায়ামাগার ও পাঠাগার। ব্যায়াম করে সুস্থ সুঠাম দেহ গঠন আর বই পড়ে মনকে উন্নত ও সমৃদ্ধ করে তােলাই ছিল অনুশীলন সমিতিপরিচালিত ব্যায়ামাগার ও পাঠাগারের লক্ষ। চূড়ান্ত লক্ষ ইংরেজ বিতাড়ন।
অনুশীলন সমিতির শিক্ষায় ইংরেজ-বিতাড়নের চিন্তা মাথায় নিয়েই মহাদেব সান্যাল বড়াে হয়ে উঠেছিলেন। উনিশ শো ছত্রিশ সালে ম্যাট্রিক পাস করে গেলেন কলকাতায়। কংগ্রেসের ভলান্টিয়ারি করলেন, ছাপাখানার কাজ শিখলেন, ইনসিওরেন্স কোম্পানির চাকরি নিলেন, এবং এ-সবের মাঝেই ক্যুনিস্ট নেতাদের সংস্পর্শে এসে এক সময় আগেকার চিন্তাভাবনার খােলনলচে বদলে ফেলে ক্যুনিস্ট হয়ে গেলেন। নওপাড়া গাঁয়ের ছেলেদের মধ্যে তিনিই সম্ভবত প্রথম কম্যুনিস্ট।
এরপর গায়ে ফিরে এসে যে-চোখ দিয়ে গাঁয়ের মানুষদের জীবন এবং নিজের গুরুজনদের আচার আচরণ দেখলেন সে চোখ কমুনিস্টের। আগে যা দেখতেন না এখন কমনিস্টের চোখ দিয়ে তা দেখতে পান। আগে যে-রকম দেখতেন এখন সে-রকম দেখেন না।
তার মামার বাড়িও ছিল নওপাড়া গ্রামেই। এবং, স্বভাবতই, মামারাও ছিলেন সামন্ততন্ত্রের প্রতিভূ। হিন্দুত্ব ও ব্রাহ্মণত্ব সম্পর্কে অতি সচেতন। হিন্দুত্ব রক্ষণের লক্ষ নিয়েই মহাদেব বাবুর বড় মামা সতীশ চন্দ্র রায় হয়েছিলেন কট্টর হিন্দু মহাসভাপন্থী। শুধু পন্থী নয়, রীতিমত নেতা। নেত্রকোনা মহকুমা হিন্দুমহাসভার সভাপতি। অন্য মামারাও ভূস্বামিত্ব ও ব্রাহ্মণত্বের অভিমানে কম যান না। মামাদের সঙ্গে ভাগ্নে মহাদেব সান্যালের ব্যক্তিগত সম্পর্ক খারাপ ছিল না। কিন্তু তাই বলে কোদালকে কোদাল বলতে মহাদেব বাবু কোনােদিনই ইতস্তত করেন না। বিশেষ করে কম্যুনিস্ট হয়ে ভূস্বামীদের শােষণ নিপীড়ন ও বর্ণহিন্দুদের সংকীর্ণতার নিন্দায় তাে তিনি
১৪৬
রীতিমত উচ্চকণ্ঠ। তাঁর মুখেই শুনেছি তার মেজোমামা বঙ্কিম রায়ের কথা। বঙ্কিম রায়কে একদিন এক কায়স্থ প্রজা জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে নমস্কার করেছিল। মুখে অবিশ্যি বলেছিল, ‘প্রণাম কর্তা’। এতে ব্রাহ্মণ বঙ্কিম রায় তাে ভীষণ অপমানিত বােধ করলেন, হয়ে উঠলেন কুদ্ধ ও উত্তেজিত। তাঁর প্রশ্ন : এতাে স্পর্ধা ওই শূদ্রটা পায় কোথায়? শূদ্র ব্রাহ্মণের পায়ে হাত দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করবে—এই চিরকালের বিধান। আর এ-ব্যাটা কিনা সােজা খাড়া হয়ে থেকে হাত জোড় করে নমস্কার জানায়; আরে, এ-রকম নমস্কার বিনিময় তাে হয় সমানে সমানে,ব্রাহ্মণে ব্রাহ্মণে কিংবা শূদ্রে শূদ্রে। বর্ণশ্রেষ্ঠ যে ব্রাহ্মণ তাকে প্রণামের বদলে যদি নমস্কার জানায় ক্ষুদ্র ব্যাটা, তবে তাে একে ইয়ারকি ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
ব্রাহ্মণের সঙ্গে এই ইয়ারকির জন্য বেয়াদব শূদ্রটি শুধু মাপ চেয়ে রেহাই পায়নি, জুতাপেটা হয়ে তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়েছিল।
বঙ্গীয় ব্রাহ্মণদের স্মৃতির বিধানে কায়স্থরা শূদ্র হলেও সৎ শূদ্র। কাজেই কায়স্থের প্রতি ব্রাহ্মণের আচরণ এতাে কঠিন হওয়ার কথা নয়। কিন্তু ধর্মশাস্ত্রের বিধানের সঙ্গে সামন্ততন্ত্রীয় অর্থশাস্ত্রের বিধান যুক্ত হয়ে অবস্থাটাকে আরাে জটিল করে তুলেছিল। কায়স্থ হলেই যে সবাই সমান সামাজিক মর্যাদার অধিকারী তাতাে হতে পারে না। যে-সব কায়স্থ কায়িক শ্রমে নিয়ােজিত, বিত্তহীন ও সহায়সম্বলহীন, যারা বেঁচে থাকার জন্য ব্রাহ্মণ বৈদ্য কিংবা অন্য কোনাে কায়স্থ ভূস্বামীর দয়ার ওপর নির্ভরশীল, যারা ওই ভূস্বামীদের নানকার প্রজা, তারা স্মৃতির বিধানে সৎশূদ্র হলেও সামাজিক বিচারে বংশানুক্রমিকভাবেই হেয়। এমন কি ওরা লেখাপড়া শিখে ভদ্র’ জীবিকা অবলম্বন করলেও ভূস্বামী ভদ্রলােক’ শ্রেণী তাদের ভদ্রলােকত্ব স্বীকারে রাজি হতাে না। কায়স্থ সম্প্রদায়ভুক্ত ভূস্বামীরাও গতরখাটা ও তালুকদারদের করুণা-নির্ভর কায়স্থ প্রজাদের প্রতি তাে বটেই, তাদের শিক্ষিত সন্তানদের প্রতিও যে অমানবিক আচরণ করতাে, তার দৃষ্টান্ত দিয়েছেন বিলাত প্রবাসী প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী নীরদচন্দ্র চৌধুরী।
নীরদবাবু কিশােরগঞ্জের বনগ্রামের কায়স্থ ভূস্বামী চৌধুরী পরিবারের সন্তান। কৈশােরের স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন,
“১৯১৩ সনে কলিকাতায় মেসে থাকিয়া স্কুলে পড়ি, গ্রীষ্মের ছুটিতে বনগ্রামে আসিয়াছি, অন্য দুই-একজন আত্মীয়ও আসিয়াছেন, তাঁহারা কাজ করেন। তাঁহাদের সহিত দেখা করিবার জন্য পাশের গ্রাম হইতে তাঁহাদের এক পুরাতন সহপাঠী আসিলেন। তাহার নাম সতীশ দে, বনগ্রামের হাইস্কুলে তিনি তখন শিক্ষকতা করিতেন। তিনি কলিকাতায় এক মেসে তাহাদের সঙ্গে অন্য সহপাঠী বা সহকর্মীর মতই থাকিতেন। সুতরাং তাহাকে আমাদের বড় আটচালার বৈঠকখানায় অন্য দ্রলােকের মত ফরাসেই বসানাে হইল । বাড়ির অন্য বালকেরা আমার মত ও আমার দাদার মত কলিকাতার অনাচারে বংশের গৌরব বিস্মৃত হয় নাই, তাহারা গিয়া গৃহিণীদের খবর দিল যে, সতীশ দে ফরাসে বসিয়াছে। তিনি চলিয়া গেলে যখন আমি ভিতরে গেলাম তখন দেখি গৃহিণীরা সিংহীর মত গর্জন করিতেছেন। আমাকে দেখিয়াই তর্জন করিয়া বলিলেন, “তােরা সতীশ দে কে ফরাসে বসিয়েছিস! আমি অবাক হইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, তাতে কি হয়েছে। ক্রুদ্ধস্বরে উত্তর আসিল, “কি হয়েছে? আমাদের ভাণ্ডারীর নাতি এসে আমাদের ফরাসে বসবে? সত্যই সতীশ বাবুর ঠাকুরদাদা আমাদের ভাণ্ডারী ছিল, কিন্তু তাঁহার পিতা ভৃত্যের কাজ ছাড়িয়া পাশের গ্রামে মুদি হইয়া পয়সা করিয়াছিল, সতীশ বাবু নিজে বি-এ পাশ। আমি শেষ প্রশ্ন করিলাম, তা হল কোথায় বসানাে উচিত ছিল?’ জ্যাঠাইমা বলিলেন, “কেন? মেঝের ওপর পিড়িতে। আমি নিরুত্তর হইয়া গেলাম।
১৪৭
বলাই বাহুল্য বংশমর্যাদা এইভাবে পুরুষানুক্রমে বজায় রাখিবার জন্য আমরা সামাজিক আচরণে আদর্শস্থানীয় বলিয়া স্বীকৃত হইতাম।” (শারদীয় ‘দেশ ১৩৯৭, পৃষ্ঠা ১১৭) ।
সতীশ দে জাতে কায়স্থ শিক্ষায় গ্রাজুয়েট এবং পেশায় শিক্ষক হলেও তাঁর পিতামহ তালুকদারদের ভাণ্ডারী বা ভৃত্য ছিলেন বলে বনগ্রামের কায়স্থ ভূস্বামী পরিবারের গৃহিণীরা পর্যন্ত এই শিক্ষিত মানুষটিকে ভদ্রলােকের মর্যাদা দিতে যদি নারাজ থাকেন, তবে নওপাড়া গ্রামের ব্রাহ্মণ ভূস্বামীরা কী করে তাঁদেরই অনুগ্রহে পালিত ও ভৃত্যস্থানীয় শূদ্র কায়স্থটির স্পর্ধাকে হজম করতে পারেন?
স্মৃতিশাস্ত্রের বিধানে যারা সৎশূদ্র বলে পরিগণিত তাদেরই যেখানে এ-অবস্থা, সেখানে। অচ্ছুৎ অসৎ শূদ্রদের অবস্থান তাে সহজেই অনুমান করা যায়। ধােপা, মালি, জেলে, পাটনি গ্রামসমাজে এ-সব বৃত্তিজীবী শূদ্রদের অবস্থা আসলেই ছিল একান্ত শােচনীয়। এরা বৃত্তিজীবী ছিল বটে, কিন্তু বৃত্তিতে স্বাধীন ছিল না। ঘর বেঁধে থাকার জন্য ভূস্বামীরা এদেরকে এক টুকরাে জমি দিততা, সামান্য ফসলি জমিও বরাদ্দ করতাে। কিন্তু বাড়ির ভিটে বা ফসলের ক্ষেত কোনােটার ওপরই তাদের মালিকানা থাকতাে না। এরা হতাে জমির মালিক তথা জোতদারতালুকদারদের চাকরান বা নানকার প্রজা। মালিক-বাড়ি থেকে যখনই ডাক আসতাে তখনই তাদের সে-ডাকে সাড়া দিয়ে হুকুম তামিল করতে হতাে। এর অন্যথা হবার কোনাে উপায় ছিল না। মালিক তার মর্জি মাফিক যে-কোনাে সময়ে যে-কোনাে চাকরান বা নানকার প্রজাকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে পারতাে। ধােপা তার মনিব বাড়ির সকলের কাপড়-চোপড় ধুয়ে দেবে, মালি মনিবের বাড়িঘর সাফ সুতরা করে রাখবে, জেলেকে তলব করলেই মনিবের বাড়ির জন্যে মাছের জোগান দিতে হবে, কাজে সামান্য শৈথিল্য বা ত্রুটি দেখা দিলে তাদেরকে শুধু গালাগালিই শুনতে হবে না, শারীরিক নির্যাতনও ভােগ করতে হবে।
নওপাড়ার হরিবল ধােপা ছিল মহাদেব সান্যালের মামাদের নানকার প্রজা। অন্য সব ধােপা-মালি-জেলের মতাে হরিবলও নিতান্তই দরিদ্র, নিজের সম্বল বা সম্পত্তি বলতে কিছুই নেই, নিজের জীবন ও জীবিকার জন্য কর্তাবাবুদের দয়ার ওপর পুরােপুরি নির্ভরশীল। রায় কর্তাদের (অর্থাৎ মহাদেব বাবুর মামাদের) বাড়ির সকলের কাপড়-চোপড় ধুয়ে দেয়ার বিনিময়ে সামান্য ফসলি জমি হরিবল ভােগ করতাে। একদিন সেই রায়কর্তাদের একজন—সারদা কান্ত রায়—শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে এসে দেখেন তার ভাগিনীর পরনের কাপড়টি ময়লা। ভাগিনীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করে জানলেন যে কী এক অসুবিধার দরুন হরিবল ধােপা ক’দিন ধরে আসতে পারছে না, তাই–। কী, ধােপার ব্যাটার এতাে আস্পর্ধা! তার অসুবিধার জন্যে সারদাকান্ত রায়ের ভাগিনীকে ময়লা কাপড় পরে থাকতে হবে! দেখাচ্ছি মজা! সারদা বাবু গৃহভৃত্যকে হুকুম দিলেন, এক্ষুনি হরিবলের ক্ষেতের সব পাট কেটে নিয়ে আয়!’ সঙ্গে সঙ্গে কর্তার হুকুম তামিল হয়ে গেলাে।
যথারীতি হরিবল এসে কর্তাদের হাতে পায়ে ধরে, জীবনে আর এ-রকম অপরাধ করবে।
বলে নাক খত দিয়ে, এবং তারপরও পিঠে দু’চার ঘা খেয়ে সে-যাত্রায় কোনাে রকমে বেঁচে গেলাে।
কিন্তু এ-রকম বাঁচাকে কি বাচা বলে? ব্রিটিশ-সৃষ্ট নয়া সামন্ততন্ত্রের অধীনে গ্রাম বাংলার অগণিত রায়ত ও নানকার চাকরান শূদ্রপ্রজা কি সত্যি সত্যিই বেঁচে ছিল? আর বেঁচে যদি না-ই থাকে তাে বাঁচার জন্য কোন্ পথের সন্ধান তারা করেছিল?
১৪৮
চল্লিশের দশকে এবং তারও কিছু আগে থেকে মুসলমান রায়ত প্রজাদের দেখি নিজেদের মুসলমান সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠতে। এই সচেতনতাই আস্তে আস্তে তাদের কণ্ঠে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের জিগির তুলে দেয়। তখনকার দেশীয় শােষকগােষ্ঠীর বড়াে তরফ আর ছােট তরফের দ্বন্দ্ব থেকেই যে পাকিস্তান আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল—বামপন্থী তাত্ত্বিকদের এই অনুমিতিকে অবশ্যই অস্বীকার করা যায় না। এবং এই দ্বন্দ্বকে উসকে দিতে বিদেশী বিভাষী বিজাতি শাসকরা যে একটা বড়াে ভূমিকা গ্রহণ করেছে, তাদের ভাগ করে শাসন করার কূটনীতিই যে এই দু’তরফ অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমানের ভেতরকার সংঘাতকে চূড়ান্ত পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে—কংগ্রেসীদের এ বক্তব্যও মিথ্যা নয়।
তবু, এরপরও, কথা থাকে। মুষ্টিমেয় সুবিধাভােগী মানুষের হাতে নির্জিত, শোষিত ও অপমানিত হয়েছে অপরিমেয় মানুষ। সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিচারে মুসলমানরা যদিও সংখ্যায় বেশি; তবু সুবিধাবঞ্চিত ও নিগৃহীত হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত শূদ্রদের সংখ্যা তাে নগণ্য ছিল না। এক্ষেত্রে মুসলমান শূদ্র নির্বিশেষে সুবিধাবঞ্চিত নিপীড়িত সকলকে মুখে একই স্লোগান নিয়ে এক কাতারে এসে দাঁড়ানাের কথা ছিল। কিন্তু তেমনটি হয়নি কেন? কেন বামপন্থীদের নেতৃত্ব মেনে নিয়ে হিন্দু-মুসলমান রায়ত প্রজারা ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিহত করে শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় কাতারবন্দি হলাে না? কেন ধােপা হরিবল, মালি রামদাস আর পাটনি শম্ভুচরণ মুসলমান রায়ত চাষা মফিজ শেখ, কইট্যার বাপ কিংবা আবদুল আলির সঙ্গে শােষিতের ঐক্যে একাত্ম হয়ে একই রাজনীতির মঞ্চে মিলিত হলাে না? কেন দেশের ধনী-দরিদ্র শােষক-শােষিত মুসলমানদের প্রায় সকলে একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জান দেয়া ও জান নেয়ার সর্বনাশা খেলায় মেতে উঠলাে? এক্ষেত্রে ব্রিটিশের ভেদনীতিই বা এমন সফল ও সার্থক হলাে কেন?
এই সব ‘কেন’র নির্মোহ উত্তর খুঁজে না নিয়ে পাকিস্তানের জন্মব্যাখ্যার কোনাে সঠিক তত্ত্বই কেউ নির্মাণ করতে পারবে না।

নানান বরণ গাভীরে ভাই, একই বরণ দুধ
আমাদের গাঁয়ে ও তার আশপাশের সবগুলাে গায়ে যে সব মানুষদের ছেলেবেলা থেকে দেখেছি, যাদের সঙ্গে সব সময় ওঠাবসা করেছি, তাদের শতকরা আশি ভাগই অসচ্ছল, অনক্ষর, খেটেখাওয়া মানুষ। তাদের সবারই সারা বছর ধরেই, নুন আনতে পান্তা ফুরােয়। এদের কারাে নাম মফিজ শেখ, আকাইল্যা, পাইন্যার বাপ আর কারাে-বা নেউলা, অপর্ত, রইস্যা, ফটিক। আদম শুমারির সময় এদের কারাে নামের পাশে লেখা হয় মুসলমান, কারাে পাশে হিন্দু। নাম শুনেই অবিশ্য কে হিন্দু কে মুসলমান সব সময় বােঝা যায় না। যার নাম রইস্যা সে মুসলমানও হতে পারে হিন্দুও হতে পারে। যদি কখনাে কোনাে কারণে তার নাম লেখার প্রয়ােজন দেখা দেয়, তবেই হয়তাে ধরা পড়বে যে ওর আসল নাম হয় রসিক, নয় তাে রসিদ। রসিক হলে সে হিন্দু আর রসিদ হলে মুসলমান। এ কথাও অবিশ্যি সব সময় খাটে না। রসিক নামের মানুষেরও মুসলমান হতে কোনাে বাধা নেই। ফটিক বা আইল্যা বা নেউলা নাম শুনেই-বা কে বলে দিতে পারবে সে হিন্দু না মুসলমান? আর মুসলমান হলেই-বা কী, হিন্দু হলেই-বা কী! যে সংস্কৃত মন্ত্র দিয়ে হিন্দুর হিন্দুত্ব দেবতার মন্দিরে ও আরবি সুরা দিয়ে মুসলমানের মুসলমানত্ব আল্লার মসজিদে গ্রাহ্য হয়, সেই মন্ত্র বা সুরা কোনােটার সঙ্গেই তার
১৪৯
প্রত্যক্ষ পরিচয় বা সম্পর্ক নেই। পূজা কিংবা রােজার প্রতি তার সম্ভ্রমের অন্ত নেই, পুরাণ কিংবা কোরানের প্রতিও তার গভীর ভক্তি। কিন্তু পুরাণ কিংবা কোরান দুয়েরই অক্ষর তার অচেনা। এর জন্য তাকে পুরুত কিংবা মােল্লার মুখেই ঝাল খেতে হয়, যদিও এ রকম ঝাল খেতে সে সব সময় রাজি হয় না, কায়দা পেলেই ওদের ওপর নানাভাবে ঝাল ঝাড়ে। তার ছড়ায় প্রবাদে গল্পে গাথায় এরকম ঝাল ঝাড়ার বহুৎ দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
জন্মের অধিকারেই বামুন হয় হিন্দুর পুরুত, শুদ্র তাকে দেবতা বলেই মানতে বাধ্য। শূদ্র তাে আর বেদ পড়তে পারে না, তাই বামুনের কথাই শূদ্রের কাছে বেদবাক্য। তবু সেই বামুনকেও সে ছেড়ে কথা কয় না। গাঁয়ের শূদ্রদেরই ছড়া কাটতে শুনেছি—কলির বামুন টোড়া সাপ, যে না মারে তার পাপ।’ অর্থাৎ বামুনরা যে প্রচার করে বামুনের গায়ে শূদ্র যদি হাত তােলে তবে সে পাপে তার নরকবাস অনিবার্য, সে কথারই ব্যঙ্গাত্মক প্রতিবাদ এই ছড়াটি । সত্যযুগের বামুনের ব্রহ্মশক্তি থাকলেও থাকতে পারে, সে যুগের বামুনের গায়ে হাত তােলা হয়তাে মহাপাপই ছিল। কিন্তু কলি যুগের বামুনের সেই ব্রহ্মতেজ মােটেই নেই, সে এখন টোড়া সাপের মতােই শুধু ফোস ফোস করে। একে না মারাই তাে বরং মহাপাপ।
বামুনকে শূদ্ররা ঠাকুর’ বলে। ঠাকুর মানে দেবতা। কিন্তু কলিযুগের ঠাকুরদেবতাদের চরিত্র যে ফুলের মতাে পবিত্র নয় তা জানে বলেই ঘৃণা ও বিদ্রুপের সঙ্গে গাঁয়ের মানুষ ছড়া কাটে—“ঠাকুর ঠুকুর এগারাে, জাইত্যা ধরাে পাগারাে। যদি ঠাকুর লড়ে, ঘাড় ভাইঙ্গা মরে। ‘পাগার’ মানে ডােবা। ডােবার জলে বামুন ঠাকুরকে ঠেসে ধরতে হবে এবং তারপরও যদি সে নড়াচড়া করতে চায় তবে ঘাড় ভেঙে মৃত্যু অনিবার্য।
বামুনরা তাদের সুবিধা ও মতলব মতাে শাস্ত্রের ব্যাখ্যা হাজির করে দেখেছি, এ বিষয়েও গ্রাম্য প্রাকৃতজন একান্ত সচেতন। নেত্রকোনার কবিয়ালরা কবিগানের আসরে এমন একটা মজাদার গল্প পরিবেশন করেন যাতে প্রমাণ পাওয়া যা যে, যাজক বামুন যদি হয় বুনাে ওল তবে যজমান শূদ্র হচ্ছে বাঘা তেঁতুল।
হিন্দুদের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের একটি উপকরণ হচ্ছে কুশ। উত্তর ভারতে কুশ নামে যে তৃণটি জন্মে বাংলায় তারই বিকল্প রূপে যা ব্যবহার করা হয় তা হচ্ছে ‘কাশ’ বা ‘কাইশ্যা। (শরৎকালে যাতে ফোটে কাশফুল’)। এক বামুন ঠাকুর গিয়েছেন যজমান বাড়িতে শ্রাদ্ধের পৌরােহিত্য করতে। যজমান বললাে, “কর্তা মশায়, দয়া করে আপনাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এখনাে কাইশ্যা আনা হয়নি তাই। কর্তা মশায়ের ছিল ভীষণ তাড়া। তাঁকে এক্ষুনি আবার আরেক বাড়িতে পুরুতগিরি করতে ছুটতে হবে। তাই যজমানের কথা শেষ না করতে দিয়েই বললেন, কাইশ্যা লাগবে না, কিছু খ্যাড় (খড়) নিয়ে এসাে।’ কাইশ্যার কাজ খ্যাড় দিয়ে হয় কী করে?’
কর্তা বলেন, হয়, হয়। বিপ্রস্য বচনং মূলং খ্যাড়ং কাইশ্যা। মানে হলাে গিয়ে ব্রাহ্মণ যদি বলে দেন তাে খ্যাড়ই কাইশ্যা হয়ে যায়। ব্রাহ্মণের কথাই তাে শাস্ত্র নিয়ে এসাে এক গাছা খ্যাড়।
খ্যাড় দিয়েই শ্রাদ্ধের কাজ সারা হলাে। এবার বামুন ঠাকুরকে দক্ষিণা দেয়ার পালা। যজমান একটি থলে ঠাকুরের হাতে তুলে দিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করলাে। থলেটা বেশ ভারি মনে হচ্ছে। ঠাকুর মশাই ভীষণ খুশি। কিন্তু থলের মুখ খুলেই তিনি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন,
১৫০
কী, আমার সঙ্গে তুই ঠাট্টা করিস? পয়সার বদলে থলের ভেতর পুরে দিয়েছিস কতকগুলাে ঝিক।’
নেত্রকোনা এলাকায় মাটির হাঁড়ি পাতিল ভাঙা খােলাম কুচিকে বলে ঝিক। ছােট ছেলেমেয়েরা তাদের খেলনা পয়সা বানায় এই ঝিক দিয়ে।
ঝিকের থলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঠাকুর মশাই চিৎকার করতে লাগলেন, আমি কি তাের ঠাট্টার পাত্র? তুই ব্যাটা নির্বংশ হবি, তাের হাতে কুষ্ঠ হবে, তুই…।’
যজমান শান্ত কণ্ঠে বললাে, ‘চটবেন না কর্তা। আপনি যেমন খ্যাড় দিয়ে কাইশ্যার কাজ সেরেছেন, আমিও তেমনি পয়সার বদলে ঝিক দিয়েছি। ব্রাহ্মণের কথায় যদি খ্যাড়ই কাইশ্যা হয়ে যেতে পারে তাে যজমানের কথায় ঝিক কেন পয়সা হবে না? মনে রাখবেন যজমানস্য বচনং মূলং ঝিকং পয়সা। আমি এই ঝিকই আপনাকে দক্ষিণা দিলাম।
সুযােগ পেলেই গাঁয়ের মানুষ বামুন ঠাকুরদের এই ‘ঝিকংপয়সা’র গল্পটি শুনিয়ে দেয়।
বামুন ঠাকুরদের মতাে মােল্লাদের নিয়েও গ্রামের প্রাকৃতজনদের একই রকম ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করতে দেখেছি। কাঠমােল্লা’ কথাটার মধ্যেই তাে রয়ে গেছে ঘৃণা ও অবজ্ঞা। মােল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত’–এই প্রবাদ মােল্লাদের সংকীর্ণতা ও কূপমণ্ডুকতার কথাই জানিয়ে দেয়। কিন্তু তাই বলে প্রকৃত আলেমকে সম্মান জানাতে প্রাকৃতজনও ভুল করে না।
বামুন ঠাকুরের মতােন যে মােল্লারা ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করে তাদের প্রতি ঘৃণা জানিয়ে গাঁয়ের মানুষ ছড়া বানিয়েছে-
সাত বাড়ির ভাত খাইয়া/মােল্লা মরে পেট লইয়া
চালাে (চালে) উইঠ্যা দেখে/আর নি কেউ ডাকে।
শুধু মােল্লা নয়, ভণ্ড পিরেরা যে নানা অসামাজিক কাজকর্ম করে তার প্রতিও ঘৃণা জানিয়ে গ্রামের গায়েন গানের আসরে সকলকে সতর্ক করে দিয়ে বলে—
এই না পিরে দেশটা নষ্ট, নষ্ট মাইয়া লােক
ভেল্কি মাইর্যা দেখায় এরা সারা ভেস্তের সুখ
শোন শােন ভাই সকল, শােন দিয়া মন
ঠগ মৌলবী পিরের কথা না মাইন্য কখন৷
ভণ্ড পির মােল্লা আর গুরু পুরােহিতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বা ঘৃণা জানায় যারা, তারাই আবার পীরের দরগা কিংবা বাবা ঠাকুরের থানে যায় মানত আদায় করতে। সংসারে জীবিত মানুষের কাছে যখন নানাভাবে কেবল প্রতারিতই হতে থাকে, তখন তারা মৃত পির বা সন্তের কাছে যায় আশ্রয় ও আশ্বাসের আশায়। সেখানেও অবিশ্যি পিরের জীবিত খাদেম বা সন্তের সেবায়েদের নানা রকম প্রতারণার শিকার তারা হয়, তবু মৃত পির বা সন্তের প্রতি গভীর বিশ্বাস তাদের দরগা বা থানে বারবার টেনে নিয়ে যায়। নিঃসন্তানের সন্তান লাভের কামনাই হােক কিংবা সন্তানবতীর সন্তানের কল্যাণ কামনাই হােক, কিংবা হােক কঠিন রােগের হাত থেকে মুক্তি বা মামলায় জয়লাভের কামনা,সব কিছুর জন্য মৃতের কাছে ধরনা দেওয়াটাই জীবিতের শরণ নেয়ার চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদ মনে হয় তাদের কাছে। আর এ ব্যাপারে হিন্দু ও মুসলমানের কোনাে পার্থক্য নেই। নেত্রকোনার মদনপুরে শাহ সুলতানের দরগায় রােজ যারা শিরনি দিয়ে যায় তাদের কে হিন্দু কে মুসলমান এ প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞেস করে না, নিজেরাও হিন্দু কি মুসলমান তা মনে রাখে না। আমাদের গ্রাম থেকে নেত্রকোনা যেতে হয় মদনপুরের শাহ
১৫১
সুলতানের দরগার সামনে দিয়ে। নেত্রকোনার দিকে যাত্রা করলেই ঠাকুরমা আমাকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিতেন যে এক আনার বাতাসা কিনে শাহ সুলতানের দরগায় শিরনি দিয়ে যেতে যেন ভুলে না যাই।
শরীরে ম্যাজ’ বা আঁচিল দেখা দিলে আমাদের এলাকার মানুষ কেন্দুয়ার লস্করপুরের শিববাড়িতে গােল মরিচ মানৎ করতাে। শিব ঠাকুরকে গােল মরিচ দিলে নাকি শরীরের আঁচিল মিলিয়ে যায়। এ বিশ্বাসেও হিন্দু আর মুসলমানের কোনাে ভেদ ছিল না। চন্দপাড়ার কালী বাড়িতে প্রতি বছর ফাল্গুন চৈত্র মাসে যখন পুজো হতাে তখন গাঁয়ের অনেক মানুষ দেবীকে উৎসর্গ করার জন্য পাঠা (ছাগ) নিয়ে আসতাে, সে মানুষদের মধ্যে সুবল দাসদের মতােন আকালু শেখরাও থাকতাে। এ সব ব্যাপারে অর্থাৎ পিরের দরগায় শিরনি দিতে কিংবা শিব বাড়িতে গােল মরিচ ও কালী বাড়িতে ছাগ উৎসর্গ করতে—পুরুত বা মােল্লার নিষেধ বিধিকে থােড়াই পরােয়া করতাে তারা। পিরের শিরনি তাে হতাে ঘরে ঘরে। সারা বাংলার সত্যপির ছাড়াও আমাদের এলাকায় শিরনি দেয়া হতাে হাজির পির, ঠুনকা পির, আৎখা পির, কানুপির এবং এ রকম আরাে অনেক পিরের নামে। আমার ঠাকুর মাকেও এ সব শিরনি দিতে দেখেছি।
সংস্কৃত মন্ত্র বা আরবি সুরা জানুক আর নাই জানুক গাঁয়ের মানুষ জানতাে তার দৈনন্দিন বালা মুসিবত দূর করার মন্ত্র। সবাই সব মন্ত্র জানতাে না নিশ্চয়, তবে বিভিন্ন বিষয়ের মন্ত্র জানা নানা বিশেষজ্ঞ গুণিন গায়ে ছিল অনেক। যেমন সাপের বিষ নামানাের ওঝা, বােরাে ক্ষেতের ওপর থেকে শিলাবৃষ্টি দূর করে দেয়ার হিরালি, ভূত ছাড়ানাের কবিরাজ। গায়ের শতকরা আশি বা পঁচাশি জন কিংবা তারও বেশি মানুষের কাছে এই সব ওঝা, হিরালি, কবিরাজের মান্যতা পুরুত বা মােল্লার চেয়ে অনেক বেশি। রােগ ব্যারামেও ডাক্তারের চেয়ে এই সব ওঝা গুণি ও কবিরাজদের ওপর তাদের অনেক বেশি ভরসা ও নির্ভরতা। আর এদের ওপর নির্ভর না করে বা ভরসা না রেখেই বা কী করবে, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার সুযােগ বা ক্ষমতাই তাদের কতােটুকু? লৌকিক জগতের সমস্ত সুযােগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত বলেই তাে তারা অলৌকিকের শরণ নেয়।
এভাবেই সুখে দুঃখে আশায় নিরাশায়, বিশ্বাসে অজ্ঞতায়, সংস্কারে কুসংস্কারে গাঁয়ের সব প্রাকৃতজনকে এক সাথে জড়াজড়ি করে থাকতে দেখেছি। আকালু শেখ আর সুবল দাসদের মধ্যে যে হাতাহাতি হয়নি কখনাে, তা নয়। তবে হাতাহাতির চেয়ে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতেই তারা বেশি অভ্যস্ত ছিল। দিনের কাজের শেষে সন্ধ্যায় তারা যে আসর জমাতাে তাতে একই ধরনের বন্দনায় গলা মিলিয়ে গাইতাে।
পুবেতে বন্দনা করি পুবের ভানুশ্বর। একদিকে উদয় গাে ভানু চৌদিকে পশর৷ উত্তরে বন্দনা করি হিমালয় পর্বত। যেখানে রাইখ্যাছে আলী মাল্লামের পাথর। পশ্চিমে বন্দনা করি মক্কা হেন স্থান। উদ্দিশে জানায় গাে সেলাম মমিন মুসলমান। দক্ষিণে বন্দনা করি ক্ষীর নদী সাগর। যে দরিয়ায় বাণিজ্য করছে চান্দ সদাগর।
১৫২
পুবের ভানুশ্বর আর আলীর মাল্লামের পাথর, মক্কা হেন স্থান আর ক্ষীর নদী সাগরকে একই সঙ্গে বন্দনা করার ব্যাপারটি পুরুত বা মােল্লা কেউ অনুমােদন করলাে কিনা তা নিয়ে কোনােই মাথা ব্যাথা নেই সুরুজ আলী বয়াতী কিংবা পীতাম্বর গায়েনের। তাদের একজন যে মুসলমান এবং আরেকজন হিন্দু, সে কথা তারা জানে ও মানে। কিন্তু হিন্দুর পুঁথিতে কিংবা মুসলমানের কিতাবে কী আছে তার খোঁজ খবর না নিয়েই তারা বিশ্বাস করে যে হিন্দু আর মুসলমান একই বংশের লােক। আদমের দুই পুত্র হাবিল আর কাবিল। হাবিলের ছেলেরা হয়েছে মুসলমান, আর কাবিলের ছেলেরা হিন্দু। সৃষ্টিকর্তাই তাদের দুজনকে দু’রকম আচারের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। একজনের মুর্দাকে যে গােরস্থানে নিয়ে কবর দিতে হয় আর অন্যজনকে পােড়াতে হয় শ্মশানে নিয়ে, একজনের জন্য যে শুয়াের খাওয়া হারাম আর অন্য জনের গােমাংস ভক্ষণ নিষিদ্ধ—তাও ওই একই ব্যবস্থা থেকে পাওয়া। কাজেই এ নিয়ে ঝগড়া বিবাদ করার কিছুই নেই। নানান বরণ গাভীরে ভাই, একই বরণ দুধ। জগৎ ভরমিয়া দেখলাম একই মায়ের পুত।’
কিন্তু এই একই মায়ের পুতেরা কেন এক সময় মাতৃপরিচয় অস্বীকার করে বসলাে, কীভাবে তারা দুই জাতি হয়ে গেলাে, একের বিরুদ্ধে অন্যে ছুরি আর বাঁশ নিয়ে তাড়া করলাে কোন প্রেরণায় নেশার ঘােরে—এ সব প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই নিহিত আছে পাকিস্তানের জন্মরহস্য। তবে সে রহস্য বড়ােই জটিল, এবং তা ভেদ করা খুবই কঠিন বৈকি!

অনক্ষর কৃষকের ভাবলােক
নেউলা কিংবা মফিজ শেখ, আকাইল্যা কিংবা রইস্যা, ফটিক কিংবা পাইন্যার বাপ—এরা হিন্দুই হােক আর মুসলমানই হােক, এদের কেউই হিন্দুর বা মুসলমানের ধর্মশাস্ত্রের ভাষা যেমন জানে না তেমনি নিজের মাতৃভাষার অক্ষরও চেনে না। ধর্মশাস্ত্রের ভাষা না জানার ক্ষতি তারা পুষিয়ে নেয় মুখে মুখে মাতৃভাষায় নিজেদের ধর্মশাস্ত্র রচনা করে নিয়ে। সেই ধর্ম হিন্দুও না মুসলমানও না। আবার হিন্দুরও অনেক কিছু সেই ধর্মে আছে, মুসলমানের ভাগও তাতে প্রচুর। হিন্দুর আর মুসলমানের ধর্ম সেখানে জড়াজড়ি করে থাকে। বিশুদ্ধ হিন্দুয়ানি আর বিশুদ্ধ মুসলমানি নিয়ে যারা গর্ব করে তাদের দৃষ্টিতে ওই মূখগুলাের কোনাে ধর্মই নেই।
কিন্তু ধর্ম বলতে আসলে যা বােঝায়, দার্শনিক পণ্ডিতরাও গম্ভীরভাবে ধর্মের যে ব্যাখ্যা দেন, হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানের সম্প্রদায়গত বিশ্বাস ও আচার-আচরণের উর্ধ্বে যে-ধর্মের অবস্থান, সেই ধর্মকে কিন্তু সেই মূখগুলােই তাদের সমগ্র সত্তায় ধারণ করে। পরকালে তারা বিশ্বাস করে বটে, কিন্তু ধর্ম তাদের ইহলােককে নিয়েই। ইহলােকের ভালােমন্দ আর ন্যায়অন্যায়ের বিবেচনাই তাদের ধর্মের অন্তঃসার। ব্রত, শিরনি, মানত, পিরের দরগা, বাবার থান—সবই ইহলৌকিক কল্যাণ বা প্রাপ্তির সঙ্গে সম্পর্কিত। সংস্কার বা সংস্কারগুলােও তাই। সংস্কার বা কুসংস্কার না বলে বরং বলা উচিত, এগুলােই তাদের মূল্যবােধ। এই মূল্যবোেধ থেকে আলাদা করে কোনাে ধর্মের কথা তারা ভাবতে পারে না। ধর্ম ও নৈতিকতা তাদের কাছে এক ও অভিন্ন। তাদের দৃষ্টিতে নৈতিকতা কোনাে বিমূর্ত বিষয় নয়, এর মূর্ত রূপকেই তারা সব সময় চোখের সামনে রাখে।
কারাে বাড়িতে আগুন লাগালে পাপ হয়—এটি হচ্ছে তাদের বিশ্বাস বা সংস্কার। কিন্তু এই পাপের ফলভােগ করবে কোথায়? পরলােকে কি? হ্যা, পরলােকের কথা তাদের ভাবনায় আবছা
১৫৩
আবছা আছে ঠিকই, তবু পাপের ফল যে ইহলােকেই ভােগ করতে হবে, এটিই তাদের বিশ্বাসের মূল অংশ। গাঁয়ের এক বুড়ােকে মরার আগে সারা শরীরের জ্বালা নিয়ে ছটফট করতে দেখেছি। আমার ঠাকুরমা বললেন, ‘এ-রকম হবে না কেন! ও যে আগুন দিয়ে অমুকের বাড়িটা পুড়িয়ে দিয়েছিলাে, সেকথা তাে আমরা ভুলিনি। তখনই বলেছিলাম—ও জ্বলে পুড়ে মরবে। এখন তাই সত্যি হচ্ছে। পাপ তাে বাপকেও ছাড়ে না।’
রােগ-ব্যারামসহ ইহজাগতিক সব দুঃখকষ্ট যে পাপেরই ফল, এ-সংস্কারও তাদের প্রবল। কুষ্ঠের মতাে রােগ যে পাপীদের দেহেই আশ্রয় নেয়, এ ব্যাপারে গ্রামীণ লােকসমাজের অনেকের মধ্যেই আমি নিঃসংশয় বিশ্বাস দেখেছি।
পরলােকের শাস্তির কথাও ওরা ভাবে অবশ্যই। যেমন, খেয়ার মাঝিকে তার পারানির কড়ি শােধ না করলে পরলােকের খেয়া পার হতে গিয়ে বড়ােই মুশকিলে পড়তে হবে—এমন ধারণা তাদের আছে। তবু, কাল্পনিক পরলােকের চেয়ে বাস্তব ইহলােকেই যে এ-পাপের শাস্তি পেতে হবে জলে ডুবে মরে, কিংবা না মরলেও ভীষণ কষ্টভােগ করে, এ-রকম বিশ্বাসই হচ্ছে তাদের ধর্মের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। অমুক কাজ করতে নেই বা অমুকটা খেতে নেই। কেন? কারণ, অমুকটা করলে বা অমুকটা খেলে সন্তানের ক্ষতি হয়। কিংবা তার চেয়েও বড়াে শাস্তি : বংশলােপ হয়।
এই বংশলােপের ভাবনাটাই প্রাকৃত বাঙালির লােকধর্মের পাপপুণ্য ভাবনার সিংহভাগ দখল করে আছে। নিঃসন্তান বা আঁটকুড়ের মুখ দেখাও কুসিদ্ধি। বাঙালির লােকগাথায় এমন কতাে আঁটকুড়ে রাজার কথা যে আছে ভােরবেলায় যে-রাজার মুখ দেখতে রাজি নয় কোনাে প্রজা, এমনকি রাজার বাড়ি আঁট দেয় যে মালি সেও। আঁটকুড়ে রাজা সন্তান-কামনায় কাঙালের মতাে গিয়ে ধর্ণা দেয় সন্ন্যাসীর কাছে, সন্ন্যাসীর দেয়া ওষুধ খেয়ে রাণী হয় গর্ভবতী, রক্ষা পায় বংশধারা।
বংশরক্ষার জন্যে বা প্রকৃতিপুঞ্জের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্যে, প্রাকৃত জনের এ-রকমই আকুতি। এখানে ঐশ্বর্যবান রাজা আর দরিদ্র প্রজার মধ্যে কোনাে পার্থক্য নেই। পরলােকে অনন্ত জীবনের বিমূর্ত কল্পনা প্রাকৃতজনকে যতােটা না অনুপ্রাণিত করে, তারচেয়ে সে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত হয় ইহলােকে সুখী সচ্ছল বংশধারার মধ্যে বেঁচে থাকার কামনায়। তাই তাে দেখি : আশি বছর বয়সী বুড়াে মানুষটি, এ জীবনে যার চাওয়া পাওয়ার আর কিছুই নেই, সেও বাড়ির সামনে তালগাছের চারা লাগাচ্ছে। তালগাছ সম্পর্কে তাে বলা হয়, যে-লােকটি গাছ লাগালাে তার ছেলে সে-গাছের তাল খাওয়ার আশা করলেও করতে পারে, আসলে তাল খায় তার নাতি। তা হলে বােঝা গেলাে মৃত্যুপথযাত্রী যে-বৃদ্ধটি পরম যত্নে তাল গাছের চারা লাগাচ্ছে, ইহকালে সে তার ফল যেমন আশা করছে না তেমনি পরলােকে ফল পাবার আশাতেও তার এই গাছ লাগানাে নয়। সে চায় নাতিপুতিরা তার কাজের বা পুণ্যের ফল ভােগ করুক। সে পুণ্যকর্ম করে তার নাতিপুতিদের সুখের জন্যে, পাপ থেকেও বিরত থাকতে চায় ওদেরই মুখ চেয়ে। অনন্তকাল ধরে সে বেঁচে থাকতে চায় ও পৃথিবীটাকে ভােগ করতে চায় তার নাতিপুতির বংশপ্রবাহের ভেতর দিয়ে।
আদিম মানুষের মতােই সে বিশ্বাস করে যে, প্রকৃতির সব কিছুরই প্রাণ আছে, গাছ পাথর আকাশ সূর্য চাঁদ ঝড় বৃষ্টি সবই প্রাণবান্। শুধু প্রাণবান্ নয়, মানুষের মতােই এ-সবও
১৫৪
হৃদয়বান, মানুষের মতােই এদের বিশ্বাস ও সংস্কার। তাই তার নড়বড়ে খড়াে ঘরটিকে বৈশাখী ঝড় যখন উড়িয়ে নিতে চায়, তখন সে ঝড়ের উদ্দেশে মন্ত্র পড়ে-
কচুপাতার ছানি ভেরনের ঠনি
ছুঁইছ না, ছুঁইছু না
এই ঘরে তাে ভাইগ্না বৌ
ছুইছু না, ছুইছু না।
অর্থাৎ যে-ঘরের ছাউনি দেয়া হয়েছে কচু পাতা দিয়ে আর খুঁটি একান্ত পলকা ভেরনা কাঠের, সে-ঘরকে যদি স্পর্শ করে ঝড়ের মতাে প্রতাপান্বিত বীর তবে তাে তার বীরত্বই কলঙ্কিত হবে। ভাগ্নে বৌ আছে যে-ঘরে, মামা শ্বশুর হয়ে ঝড় তাে সে-ঘরকে কিছুতেই ছুঁতে পারে না। ভাগ্নে বৌকে ছোঁয়া তাে দূরের কথা, তার মুখ দেখাও গ্রামীণ লােকশাস্ত্রে নিষিদ্ধ। ঝড়ও সে-শাস্ত্র মেনে চলবে নিশ্চয়।
স্বর্গের দেবতাকেও সে মানে। সেই দেবতার স্তুতিও যে করে না, তাও নয়। তবে স্তুতি দিয়ে খুশি করার চেয়ে মন্ত্র দিয়ে দেবতাকে জয় করার দিকেই তার বেশি নজর। মন্ত্রের শক্তিতে তার বিশ্বাস এমনই নিচ্ছিদ্র যে, কামনা পূরণের যে কোনাে মন্ত্র আবৃত্তি করে একান্ত স্পর্ধার সঙ্গে সে বলে—“আমার মন্ত্র যদি লড়ে চড়ে/ঈশ্বর মহাদেবের জটা কাইট্যা ভূমিত পড়ে। অর্থাৎ কামনা পূরণের জন্যে সে ঈশ্বর বা মহাদেবের কাছে কোনাে কাকুতি মিনতি করে না, প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মন্ত্র পড়ে শুধু। কারণ, সে জানে, তার মন্ত্র যদি ব্যর্থ হয়ে যায় (‘লড়ে চড়ে’) তবে তার নিজের কিছু ক্ষতি হবে না, ঈশ্বর মহাদেবেরই জটা কেটে মাটিতে পড়ে যাবে! তাই মহাদেব নিজের প্রেস্টিজ বাঁচাবার জন্যে নিজের গরজেই মন্ত্রকে সার্থক করে তুলবেন, এর জন্যে মন্ত্রকর্তাকে মন্ত্রোচ্চারণ ছাড়া আর কিছুই করতে হবে না।
মহাদেব তাে হিন্দুর দেবতা, অথচ হিন্দু ওঝার মতাে মুসলমান ফকিরও তার নাম দিয়ে মন্ত্র পড়ে। আবার হিন্দু ওঝা মা কালীর মতাে মা ফাতেমারও দোহাই দেয়। রক্তমাংসের মানুষ মুসলমান আলীর সঙ্গে হিন্দু পুরাণের কাল্পনিক দেবতা শিব বা মহাদেবের মােলাকাত ঘটিয়ে দিতেও ইতস্তত করে না বাংলার লৌকিক পুরাণ। ছেলেবেলায় লােকপুরাণের এ-রকম অনেক অনেক গল্প শুনেছি, শুনতে শুনতে রােমাঞ্চিত হয়েছি। এ-সব গল্প যে হিন্দু ও মুসলমানি পুরাণের মিলনই ঘটিয়েছে কেবল, তা অবিশ্যি নয়। পরস্পরের প্রতি বিদ্রুপের আভাসও এগুলােতে কম ফুটে ওঠেনি। তবু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের ভেতরও গাঁয়ের কৃষক মেনে নিয়েছে যে, হিন্দু আর মুসলমান পরস্পরের জ্ঞাতি, আদমের পুত্র হাবিল আর কাবিলের বংশধর, আচারের বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি দিয়েই তারা একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারে।
হিন্দু শিবের লিঙ্গ পূজা করে। পণ্ডিতরা এর নানা দার্শনিক ও নৃতাত্ত্বিক তাৎপর্য খুঁজে খুঁজে হয়রান হন। নেত্রকোনার অনক্ষর কৃষকদের কল্পনায় কিন্তু লিঙ্গপূজার কার্যকারণটি খুবই সহজ। তাদের লৌকিক পুরাণ বলছে : শিবের সঙ্গে আলী একবার কুস্তি লড়েছিলেন। কুস্তিতে পরাজিত হয়ে শিব বন্দি হলেন আলীর হাতে। বন্দি শিবকে নিয়ে আলী যাত্রা করলেন মক্কার দিকে। ভক্তরা কাঁদতে কাঁদতে শিবকে জিজ্ঞেস করলাে, আপনি তাে আমাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, এখন আমরা পুজো করবাে কাকে?’ নিরুপায় শিব আর কী করেন। তিনি তার লিঙ্গটি ভক্তদের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বললেন, এখন থেকে আমার এই লিঙ্গটিকেই তােরা পূজা করিস।
১৫৫
সেই থেকেই চলে আসছে শিবলিঙ্গের পূজা।
কৃষকের লােকপুরাণ এখানেই থেমে থাকেনি। এর পরের কাহিনী এরকম :
বন্দি শিবকে নিয়ে আলী তাে আটকে রাখলেন মক্কায়। তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে আনার উপায় কী? উপায় একটাই। কোনাে শিবভক্ত যদি একটি মন্ত্রপড়া বেলপাতা বন্দি শিবের মাথায় অর্পণ করতে পারে তবেই শিবের বন্ধনমুক্তি ঘটবে। কিন্তু তেমনটি তাে হওয়ার জো নেই। কারণ, যেখানে শিবকে বন্দি করে রাখা হয়েছে সেখানে যে কেউই ঢুকতে যায় তাকেই গরুর রক্ত খাইয়ে দেয়া হয়। হিন্দুর জন্যে তাে গরুর রক্ত নিষিদ্ধ। কাজেই যে ভক্ত শিবের মাথায় বেলপাতা দিতে যাবে, সে গরুর রক্ত খেলে অশুচি হয়ে পড়বে এবং সেই অশুচি ভক্তের হাতের বেলপাতা শিবকে মুক্ত করতে পারবে না।
সে-কারণেই শিব আজো মক্কাতেই বন্দি হয়ে আছেন, আর ভক্তরা তার লিঙ্গেরই পূজা করে যাচ্ছে।
এই কাহিনীতে যদি হিন্দু দেবতার পরাভবের কথা বলা হয়ে থাকে তাে মনসামঙ্গলের হাসান-হােসেনের পালায় আছে লৌকিক দেবী মনসার জয়ের ঘােষণা। হাসান আর হােসেন নামে দুই কাজি রাখালদের মনসা পূজার মণ্ডপ অপবিত্র করেছিলেন, রাখালদের ধরে এনে নির্যাতন করেছিলেন। এতে মনসা দেবী রুষ্টা হয়ে ওই দুই কাজিকে এমন শাস্তি দিয়েছিলেন যে, তারা মনসা দেবীকে পুজো দিয়ে তবে তার রােষ থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন।
এভাবেই হিন্দু-মুসলমানের ক্লাসিকাল ধর্মশাস্ত্রের অক্ষরের সঙ্গে অপরিচয়ের ক্ষতিপূরণ কৃষকরা করে নেয় তাদের নিজস্ব ধর্মশাস্ত্র ও লৌকিক পুরাণ সৃষ্টি করে। কিন্তু মাতৃভাষা ও ‘রাজভাষা’র অক্ষরের সঙ্গে তাদের অপরিচয়ের কোনাে ক্ষতিপূরণ হয় না। তাদের অনরক্ষরতার সুযােগ পুরােপুরি গ্রহণ করে সেয়ানা সাক্ষর লােকেরা। স্বাক্ষর দিতে পারে না বলেই নেউলা বা আকাইল্যা বা রইস্যাকে বাঁ হাতের বুড়াে আঙুল বাড়িয়ে দিতে হয়; সাক্ষর লােকেরা সে-আঙুলে কালি মাখিয়ে কাগজে ছাপ দিয়ে নেয়, যাকে বলে টিপসই। এই টিপসই দিয়েই জমি বিক্রি করে সে প্রতারিত হয়, টিপসই দিয়ে মহাজনের হাত থেকে ঋণ এনে ভিটেমাটিহারা হয়। জমিদার-তালুকদার তাকে মানুষ বলেই গণ্য করে না, জোতদার-মহাজন তার রক্ত শুষে খায়।
রক্তচোষা মহাজনরা করে সুদের কারবার। এই সুদই কৃষক খাতককে সর্বস্বান্ত করে। ‘জনগণে যারা জোকসম শেষে সেই ইতরজনগুলােকেই ‘মহাজন’ সম্বােধন করে তাদের শরণ নিতে বাধ্য হলেও নিরুপায় কৃষক খাতক ওদের প্রতি তার প্রচণ্ড ঘৃণাকে লুকিয়ে রাখে না। একটি যাদু বিশ্বাসমূলক লৌকিক আচারের অনুষ্ঠান করে সুদখােরের প্রতি কৃষক তার ঘৃণার প্রকাশ ঘটায়। জোয়ালের ঘষায় কৃষকের বলদের ঘাড়ে অনেক সময়ই ঘা হয়ে যায়, সেই ঘায়ে পােকার উপদ্রব দেখা দেয়। সেই পােকা দূর করার জন্যে কৃষক পাঁচজন সুদখােরের নাম লিখে বলদের ঘাড়ের ওপর রেখে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গে ঘায়ের পােকাগুলাে নাকি ঝরঝর করে পড়ে যায়। অর্থাৎ গরুর ক্ষতের পুঁজরক্ত খেয়ে বেঁচে থাকে যে পােকা, সেও সুদখােরকে ঘৃণা করে, সুদখােরদের নাম পর্যন্ত সহ্য করতে পারে না।
শুধু সুদখাের নয়। যে কৃপণ ধনী লােকটি মানুষকে নানাভাবে শােষণ করে বিপুল অর্থসম্পদ জমায়, জমানাে সম্পদকে কেবলই যক্ষের মতাে আঁকড়িয়ে রাখে, দান-খয়রাত দূরে থাক নিজেও ভােগ করে না, সেই লােকটিকে কৃষকরা এমন ঘৃণা করে যে, তারা মনে করে :
১৫৬
সকালবেলায় ওই লােকটির নাম নিলে সারাদিনে কোনােকাজেই সফল হওয়া যাবে না, এমনকি খাবারও মিলবে না। এরকম একাধিক কৃপণ ধনী বাস করে যে-গ্রামে, সকালবেলায় সেগ্রামটির নাম মুখে আনতে চায় না আশপাশের গ্রামের কৃষকরা। শুধু মানুষ নয়, কোনাে কোনাে গ্রামের নাম মুখে নিলেও ‘হাঁড়ি ফাটে। এমনই অপয়া এই সব মানুষ ও এইসব গ্রাম। আমার জানা এমন অনেক মানুষ ও গ্রামের নাম আমি উল্লেখ করতে পারতাম, কিন্তু ইচ্ছে করেই তা করছি না।
অনক্ষর কৃষকের ভাবলােকের এ-রকমই রূপ প্রকৃতি। সারা বাংলায় এই অক্ষর কৃষকরাই তাে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষগুলাের কেউ হয়তাে হিন্দু, কেউ মুসলমান। বৌদ্ধ বা খ্রিস্টানও কেউ কেউ আছে নিশ্চয়, কিন্তু আমাদের এলাকায় তাদের অবস্থিতি ছিলাে না বা নেই বলে তাদের কথা কিছু বলতে পারছি না। তবে এইটুকু জানি, সংখ্যাগরিষ্ঠ অক্ষর হতদরিদ্র কৃষককূলের যে ধর্মভাবনা তার সঙ্গে মােল্লা-পুরুত-পাদ্রি-ভিক্ষুর প্রচারিত ধর্মের গভীর অনৈক্য। কোনােরূপ ধর্মীয় মৌলবাদই কৃষকের চিন্তায় শিকড় গাড়তে পারে না। ভদ্রলােক বা ‘শরিফ আদমি’রা যে-ধর্ম সম্প্রদায়ের মানুষই হােন, কৃষক ক্ষেতমজুর প্রাকৃতজনদের থেকে তাদের বস্তুগত ও চিন্তাগত অবস্থানের দূরত্ব একেবারে আকাশ-পাতালের।
তবু, এক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমন্বয়ী লােকধর্মকে ছাপিয়ে প্রবল হয়ে ওঠে সংখ্যালঘিষ্ঠ মােল্লা-পুরুতের বিভেদকামী সাম্প্রদায়িক ধর্মের প্রভাব। অনক্ষর কৃষক নেউলা আর ফটিক প্রচণ্ডভাবে মনে করতে থাকে যে, তারা হিন্দু, রইস্যা আর পাইন্যার বাপ মুসলমান। জমিদারতালুকদার-জোতদার-মহাজনের হাতে একইভাবে শােষিত হয়েও তাদের ঐক্য থাকে না। নেউলা আর ফটিক একদিকে, অন্যদিকে রইস্যা আর পাইন্যার বাপ।
কেন এবং কেমন করে এমনটি হলাে?

হিন্দুর জাত যেনাে কচুপাতার পানি
ভদ্রলােক’ ও ‘শরিফ আদমি’র দৃষ্টিতে নেউলা, ফটিক, রইস্যা, পাইন্যার বাপ এবং এরকম আর সবাই ছােটোলােক। এই ছােটোলােকরা সবাই মিলে যে নিজস্ব ভাবজগৎটি তৈরি করে নেয় সে জগতে তাদের হিন্দু ও মুসলমান পরিচয়টি মুছে যায় না অবশ্যই, হিন্দু-মুসলমানদের স্বাতন্ত্রও স্পষ্ট হয়েই থাকে। নেউলা আর ফটিককে যেমন মদনপুরের শাহ সুলতানের দরগায় গিয়ে নানা কামনা পূরণের আশায় শিরনি দিতে দেখেছি, তেমনি রইস্যা আর পাইন্যার বাপকে চন্দপাড়ায় বা অন্য কোথাও দেবীকে উৎসর্গ করার জন্যে পাঁঠা নিয়ে যেতেও দেখেছি। তবে সে সঙ্গে এও লক্ষ করেছি যে, দরগায় খাদেমের আর কালীবাড়িতে পুরােহিতের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বকে তারা বিনা প্রতিবাদেই মেনে নেয়। খাদেম যে মুসলমান আর পুরােহিত হিন্দু এবং দরগা যে মূলত মুসলমানের আর কালীবাড়ি হিন্দুর—এ বিষয়েও নেউলা বা ফটিক, রইস্যা বা পাইন্যার বাপ কারাে মনে কোনাে সন্দেহ নেই। যদিও তারা নিজেদের জন্যে একটা সমন্বিত ভাবলােকের সৃষ্টি করে নিয়ে সেখানে এসে একত্র হয়, তবু তাদের আপন আপন জায়গা যে আলাদা—সে কথাও তারা কখনাে ভুলে থাকে না। তাদের সেই একান্ত আপনার স্থানের আলাদা আলাদা রীতি-নিয়ম আছে, আলাদা আলাদা বিশ্বাস-সংস্কার আছে। সেই আলাদা রীতি-নিয়ম ও বিশ্বাস-সংস্কারগুলােকে তারা অমান্য করে না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যে সব আচার-অনুষ্ঠান তারা পালন করে সে সবের মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের স্বাতন্ত্র চিহ্ন অবশ্যই একান্ত স্পষ্ট। কিন্তু
১৫৭
গাঁয়ের লােকসাধারণ হিন্দু-মুসলমানের আচার-বিশ্বাসের স্বাতন্ত্র মেনেছে, স্বাতন্ত্রকে বিরােধের উপাদান বলে মনে করেনি, পরস্পরের আচার-অনুষ্ঠান পালনে সহায়তা দেয়াটাকেই বরং তারা ধর্ম বলে বিশ্বাস করেছে। কখনাে কখনাে পরস্পরের আচার-অনুষ্ঠানের সুবিধাজনক উপাদানগুলাে নিয়ে তারা লৌকিক ধর্মের লৌকিক আচার-অনুষ্ঠান বানিয়ে নিয়েছে, কখনাে বা স্বাতন্ত্র রক্ষা করেই একে অন্যের দান গ্রহণ করেছে। এভাবেই মুসলমানের পির হিন্দুর দেবতা হয়েছেন, হিন্দুর দেবতাও মুসলমানের পিরের পােশাক ধারণ করেছেন। মুসলমানের শিরনি অনুষ্ঠান হিন্দু বাড়িতে ব্রতের রূপ ধরেছে, ব্রতকেও মুসলমানরা শিরনিতে পরিণত করেছে। বনদুর্গা যে কখন বনবিবি হয়ে গিয়েছেন তা টেরই পাওয়া যায়নি। সত্যপিরের সত্যনারায়ণ হওয়ার বৃত্তান্ত তাে সারা বাংলার মানুষই জানে।
হিন্দু গােরস্থানকে ও মুসলমান শ্মশানকে মর্যাদার দৃষ্টিতে দেখেছে, এক গােষ্ঠী অন্য গােষ্ঠীর খাদ্য সম্পৰ্কীয় নিষেধবিধি ও আচার-আচরণগুলােকে সম্মান দেখিয়েছে। এমনকি হিন্দু যে মুসলমানের ছোঁয়া কোনাে কিছু খায় না, এটিতেও লােকসমাজের মুসলমানরা কোনাে ঘৃণাবিদ্বেষের সন্ধান পায়নি। হিন্দু যে এঁটো বা উচ্ছিষ্ট নিয়ে বাছ-বিচার করে আর মুসলমান যে করে না, এটিকে উভয় গােষ্ঠীর লােকেরাই স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছে। এ-সব আচারভেদ সম্পর্কে নেত্রকোনার গাঁয়ের হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের মুখেই শুনেছি, এই রকমই আমরা পাইয়া আইছি। পাইয়া আইছি’ কথাটা দিয়ে তারা যা বােঝাতে চায় তা হচ্ছে : জন্মের আগে থেকেই ভিন্ন ভিন্ন আচারগুলাে ভিন্ন ভিন্ন গােষ্ঠীর মানুষের জন্যে নির্ধারিত হয়ে রয়েছে, এগুলাে তাদের মেনে চলতেই হবে। এগুলাের ভেতর যে ঘৃণা-বিদ্বেষের কোনাে বীজ থাকতে পারে, এরকমটি তারা একসময় ভাবতেই পারতাে না।
অথচ, পরে সম্পূর্ণ অন্যরকম হয়ে গেলাে। আচারের বৈচিত্র্য হয়ে গেলাে বিদ্বেষের হাতিয়ার। নিজের গােষ্ঠীর কদাচারকেও পরম পবিত্র ও সুন্দর বলে ভাবতে শুরু করলাে, অন্যের সদাচারের মধ্যেও আবিষ্কার করলাে গলদ ও অপবিত্রতা। একজন যাকে পবিত্র স্থান বলে মনে করে, অন্যজন সেটিকে অপবিত্র করাটাকেই পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করলাে। মন্দিরে গােরুর হাড় নিক্ষেপ করা মুসলমানের জন্যে আর মসজিদে কচ্ছপের খােলা রেখে আসা হিন্দুর জন্যে যেনাে পুণ্যকর্ম হয়ে উঠলাে। উভয় সম্প্রদায়ের বালকদের মনেও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের সংক্রমণ ঘটলাে, সমন্বয়ীভাবের ছড়া-প্রবাদগুলাের বদলে সাম্প্রদায়িক ঘৃণাবিদ্বেষমূলক ছড়াপ্রবাদের ব্যাপক ব্যবহার চলতে লাগলাে। নানান বরণ গাভীরে ভাই, একই বরণ দুধ’-এর চেয়ে কলাপাতার দুই পিঠেতে দুই জাতির খানা’ অনেক বড়াে সত্য হয়ে দেখা দিলাে।
গ্রামের একজন মুসলমান তার ছেলে বা মেয়ের বিয়েতে শুভাকাঙ্ক্ষী হিন্দুদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ান পাচক বামুন দিয়ে তাদের জন্যে আলাদা রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করে। হিন্দুও মুসলমানদের আপ্যায়িত করেন যথাযথভাবে মুসলমানি কায়দায় বাবুর্চির তৈরি খাবার পরিবেশন করে। দলপা গ্রামের গম্ভীর মিঞা, দুর্গাপুরের সুধীর দে এবং এ-রকম আরাে অনেকের বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি এ-ধরনের ব্যবস্থাই দেখেছি। কখনাে, ছােটোখাটো পারিবারিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে, হিন্দু গৃহস্থ মুসলমান প্রতিবেশীর বাড়িতে ও মুসলমান গৃহস্থ হিন্দু বাড়িতে চাল-ডাল-মাছ-তরকারির ‘সি’ পাঠিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ খাওয়া-ছোঁয়ার ব্যাপারেও পরস্পরের সংস্কারের প্রতি সম্মান দেখিয়েই গ্রামীণ হিন্দু ও মুসলমানরা শান্তিপূর্ণ সামাজিক জীবন যাপন করেছে।
১৫৮
আমার শৈশব-কৈশােরে গাঁয়ের হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে এরকম পারস্পরিক শ্রদ্ধাশীল আচরণ যেমন দেখেছি, নিতান্ত অল্পদিনের ব্যবধানে তার বিপরীতটি দেখার দুর্ভাগ্যও আমার হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরনাে আনুষ্ঠানিকতার খােলসটি থেকে গেলেও ভেতরের সেই বিশ্বাস ও আন্তরিকতার শাসটি উবে গেছে। পুরাে চল্লিশের দশক এবং পঞ্চাশের দশকের গােড়ার কয়েকটি বছর বাংলাদেশ এমনই ক্রান্তিকাল অতিক্রম করেছে যে, এ-রকম ক্রান্তি ইতিহাসে সম্ভবত খুব বেশি আসেনি। লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের জিগির, পাকিস্তানের অস্বাভাবিক জন্ম, জন্মের পর তা নিয়ে নানান আদেখলাপনা এবং এ-সবের মধ্য দিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি—এ-রকম অনেক কিছুর ধাক্কায় অনেক উল্টোপাল্টা ব্যাপার ঘটে গেলাে খুবই অল্প সময়ের মধ্যে।
এ-সব নিয়ে হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে প্রায়ই আমার কথা হতাে। আমি জিজ্ঞেস করতাম, ‘এ-রকম হয়ে গেলাে কেন? লােকসমাজের লৌকিক মূল্যবােধগুলাে মােল্লা-পুরুতদের বিভেদপন্থী ধর্মের হাতে মার খেয়ে গেলাে কেন? গায়ের মানুষগুলাে এরকম কট্টর হিন্দুমুসলমানে ভাগ হয়ে গেল কী করে? কে তাদের এমন হিন্দু বা মুসলমান বানালাে?’
হেকিম ভাইয়ের নিজের মনেও এ-সব নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিলাে। আমি যে-সময় তাকে এ-সব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি, সে-সময় তার মধ্যে পাকিস্তানি জোশ আর একটুও অবশিষ্ট নেই। তমদ্দুন মজলিসের প্রভাবও তিনি ঝেড়ে মুছে ফেলে দিয়েছেন। খােলাফায়ে রাশেদিনের দিনগুলােকে ফিরিয়ে আনার কল্পনাও তিনি আর এখন করেন না। সেটি পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকের কথা। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি সম্পর্কে তিনি তখন মােহমুক্ত। পাকিস্তানআন্দোলনের সময়কার তার নিজের ভূমিকাকেই তিনি তখন নানাভাবে সমালােচনা করেন। শুধু সমালােচনা নয়, নিজের অতীতকেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে বিদ্ধ করে ফেলেন।
হাসতে হাসতে একদিন বলেছিলেন, আমার তাে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান করার কথা ছিলাে না। আমিও তাে ব্রাহ্মণ বংশের মানুষ। অথচ আমিই কিনা আশুজিয়ার ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেলাম পাকিস্তান কায়েমের জন্যে। এ-রকমটি তাে নাও হতে পারতাে।
কথাগুলাে বলেই তিনি গম্ভীর হয়ে গিয়েছিলেন। আলােচনাটাকে ইতিহাসের দিকে মােড় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সিংহের গাঁওয়ের খা বাড়ির সেই গােল ঘরটিতে বসে এ-রকম ইতিহাস আলােচনা আমরা প্রায়ই করতাম । এদেশে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে গেলাে কী করে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়েও সংখ্যালঘু হিন্দুদের চেয়ে পেছনে পড়ে রইলাে কেন, হিন্দু-মুসলমানের লৌকিক ধর্মাচরণের প্রতি পুরােহিত মােল্লাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা কী রকম ছিলাে—এ-রকম বহু প্রশ্ন আমাদের আলােচনায় উঠে আসতাে।
সেদিন হেকিম ভাই তার ব্রাহ্মণ পূর্বপুরুষের কথা স্মরণ করেছিলেন। মনাং গ্রামের বিশিষ্ট ব্রাহ্মণ শচীন্দ্র শর্মা যে সেই আঠারাে শতকে বুড়াপির’ নামে পরিচিত সুফি সাধক সৈয়দ খােয়াজের কাছে গিয়েছিলেন, তা কি আধ্যাত্মিক পিপাসা মেটানাের জন্যে? ধর্মজিজ্ঞাসার জবাব খুঁজতে? বুড়াপিরের কাছে মূল্যবান আধ্যাত্মিক সম্পদের সন্ধান পেয়েই কি ব্রাহ্মণ শচীন্দ্র শর্মা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম পরিত্যাগ করে সানন্দে মুসলমান হয়ে গিয়েছিলেন? মােটেই নয়। আধ্যাত্মিকতার সন্ধানে পিরের কাছে যাওয়ার প্রয়ােজন পড়েনি যাজক ব্রাহ্মণ শচীন্দ্র শর্মার। আধ্যাত্মিক নয়, একান্ত আধিভৌতিক কারণেই তিনি পিরের শরণ নিয়েছিলেন। সেই আধিভৌতিক কারণটি হচ্ছে দুরারােগ্য ব্যাধি।
১৫৯
এক দুরারােগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শচীন্দ্র শর্মা জীবনের আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন। সে-সময়েই তার কানে এলাে : পাশের গ্রাম তেঁতুলিয়ায় যে বুড়াপির আছেন। আস্তানা গেড়ে তিনি নানা বনজ ওষুধ আর পানিপড়া দিয়ে অনেকের অনেক কঠিন রােগ সারিয়ে তােলেন। যথারীতি শচীন্দ্র শর্মাও সেই পিরের কাছে গেলেন, তার ওষুধ ও পানিপড়া খেলেন, তার নির্দেশিত কিছু নিয়ম ও নিষেধবিধি মেনে চললেন এবং আস্তে আস্তে রােগমুক্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু রােগমুক্ত হলেও ওই যে পিরের হাতের পানিপড়া খেলেন, সে-অপরাধ থেকে তিনি মুক্ত হবেন কী করে? ব্রাহ্মণ সমাজপতিদের বিচারে সে-অপরাধের শাস্তিস্বরূপ তিনি একঘরে হলেন, একঘরে হয়ে সমাজচ্যুত হলেন। অর্থাৎ তার জাত গেলাে।
হিন্দুর তাে এভাবেই জাত যায়। গাঁয়ের লােকে ঠাট্টা করে বলে, ‘হিন্দুর জাত যেন কচুপাতার পানি। একটু টোকা লাগলেই পড়ে যায়।’
হঁ্যা, কথাটা খুবই সত্য। এখনকার দিনে না হলেও এক সময় তাে এটি ছিলাে একেবারে শতকরা একশ’ ভাগ সত্য। নিষিদ্ধ খাদ্য ভােজন করলে তাে কথাই নেই, খাদ্যের ঘ্রাণেও হয় অর্ধভােজন এবং সেই অর্ধভােজনেও যে অনেক হিন্দুর জাত চলে গেছে, ইতিহাস ও জনশ্রুতিতে তারও অনেক নজির মেলে। পীরালি ব্রাহ্মণ’ নামে পরিচিত এক গােষ্ঠীর ব্রাহ্মণ নাকি জাতিচ্যুত হয়েছিলেন মুসলমানের রান্নার গন্ধ নাকে যাওয়ার ফলে। নাকে গন্ধ গেলেই যদি জাত যায়, তবে ব্রাহ্মণ শচীন্দ্র শর্মা মুসলমান পিরের হাতের পানি খেয়ে জাত যাওয়া মানেই হিন্দু সমাজের বাইরে চলে যাওয়া। তখন মুসলমান সমাজে আশ্রয় নেয়া ছাড়া অন্য কোনাে পথই খােলা থাকে না, শচীন্দ্র শর্মারও ছিলাে না। শচীন্দ্র শর্মা সৈয়দ খােয়াজ বা বুড়াপীরের মুরিদ হয়ে মুসলমান হলেন, নাম নিলেন—সুলতান উদ্দিন খাঁ।
সৈয়দ খােয়াজের মতাে সুফি তরিকার অনুসারী পির-দরবেশরা ঠিক আনুষ্ঠানিক অর্থে ধর্মপ্রচারক ছিলেন না। এরা যেখানে আস্তানা গেড়ে বসতেন সেখানে প্রচুর অনুগ্রহপ্রার্থীর ভিড় জমতাে। সেই অনুগ্রহ প্রার্থীদের মধ্যে নানা জাত, ধর্ম, বর্ণ বা সম্প্রদায়ের মানুষ থাকতেন, পির-দরবেশগণ সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখতেন। পারলৌকিক মুক্তির আশায় কেউ হয়তাে পিরদের শরণ নিলেও নিতে পারেন, তবে তাদের সংখ্যা খুব বেশি ছিলাে না। অধিকাংশ মানুষই পিরদের কাছে যেতাে নানা ইহলৌকিক কামনা পূরণের আশায়। পিরদের কেরামত বা অলৌকিক ক্ষমতার ওপর লােকসাধারণের বিশ্বাস একেবারে নিচ্ছিদ্র। শাস্ত্রব্যবসায়ী ব্রাহ্মণ পুরােহিতদের চেয়ে লােকসমাজ বেশি শ্রদ্ধান্বিত হয়েছে মিস্টিকপন্থী পির-দরবেশদের ওপর। হিন্দু পুরােহিতের সামনে এই মুসলমান দরবেশরা রীতিমতাে প্রতিদ্বন্দ্বী রূপে দেখা দিয়েছিলেন। সে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুরােহিতেরা তাদের হৃদয়হীন আচারের অস্ত্রটিকেই আরাে ধারালাে করে তুলেছিলেন। তার ফলে ছোঁয়াছুঁয়ির বাছবিচার, খাদ্যাখাদ্যের বিধিনিষেধ বা যৌন সম্পর্কের শুচিতার সামান্য লংঘন হলেই—অর্থাৎ পান থেকে চুন খসলেই—কোনাে হিন্দু সন্তানের আর রক্ষা থাকতাে না। ব্রাহ্মণ্য বিধান তাকে সমাজের বাইরে ঠেলে দিতাে। সমাজচ্যুতরা বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিতাে মুসলমান সমাজে, যেমনটি নিয়েছিলেন আমার হেকিম ভাই বা খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমের নবম পূর্বপুরুষ শচীন্দ্র শর্মা।
হেকিম ভাই তার ব্রাহ্মণ পূর্বপুরুষের গল্প শেষ করে কৌতুকের সঙ্গে চোখ নাচাতে নাচাতে বলতেন, “দেখাে, হিন্দুর জাত যদি কচুপাতার পানি না হতাে, তবে শচীন্দ্র শর্মাকে মুসলমান হতে হতাে না, তার বংশধর আমিও তােমাদের বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণই থাকতাম। মূর্খ হলেও হতাম শূদ্রের দেবতা। তাহলে কি আর আমি লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান করি?
১৬০
আমিও হেসে হেসেই বলতাম, ব্রাহ্মণ না থাকার জন্যে তাে আপনার দুঃখ করার কিছুই নেই। কারণ শর্মা থেকে খা হয়েছেন। খাঁ তাে ব্রাহ্মণই। মুসলমান ব্রাহ্মণ।
হাে হাে করে হেসে উঠতেন হেকিম ভাই।
হিন্দুর জাতের সূত্র ধরে জাত ও জাতি নিয়ে আমাদের মাঝে অনেক কথা হতাে। মুসলমানের কোনাে জাতপাতের ব্যাপার নেই—তত্ত্বগতভাবে কথাটা অবশ্যই সত্য। কিন্তু বাস্তব সত্য এতাে সরল নয়।
সেই অসরল বিষয়টি নিয়েই হেকিম ভাই আর আমি দিনের পর দিন আলােচনায় বসেছি, তর্কে-বিতর্কে মেতে উঠেছি। আমাদের এলাকার বিভিন্ন গ্রামের হিন্দু-মুসলমানের সামাজিক বিন্যাস পর্যবেক্ষণ করেছি, অনেক ভূয়ােদর্শী লােকের সঙ্গে কথা বলেছি, এ বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নানা বইপত্রও পড়েছি।
এ সবের ফলে আমাদের উভয়েরই অনেক প্রশ্নের উত্তর বা উত্তরের সূত্র খুঁজে পেয়েছি, দ্বিজাতিতত্ত্বসহ পাকিস্তানের জন্মরহস্য সম্পর্কেও ভাবনার অনেক খােরাক পেয়েছি।
জাতে মুসলমান থেকে মুসলমান জাতি খাঁ বাড়ির ছেলে হেকিম ভাইকে যে আমি ঠাট্টা করে বলতাম ‘মুসলমান ব্রাহ্মণ’ হেকিম ভাই আমার সে ঠাট্টাটা প্রসন্ন মনেই উপভােগ করতেন। তবে নিজে তিনি ব্রাহ্মণত্বের অভিমান পােষণ করতেন না। আর সে কারণেই নিজেকে নিয়েও দেদার ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে পারতেন। কিন্তু যাদের পূর্বপুরুষ ব্রাহ্মণ থেকে মুসলমান হয়েছিলেন, এমন অনেককে দেখেছি, তারা নিজেদেরকে অন্য মুসলমানের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে। অন্যরাও যে তাদের শ্রেষ্ঠত্বকে অস্বীকার করে, তাও নয়। অনেক নবদীক্ষিত মুসলমানকেই তাে নামের শেষে ব্যানার্জি বা ভট্টাচার্যের মতাে ব্রাহ্মণ পদবীগুলাে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এ রকম পদবীধারীরা যখন ধর্মসভায় ওয়াজ করেন তখন সে সভায় শ্রোতা-দর্শকদের ঢল নামে।
নেত্রকোনার বারহাট্টা থানায় আমগােয়াইল একটি প্রসিদ্ধ গ্রাম। সে গ্রামের ‘ঠাকুর’ পদবীধারী মুসলমানরাও বেশ প্রসিদ্ধ ও সম্ভ্রান্ত। এদের পদবী ঠাকুর কেন, এ নিয়ে একটি জনশ্রুতি নেত্রকোনা অঞ্চলে বহুশ্রুত। অনেকের মুখেই এটি আমি শুনেছি, হেকিম ভাইও প্রায়ই বলতেন।
আমগােয়াইলের ঠাকুররা আসলেই ‘ঠাকুর’ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ছিলেন। জনশ্রুতি বলে : এ গ্রামে এক সময় ছিলাে বারাে ঘর ব্রাহ্মণ, আর একঘর মাত্র মুসলমান। ব্রাহ্মণরা ভাবলেন, একঘর মুসলমানকে পর করে না রেখে ঘরে তুলে নিলে কেমন হয়? এদের কি হিন্দু বানিয়ে নেয়া যায় না? এই ভাবনা থেকেই তারা ব্রাহ্মণ্য ছাত্মার্গের কড়াকড়ি অনেকটা কমিয়ে এনে ওই মুসলমান পরিবারটির সঙ্গে হৃদ্য ব্যবহার করতে ও তাদের পাশে বসিয়ে পানভােজন করতে লাগলেন। আর যায় কোথায়! ভিন গ্রামের ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা এ খবর জানতে পেরে আমগােয়াইলের বারাে ঘর ব্রাহ্মণকেই একসঙ্গে সমাজচ্যুত করে ফেললেন। ব্রাহ্মণ সমাজে তথা হিন্দু সমাজে ফিরে আসার কোনাে পথ আর তাদের রইলাে না। ওই বারাে ঘর ব্রাহ্মণের সবারই ব্রাহ্মণত্ব ও হিন্দুত্ব খারিজ হয়ে গেলাে, মুসলমান সংস্পর্শের দায়ে তারা মুসলমান হয়ে গেলেন। বারাে ঘর হিন্দু মিলেও একঘর মুসলমানকে হিন্দু বানাতে পারলাে না, উল্টো একঘর মুসলমানই কিনা বারাে ঘর হিন্দুকে মুসলমান বানিয়ে ফেললাে! ‘গােরা’ উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ
১৬১
যে দেখিয়েছিলেন, হিন্দু সমাজ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে হাজারাে দরােজা খােলা থাকলেও ভেতরে ঢােকার জন্যে নেই একটি ছিদ্রও—আমগােয়াইলের ঠাকুরদের কাহিনীটি যেন তারই প্রমাণ।
তবু মজা হচ্ছে এই, আমগােয়াইলের ঠাকুররা মুসলমান হয়েও ঠাকুরই রয়ে গেলেন। বংশানুক্রমে তারা নামের সঙ্গে ঠাকুর পদবীটি গেঁথে রেখে হলেন অমুক হােসেন বা অমুক উদ্দিন ঠাকুর। এই ঠাকুর পদবীটি নিয়ে তাদের নিজেদেরও যেমন গৌরবের অন্ত নেই, তেমনি অন্যরাও তাদের সে গৌরবটুকু স্বীকার করতে একটুও দ্বিধা করে না। মুসলমানদের মধ্যে জাতভেদের কোনাে শাস্ত্রীয় বা তত্ত্বগত স্বীকৃতি না থাকলেও গ্রামীণ হিন্দু ও মুসলমান উভয়ের দৃষ্টিতেই আমগােয়াইলের ঠাকুররা উঁচু জাতের মুসলমান। ওদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারাটা অনেক মুসলমানের জন্যেই জাতে ওঠার সিঁড়ি বিশেষ।
আমগােয়াইলের ঠাকুরদের মতাে এ-রকম স্পষ্ট ব্রাহ্মণ্য উত্তরাধিকার যাদের ছিলাে না তাদেরও অনেকের মধ্যে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ বা বৈদ্যের বংশধর হওয়ার অভিমান ছিলাে। বিশেষ করে আমাদের এলাকার খাঁ পদবীধারী সকল মুসলমানকেই মনে করা হতাে হিন্দুবংশ সস্তৃত। খা বা খান একটি তুর্কি শব্দ। অথচ এখানকার মুসলমান সমাজে এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের উত্তরাধিকারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাে। এমন কি হিন্দু ব্রাহ্মণ কায়স্থ সমাজেও এই খাঁ পদবীটির প্রচলন ছিলাে এবং সকলেই এই পদবীধারীদের আভিজাত্য স্বীকার করে নিতাে। গৌরীপুরের কাছাকাছি কোনাে একটি গ্রামের একজন ব্রাহ্মণ ভদ্রলােককে চিনতাম, তার নাম ছিলাে মন্মথ খা।
মুসলমান সমাজেও অবিশ্যি সব খাঁ-এর সমান মর্যাদা স্বীকার করা হতাে না। কোনাে কোনাে খাঁ গােষ্ঠী সম্পর্কে তাে একান্ত অবজ্ঞার সঙ্গেই বলা হতাে : আরে, অমুক গাঁয়ের খায়েরা আবার ভদ্রলােক হলাে কবে থেকে! ওরা তাে চাড়াইল্যা খাঁ।
অর্থাৎ চাড়াল (চণ্ডাল) থেকে মুসলমান হয়ে খ পদবী ব্যবহার করলেও কেউ ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ থেকে মুসলমান হওয়া খাঁ-এর সমান হতে পারে না।
সবচেয়ে বেশি সম্মান ও মর্যাদা হলাে সেই মুসলমানদের যারা তাদের পূর্বপুরুষদের বহিরাগত বলে এ দেশের মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মাতে পেরেছেন। সৈয়দরা তাে সম্মানিত হবেনই। কারণ তাঁরা যে আরব দেশ থেকেই এসেছেন, শুধু তাই নয়। তারা যে আওলাদে রসুল। পাঠান’ পদবীধারীরা তাে পদবীটা দিয়েই তাদের বৈদেশিকত্ব প্রমাণ করতে পারেন, আর এ-রকম বৈদেশিকত্ব দিয়েই তারা স্থানীয় বাঙালিদের চোখে আশরাফ হয়ে ওঠেন। পাকিস্তান আমলে নাকি এখানকার এক পাঠান উপাধিধারী নেতা করাচিতে গিয়ে একান্ত গর্বের সঙ্গে বলেছিলেন, “আমি বাঙ্গাল নই, সীমান্তের পাঠান। এছাড়া মীর, খাজা, শাহ, ফকির, খন্দকার, আকন্দ, মিলকি—এ-রকম পদবীধারী মুসলমান যে একান্তভাবে আশরাফ, সে কথা সবাই মেনে নেয়। কারণ তারা যে পশ্চিমের কোনাে না কোনাে অঞ্চল থেকে হিজরত করে এই বাংলা মুলুকে এসে ঘর বেঁধেছেন তার দলিলী প্রমাণ তাঁদের হাতে আছে। এঁরা অনেকেই পশ্চিমী উৎসের জোরেই, স্থানীয় মুসলমানের ধর্মীয় নেতা ও সমাজনেতার আসন দখল করে বসেন।
হেকিম ভাই এঁদের এই নেতৃত্বের অধিকার সম্পর্কে নানা প্রশ্নের অবতারণা করতেন। তাছাড়া এদের অনেকের বংশগৌরবের দলিলের খাঁটিত্ব সম্পর্কেই যে সন্দেহ আছে, তাও
১৬২
বলতেন। ভাটি এলাকার কোনাে এক খাজা পরিবার সম্পর্কে একটা কৌতুকজনক গল্পও তার মুখে শুনেছি।
ওই পরিবারটি আসলে ছিলাে সাধারণ কৃষিজীবী। তেজারতি কারবার করে এক সময় তাদের অবস্থা বেশ সচ্ছল হয়ে যায়। কিন্তু এতে তাদের সামাজিক মর্যাদা খুব একটা বাড়ে না। গ্রাম সমাজে সামাজিক মর্যাদার জন্যে চাই বংশগৌরব। তারা তাই নতুন করে বংশগৌরবের সন্ধান করতে থাকে। এক সময় দেখা গেলাে যে, ওই পরিবারের সবাই নামের আগে লিখছেন ‘খাজা। আগে তাে এরা খাজা টাজা কিছু ছিলেন না, এখন হঠাৎ করে খাজা হয়ে গেলেন কী করে? গাঁয়ের লােকের কৌতূহলের জবাবে ওই পরিবারের প্রধান জানালেন : তাদের একটি পুরনাে ঘরের মেঝে খুঁড়তে গিয়ে একটি চোঙ্গা পাওয়া গেছে, সেই চোঙ্গার ভেতর ছিলাে একতাড়া পুরনাে কাগজ। সেই কাগজের লেখা পড়ে জানা যায় যে, তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন ‘খাজা। এভাবেই তারা তাদের বংশের হারানাে পদবীটি ফিরে পেয়েছেন।
গাঁয়ের লােক কিন্তু এতাে সহজে কথাটি বিশ্বাস করতে পারলাে না। তারা বিদ্রুপ করে ওদের নাম দিলাে ‘চোঙ্গার খাজা।
হেকিম ভাই বলতেন, এ রকম ‘চোঙ্গার খাজা’ যে কতাে আছে কে জানে?
বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাসের গবেষকগণও লক্ষ করেছেন : সাধারণ অনভিজাত মুসলমানরা যখন কোনাে রকমে সম্পদশালী হয়ে উঠেছেন, তখন তারা অনেকেই নামের সঙ্গে ওজনদার পদবী যুক্ত করে নিয়েছেন এবং এভাবেই ‘আতরাফ’ পরিচয় মুছে ফেলে আশরাফ’ হওয়ার প্রয়াস পেয়েছেন।
এরকম প্রয়াসের দৃষ্টান্ত হিসেবে ডক্টর ওয়াকিল আহমদ তাঁর গবেষণা ‘উনিশ শতকে বাঙালি মুসলমানের চিন্তা চেতনার ধারা’য় দুটো প্রবাদের উল্লেখ করেছেন। প্রবাদ দুটো হচ্ছে ঃ
(১) আগে ছিলাে উল্লা তুল্লা শেষে হয় উদ্দিন, তলের মামুদ উপরে যায় কপাল ফেরে যদ্দিন।
(২) গত বছর আমি একজন ‘জোলা’ ছিলাম, এ বছর আমি একজন ‘শেখ, আগামী বছর ভালাে দর পেলে আমি একজন সৈয়দ হবাে।
গ্রন্থের পাদটীকায় ডক্টর আহমদ দ্বিতীয় প্রবাদটির একটি ফারসী রূপের উদ্ধৃতি দিয়েছেন-
পেশ আই ইন কাসাব কুঁদে
বাদাজান গুশতে শৈখ
খালা চু আরজান শাওয়াদ
ইস সাল সৈয়দ মেশাওয়ে।
এর অর্থ—প্রথম বছর আমরা কসাই ছিলাম, পরের বছর শেখ, বর্তমান বছরে যদি ভালাে দাম পাই তবে আমরা সৈয়দ হবাে।
ধর্মশাস্ত্রের অনুমােদন না থাকা সত্ত্বেও এরকম উঁচু জাতের গৌরব ও জাতে ওঠার নানা কায়দা-কানুনের প্রচলন এদেশের মুসলমানদের মধ্যে একেবারে কম ছিলাে না। হিন্দু সমাজের মতাে জাতের নামে বজ্জাতির নানা উপাদানও মুসলমান সমাজের এখানে-ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলাে। এমনকি, তথাকথিত শরিফ মুসলমানরা অন্য মুসলমানদের প্রতি আচরণে ছাত্মার্গেরও পরিচয় দিতাে। উনিশ শতকে ও বিশ শতকের গােড়ার দিকে মুসলমান-সম্পাদিত
১৬৩
পত্রপত্রিকাগুলােতে এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী ‘আল এসলাম পত্রিকায় (অগ্রহায়ণ, তেরােশাে ছাব্বিশ সাল) লিখেছিলেন—শরিফ-রজিল বা আশরাফ-আতরাফের পার্থক্য বঙ্গদেশীয় মুসলমান সমাজে অত্যন্ত প্রবল।…পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান, বীরভূম ও মুর্শিদাবাদের অংশ বিশেষে শরাফতের দাবীদাওয়াটা খুব বেশি। তত্রত্য তথাকথিত শরিফগণ অশরিফগণকে কু কুর, শৃগাল হইতেও অধম বলিয়া জ্ঞান করে ।…উত্তরবঙ্গে বাদিয়া’ ‘নিকারী’ ও আসামে ‘মাটিয়া’ উপাধিবিশিষ্ট মােসলমানগণ একসঙ্গে অন্য মােসলমানের সহিত আহার করা দূরে থাকুক, এক মসজিদে, এক ঈদগাহে বা মাঠে নামাজ পড়িতেও পারে না। সালাম আদান-প্রদানের অধিকারীও নহে।…মধ্যবঙ্গে নদীয়া, ২৪ পরগণা অঞ্চলে কোন নীচ জাতীয় হিন্দু মােসলমান হইলে তাহাকে সমাজে নেওয়া হয় না, জুমা জামাতে শরিক করা হয় না।’
এতােখানি মর্মান্তিক অবস্থা অবশ্যি আমাদের এলাকায় আমি দেখিনি। কখনাে এ-রকম ছিলাে বলেও কারাে কাছে শুনিনি। আমি তাে বরং আমার শৈশবে, পাকিস্তানি ভাবনার জোয়ারের মুখেও, আশরাফদের চেয়ে তথাকথিত আতরাফ মুসলমানদের প্রতাপই বেশি দেখেছি। পাকিস্তানের জন্মের পরও এই আতরাফ মুসলমানরা তাদের লৌকিক ভাবনার জগতটি একেবারে পরিত্যাগ করেনি। সাম্প্রদায়িক প্রচারণায় টানটান হয়ে উঠে এরা পাকিস্তানি জোশ দেখিয়েছে বটে, কিন্তু কখনাে প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় জড়িয়ে পড়েনি। তবে পাকিস্তানি জোশ যে তাদের সকলকে মুসলমানত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তুলেছিলাে—এ কথা ঠিক। মুসলমানদের ভেতর যতােই আশরাফ-আতরাফের ভেদ থাকুক, সে ভেদকে কোনাে মতেই হিন্দুদের জাতভেদের সঙ্গে এক করে দেখা চলে না। হিন্দুদের মতাে মুসলমানের জাত কচুপাতার পানি নয়। কোনাে কিছুতেই মুসলমানের জাত যায় না। যে সব হিন্দুর জাত চলে যায় তারাই বরং মুসলমান হয়ে একটা নতুন জাতের ঠিকানা পায়। হিন্দুরা তাদের বিভিন্ন গােষ্ঠির মানুষকে দেখে নানা জাতে ভাগ করে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য, কৈবর্ত, ধােপা, নাপিত, তেলী, কামার, নমশূদ্র ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু যখন এ সব যে কোনাে জাতের যে কোনাে লােক মুসলমান হয়ে যায় তখন তাদের অন্য কোনাে জাত-পরিচয় আর থাকে না, তার তখন। একটিই জাত—মুসলমান। কলু, নিকারি, কারিগর, আবদাল—এরকম বংশানুক্রমিক পেশাভিত্তিক কিছু কিছু জাত মুসলমান সমাজে তৈরি হয়ে গেলেও, এর কোনােটিই হিন্দুদের জাতের মতাে চিরকালের জন্যে নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় হয়ে থাকে না। পেশা পরিবর্তন করে, ধন সম্পদের অধিকারী হয়ে, লেখাপড়া শিখে, উঁচুঘরে বিয়েশাদি করে এবং এ-রকম আরাে নানা উপায়ে মুসলমানরা জাতের চিহ্ন মুছে ফেলতে পারে। সামন্ততান্ত্রিক প্যাটার্নের গ্রাম সমাজে বংশগৌরবের গুরুত্ব অনেক বেশি যদিও, তবু নিজের অর্জন দিয়ে বংশগৌরবের ঘাটতি দূর করে নেয়াটা মুসলমানের জন্যে মােটেই কঠিন কিছু নয়। তাছাড়া মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে উঁচু নিচু বা আশরাফ-আতরাফের টানাপােড়েন যতােই থাক, হিন্দুদের দৃষ্টিতে সব মুসলমানই এক জাত। এ জাত অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ। সব হিন্দুর কাছে অস্পৃশ্য যে ডােম কিংবা বাগদি জাত, সে জাতের কাছেও মুসলমান জাত অস্পৃশ্য।
এই ‘জাত’ শব্দটা দিয়ে অবশ্যই গােষ্ঠী বা কাস্ট বা কমিউনিটি বােঝায়, জাতি’ বা ‘নেশন’ নয়। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রী হিন্দুরা যুগ যুগ ধরে তাদের নিজেদের মধ্যে নানা জাত সৃষ্টি করে রাখতে পেরেছে, স্মৃতিশাস্ত্রের বিধান অনুযায়ীই এ সব জাত নিজের নিজের অধিকারের সীমানা
১৬৪
মেনে নিয়েছে। কিন্তু মুসলমান তাে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বা তার স্মৃতিশাস্ত্রের অধীন নয়। হিন্দুরা মুসলমানকে যে অর্থেই একটি জাত’ বলুক, মুসলমান সে অর্থকে মেনে নিতে পারে না, মেনে নেয়ওনি। ধর্মীয় নেতাদের কাছে সে কওম’-এর কথা শুনেছে। চল্লিশের দশকের মুসলমানকে সেই কওমের ভাবনাই ভাবানাে হয়েছে।
তবে হিন্দুরা সব মুসলমানকে একটি জাত’ শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করায় মুসলমানদের ক্ষতি কিছু হয়নি, এতে তাদের কওমী ঐক্য গড়ে তুলতে সুবিধাই হয়েছে বরং। সাম্প্রদায়িক স্বার্থ নিয়ে সংগ্রামের এক পর্যায়ে নিজেদেরকে তারা কমিউনিটির বদলে নেশন বলে ঘােষণা করলাে—জাত থেকে হয়ে গেলাে জাতি। আরবি কওম’ ইংরেজি ‘নেশন’-এর সংজ্ঞাকে বিকৃত করে হলাে বাংলা ‘জাতি’। মুসলমান জাতি। দি মুসলিম আর অ্যা নেশন—জিন্নাহর ভাষায় পাকিস্তানের ‘ভাইটাল প্রিন্সিপল।
এ ধরনের জাতিতত্ত্ব সমাজবিজ্ঞানের নিয়মনীতির বিবেচনায় অবশ্যই ভ্রান্ত—একেবারেই ভ্রান্ত। তবু এই ভ্রান্ত তত্ত্বই যে একটা পুরাে জনগােষ্ঠীকে মাতিয়ে তুলতে পারলাে একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, তার হেতুটি যে সমাজ বাস্তবের মাটিতেই লুকিয়ে ছিলাে—সে কথা অস্বীকার করাও বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক হবে না নিশ্চয়ই।

‘আকবর বাদশার সঙ্গে সলিমুদ্দিন চাষীর কোনাে ভেদ নেই’
তালুকদাররা যাদের তুই, তুমি বা আপনি না-বলে ভাববাচ্যে কথা বলতাে, চল্লিশের দশকে তাদেরই একটি প্রভাবশালী অংশ ‘দি মুসলিমূস আর অ্যা নেশন’-এর বীজমন্ত্রে দীক্ষা নিয়েছিলাে। খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম হয়েছিলেন সেই দীক্ষিতদেরই একজন।
তার সহযােগী বা সহমর্মী স্বগ্রাম সিংহের গাঁওয়ে বােধ হয় কেউই ছিলাে না। কেবল কিছু অনুগামী তিনি সৃষ্টি করে নিতে পেরেছিলেন মাত্র। কারণ এ-গ্রামের মুসলমান কৃষকের ছেলেরা তখনাে স্কুল-কলেজের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠতে পারেনি। পাশের গ্রাম কচন্দরার লাল মিঞা স্কুলে হেকিম ভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন। পরে তিনি ডাক্তারী পাস করেছিলেন। হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে আলাপে প্রসঙ্গক্রমে মাঝেমধ্যে তার কথা উঠতাে। এছাড়া পাকিস্তান-ভাবনায় তার আর যে-সব সহযােগীর কথা তিনি বলতেন, তাদের কাউকে আমি দেখিনি। তাদের কারাে নামও আমার মনে নেই। তারা ছিলেন তাঁর কলেজের সহপাঠী অথবা আত্মীয়। সহপাঠী বা আত্মীয় নন, এমনকি সাক্ষাৎ পরিচয়ও ছিলাে না যাদের সঙ্গে, এ-রকম অনেকের কথাও তিনি বলতেন। শহুরে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন বা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চেষ্টা করছিলেন। খুব সহজে তাদের প্রতিষ্ঠা ঘটেনি। অনেকের কনুইয়ের গুঁতাে খেয়ে ও অনেককে গুঁতাে দিয়ে টিকে যেতে বা সটকে পড়তে হতাে তাদের। এ রকম অনেকের জীবন সংগ্রামের নানা উত্তেজনাকর কাহিনী হেকিমভাই আমাকে শুনিয়েছিলেন। উকিল মােক্তার বা ডাক্তারের মতাে স্বাধীন পেশাতেও যেমনি, তেমনি সরকারি বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও তাদের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখােমুখি দাঁড়াতে হয়েছিলাে এবং এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিলাে প্রায় সব ক্ষেত্রেই অসম। প্রতিপক্ষ অনেক বেশি প্রবল। আরবি নামধারী মানুষগুলাের সেই প্রবল প্রতিপক্ষ ছিলাে সংস্কৃত নামধারীরা। জন্মসূত্রে সংস্কৃত নামধারী হয়েও যিনি শেষ পর্যন্ত আরবি নাম নিতে বাধ্য হয়েছিলেন শচীন্দ্র শর্মা থেকে হয়েছিলেন সুলতান উদ্দিন খা—তারই অধস্তন নবম পুরুষ খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম তার যৌবনে সকল আরবি নামধারীর সঙ্গে যে গভীর একাত্ম ও
১৬৫
সংস্কৃত নামধারীদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন, তার কারণটি খুঁজে পাওয়া যাবে চল্লিশের। দশকের সামাজিক পরিমণ্ডলের মধ্যেই। গ্রামে তিনি আরবি নামধারীদের প্রতি সংস্কৃত নামধারী তালুকদার জোতদারদের অবজ্ঞা-অবহেলার জঘন্য রূপ দেখেছেন, শহরেও দেখেছেন তারই রকমফের। খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমের মতাে স্কুল-কলেজপড়া যুবকদের চোখের সামনে থেকে তখন গ্রামীণ লােকজীবনের সনাতনী ছবিটি সাময়িকভাবে হলেও মুছে গেছে। গ্রামের হিন্দু বা মুসলমান যে উভয়ের আচারভেদ ও খাদ্যাখাদ্যভেদকে মেনে নিয়েই পরস্পরকে ভুরিভােজে আপ্যায়িত করে এবং এতে আছে বৈচিত্রের মধ্যেই ঐক্যের একটা বােধ—নতুন প্রজন্মের সাক্ষর মুসলমানরা এ কথা আর মানতে রাজি নয়। মুসলমানের ছোঁয়া লাগলেই যে হিন্দুর জাত যায়—এ বিধানের মধ্যে তারা হিন্দুর জাতের দম্ভই প্রত্যক্ষ করলাে। এ দম্ভের বিরুদ্ধেই রুখে দাঁড়াতে গিয়ে তারা নিজেদের জন্যেও দম্ভের কিছু বাস্তব আর প্রচুর কল্পিত উপাদান জড়াে করতে লাগলাে এবং এ সব উপাদান ব্যবহার করে নিজেরাও দাম্ভিক হয়ে উঠলাে। মুসলমানের এক কল্পিত অতীতকেই একান্ত বাস্তব ভেবে নিয়ে নিজের চারপাশে একটা আত্মসম্মােহনের জাল তৈরি করে নিলাে।
এই বাংলাদেশটা, তামাম হিন্দুস্তানটা কাদের ছিলাে জানাে?…সেই যে আকবর বাদশা, তামাম হিন্দুস্তানের বাদশা ছিলেন। আর ওই যে নবাব আলীবর্দী তিনি ছিলেন সুবে বাংলার হর্তাকর্তা, মালিক। তাদেরই বংশধর আমরা, এই দেশ তাে আমাদের ।…কিন্তু ঐ শুয়ােরখাের ইংরেজ? কেড়ে নিলাে আমাদের বাদশাহি তখৃত্। বাদশার জাত আমরা ভিখিরির জাত। পােয়াবারাে, ওই মালাউনদের, জমিজিরাত সবই লুটেপুটে খাচ্ছে ঐ ব্যাটারা।’_শহীদুল্লা কায়সারের ‘সংশপ্তক’ উপন্যাসের ফেলু মিঞার এ উক্তিটিই নানাভাবে নানা ভাষায় চল্লিশের দশকের অনেক মুসলমানের মুখে শােনা গেলাে। এবং উঁচু তলার মুসলমানরা এ বক্তব্যটিকেই নিচুতলার মুসলমানদের মধ্যে চারিয়ে দিলাে। নিচুতলার মুসলমানদের মাথায় যখন ঢুকিয়ে দেয়া গেলাে যে, তারা বাদশার জাত’, তখনই উঁচুতলার বা উঁচুতলার কাছাকাছি মুসলমানদের শক্তি বেড়ে গেলাে কয়েকগুণ। সব মুসলমানই বাদশার জাত, সব মুসলমানই এক। মুসলমানে মুসলমানে কোনাে ভেদ নেই, কোনাে বিবাদ নেই, কোনাে শত্রুতা নেই। মুসলমানদের কাছ থেকে বাদশাহি কেড়ে নিয়েছে নাছারা ইংরেজরা। বিদেশি নাছারাদের সঙ্গে মিলে গেছে। এদেশের মালাউন হিন্দুরা। এই নাছারা আর মালাউনরা মিলে বাদশার জাত মুসলমানকে বানিয়েছে ভিখিরির জাত। এখন আবার নাছারাদের হাত থেকে বাদশাহি নিয়ে আসার জোগাড় করছে মালাউনরা। কাজেই ভাই মুসলমান, সবাই এক হও। ওই বাদশাহি ফিরিয়ে আনতে হবে। বাদশাহি ফিরিয়ে আনার জন্যে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।
এদেশের সব মুসলমানই যদি হয় বাদশাহর জাত—অর্থাৎ আকবর বাদশা আর নবাব আলীবর্দীর গােত্রের মানুষ—তা হলে যারা হিন্দু কিংবা বৌদ্ধ থেকে মুসলমান হয়েছে তাদের পরিচয়টা কী হবে? অনেকেই তাে বলেছেন : বর্ণহিন্দুদের নির্যাতন-নিপীড়ন কিংবা বর্ণাশ্রমের অমানবিক কঠোরতা সইতে না পেরেই এদেশের নিম্নবর্ণ ও দরিদ্র হিন্দুরা দলে দলে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয় এবং এভাবেই এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অধিবাসী হয়ে যায় মুসলমান। তাই যদি হয়, তাহলে এ কথাও তাে মানতে হয় যে, নিপীড়িত-নির্যাতিত ও দরিদ্র মানুষরাই এদেশের মুসলমানদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। অর্থাৎ ভিখিরি অবস্থাতেই অমুসলমান
১৬৬
থেকে মুসলমান হয়েছে বিপুল অধিকাংশ মানুষ। মুসলমান হওয়ার পরও তাদের অবস্থার খুব একটা হেরফের হয়নি। ভিখিরিরা ভিখিরিই থেকে গেছে। এখন এরা সবাই নিজেদেরকে বাদশার জাত ভাবতে পারলাে কী করে?
হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে এ-সব প্রশ্ন নিয়ে আমার আলােচনা হয়েছে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে। তখন তিনি নির্মোহ দৃষ্টিতে তার চল্লিশের দশকের ভাবনাগুলাের পুনর্বিচার করে চলেছেন। সাতান্ন সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জন্মের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি সে দলে যােগ দিয়েছেন। কাজেই আমার প্রশ্নগুলাে নিয়ে সে-সময়ে তিনি অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে খােলাখুলি মত প্রকাশ করতেন। কখনাে কখনাে নিজের অতীত নিয়েই ব্যঙ্গ করতেন।
হেকিম ভাই তার যৌবনের স্মৃতিচারণ করে বলতেন, সে-সময়ে আমরা এ-দেশের ইতিহাসে কেবল মুসলমানের গৌরবগাথা খুঁজতাম। আমাদের পাঠ্য ইতিহাসে তাে রাজা আর রাজবংশের বিবরণ ছাড়া আর কিছুই ছিলাে না। হিন্দু রাজার সঙ্গে মুসলমান বাদশার যুদ্ধে বাদশাই যে জিতবেন, আমাদের বিবেচনায় এ ছিলাে অবধারিত। যে-সব ক্ষেত্রে ইতিহাস বইয়ে বাদশার পরাজয়ের কথা দেখতাম, সে-সব ক্ষেত্রে আমরা ধরেই নিয়েছি যে কথাগুলাে ঠিক নয়। হিন্দু লেখকরা মুসলমানদের হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যেই এ রকম কথা বানিয়ে লিখেছে।
হেকিম ভাইয়ের সহপাঠিদের মধ্যে দু’চারজন মাত্র ছিলাে মুসলমান, আর সবাই হিন্দু। ইতিহাস নিয়েই ওই হিন্দু সহপাঠিদের সঙ্গে তর্কটা বেশি হতাে। সে তর্কে হিন্দু সহপাঠীরা যে শুধু সংখ্যার জোরেই জিতে যেতাে, তা নয়। তাদের পক্ষে তথ্যের সম্ভারও ছিলাে অনেক বেশি। আর সে সব তথ্যের জোগান আসতাে যে সব বই থেকে সে-সবের কোনােটারই লেখক ছিলাে না কোনাে মুসলমান। হিন্দু সহপাঠিরা কখনাে আকার-ইঙ্গিতে কখনাে বা স্পষ্ট ভাষাতেই মুসলমানদের চাষাভূষা’ বলে বিদ্রুপ করতাে। মুসলমানের কোনাে কালচার নেই, কেবল আছে এগ্রিকালচার—এরকম কথা বলাকেও ওরা উচ্চাঙ্গের রসিকতা বলে মনে করতাে। আর এরকম রসিকতা যাদের উদ্দেশে করা হচ্ছে তাদের জন্যে যে তা কতােখানি মর্মচ্ছেদী হতে পারে, সে-সম্পর্কে সামান্য বােধও ওই রসিকদের ছিলাে না।
হেকিম ভাইয়ের অন্য অন্য মুসলমান সহপাঠিরা হয়তাে স্থল রসিকতার জবাব সুলতর ভাষাভঙ্গিতেই দিতাে। কিন্তু আবহমান বাংলার লােকঐতিহ্য-সংস্কৃতির ধারক, উদার চেতনা সম্পন্ন ও অত্যন্ত উঁচু মানের বাউল কবি জালাল উদ্দিন খাঁর পুত্র খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমের রুচি ছিলাে অনেক উন্নত। ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল কবি, ছেলেবেলা থেকেই বিস্তৃত ছিলাে তার পড়াশােনার পরিধি, তাঁর মননশীলতা ছিলাে অনেক উঁচু পর্দায় বাধা। সেই মননশীলতার ওপর ভর করেই তিনি তাঁর হিন্দু সহপাঠিদের ঠেস দেয়া কথার অন্যতর জবাব সন্ধান করতে লাগলেন।
মুসলমানের কোনাে কালচার নেই’—এ অপবাদের জবাবই তিনি দিতে চেয়েছিলেন তার বাড়িতে আবেহায়াৎ সাহিত্য মঞ্জিল প্রতিষ্ঠা করে। আশুজিয়ার হিন্দু তরুণদের মতােই তিনি নাটক অভিনয় নিয়ে মাতলেন এবং সিংহের গাঁও ও আশপাশের গ্রামের মুসলমান যুবককিশােরদের অভিনয়শিল্পী হিসেবে গড়ে তােলার চেষ্টা করলেন। নিজের কবিতাকে মুসলিম তমদুনের বাহন করে তুললেন। বাড়িতে ঘন ঘন গানের আসর বসাতে লাগলেন। সে-আসরে তার বাবার বাউল ও মারফতি গানের পাশাপাশি আধুনিক নাগরিক সঙ্গীতেরও চর্চা চললাে।
১৬৭
নিজেও ইসলামী গানের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক গান রচনায় মন দিলেন। তার নীল কপােত’-এর প্রেমগীতিগুলাে আধুনিক গানেরই উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
হেকিম ভাই সুযােগ-পেলেই তার চল্লিশের দশকের দিনগুলাের স্মৃতির ঝাঁপি আমার সামনে খুলে ধরতেন। আর আমি তার মধ্যেই দ্বিজাতিতত্ত্বের নির্মাণ প্রক্রিয়াটি অবলােকন করতাম। পাকিস্তানের জন্মের দিনটি ওই প্রক্রিয়াতেই কীভাবে শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে এসেছিলাে তাও দেখতে পেতাম।
উনিশ শাে পঁয়ত্রিশ সালের ভারত শাসন আইনের আওতায় সঁইত্রিশ সাল থেকে বাংলার নির্বাচিত সরকার ছিলাে মুসলমানদের নিয়ন্ত্রণে। আর এর ফলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষিত মুসলমানের চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রটি যেমন অনেক মসৃণ হয়ে গিয়েছিলাে তেমনি মনস্তাত্ত্বিক দিক দিয়েও তাদের জন্যে আত্মবিশ্বাস ও সাহসের জোগান এসেছিলাে। শিক্ষায় ও সম্পদে প্রতিপক্ষ হিন্দুরা অনেক প্রবল হলেও চল্লিশের দশকে বাংলার রাজনৈতিক শক্তিটি এসে গিয়েছিলাে উঠতি মুসলমান মধ্যবিত্তের অনুকূলে। সেই অনুকূল রাজনৈতিক শক্তির বলেই প্রবল প্রতিপক্ষকে মােকাবেলা করাও তাদের পক্ষে অনেক পরিমাণে সহজ হয়ে এসেছিলাে। এ-ধরনের একটি অনুকূল পরিবেশকে যে কিছুতেই নষ্ট হতে দেয়া উচিত নয়, এ-রকম একটি বােধ সকল মুসলমান মধ্যবিত্তের মর্মে মর্মে সঞ্চারিত হয়ে গিয়েছিলাে। ঔপনিবেশিক শাসনের আওতার ভেতরে থেকেই কেউ কেউ শাসক হওয়ার স্বাদ পেয়ে যান। সে স্বাদ থেকে যারাই তাদের বঞ্চিত করতে চায় তারাই হয় তাদের দুশমন। বিদেশি শাসক চলে গেলেও অখণ্ড ভারতের শাসন ক্ষমতায় যে তাদের অধিষ্ঠান হবে না এবং সে জন্যেই যে চাই একটি আলাদা রাষ্ট্র, চল্লিশের দশকের নব্যশিক্ষিত মুসলমান এ বিষয়ে ছিলাে নিঃসংশয়। এ নিঃসংশয় বােধ থেকেই তারা হয়ে ওঠে দ্বিজাতিতত্ত্বের সােচ্চার প্রচারক। শহরে-বন্দরে গায়ে-গঞ্জে তারা প্রচার করে : মুসলমান জাতি কেবল এই ইংরেজ রাজত্বেই ইংরেজ আর তার সহযােগী হিন্দুর শাসনশােষণে হতদরিদ্র হয়েছে। অতীতে কখনাে এমনটি ছিলাে না, ভবিষ্যতেও এ-রকম থাকবে না। পাকিস্তান কায়েম হলে এই বাদশার জাত’ আবার হবে বাদশা ফিরে পাবে অতীতের সব শান শওকত। মুসলিম লীগের নেতারা বিভিন্ন জনসভায় পাকিস্তানের এ-রকম ছবিই তুলে ধরতেন। যেমন, মােহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ্ জানিয়েছেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রে মুসলমানরা কী পাবে তার ফিরিস্তি দিতে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিন চট্টগ্রামের এক জনসভায় বলেছিলেন, পাকিস্তান হাসিল হলে, আপনার ছেলে মুন্সেফ হবে, তার ছেলে ম্যাজিস্ট্রেট হবে, উনার ছেলে ডেপুটি হবে, দারােগা হবে।’
এ-রকম কথা শুনতে শুনতে শােষিত-বঞ্চিত মুসলমান চাষী সলিমুদ্দিনও ভবিষ্যতের পাকিস্তানের মধ্যেই দেখতে পেলাে এক সব পেয়েছির দেশ, ‘কিনু গােয়ালার গলি’র হরিপদ কেরানির মতােই সে ভাবতে লাগলাে—‘আকবর বাদশার সঙ্গে সলিমুদ্দিন চাষীর কোনাে ভেদ নেই।
কোনাে কোনাে মুসলিম লীগ নেতার ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সম্পর্কে এ্যাপ্রােচটি ছিলাে এরকম : ব্রিটিশরা মুসলমানের কাছ থেকেই এ-দেশের তখৃত্ কেড়ে নিয়েছিলাে, তাই এখন সেই তখত মুসলমানকেই ফেরত দিয়ে ওরা নিজের দেশে ফিরে যাক।
আর এরই বিপরীতে, পাকিস্তান আন্দোলনের তীব্র জোয়ারের মুখে, স্বমূর্তি ধারণ করে দীর্ঘকালের কায়েমি স্বার্থভােগী হিন্দু জমিদার-তালুকদার-জোতদার-মহাজনরা। আবুল মনসুর আহমদ তার উপন্যাস ‘জীবন ক্ষুধায় এদেরই মুখপাত্র রূপে হাজির করেছেন সুরেন মিত্র নামক
১৬৮
একটি কাল্পনিক চরিত্রকে। ময়মনসিংহের উপভাষায় সুরেন মিত্র বলে, ‘পাকিস্তান চায় মুসলমানরা কোন অধিকারে? এ দেশ কার? আর্যরার। মুসলমানরা তাে বিদেশি। তারাও তাে ইংরেজের মতাে জোর কৈরা আমরার মাতৃভূমি দখল করছিলাে। তারা এ দেশে থাকতে চায়, হিন্দুরার লগে মিইশা থাকুক। না থাকতে চায়, চইলা যাউক তারার আরব দেশে। আরেকটা ব্যাপার দেখ। দেশের স্বাধীনতার লাগি আন্দোলন করলাম, জেল খাটলাম, ফাঁসিতে ঝুললাম আমরা হিন্দুরা। আর ইংরেজরা চইলা যাইতেছে দেইখা এখন মুসলমানরা কয়, আমরা অংশ চাই, দেশ বাটোয়ারা করুম। আরে আমার শরিক রে। ।
কথাগুলাে একটি উপন্যাসের কাল্পনিক চরিত্রের মুখের কাল্পনিক সংলাপ হলেও সুরেন মিত্র চরিত্রটি উদ্ভট কল্পনার সৃষ্টি নয়। আমি নিজেই এ-রকম অনেক অনেক সুরেন মিত্রকে দেখেছি, ওদের মুখে হুবহু এ-রকম উক্তিই শুনেছি। শহীদুল্লাহ কায়সারের ফেলু মিঞার মতাে আবুল মনসুরের সুরেন মিত্রও বাস্তব—একান্ত বাস্তব। এদেশের গায়ে ও শহরে বাস্তবের ফেলু মিঞা ও সুরেন মিত্ররাই অনেক অনেক কল্পনার ফানুস উড়িয়ে অনেক অনেক মানুষের মনে রঙ লাগিয়েছে। একদল মেতেছে পাকিস্তানের সবুজ রঙের নেশায়, আরেক দল হাঁটু গেড়ে বসেছে অখণ্ড ভারতমাতার তিনরঙা মূর্তির সামনে। জোতদার ফেলু মিঞা-কালুমিঞাদের সঙ্গে সঙ্গে বর্গাদার সলিমুদ্দিন-কলিমুদ্দিনরাও নিজেদের ভেবেছে ‘বাদশার জাত। সুরেন মিত্রদের মতাে বর্ণহিন্দুদের কাছে যারা অস্পৃশ্য অনার্য, সেই সুবল নমদাস বা শরৎ ধােপারাও স্ফীত হয়ে উঠেছে আর্যগৌরবে ।
এমনই মাহাত্ম্য দ্বিজাতিতত্ত্বের। এ দ্বিজাতিতত্ত্ব শােষিত-নিপীড়িত মানুষগুলােকে শ্ৰেণীস্বার্থ ভুলিয়ে দেয়, তাদেরকে মিলিট্যান্ট মুসলমান কিংবা হিন্দু বানিয়ে তােলে। আর শােষকদের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গােষ্ঠী শােষিতদেরই সহায়তায় গােষ্ঠীস্বার্থ রক্ষার মওকা পেয়ে যায়।

হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে পাপের ছিদ্র ও শনির প্রবেশ
উনিশোে সাতান্ন-আটান্নর দিকে হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে আলােচনায় আমার ধারণা জন্মেছিলাে যে, চল্লিশের দশকের একেবারে গােড়া থেকেই এ দেশের গ্রাম এলাকার মুসলমানের মধ্যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভাবনা আস্তে আস্তে ছড়াতে থাকে। এরপর ছেচল্লিশ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলমানদের জন্যে নির্ধারিত আসনে মুসলিম লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়, সে বছরেই আগস্ট মাসে মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’-এর ঘােষণা এবং তারই অনিবার্য পরিণতিতে কলকাতাবিহার-নােয়াখালির হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা—এই কয়েকটি ঘটনার প্রভাব এমন সর্বব্যাপী হয়ে পড়ে যে, তখন আর হিন্দু-মুসলমানকে এক ভাবার কোনাে সুযােগই যেনাে অবশিষ্ট থাকে না। তখন আরবি নামধারী মানুষরা একদিকে, অন্যদিকে সংস্কৃত নামধারীরা। অর্থাৎ মুসলমান আর হিন্দু যেনাে দুটি সমান্তরাল রেল লাইন। পাশাপাশি আছে কিন্তু মেশামেশি হওয়ার কোনেই সম্ভাবনা নেই। আবার সমান্তরাল রেল লাইনের উপমাকেও বেশি দূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়া চলে না। কারণ রেলের দু’টি লাইন তাে পরস্পরের পরিপূরক, দুটোতে না মিললেও রেলগাড়িটিকে তারাই মেলায়। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কিন্তু এমনটি হওয়ারও কোনােই উপায় নেই। তারা মিলবেও না, মেলাবেও না। সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের থাকতে হবে। ধুতি-লুঙ্গির দ্বন্দ্বের কোনাে মীমাংসা নেই। জল আর পানি দুটো আলাদা জিনিস, স্নান আর গােসল সম্পূর্ণ। পৃথক দুটো কর্ম! মাংস আর গােশত, ডিম আর আণ্ডা কখনাে এক হতে পারে না!
১৬৯
দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রবক্তা অনেক লেখকই সমান্তরাল রেললাইনের উপমা দিয়ে এদেশের হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ককে বােঝাতে চেয়েছেন। কলকাতায় পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটির প্রধান সংগঠকরূপে আবুল মনসুর আহমদই বােধহয় সর্বপ্রথম এই উপমাটি ব্যবহার করেছিলেন। এরপর থেকেই এটি বহুদিন ধরে ক্রমাগত ব্যবহৃত ব্যবহৃত ব্যবহৃত হয়ে এসেছে।
উনিশোে ছেচল্লিশের অনেক কথাই তাে আমার বেশ স্পষ্ট মনে আছে। সে সময়ে ধুতিলুঙ্গি দ্বন্দ্বসমাস এমন স্পষ্ট রূপ ধরেছে যে, ‘মােরা একই বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান’– জাতীয় কথাগুলাে নিছক পরিহারের মতাে শােনায়। অথচ সে সময়েই নজরুলের এ গানটি গায়ে-গঞ্জে প্রচুর প্রচার পেয়েছে। সে-সময়েই আমাদের গ্রাম এলাকার অনেক সচ্ছল মানুষের বাড়িতে কলের গানের প্রবেশ ঘটে গেছে। গ্রামােফোনকেই গাঁয়ের মানুষ বলতাে কলের গান। কলের গানই আব্বাস উদ্দিন আর শচীন দেব বর্মণকে সকল গাঁয়ের মানুষের আপন জন করে তুলেছে। কলের গান শুনেই গাঁয়ের যুবক-কিশােররা নিজেদের কণ্ঠে তুলে নিয়েছে ওই মালতীলতা দোলে’। এ গানটিকে সবাই বলতাে আধুনিক গান। এটি যে রবীন্দ্রসঙ্গীত, সে-কথা আমি জেনেছি অনেক বছর পরে। কলের গানই গাঁয়ের মানুষকে রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুল ইসলামের গান আর আধুনিক গানের সঙ্গে পরিচয়ের নিবিড়তা এনে দিয়েছে। পল্লীর বাউলমারফতি-ভাটিয়ালী-ভাওয়াইয়ার মতাে এ-সব গানও তাে দ্বিজাতিতত্ত্বের কথা বলে না। পল্লীর গানের মতাে এ-সব গানও বাঙালির সেকুলার ঐতিহ্যেরই ধারক। তবু কী আশ্চর্য, চল্লিশের দশকে কলের গানের মারফত গাঁয়ের ঘরে ঘরে সেকুলার বাঙালি সংস্কৃতির বাণী ও সুরের ব্যাপক প্রচার ঘটলেও, এ-সময়েই কিনা গেঁয়াে আর শহুরে নির্বিশেষে প্রায় সকল বাঙালিই হয়ে গেলাে কমবেশি কম্যুনাল। কমুনিটিই তার কাছে হয়ে গেলাে নেশন, কমনালিজমকেই সে গ্রহণ করলাে ন্যাশনালিজমের বেনামিতে।
কলের গানেই আমরা প্রথম শুনি শচীন সেনগুপ্তের ‘সিরাজউদ্দৌলা নাটকের রেকর্ড। সেই নাটক শুনে আমাদর সে কী উত্তেজনা! পথে ঘাটে মাঠে আমরা সিরাজউদ্দৌলা, মােহনলাল, গােলাম হােসেন, লুৎফা আর আলেয়ার সংলাপ আওড়াই। এ সময়ের ‘সিরাজউদ্দৌলা নাটকের বইটিও গাঁয়ের মানুষের হাতে এসে যায়। এ পাড়া ও পাড়ায় স্টেজ বেঁধে শুরু হয়ে যায় সিরাজউদ্দৌলা’র অভিনয়। কিন্তু বাংলা শুধু হিন্দুর নয়, বাংলা শুধু মুসলমানের নয়, বাংলা হিন্দু-মুসলমানের মিলিত গুলবাগ’—সিরাজের এই সংলাপ শুনে যতােই হাততালি দিই, বাস্তবে কি এ-কথা আমরা বিশ্বাস করেছি? করিনি যে, তার প্রমাণ তাে আমরা আমাদের সব কাজেকর্মেই রেখেছি। হেকিম ভাইয়ের পরিচালনাতেও তার বাড়ির গােলঘরে বেশ কয়েকবার ‘সিরাজউদ্দৌলা’র মঞ্চায়ন হয়েছে, তিনি নিজেই সিরাজের ভূমিকায় মঞ্চাবতরণ করেছেন। অথচ, অন্তত চল্লিশের দশকে, বাংলাকে তিনি হিন্দু-মুসলমানের মিলিত গুলবাগ বলে মনে করতেন না। কিন্তু তার রক্তে ছিলাে হিন্দু-মুসলমানের মিলিত সংস্কৃতিরই ঐতিহ্য। যে বাউল পিতার সৃষ্টি সম্ভারের প্রতি ছিলাে তার অসীম শ্রদ্ধা, সেই জালাল উদ্দিন খার ‘জাতে জাতে যার তার মতে, গেছে ধর্ম বিভাগ করে কিংবা বিচার করলে নাইরে বিভেদ কে হিন্দু কে মুসলমান’—এসব বাণীতেও তাে পুত্র খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিম আস্থা হারাতে পারেন না। তবে আস্থা না হারালেও সে-আস্থার সূর্যকে যে সে-সময়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের রাহু এসে গ্রাস করেছিলাে, সে-কথাও একান্ত সত্য। অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিলাে যে, সাম্প্রদায়িক
১৭০
সমস্যার চরম অবনতি দেখে, অনেক উদার অসাম্প্রদায়িক মানুষও সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে দেশবিভাগকেই শেষ সমাধান বলে ধরে নিয়েছিলেন। গরু কোরবানি আর মসজিদের সামনে বাজনা বাজানাে নিয়ে হিন্দু-মুসলমানী কাণ্ড-কারখানা অনেক দিন ধরে চলতে থাকায় এমনিতেই শান্তিপ্রিয় মানুষরা ত্যক্তবিরক্ত হয়ে গিয়েছিলাে। এরপর ছেচল্লিশের দাঙ্গায় তাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে বিশ্বাস একেবারে ধসে পড়লাে। এভাবে একত্রে থেকে খেয়ােখেয়ি করার চেয়ে হিন্দু-মুসলমান পৃথক হয়ে যাওয়াই যে ভালাে, সে-কথাই বলেছিলেন সুফী জুলফিকার হায়দার নামক এক কবি–
বহুদিন ধরে হিন্দু ও মুসলমান এ দুই মহাজাতে
একে অন্যের প্রতি দিনের পর দিন, বহু নির্মম আঘাতে আঘাতে
ভেঙেই গেছে যখন হৃদয়ে হৃদ্যতার মন্দির মসজিদ
তবে কেন আর মিথ্যা ছলনা অথবা কাস্তেয় শান দেয়া।
এভাবেই, চল্লিশের দশকেই, দ্বিজাতিতত্ত্ব পৌছে গেলাে চূড়ান্ত পরিণতিতে।
তাই বলে এমন মনে করারও কোনাে কারণ নেই যে, দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণাটি চল্লিশের দশকে জন্ম নিয়ে সে দশকেই গায়ে গতরে বেড়ে ওঠে এবং হঠাৎ করে প্রলয়কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলে। হ্যা, দ্বিজাতিতত্ত্বের চূড়ান্ত পরিণতি চল্লিশের দশকেই ঘটেছিলাে বটে, কিন্তু ধারণা রূপে এর বয়স নিতান্ত কম নয়। উনিশ শতকেই এর জন্ম হয়েছে, আর এর জন্মদাতা স্যার সৈয়দ আহমদ—দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে এমন কথাও তাে বলেছেন অনেকে।
তবে যে যাই বলুন, দ্বিজাতিতত্ত্বই হােক আর একজাতিতত্ত্বই হােক, জাতি’ বস্তুটার জন্ম এদেশে হয়ইনি। জাতি’ বলতে আমি ইংরেজি ‘নেশন’-এর কথা বলছি। ‘নেশন’-এর তর্জমা আমরা জাতি’ শব্দটি দিয়ে করেছি বটে, কিন্তু এ-কথাও না মেনে উপায় নেই যে, জাতি আর নেশন মােটেই এক নয়। আমাদের কাছে জাতি মানে ছিলাে জাত । আর এই ‘জাত’ হতে পারে কাস্ট’-এর প্রতিশব্দ। যখন ‘নেশন’-এর তর্জমা ‘জাতি’ দিয়ে করলাম, তখনাে আমাদের মগজের কোষে কোষে কাজ করেছে কাস্ট’-এরই ধারণা। কারণ ‘নেশন তাে আমাদের দেশে কোনােদিনই ছিলাে না। এর জন্ম ষােড়শ শতকের ইউরােপে। আমাদের দেশে নেশন কিংবা নেশনের ধারণা গড়ে ওঠার মতাে কোনাে পরিবেশ ষােড়শ শতকে তাে ছিলােই না, এমনকি উনিশ শতকেও তেমন পরিবেশ পুরােপুরি সৃষ্টি হতে পারেনি। রােমান চার্চ-বিরােধী ধর্মসংস্কার আন্দোলন আর ধনতন্ত্রের উদ্ভবের সঙ্গে নেশনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ষােড়শ শতক থেকে শুরু করে উনিশ শতক পর্যন্ত বিস্তৃত সময়ের ভেতর ইউরােপে নেশন ও নেশন স্টেটগুলাে গড়ে ওঠে। ব্রিটিশরা আমাদের দেশে অনেক কিছুর মতাে এই নেশনের ধারণাটিও নিয়ে এলাে, কিন্তু এদেশে সত্যিকার নেশন গড়তে দিলাে না। অনেক জাতপাত, কাস্ট, ট্রাইব, কম্যুনিটি আর রেসের এই উপমহাদেশে নেশনের জন্ম হওয়া তাে এমনিতেই শক্ত, তার ওপর বিদেশি শাসকরা এ-সবের ভেদ-বিভেদকে আরাে দুস্তর ও দুরতিক্রম্য করে তােলে। এরই নাম “ভেদনীতি’ বা ‘ভাগ করে শাসন করা’র নীতি। শাসকশ্রেণী প্রতি দেশে প্রতি যুগেই এ নীতির প্রয়ােগ করেছে। প্রাচীন রােমের শাসকরা করেছে, প্রাচীন ভারতের শাসকরা করেছে, এ যুগের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরাও করেছে। ব্রিটিশদের ভেদনীতিই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভ্রুণটিকে লালন করেছে। এবং এদেশে প্রকৃত নেশন গড়ে ওঠার পথে কাঁটা বিছিয়ে রেখেছে।
১৭১
মুসলিম লীগ কিন্তু কোনােদিনই এ-কথাটি স্বীকার করেনি। হেকিম ভাইও, পঞ্চাশের দশকের শেষেও, ব্রিটিশের ভেদনীতির ফলেই দ্বিজাতিতত্ত্বের জন্ম হয়েছে বলে স্বীকার করতেন। । অথচ সে-সময়ে তিনি মুসলিম লীগের রাজনীতিকে পুরােপুরি পরিত্যাগ করেছেন।
এ নিয়ে হেকিম ভাইয়ের সঙ্গে আমি অনেক তর্ক করেছি, কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভবের পেছনে কার্যকর ছিলাে ব্রিটিশের যে ভেদনীতি তার সুস্পষ্ট দলিলী প্রমাণ হাজির করতে পারিনি। এ-রকম দলিলী প্রমাণসমৃদ্ধ বই-পুস্তকের সন্ধান পেয়েছি অনেক পরে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে। রােমিলা থাপার, বিপান চন্দ্র, হরবংশ মুখিয়া, শৈলেশ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এবং এ-রকম আরাে কিছু প্রগতিচেতন ইতিহাসবিদের নানা লেখায় ব্রিটিশের ভেদনীতির স্বরূপটি খুবই স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠতে দেখেছি।
আঠারােশাে সাতান্নর সিপাহী বিদ্রোহে (যা পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম’রূপে চিহ্নিত) মুসলমানদের একটি বড়াে ভূমিকা ছিলাে বলে ওদের আচ্ছা করে শিক্ষা দেবার জন্যে ইংরেজদের কেউ কেউ দিল্লীর জুম্মা মসজিদকে ধূলিসাৎ করে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিলাে। কিন্তু লর্ড ক্যানিং এ পরিকল্পনার বিরােধিতা করে কর্তৃপক্ষকে লিখেছিলেন, ‘আমরা যদি মুসলমানদের মসজিদ ও ব্রাহ্মণদের মন্দির ভেঙে ফেলি বা কলুষিত করি তাহলে ঠিক সেই কাজ করা হবে যাতে পরস্পরবিরােধী উভয় সম্প্রদায় আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পড়ে… … আমাদের যেহেতু মুষ্টিমেয় (অপেক্ষাকৃত অল্পসংখ্যক) ইংরেজদের দ্বারা পনেরাে কোটি মানুষের ওপর শাসন চালাতে হবে তাই আমরা এমনভাবে সেই শাসনকার্য চালাবাে যাতে তারা পৃথক (ধর্ম ও জাতীয় ধ্যানধারণার ক্ষেত্রে পূর্ব থেকেই তারা এভাবে পৃথক) থেকে যায় এবং আমাদের ক্ষমতা সম্বন্ধে তাদের মনে যেনাে সর্বোচ্চ ভীতিমিশ্রিত সন্ত্রমভাব জাগ্রত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অভিসন্ধি সম্পর্কে তারা যেনাে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে না পারে।’
এরও আগে, আঠারােশাে বিয়াল্লিশ সালেই, লর্ড এলেনবরাে বলেছিলেন, মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের কাজে লাগাতে হবে। আর আঠারােশাে আটান্ন সালে লর্ড এলফিনস্টোন এদেশে ভাগ করে শাসন করার প্রাচীন রােমান নীতি গ্রহণ করার জন্যে স্পষ্ট সুপারিশ করেছিলেন। সে-সময়কার ভারত সচিব চার্লস উড বড়লাটকে লিখেছিলেন, “ভারতের ‘জাতিগুলি’র অন্তর্দ্বন্দ্বই ভারতের ব্রিটিশদের শক্তি জোগাবে। তাই এক বিভেদকারী শক্তিকে জিইয়ে রাখতে হবে, কারণ সমগ্র ভারত আমাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলে আর কতােদিন আমরা টিকে থাকতে পারবাে?’ আরাে পরে, আঠারােশাে সাতাশি সালে, আরেক ভারত সচিব লর্ড ক্রসও সে সময়কার বড়লাটকে বলেছিলেন যে, এই ধর্মীয় মনােভাবের বিভাগ আমাদের পক্ষে খুবই সুবিধাজনক।
এই সুবিধাজনক অবস্থাটিকে ব্রিটিশ শাসকরা আগাগােড়াই কাজে লাগিয়েছে। তারা মুসলমানদের আলাদা রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ জুগিয়েছে, পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তন করে হিন্দু-মুসলমানের রাজনীতিকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দিয়েছে, উনিশোে চল্লিশের পরে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহকে গান্ধীজীর বিপরীতে মুসলিম মহাত্মা’রূপে দাঁড় করাতে চেয়েছে। ব্রিটিশ প্রধামন্ত্রী চার্চিল যে জিন্নাহর সঙ্গে গােপন যােগাযােগ করে তাকে নানা পরামর্শ দিয়ে পাকিস্তান আন্দোলনকে চাঙ্গা করে রেখেছেন, সে-সব তথ্য তাে এখন আর গােপন নেই।
১৭২
হিন্দু-মুসলমানের বিরােধকে চার্চিল ভারতের ব্রিটিশ শাসনের স্তম্ভ’ বলে মনে করতেন। সেই স্তম্ভটি যাতে ভেঙে না পড়ে সে-সম্পর্কেই সচেতন ও সতর্ক করে দিয়ে তিনি বড়লাট লিনলিথগােকে উনিশোে সাঁইত্রিশ সালের সেরা অক্টোবরে লিখেছিলেন, আমার দৃষ্টিতে ভারত ইউরােপের মতােই বিভাগ ও বৈপরীত্যে ভরা। ব্রিটিশের কাজ হলাে এই বিপুল জনতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা এবং দুইভাবে আমাদের সুবিধা ও তাদের মােক্ষলাভের জন্যে আমাদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা।…এই চিন্তাধারা অনুসরণ করে আমি বরং দেখতে চাইবাে উত্তরের মুসলিমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছে যাতে কংগ্রেসের ব্রিটিশ-বিরােধী প্রবণতাকে ঠেকানাে যায় ।…যে ঐক্যবদ্ধ ভারত আমাদের দরােজা দেখিয়ে দেবে, তার সম্ভাবনা আমাকে মােটেই আকর্ষণ করে না। আমরা হয়তাে তাকে আটকাতে পারবাে না; কিন্তু তা বলে আমরা তাকে বাস্তবায়িত করতে সর্বশক্তি নিয়ােগ করবাে–এটা আমার পক্ষে চরম পীড়াদায়ক। অবশ্যই আমার আদর্শ সংকীর্ণ ও সীমাবদ্ধ। আমি দেখতে চাই যে, বিট্রিশ সাম্রাজ্য আরাে কয়েক প্রজন্মের জন্যে তার শক্তি ও জৌলুস নিয়ে বেঁচে থাকবে। ব্রিটিশ প্রতিভার সর্বোত্তম প্রয়ােগের মাধ্যমে কেবল এই লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে।’
ব্রিটিশরা তাদের প্রতিভার সর্বোত্তম প্রয়ােগ ঘটিয়েই যে এদেশে সত্যিকার ‘নেশন’ গড়ে উঠতে দেয়নি, তাদের ভেদনীতিই যে হিন্দু ও মুসলমান কম্যুনিটি দুটোকে মেকি নেশনের রূপ দিয়ে দ্বিজাতিতত্ত্বের মতাে একটি ভুয়া তত্ত্বের সৃষ্টি করেছে এবং এই তথাকথিত একটি জাতির নাম করে যে পাকিস্তান নামক একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে—এ বিষয়ে সন্দেহ পােষণ করার কোনাে সুযােগই নেই। কিন্তু ব্রিটিশের ভেদনীতিকে সর্বশক্তিমান মনে করা কিংবা যতাে দোষ নন্দঘােষের মতাে হিন্দু-মুসলমানের বিবাদ-বিসংবাদের সব দায় ব্রিটিশের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে নিজেদেরকে ধােয়া তুলসী পাতা প্রমাণের চেষ্টা করা—চূড়ান্ত আহাম্মকি ছাড়া আর কিছুই নয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ আমাদের এই আহাম্মকিকেই ধিক্কার দিয়েছিলেন তার ব্যাধি ও প্রতিকার’ প্রবন্ধটিতে। উনিশোে সাত সালে প্রবাসী পত্রিকায় এই প্রবন্ধটি যখন তিনি প্রথম প্রকাশ করেন, তখনাে তত্ত্বরূপে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রসার ঘটেনি। অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমান দুটি সম্পূর্ণ আলাদা জাতি এমন কথা কেউ বলেনি। উত্তর ভারতে স্যার সৈয়দ আহমদের বক্তব্যে দ্বিজাতিতত্ত্বের জ্বণের সন্ধান পাওয়া গেলেও এটি তখনাে সুস্পষ্ট অবয়ব লাভ করেনি। অথচ তখনই ক্রান্তদর্শী কবি হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কের আসল রূপটি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখে ফেলেছিলেন। প্রবন্ধটিতে তিনি লিখেছিলেন—
“আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে, ইংরেজ মুসলমানদিগকে গােপনে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে। কথাটা যদি সত্যই হয় তবে ইংরেজের বিরুদ্ধে রাগ করিব কেন। দেশের মধ্যে যতগুলি সুযােগ আছে ইংরেজ তাহা নিজের দিকে টানিবে না, ইংরেজকে আমরা এতবড় নির্বোধ বলিয়া নিশ্চিত হইয়া থাকিব এমন কী কারণ ঘটিয়াছে।
“মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানাে যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়, কে লাগাইল সেটা গুরুতর বিষয় নয়। শনি তাে ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করিতে পারে না; অতএব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্বন্ধেই সাবধান হইতে হইবে। আমাদের মধ্যে যেখানে পাপ আছে শত্রু সেখানে জোর করিবেই—আজ যদি না করে তাে কাল করিবে, এক শত্রু যদি না করে তাে অন্য শক্র করিবে—অতএব শক্রকে দোষ না দিয়া পাপকেই ধিক্কার দিতে হইবে।
১৭৩
“হিন্দু-মুসলমানের সম্বন্ধ লইয়া আমাদের দেশে একটা পাপ আছে; এ-পাপ অনেকদিন হইতে চলিয়া আসিতেছে। ইহার যা ফল তাহা ভােগ না করিয়া আমাদের কোনাে মতেই নিষ্কৃতি নাই।…
“… আর মিথ্যা কথা বলিবার কোনাে প্রয়ােজন নাই। এবার আমাদিগকে স্বীকার করিতেই হইবে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানে একটা বিরােধ আছে। আমরা যে কেবল স্বত তাহা নয়। আমরা বিরুদ্ধ।
“আমরা বহুশত বৎসর পাশে পাশে থাকিয়া এক খেতের ফল, এক নদীর জল, এক সূর্যের আলােক ভােগ করিয়া আসিয়াছি; আমরা এক ভাষায় কথা কই, আমরা একই সুখ দুঃখে মানুষ; তবু প্রতিবেশীর সঙ্গে প্রতিবেশীর যে সম্বন্ধ মনুষ্যোচিত, যাহা ধর্মবিহিত, তাহা আমাদের মধ্যে হয় নাই। আমাদের মধ্যে সুদীর্ঘকাল ধরিয়া এমন একটি পাপ আমরা পােষণ করিয়াছি যে, একত্রে মিলিয়াও আমরা বিচ্ছেদকে ঠেকাইতে পারি নাই। এ পাপকে ঈশ্বর কোনােমতেই ক্ষমা করিতে পারেন না।”

ইতিহাসের ভ্রান্তিবিলাস, নব্যহিন্দুত্ব ও দ্বিজাতিতত্ত্ব
হেকিম ভাই কিংবা আমি কেউই একষট্টি সালের আগে রবীন্দ্রনাথের হিন্দু-মুসলমান নিয়ে লেখাগুলাের সম্পর্কে সচেতন ছিলাম না। একষট্টিতে রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উদযাপন নিয়ে যখন বিতর্ক শুরু হলাে, তখনই অনেকে তাদের লেখায় রবীন্দ্রসৃষ্টির ওদিকটির পরিচয় তুলে ধরতে লাগলেন। আমরাও রবীন্দ্র রচনাবলী খুলে পড়তে লাগলাম—ব্যাধি ও প্রতিকার’, ‘দেশহিত, ‘হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের ‘কালান্তর’-এর প্রবন্ধগুলাে পড়ে একেবারে চমকৃত হয়ে গেলাম। উপলব্ধি করলাম : পাকিস্তানের জন্মের অনেক আগেই পাকিস্তানের জন্মরহস্য যার চেতনার আলােকে স্ফটিকস্বচ্ছ হয়ে উঠেছিলাে তিনি কবিসার্বভৌম রবীন্দ্রনাথ। তার কোনাে কোনাে লেখা পড়ে তাে মনে হয় যে, তিনিই যেনাে মুসলমান সমাজের দরদী মুখপাত্র, মুসলমানদের পক্ষ নিয়ে তিনি হিন্দু সমাজকে ধিক্কার জানাচ্ছেন, নিপীড়িত মুসলমানদের মূক মুখে ভাষা জুগিয়ে দিচ্ছেন। অথচ সেই রবীন্দ্রনাথকেই কিনা মৌলানা আকরম খার ‘আজাদ পত্রিকা ও পাকিস্তানপন্থী মুসলমানদের একটি দল মুসলমানবিরােধী বলে অভিযুক্ত করছে, রবীন্দ্র শতবার্ষিকী উৎসবের আয়ােজনকারীদের পাকিস্তানের দুশমন বলে চিহ্নিত করেছে।
হেকিম ভাই তার কৈশােরের কথা স্মরণ করে বলতেন, গায়ের ছেলে হিসেবে সে সময়ে রবীন্দ্রনাথ পড়ার খুব বেশি সুযােগ আমরা পাইনি। রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর গল্পের সঙ্গে মােটামুটি পরিচয় থাকলেও তার প্রবন্ধ পড়েছি খুব কম। তবে আমাদের ছেলেবেলায় বসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এর ‘বঙ্কিমচন্দ্রের গ্রন্থাবলী ছিলাে সহজলভ্য। আশুজিয়া ইস্কুলে আমার সহপাঠি ব্রাহ্মণ ছেলেরা বঙ্কিমচন্দ্রের বই থেকেই মুসলমানদের নানা কুৎসা আর নিন্দার কথা সংগ্রহ করতাে আর সে-সবের উল্লেখ করেই আমাদের খোচাতাে। বঙ্কিমচন্দ্রের বই পড়ে আমিও তার মুসলমান-বিদ্বেষের পরিচয় পেয়ে বঙ্কিম-বিদ্বেষী না হয়ে পারিনি। শুধু বঙ্কিম নয়। সে-সময়ে আশুজিয়ার ছেলেরা যতাে ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়তাে সেগুলাে সবই ছিলাে মুসলমান-বিদ্বেষে ঠাসা। এ-সব বই আমাকে খুবই উত্তেজিত করে তুলেছিলাে।
১৭৪
খুবই স্বাভাবিক। খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমের মতাে একজন সংবেদনশীল মুসলমান কিশাের মুসলমান-বিদ্বেষে ভরা বই পড়ে অনুত্তেজিত থাকেন কী করে? তাছাড়া সে-সময়ে বঙ্কিমচন্দ্রের দাঁতভাঙা জবাব’ বলে বিজ্ঞাপিত মুসলমানের লেখা অনেক বইও বাজারে চালু হয়ে গিয়েছিলাে। স্বভাবতই সেগুলাে ছিলাে উগ্র হিন্দু বিদ্বেষের আধার। হেকিম ভাইদের মনমানস গঠনে সে সব বইয়ের অবদানও কম ছিলাে না।
আমি নিজে ছেলেবেলা থেকেই বঙ্কিম-অনুরাগী। পরিণত বয়সে সে অনুরাগ বেড়েছে বৈ কমেনি। কিন্তু বঙ্কিমের মতাে অমিত প্রতিভাধর মনীষীও যে তাঁর সৃষ্টিতে এমন কিছু উপাদান রেখে গিয়েছেন যা পরবর্তীকালে দ্বিজাতিতত্ত্বের মতাে একটি জঘন্য পিশাচকে শক্তি জুগিয়েছে—সে কথাও তাে অস্বীকার করতে পারি না।
শুধু বঙ্কিম কেন, উনিশ শতকের আরাে অনেক প্রতিভাধরও জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজতলা তৈরিতে নানাভাবে সহায়তা করে গেছেন। সত্যি কথা বলতে কি, উনিশ শতকের শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তরা যে জাতিতত্ত্ব নির্মাণ করেছিলেন তারই একেবারে ভেতর থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছিলাে মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ব। তখনকার হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা জাতি’ শব্দটি প্রয়ােগ করেছেন খুবই শিথিলভাবে। অর্থাৎ এ-শব্দটির কোনাে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট অর্থ তাদের কাছে ছিলাে না। জাতি’ বলতে তারা কখনাে বুঝিয়েছেন কাস্ট’, কখনাে, ‘রেস’, কখনাে বা ক্যুনিটি’। আবার ইংরেজি ‘নেশন’ অর্থে তারা জাতি’ শব্দটির ব্যবহার যখন করেছেন তখনাে সেই জাতির সংজ্ঞার্থ সম্পর্কে কোনাে স্পষ্ট ধারণা না নিয়েই তা করেছেন। এবং জাতি’ অর্থেই হিন্দু শব্দটির নির্বিচার প্রয়ােগ ঘটিয়েছেন। হিন্দুর আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই—আরাে স্পষ্ট করে বললে, উঠতি হিন্দু মধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই—বলেছেন জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা। ‘হিন্দুমেলা’ই তাদের কাছে হয়েছে জাতীয় মেলা। আর এভাবেই তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের বীজটি রােপণ করে ফেলেছেন, হিন্দু জাতির বিপরীতে মুসলমান জাতির ধারণার গােড়াপত্তন করে দিয়েছেন। এ কাজে রাজনারায়ণ বসু বা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বা নবগােপাল মিত্রের মতাে মনীষীদেরও অনেকেই কিছু না কিছু অবদান রেখেছেন।
ইংরেজরা এদেশে যে-ধরনের ইতিহাস বই চালু করেছিলাে তা থেকে প্রকৃত ইতিহাস চেতনা জন্মাতাে না, বিকৃত ইতিহাসবােধেই বরং পাঠকের মনমেজাজ আচ্ছন্ন হয়ে যেতাে। সে ইতিহাসে সত্য বিকৃতি যেমন ছিলাে, তেমনি ছিলাে সত্য গােপনের ধূর্ত প্রয়াসও। ভারতবর্ষের মধ্যযুগের ইতিহাসকে তারা চিহ্নিত করেছে মুসলিম যুগ’ নামে। আর তাদের ইতিহাস বইয়ে এই মুসলিম যুগ হয়ে উঠেছে কুশাসন, স্বৈরশাসন, সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন ও ধর্মান্ধতার যুগ। মুসলিম যুগে মুসলমানরা হিন্দুদের কারণে-অকারণে হত্যা করেছে, হিন্দু মেয়েদের বলাকার করেছে, হিন্দুদের মন্দির ধ্বংস করেছে, জোর করে তাদের মুসলমান বানিয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ হেন অপকর্ম নেই যা মুসলমানরা করেনি! কিন্তু এই মুসলমানরা কারা? সব মুসলমানই কি সব হিন্দুর ওপর অত্যাচার-উৎপীড়ন করেছে, আর সব হিন্দুই কি সে-সব সুবােধ বালকের মতাে মুখ বুজে সয়ে গেছে? মােগলদের সঙ্গে রাজপুত বা মারাঠাদের যে যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে সে কি মুসলমানের সঙ্গে হিন্দুর যুদ্ধ, না রাজা-রাজড়াদের বিভিন্ন গােষ্ঠীর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বন্দ্ব? সব রাজপুতই কি সব মােগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে? প্রতাপ সিংহের মতাে মােগল বিরােধী রাজপুত যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন না কি মানসিংহ বা যশােবন্ত সিংহের মতাে মােগল-অনুগত রাজপুত সেনাপতিও? মারাঠা শিবাজী হিন্দু হলেও তার দলে কি ছিলেন
১৭৫
অনেক দুর্ধর্ষ মুসলমান সেনানায়কও? গোঁড়া সুন্নি মুসলমান সম্রাট আওরঙ্গজেব কি শুধু। কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরই ধ্বংস করেছিলেন? তিনি কি গােলকুণ্ডার জামে মসজিদকেও ভেঙে গুঁড়িয়ে দেননি? যতােই গোঁড়া ধার্মিক ও সাম্প্রদায়িক হােন সম্রাট আওরঙ্গজেব, তার মন্দিরমসজিদ ভাঙার পেছনে ধর্মচেতনার বদলে সাম্রাজ্যিক তথা বৈষয়িক চেতনাই কি কার্যকর ছিলাে না? গোঁড়া মুসলমান বাদশাহ আওরঙ্গজেবই যে এলাহাবাদের সােমেশ্বরনাথ মহাদেব, কাশীর জঙ্গমবাড়ি শিব, উজ্জয়িনীর মহাকালেশ্বর, চিত্রকুটের বালাজী, গৌহাটির উমানন্দ কিংবা মহারাষ্ট্রের দত্তাত্রেয় গুরুমন্দিরের মতাে বহু হিন্দু মন্দিরের জন্যে জায়গির দিয়েছিলেন—সে কথা কি মিথ্যা?
এ-সব প্রশ্নের উত্তর সন্ধান কিংবা প্রকৃত সত্য উদ্ধারের চেষ্টা করেননি ইতিহাসের পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা ইংরেজ গ্রন্থকাররা। কারণ, নিরপেক্ষ ইতিহাস রচনা তাদের উদ্দেশ্য ছিলাে না। তাদের উদ্দেশ্য ছিলাে : ভারতের মুসলিম শাসনকে কালাে রঙে চিত্রিত করে হিন্দুদেরকে মুসলিম-বিদ্বেষী করে তােলা। কারণ, তারা ধারণা করেছিলেন : হিন্দুদের মনে মুসলিম বিদ্বেষ শিকড় গেড়ে বসলেই ইংরেজ রাজত্বের প্রতি তাদের আনুগত্য বেড়ে যাবে, ব্রিটিশ শাসনের ন্যায্যতা প্রমাণিত হবে।
এরা যে বিকৃত ও অসত্য ইতিহাস রচনা করেছিলেন তার পেছনকার তিনটি মতলব চিহ্নিত করেছেন প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ বিপানচন্দ্র। সেগুলাে হচ্ছে :
‘প্রথমত, তারা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, ভারতীয় জনগণকে চিরকাল নিষ্ঠুর প্রজাপীড়নকারী শাসনকর্তা ও অনিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচারীরা শাসন করেছে। সুতরাং ব্রিটিশ শাসন যদি স্বৈরতান্ত্রিক বা স্বেচ্ছাচারী হয় তাতে অন্যায় কিছু নেই। বরং তা প্রজাহিতৈষী ন্যায়পরায়ণ এবং আইনের শাসনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তদুপরি মুসলিমরাও ব্রিটিশদের মতােই বিদেশি ছিলাে! সুতরাং ব্রিটিশরা ভারতে বিদেশি শাসনের সূচনা করেনি বরং একটি বর্বর ও অমানুষিক বিদেশি শাসনের পরিবর্তে একটি মানবিক ও সুসভ্য বিদেশি শাসন এনেছে।
দ্বিতীয়ত, তারা দেখাতে চেয়েছিলেন যে, হিন্দুরা অত্যন্ত নৃশংস ও ভয়াবহভাবে মুসলমানদের দ্বারা শােষিত পদদলিত ও অত্যাচারিত হয়েছিলাে। ইংরেজরা কার্যত তাদের ‘মুক্ত করেছিলাে। যেহেতু হিন্দুরা ব্রিটিশ শাসনে অনেক সুখে আছে, তাই তাদের ব্রিটিশদের প্রতি কৃতজ্ঞ বােধ করা উচিত এবং ব্রিটিশদের পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা উচিত।
তৃতীয়ত, তারা দৃঢ়ভাবে দাবি করতে চেয়েছিলেন যে, হিন্দু ও মুসলমানরা চিরকাল বিভক্ত ছিলাে এবং পরস্পরের রক্তের জন্যে উন্মুখ ছিলাে। তাই একটি তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ ব্রিটিশ পক্ষ থাকলে তারা পরস্পর শান্তিতে বাস করতে পারতাে না।’
ভাগ করে শাসন করার সনাতনী নীতি কার্যকর করার লক্ষেই যে ইংরেজরা ভারত ইতিহাসের পাঠ্য বই রচনা করেছে—এ-কথা ঠিক। কিন্তু এখানেও তাে রবীন্দ্রনাথের কথাই স্মরণ করে বলতে হয় যে, এর জন্যে আমরা ইংরেজের বিরুদ্ধে রাগ করিব কেন?’ ইংরেজ যে আমাদের ইতিহাস বিকৃত করতে পেরেছে, সেই বিকৃত ইতিহাস আমাদেরকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে এবং সেই বিশ্বাসের তালে তালে আমাদের সকলকে নাচাতে পেরেছে—এ সবের জন্যে তাে ইংরেজকে বুদ্ধিমান জাত বলে বাহবা দিতে হয়। আর ধিক্কার জানাতে হয় আমাদের নিজেদের নির্বুদ্ধিতাকে। সেই নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন আমাদের দিকপাল লেখকসাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে ধুরন্ধর রাজনীতিক পর্যন্ত অনেকেই।
১৭৬
ইংরেজের পাঠশালায় ইংরেজি বিদ্যার পাঠ গ্রহণের সুযােগ যারা প্রথম পেয়েছিলেন তারা ছিলেন একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ। ধর্মীয় বিচারে সে সম্প্রদায়টির নাম ‘ হিন্দু’। হিন্দুদেরই একটি ক্ষুদ্র অংশ (যারা মূলত বর্ণহিন্দু ও ভদ্রলােক’ বলে পরিচিত) অর্থেবিত্তে প্রতিপত্তিশালী হয়ে উঠে ইংরেজের আনা বিদ্যারও অধিকারী হয়েছিলেন। রাজধানী কলকাতা থেকে শুরু করে মফস্বলের নানা পৌরকেন্দ্র ও বর্ধিষ্ণু গ্রাম পর্যন্ত ঘটেছিলাে তাদের বিস্তার। আমাদের নেত্রকোনা এলাকার আশুজিয়া, নওপাড়া, বাড়রি, কাটিহালির মতাে গ্রামগুলােতেও এদেরই ছিলাে রাজত্ব। হঁ্যা, রাজত্ব’ শব্দটাই ব্যবহার করতে হয়। রায়ত-প্রজার মালিকানা মানে তাে রাজত্বই। প্রজারা রাজা বলতে মধ্যস্বত্বভােগী ছােট বড়াে জমিদার-তালুকদারদেরই বুঝতাে। এই রাজারা আর তাদের ছেলেপুলেরা বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র দত্ত, হরিসাধন মুখােপাধ্যায় এবং আরাে অনেক খ্যাত-অখ্যাত লেখকের ঐতিহাসিক উপন্যাস পড়ে হিন্দুগৌরবের উত্তাপে নিজেদের উত্তপ্ত করে নিতাে। সে সঙ্গে করতাে মুসলিম বিদ্বেষের বিষােদগার। ইংরেজদের লেখা ইতিহাসের পাঠ্য বইগুলাে ছিলাে ইতিহাসের তথ্য বা তথ্যবিকৃতির কঙ্কাল মাত্র। হিন্দু ঔপন্যাসিক ও কাহিনীকাররা সেই কঙ্কালের ওপর এমনভাবে মেদ-মাংস-মজ্জা আর লাবণ্যের সঞ্চার ঘটালেন যে, তা হয়ে উঠলাে একান্তভাবে মােহময়ী ও মনমােহিনী। এই মােহময়ী মনমােহিনী কাহিনীগুলােই হিন্দু সম্প্রদায়ের ভেতর ইতিহাসের এক মারাত্মক ভ্রান্তিবিলাস ছড়িয়ে দিলাে, আসল ইতিহাস-চেতনা গেলাে যােজন যােজন দূরে। এই ভ্রান্তিবিলাস থেকেই জন্ম নিলাে এক নব্যহিন্দুত্ব। নব্যহিন্দু ইংরেজ তাড়িয়ে দেশকে স্বাধীন করতে চাইলাে অবশ্যই, কিন্তু হিন্দু ছাড়া দেশের আর কারাে কথা ভাববার অবকাশ তার হলাে না। তার কাছে হিন্দুই হয়ে উঠলাে দেশ, হিন্দুই জাতি। দেশকে মা বলে বন্দনা করে অবশ্যই সে একটি মহৎ কাজ করলাে, কিন্তু সেই মাকেও সে তৈরি করে নিলাে হিন্দু দেবী দুর্গার আদলে। ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী…’। দুর্গা বা কালীর নাম করে—এবং গীতা স্পর্শ করে—সে ইংরেজ তাড়ানাের শপথ নিলাে। একবারও ভাবলাে না যে, যারা দুর্গা-কালী বা গীতায় বিশ্বাস করে না, দেশটা তাদেরও।
কিন্তু চিরদিন তাে আর এক রকম যায় না। যে ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষের দুর্গা-কালী বা গীতার ওপর বিশ্বাস নেই, সেই মুসলমানদের মধ্যে থেকেও একটি গােষ্ঠী বিত্তের অধিকারী তথা মধ্যবিত্ত হয়ে উঠে এলাে। তারাও লেখাপড়া শিখলাে।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী বা রাজসিংহ আর রমেশচন্দ্রের ‘রাজপুত জীবনসন্ধ্যা বা ‘মহারাষ্ট্র জীবন প্রভাত’ তারাও পড়লাে। এ সব পড়ে তারা নিশ্চয়ই হিন্দুর মতাে খুশিতে বাগবাগ হয়ে উঠতে পারলাে না। বরং হলাে এর উল্টোটা। হিন্দু বিদ্বেষের উপাদান তারা এ সব থেকেই সংগ্রহ করলাে। তাদের নিজেদের লেখকদের হাতেও তৈরি হলাে চাঁদতারা বা হাসন-গঙ্গা-বাহমনি কিংবা রায়নন্দিনীর মতাে উপন্যাস। এ-সব উপন্যাসের শিল্পগুণ কতােখানি তা নিয়ে মাথা ঘামানাের কোনাে প্রয়ােজন মুসলমান পাঠকেরা বােধ করলাে না। কারণ, সে সময়ে বাঁশির চেয়ে বাঁশের প্রয়ােজনই তাদের বেশি ছিলাে। নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন বা ইসমাইল হােসেন সিরাজীর উপন্যাসকে তারা বাঁশের মতােই হাতে তুলে নিলাে। এবং তারাও হিন্দুদের মতােই ইতিহাসের আরেক ভ্রান্তিবিলাসের পাঁকে মজে গেলাে। সে ভ্রান্তিবিলাস সৃষ্টিতেও শাসক ইংরেজরা কম সাহায্য করলাে না। আঠারােশাে সত্তর সালে ইংরেজ সিভিলিয়ান হান্টার সাহেব ভারতীয় মুসলমানদের এক আধা কাল্পনিক ইতিহাস তৈরি
১৭৭
করে তাদের জন্যে নানা ধরনের অসত্য ও অর্ধসত্য গর্বের জোগান দিলেন। দেড় শো বছর আগে কোনাে মুসলমানের পক্ষে গরিব হওয়া ছিলাে অসম্ভব’—এ রকম কথা বলে হান্টার সাহেব হতদরিদ্র মুসলমানদেরও এক কল্পিত মুসলিম গৌরবের যুগের বাসিন্দা বানিয়ে ফেললেন। সেই কল্পিত যুগটিকে ফিরিয়ে আনাই নবগঠিত মুসলিম মধ্যবিত্তের ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠলাে। মুসলিম গৌরব ফিরিয়ে আনার পথের বাধা তাে হিন্দুরাই। হিন্দুর গৌরবে মুসলমানের গৌরব করার কিছু নেই। হিন্দু যেমন এক সময় নেশন অর্থেই ‘হিন্দু’ শব্দটির প্রয়ােগ করেছিলাে, মুসলমানও যদি এখন মুসলমানকেই নেশন বলে সাব্যস্ত করে তবে তাকে দোষী বলতে পারবে কে?
হিন্দুরা যখন মারাঠা শিবাজীকে নিয়ে আদিখ্যেতা শুরু করলাে, তখনই মুসলমানদের কাছে মােগল আরওরঙ্গজেব অনেক বড়াে হয়ে উঠলাে। শিবাজীকে আদর্শ বানিয়ে যে জাতীয়তাবাদ হিন্দু মধ্যবিত্ত প্রচার করে মুসলমান একান্ত স্বাভাবিকভাবেই সে জাতীয়তাবাদের শরিক হতে পারে না। তাই আস্তে আস্তে হিন্দু মুসলমানের চলার পথ আর এক থাকে না। ‘নেশন’-এর অর্থবিভ্রাট ঘটে, প্রকৃত নেশন আর সৃষ্টি হয় না।
ভারতের জাতীয় কংগ্রেস নামক রাজনৈতিক দলটি অবিশ্যি ক্লান্তিহীনভাবে দেশের মানুষের একজাতিত্বের কথা বলে গেছে। হিন্দু আর মুসলমান কোনােমতেই আলাদা জাতি নয়, ব্রিটিশই তার ভেদনীতির প্রয়ােগ করে দুটি সম্প্রদায়ের ভেতর বিবাদ-বিসংবাদের সৃষ্টি করেছে, সকলে মিলে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটাতে পারলেই এই সাম্প্রদায়িক বিরােধেরও অবসান ঘটে যাবে—এমন কথা কংগ্রেস তার জন্মলগ্ন থেকেই প্রচার করে এসেছে। কথাগুলাে অর্ধসত্য। হিন্দু আর মুসলমান আলাদা জাতি না হলেও ঐতিহাসিক কারণেই যে এই দুয়ের মধ্যে রয়ে গেছে অনেক প্রভেদ ও পার্থক্য এবং এই দুয়ের অসম বিকাশের ফলেই যে এই প্রভেদ ও পার্থক্যগুলাে পরিণত হয়েছে বিবাদ ও বিভেদে—এ সত্যকে কংগ্রেস নানাভাবেই চাপা দিয়ে রাখতে চাইতাে। আর মুসলিম লীগ এই কুৎসিত সত্যটাকেই নানা মােহিনী মিথ্যার আবরণে জড়িয়ে একটি জঘন্য ও মারাত্মক অসত্য অপতত্ত্বের জন্ম দিলাে। এই অপতত্ত্বটির নামই দ্বিজাতিতত্ত্ব।

পাকিস্তানের শত্রুরাই পাকিস্তানের জন্মবীজ রােপণকারী!
উনিশোে সাতচল্লিশের ফেব্রুয়ারি-মার্চে, পাকিস্তানের জন্মের কয়েক মাস আগেই, পবিত্রদার মুখে পাকিস্তানের জন্মের বামপন্থী ব্যাখ্যা শুনেছিলাম রামপুর পােস্ট অফিসে পত্রিকা পাঠের আসরে। পবিত্রদার সব কথাই যে ঠিক ঠিক বুঝতে পেরেছিলাম, তা অবশ্যই নয়। তবে তার কথাগুলাে যে অন্যরকম, সেটা বুঝেছিলাম। সােনার মাস্টার সাহেব মুসলিম লীগের বক্তব্য উচ্চকণ্ঠে বলতেন, আর মহেন্দ্র চৌধুরী কংগ্রেসী মতবাদের ব্যাখ্যা করতেন। আসরে উপস্থিত মুসলমানরা মাস্টার সাহেবের আর হিন্দুরা চৌধুরী মহাশয়ের কথায় সায় দিতাে। পবিত্রদার মতের প্রতি সমর্থন ছিলাে না প্রায় কারুরই।
পবিত্র দাস ছিলেন খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমের সহপাঠি। দু’জনের মধ্যে হৃদ্যতাও ছিলাে যথেষ্ট। কিন্তু হেকিম ভাই আর পবিত্ৰদার মতের মিল হয়নি। কেন?
হেকিম ভাইয়ের বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন কথার ফাঁকে ফাঁকে এ-প্রশ্নের জবাব পেয়েছি।
১৭৮
কমরেড মুজফফর আহমদের মতাে মানুষ—যিনি হয়েছিলেন ভারতবর্ষের ক্যুনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি—বাঙালি মুসলমান সমাজ থেকেই উঠে এসেছিলেন। তার সহযােগীদের মধ্যেও মুসলমান ছিলেন বেশ কয়েকজন। আমাদের নেত্রকোনার জহিরউদ্দিন মুন্সী ও হান্নান মৌলবী কিংবা কিশােরগঞ্জের ওয়ালি নেওয়াজ ও জমিয়ত আলীও তিরিশের দশকের শেষ ও চল্লিশের দশকের গােড়াতেই কম্যুনিস্ট হয়েছিলেন। নেত্রকোনা-কিশােরগঞ্জের বেশ কয়েকটি গ্রামের মুসলমান কৃষকরাও কম্যুনিস্ট পার্টির জঙ্গী কর্মি হয়ে উঠেছিলেন।
কিন্তু মুসলমানদের ক্যুনিস্ট হওয়ার ওগুলাে বিচ্ছিন্ন দৃষ্টান্তই।
হেকিম ভাই বলতেন, পবিত্র মাঝে মধ্যে কলকাতা যেতাে। সেখানকার কমুনিস্ট ছাত্রদের সঙ্গে তার যােগাযােগ ছিলাে। নেত্রকোনা ও ময়মনসিংহ শহরের কম্যুনিস্ট নেতাদের কথাও সে বলতাে। তবে নেত্রকোনার হান্নান মৌলবী ছাড়া আর কোনাে ক্যুনিস্ট নেতাকে আমি দেখিনি। ক্যুনিজম সম্পর্কে লেখা কিছু কিছু চটি বই পবিত্র আমাকে পড়তে দিতাে। আমি পড়তাম বটে, কিন্তু কোনাে আকর্ষণ বােধ করতাম না। পবিত্রর কথাগুলােও আমার কাছে কেমন যেনাে ধোয়াটে লাগতাে। ওর প্রলেতারিয়েত বিপ্লবের মধ্যে আমি আমার সমস্যার কোনাে সমাধান খুঁজে পেতাম না। আশুজিয়ার তালুকদারদের ছেলেরা আমার প্রতি যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে মারতাে, মুসলমানের কোনাে কালচার নেই বলে ওরা আমাকে যে-সব ঠেস দেয়া কথা বলতাে, আমি সে-সবেরই জবাব খুঁজতাম। পবিত্র আমাকে সে-সব ব্যাপারে মােটেই সাহায্য করতে পারতাে না। আমার বাড়ির আশেপাশে আশুজিয়ার তালুকদারদের যে-সব মুসলমান রায়ত ছিলাে, আমি ভাবতাম তাদের নিয়ে। পবিত্র বলতাে, প্রলেতারিয়েত বিপ্লব ছাড়া এদের সমস্যার কোনাে সমাধান নেই। আমার কাছে তার এ কথা একান্তই অবাস্তব মনে হতাে। আসলে আমার মানসিক সমস্যা ও সংকটগুলাের প্রকৃতিই সে বুঝতে পারতাে না। পাকিস্তান কায়েম হলেই আমাদের সকল সমস্যার সমাধান হবে বলে আমি একান্তভাবে বিশ্বাস করতাম। পবিত্র পাকিস্তান সম্পর্কে একেকদিন একেক রকম কথা বলতাে। আমি তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতাম না।
হেকিম ভাইয়ের কথাগুলাের তাৎপর্য আমি অনুধাবন করতে চেষ্টা করেছি। তাতে শুধু হেকিম ভাই নয়, তখনকার বাংলার শিক্ষিত তরুণ মুসলমানের ভাবনার সাধারণ পরিচয়ই আমার কাছে উদ্ঘাটিত হয়েছে।
রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণায় পুষ্ট হয়ে যারা রাজনৈতিক দলের কর্মি বা সমর্থক হয় তারা মূলত সমাজের সচেতন অংশেরই মানুষ। সেই সচেতন অংশটি অবশ্যই মােটামুটি সচ্ছল মানুষদের নিয়ে গড়ে ওঠে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সচ্ছল মানুষরাই লেখাপড়া শেখার সুযােগ পায়। লেখাপড়া জানা মানুষই প্রথমে রাজনৈতিক ভাবনায় ভাবিত হয়। তারাই পরে অন্যদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে টেনে নিয়ে আসে। তাদের প্রেরণাতেই নিরক্ষর অসচ্ছল মানুষও তখন রাজনীতিতে যুক্ত হয়।
বাংলার মুসলমানদের মধ্যে এভাবে রাজনীতি-সচেতন হয়ে ওঠার মতাে অবস্থানে ছিলেন সচ্ছল কৃষকরা। বিশ শতকের বিশ ও তিরিশের দশকে এদের ছেলেপুলেরাই লেখাপড়া শিখে একটি শিক্ষিত মুসলমান গােষ্ঠী গড়ে তােলে, এরাই রাজনীতির আসর জাঁকিয়ে বসে। নবাব সলিমুল্লার মতাে উচ্চবিত্ত অভিজাতদের হাতে মুসলমানদের রাজনৈতিক সংগঠন মুসলিম লীগের গােড়াপত্তন হলেও এর মূল শক্তি ছিলাে সম্পন্ন মুসলমান কৃষক ও ছােট বড় জোতদাররাই। সাধারণ কৃষক-প্রজারা রাজনীতির দিকে আকৃষ্ট হয় আরাে পরে। মুসলমান
১৭৯
কৃষক প্রজারা যখন বেশি সংখ্যায় রাজনীতিতে এসে যায় তখন সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ দলের বদলে একটি নতুন শক্তি একান্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। সেই শক্তিটিরই রাজনৈতিক সংগঠনের নাম কৃষক প্রজা পার্টি। কৃষক প্রজা পার্টি মূলত মুসলমানের সংগঠন হলেও মুসলিম লীগের মতাে এটি সাম্প্রদায়িক দল ছিলাে না। আবার ক্যুনিস্ট পার্টির মতাে সর্বহারা আন্তর্জাতিকতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিপ্লবীও ছিলাে না। এ দলটি শুরুতে কংগ্রেসের সঙ্গে সদ্ভাব রক্ষা করেই চলতে চেয়েছিলাে। কিন্তু কংগ্রেস দলের হিন্দু জমিদার-মহাজন ও অভিজাত নেতারা কৃষক-প্রজার অধিকার মেনে নিতে কিছুতেই রাজি ছিলেন না। জমিদার-মহাজনদের স্বার্থের দিকে তাকিয়েই তারা কৃষি-সংস্কারের কোনাে পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে দেননি, আইনসভাতে বসেও তারা কৃষক-প্রজার বদলে জমিদার-মহাজনের স্বার্থ রক্ষা করেছেন। এভাবেই তারা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান কৃষক-প্রজাদের কংগ্রেসের প্রতি বিমুখ করে তােলেন ও তাদেরকে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার দিকে ঠেলে দেন। এ বিষয়টির ব্যাখ্যা করেই অতুলচন্দ্র গুপ্ত তার জমির মালিক’ বইয়ে লিখেছিলেন—মহাত্মার প্রথম অসহযােগ আন্দোলনে বাংলার চাষী, যাদের অধিকাংশ মুসলমান, কংগ্রেসের ডাকে প্রবল সাড়া দিয়েছিলাে, কংগ্রেসকে মনে করেছিলাে নিজের জিনিস। তেমন ঘটনা পূর্বে কখনাে ঘটেনি। এই অভূতপূর্ব অবস্থার সুযােগেও বাংলার কংগ্রেস নেতারা বাংলার রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি ও আন্দোলনকে ধর্মভেদের নাগপাশ থেকে মুক্তি দেবার কোনাে চেষ্টাই করেননি। নিজেদের শ্রেণীগত স্বার্থের চিন্তা তাদের বুদ্ধিকে অন্ধ ও কর্মকে পঙ্গু করেছিলাে। বাংলার চাষীর অনায়াসলভ্য নেতৃত্ব বাংলার কংগ্রেসের পক্ষে অসাধ্য হয়েছিলাে। ১৯২৮ সালের আইন সংশােধনের ব্যাপারে স্পষ্ট প্রমাণ হলাে বাংলার আইনসভার কংগ্রেসী সভ্যদের কাছে চাষীর স্বার্থের চেয়ে জমিদারের স্বার্থ বড়।’
তবু, উনিশোে পঁয়ত্রিশ সালের ভারত শাসন আইনের বিধানে সাইত্রিশ সালে যে নির্বাচন হলাে তাতেও অবিভক্ত বাংলায় মুসলমানদের জন্যে নির্দিষ্ট আসনে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগ দল জিততে পারলাে না, সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলাে অসাম্প্রদায়িক দল কৃষক প্রজা পার্টি। একশাে উনিশটি আসনের মধ্যে মুসলিম লীগ পেলাে মাত্র চল্লিশটি। বাংলার এই মুসলিম লীগও, তখনাে পুরােপুরি সাম্প্রদায়িক দলে পরিণত হয়নি। সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ হিন্দুমুসলমানের পৃথক নির্বাচন প্রথার সমর্থক হলেও এর বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটি ছিলাে এ-প্রথার বিরুদ্ধে। উনিশোে বত্রিশ সালের সেরা এপ্রিল নির্বাচন সম্পর্কীয় প্রস্তাবে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ বলেছিলাে, …সাম্প্রদায়িক নির্বাচন ব্যবস্থা যে উদ্দেশ্যে প্রবর্তিত হয়েছিলাে তার পরিপূর্তি করতে ব্যর্থ হয়েছে। …হিন্দু ও মুসলমান জনসাধারণ, যারা আজ সাম্প্রদায়িক নির্বাচনের কারণে পরস্পর-বিচ্ছিন্ন তারা যুক্তনির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে সমস্বার্থে একত্র না হলে জনগণের আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন অসম্ভব। পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা বাংলার জনসাধারণের জন্যে শক্তি অথবা সমৃদ্ধি—কোনাে কিছুরই ব্যবস্থা করতে পারেনি এবং সেই কারণে জনগণ আজ স্বার্থপর ব্যক্তিদের দ্বারা তাদের স্বার্থ সাধনের জন্যে শােষিত হচ্ছে।”
এর পরের বছরের চব্বিশে নভেম্বরও বাংলার মুসলিম লীগ এ-রকম প্রস্তাবই গ্রহণ করেছিলাে। তারপর পৃথক নির্বাচনের ভিত্তিতেই সাঁইত্রিশ সালে যে নির্বাচন হলাে তাতেও বাংলার মুসলমান একটি অসাম্প্রদায়িক দলকেই জিতিয়ে দিলাে। অর্থাৎ বাংলার মুসলমান কৃষকরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়েও (এবং স্বাতন্ত্র চেতনায় উদ্বুদ্ধ থেকেও) সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করেছিলাে। তখনাে, সেই সাঁইত্রিশ সালেও, মুসলমানরা জোরেশারে বলেনি যে, তারা একটি জাতি। তারা কেবল সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের
১৮০
পশ্চাৎপদতা দূর করার জন্যে কিছু কিছু বিশেষ সুবিধা আদায় করে নিতে চেয়েছিলাে, জমিদারি-মহাজনি নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে চেয়েছিলাে, ছেলেপুলের লেখাপড়া শেখার সুযােগ চেয়েছিলাে, শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মােকাবেলায় তাদের নব্যশিক্ষিত ছেলেদের চাকরির ক্ষেত্রে কিছুটা রক্ষাকবচের ব্যবস্থা চেয়েছিলাে। মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেরেবাংলা ফজলুল হক বাংলায় মন্ত্রিসভা গঠনের জন্যে কংগ্রেসেরই সহায়তা চেয়েছিলেন, মুসলিম লীগের নয়। অথচ কংগ্রেস হক সাহেবকে সমর্থন দিতে রাজি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তিনি মুসলিম লীগের সঙ্গে আঁতাত করতে বাধ্য হলেন। এভাবেই কংগ্রেস অসাম্প্রদায়িক শেরেবাংলা ও তার দলকে সাম্প্রদায়িক মুসলিম লীগের দিকে ঠেলে দিলাে, বাংলায় দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করলাে। এমনকি, কংগ্রেসের এ-রকম অর্বাচীনতার জন্যেই, মুসলিম লীগের ধুরন্ধর নেতা জিন্নাহ সাহেব হক সাহেবকে দিয়েই উনিশোে চল্লিশে লাহােরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে মুসলমানদের জন্যে স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রস্তাব উত্থাপন করাতে সক্ষম হলেন।
কংগ্রেসী নেতারা কেন কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশনে রাজি হলেন না, সে সম্পর্কে দু’জন লেখকের অভিমত আমি উল্লেখ করতে চাই। একজন শৈলেশকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যজন নীরদচন্দ্র চৌধুরী।
শৈলেশ বাবু লিখেছেন, অবিভক্ত বঙ্গে হক সাহেবের সঙ্গে কংগ্রেসের কোয়ালিশন বা এমনকি মন্ত্রী মণ্ডলের বাইরে থেকেও তার মতাে কৃষকদরদী নেতার মন্ত্রিসভাকে সমর্থন সম্ভব না হবার অন্যতম কারণ ছিলাে ঐ প্রদেশে কংগ্রেস নেতৃত্বের ভূমির মধ্যস্বত্বভােগী দ্রলােকদের চরিত্রধর্ম। কারণ হক সাহেবের কৃষক-প্রজা পার্টি ভাগাচাষীদের অধিকার রক্ষা এবং তাদের ঋণের বােঝা কমানাের জন্যে ঋণসালিশী বাের্ড ইত্যাদি গঠন করার যে কর্মসূচি নিয়েছিলাে তা স্বভাবত বহু কংগ্রেস নেতার স্বার্থের পরিপন্থী ছিলাে। কংগ্রেস নেতৃত্বের এই মধ্যস্বত্বভােগী চরিত্রধর্ম অন্য অনেক প্রদেশেই ছিলাে। [জিন্না/পাকিস্তান নতুন ভাবনা (১৪০০ সাল) পৃষ্ঠা ১০০]।
নীরদ বাবু দেখিয়েছেন যে, ভারতীয় শিল্পপতি বিড়লার প্রভাবেই মহাত্মা গান্ধী বাংলার কংগ্রেসকে হক সাহেবর কৃষক প্রজা পার্টির প্রতি সমর্থন দানে বাধা দিয়েছিলেন এবং এভাবে এখানে হিন্দু-মুসলমান মিলনের সম্ভাবনাকে নষ্ট করে দিয়েছিলেন। বিড়লা কেন হিন্দু-মুসলমান মিলনের বিরােধী’ হলেন, সে সম্পর্কে নীরদ বাবুর অভিমত বহুকাল হইতে কলিকাতায় তাে বটেই, এমনকি সমস্ত বাংলাদেশ ও আসামে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আর্থিক ব্যাপারে মারওয়াড়িদের প্রাধান্য। ইংরেজদের প্রাধান্য ইহার উপরে হইলেও এত বিস্তৃত ছিল না। বিড়লার নিশ্চয়ই মনে হইয়াছিল, বঙ্গদেশে হিন্দু-মুসলমান মিলিত হইলে তাহারা মারওয়াড়ির প্রাধান্য বিনষ্ট করিবে। সুতরাং মারওয়াড়িদের আর্থিক স্বার্থ রক্ষা করিতে হইলে হিন্দু-মুসলমান বিরােধ বজায় রাখিতে হইবে। (শারদীয় ‘দেশ, ১৪০১ সাল, পৃষ্ঠা ১৫০]
শৈলেশ বন্দ্যোপাধ্যায় বা নীরদ চৌধুরী এই দুয়ের একজনও কম্যুনিস্ট নন। অথচ তাদের অভিমত কিন্তু পাকিস্তানের জন্মব্যাখ্যার কমুনিস্ট তত্ত্বকেই সমর্থন করে। পাকিস্তানের জন্মের আগেই পবিত্ৰদার মুখে প্রায় এ-রকম ব্যাখ্যাই আমি শুনেছিলাম।
কংগ্রেস দলের কাজেকর্মে নানাভাবে সম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটে গেলেও নীতিগতভাবে তারা অবশ্যই ছিলাে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী। কিন্তু হিন্দু মহাসভা তাে আর তা ছিলাে না। এ দলের নেতা বিনায়ক দামােদর সাভারকর উনিশোে আটত্রিশের ডিসেম্বরে হিন্দু
১৮১
মহাসভার নাগপুর অধিবেশনে প্রকাশ্যেই ঘােষণা দিলেন যে, “উই দি হিন্দুজ আর অ্যা নেশন বাই আওয়ার সেক্স’। জিন্নাহ সাহেব সাভারকরের কথা যেনাে লুফে নিলেন। দু’বছর পর উনিশোে চল্লিশে, মুসলিম লীগের লাহাের অধিবেশনে সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিলেন, ভারতীয় মুসলমানরা শুধু একটা সম্প্রদায় মাত্র নয়, তারাও একটা জাতি (নেশন) এবং ব্রিটিশ ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই জাতির বাস।’
সাম্প্রদায়িক হিন্দুরা এভাবে মুসলমানকে কেবল একটা ‘নেশন’ই বানালাে না, মুসলমানদের হাতে ‘পাকিস্তান’ও তুলে দিলাে। উনিশোে চল্লিশের তেইশ মার্চ মুসলিম লীগের লাহাের প্রস্তাবে পাকিস্তানের নামগন্ধও ছিলাে না। অথচ এ প্রস্তাবটিই কী করে পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে দ্রুত জনপ্রিয়তা পেয়ে যায় তার বর্ণনা দিয়ে মুসলিম লীগ নেতা খালিকুজ্জামান জানিয়েছেন যে, পরের দিন (অর্থাৎ চব্বিশে মার্চ) সকালে হিন্দু সংবাদপত্রসমূহে বড়াে বড়াে অক্ষরে প্রকাশিত হলাে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত’, যদিও ওই নাম দুটি বক্তৃতার কোনােটিতেই উচ্চারিত হয়নি বা প্রস্তাবেও উল্লিখিত হয়নি। জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্রসমূহ মুসলিম জনসাধারণের সামনে এক সুসংবদ্ধ ধুয়াে উপস্থিত করলাে এবং অবিলম্বে তা তাদের সামনে একটি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি খাড়া করলাে। লাহাের প্রস্তাব মুসলমানদের কাছে পৌছে দিতে এবং তার যথার্থ অর্থ ও তাৎপর্য তাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে মুসলমান নেতাদের অনেক সময় লাগতাে। হিন্দু সংবাদপত্রসমূহ লাহাের প্রস্তাবের নাম ‘পাকিস্তান প্রস্তাব দিয়ে মুসলিম জনসাধারণের কাছে এর তাৎপর্য বােঝানাের জন্যে নেতাদের যে বহু বছরের পরিশ্রমের প্রয়ােজন পড়তাে তার হাত থেকে তাদের রেহাই দিলাে।
জিন্নাহর এককালের একান্ত সচিব পীরজাদা জানিয়েছেন যে, স্বয়ং জিন্নাহ সাহেব হিন্দুদের ধন্যবাদ দিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান শব্দ আমরা চালু করিনি, হিন্দুরাই এই শব্দটি আমাদের উপহার দিয়েছেন। লাহাের প্রস্তাবের তীব্রভাবে সমালােচনা করতে গিয়ে হিন্দুরা পাকিস্তান প্রস্তাব রূপে এর উল্লেখ করেন। তার ফলেই এই শব্দের প্রচলন হয়।
কোনাে হিন্দুই সাম্প্রদায়িক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের সমর্থক হতে পারে না। যে কোনাে হিন্দু, একান্ত স্বাভাবিক কারণেই, পাকিস্তানের শত্রু। সে হিন্দু উদার অসাম্প্রদায়িকই হােক, অথবা হােক সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক বা কট্টর মৌলবাদী। কিন্তু সবকিছু দেখে শুনে আমার তাে অনেক সময় বলতে ইচ্ছে হয় যে, পাকিস্তানের শত্রুরাই পাকিস্তানের জন্মবীজ রােপণ করে দিয়েছিলাে।
কম্যুনিস্টরাও তাে পাকিস্তানের শত্রু হতে বাধ্য। পাকিস্তানের মতাে একটি ধর্মভিত্তিক মধ্যযুগীয় রাষ্ট্র কিছুতেই কম্যুনিস্টদের অনুমােদন পেতে পারে না। ধর্মের ভিত্তিতে যে কোনাে নেশন বা জাতি হয় না এবং এ-রকম তথাকথিত নেশনের জন্যে কোনাে নেশন স্টেটও হতে পারে না, সে কথা কম্যুনিস্টদের চেয়ে বেশি ভালাে করে আর কে জানে? নেশন ও নেশন স্টেট সম্পর্কে অন্য সবার ধারণা যতাে অস্পষ্টই থাকুক, কম্যুনিস্টদের কাছে এর রূপ একেবারে স্ফটিক স্বচ্ছ। তাদের মতে, নেশন হচ্ছে ঐতিহাসিক বিকাশ ধারার ভেতর দিয়ে উদ্ভূত এমন একটি জনসমাজ যার ভাষা এক, বাসভূমি এক, অর্থনৈতিক জীবন এক এবং সংস্কৃতিগত সমাজ-জীবনের মধ্যদিয়ে প্রকাশিত মানসিক গড়নও এক। এ-বিচারে হিন্দু বা মুসলমানের মতাে ধর্মীয় কম্যুনিটিগুলাে কোনাে মতেই নেশন নয়। ‘নেশন’-এর ভাষান্তর যদি করা হয় ‘জাতি’, তাহলে বলতে হবে যে, ভারতবর্ষে বহুজাতির বাস, এটি একটি বহুজাতিক
১৮২
উপমহাদেশ। ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে এখানে জাতিসত্তাগুলাের স্বাভাবিক বিকাশ হতে পারেনি, বিদেশি শাসকরাই তা হতে দেয়নি। বিদেশি আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়েই কেবল বিভিন্ন জাতিগুলাে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রয়ােগ করতে পারে। স্বাধীন জাতিরূপেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে : তারা আলাদা আলাদা জাতিরাষ্ট্র গঠন করবে, না স্বেচ্ছায় সবাই একটি বহুজাতিক রাষ্ট্রে বাস করবে, অথবা বিভিন্ন জাতিরাষ্ট্রগুলাের কনফেডারেশনে সম্মিলিত হয়ে থাকবে। কিন্তু সে-রকমটি না হয়ে মুসলমানের মতাে একটি ধর্মীয় কমুনিটি যদি কৃত্রিমভাবে নিজেকে জাতি বলে ঘােষণা দেয় ও একটি জাতিরাষ্ট্র তৈরি করে বসে, তবে কম্যুনিস্টরা হবে সে-রাষ্ট্রের স্বাভাবিক শক্র। বাস্তবে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিতে তারা তাই হয়েছিলাে। অথচ মজার কথা হলাে, ব্রিটিশ ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি পাকিস্তান আন্দোলনের এক পর্যায়ে জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দোহাই দিয়ে মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবিকে সমর্থন করে বসেছিলাে। ডক্টর গঙ্গাধর অধিকারীর মতাে ধীমান কমুনিস্টও পাকিস্তান এড ন্যাশনাল ইউনিটি নামক একটি পুস্তিকায় পাকিস্তান দাবির পক্ষে নানা যুক্তিজাল বিস্তার করেছিলেন। তখনকার কম্যুনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পূরণচন্দ্র যােশী যুক্তি দিয়েছিলেন : উনিশোে উনত্রিশ সালে কংগ্রেস যেমন তার লাহাের অধিবেশনে স্বাধীনতার প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাে, এর এগারাে বছর পরে চল্লিশ সালে মুসলিম লীগের অধিবেশনে গৃহীত লাহাের প্রস্তাব’ও এরকমই ‘একটি স্বাধীনতার প্রস্তাব এবং স্বরাজের মতােই পাকিস্তানও মুসলিমদের জন্মগত অধিকার।
পাকিস্তান দাবির সপক্ষে কম্যুনিস্ট পার্টির এই অদ্ভুত ভূমিকাটি বােধহয় সে-সময়কার সকল কম্যুনিস্টের কাছেও স্পষ্ট হয়নি। সে জন্যেই সম্ভবত আমাদের এলাকার ছাত্র কম্যুনিস্ট পবিত্র দাস তার বন্ধু খান মােহাম্মদ আবদুল হাকিমকে ‘পাকিস্তান সম্পর্কে একেক দিন একেক রকম কথা বলতেন, আর আবদুল হাকিম তার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতেন না।
যাই হােক, হিন্দু আর ক্যুনিস্টদেরকে পাকিস্তান কিন্তু তার জন্মলগ্ন থেকেই জাতশত্রু বলে জেনেছে এবং তাদের সঙ্গে সে রকমই আচরণ করেছে। অথচ ইতিহাসের নানা সাক্ষ্য প্রমাণ কি এ রকমই ইঙ্গিত দেয় না যে, পাকিস্তানের এই শত্রুরাই পাকিস্তানের জন্মবীজ রােপণ করতে নানাভাবে সহায়তা করেছিলাে? আর কুশলী ও কৌশলী জিন্নাহ তার পাকা ফসলটি অবলীলায় ঘরে তুলে নিয়েছিলেন?

Reference: পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন – যতীন সরকার